শিরক করলে কি হয়? আমি তো কারো ক্ষতি করছি না!
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, শির্ক কেন ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ? কেন আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করেন কিন্তু শির্ক ক্ষমা করেন না? শির্ক করে তো আমরা আল্লাহর কোনো ক্ষতি করছি না। শির্ক করে তো আমরা মানুষের কোনো ক্ষতি করছি না। আমি যদি একটা তাবিজ পড়ে ভাবি এই তাবিজের কারণে আমার পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট হবে, তাতে এমন কি দোষ হল? আমি যদি পীরের মুরিদ হয়ে ভাবি পীর বাবা আমার হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে আমার জীবনের সমস্যা দূর করে দিবে, কিয়ামতের দিন আমার জন্য আল্লাহর কাছে তদবির করবে, তাতে এমন কি মহাপাপ হল? কেন সুদ, ঘুষ, খুনের মতো বিরাট সব পাপ ক্ষমা করা যাবে কি না, তা আল্লাহ্ বিবেচনা করবেন, কিন্তু শির্ক কখনও ক্ষমা করবেন না?
আসুন বোঝার চেষ্টা করি মানুষ কেন শির্ক করে। ধরুন আপনি একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন, যার চেয়ারম্যান খুবই ন্যায়পরায়ণ মানুষ। তিনি কাউকে কোনো ছাড় দেন না। প্রত্যেকের সাথে সমান আচরণ করেন এবং প্রত্যেকের কাজের খুঁটিনাটি হিসাব রাখেন। এখন তার অধীনে যে ডিরেকটররা আছে, তার মধ্যে একজন হচ্ছে আপনার মামা। আপনি জানেন যে আপনি যদি অফিসে একটু দেরি করে আসেন, মাঝে মধ্যে না বলে ছুটি নেন, হাজার খানেক টাকা এদিক ওদিক করে ফেলেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। যদি চেয়ারম্যানের কাছে একদিন ধরা পড়েও যান, আপনার মামা ঠিকই আপনাকে বাঁচিয়ে দিবে। হাজার হোক, মামা তো। সেজন্য মামাকে খুশি রাখার জন্য আপনি প্রতি মাসে তার বাসায় উপহার নিয়ে যান, অফিসে তাকে শুনিয়ে সবার কাছে তার নামে প্রশংসা করেন, তার বাসায় বাজার করে দিতে বললে আপনি অফিসের সব কাজ ফেলে রেখে ছুটে যান বাজারে। যেভাবেই হোক মামাকে হাতে রাখতেই হবে। মামা না থাকলে সর্বনাশ।
এই হচ্ছে শির্কের সমস্যা। মানুষ জানে যে আল্লাহ (বা অন্য ধর্মের সর্বোচ্চ সৃষ্টিকর্তা) হচ্ছেন Absolute Just – পরম বিচারক, পরম ন্যায়পরায়ণ। তিনি সব কিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করবেনই। এখন মানুষ যে প্রতিদিন আল্লাহর নিয়ম ভাঙছে, এদিক ওদিকে ফাঁকি দিচ্ছে, নিজের সুবিধার জন্য একটু ঘুষ দিচ্ছে, একটু সুদ দিচ্ছে – এগুলোর প্রত্যেকটা যদি গুণে গুণে হিসাব করা হয় এবং প্রতিটা অপকর্মের বিচার করা হয়, তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে! বেহেশত পাওয়ার কোনো আশাই থাকবে না! তাহলে কি করা যায়? দেখি আল্লাহর অধীনে কাউকে হাত করা যায় কি না। তাহলে তাকে দিয়ে কিয়ামতের দিন আল্লাহকে বলালে হয়ত আল্লাহ কিছু দোষ মাফ করে দিবেন। এই ধারণা থেকে মানুষ চেষ্টা করে কোনো কোনো এক পীর বাবার মুরিদ হবার, কোনো এক নবীর দিনরাত গুণগান করার, কোনো এক দেবতাকে সন্তুষ্ট করার, যাতে করে সেই পীর/নবী/দেবতা একদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে তার অপকর্মের বিচার হালকা করার জন্য তদবির করতে পারে। মানুষ জানে যে সে এতো অপকর্ম করেছে যে, সে আর আল্লাহকে মুখ দেখাতে পারবে না। তাই কত ভাবে দুই নম্বরি করে পালানো যায়। সে নামায ফাঁকি দেওয়া বন্ধ করবে না, ঘুষ খাওয়া বন্ধ করবে না, অর্ধ নগ্ন হয়ে বিয়ের দাওয়াতে যাওয়া ছাড়বে না। কিন্তু ঠিকই চেষ্টা করবে কিভাবে আল্লাহর ‘কাছাকাছি’ কাউকে হাত করে বিচার থেকে পালানো যায়। কিভাবে দোষগুলো কোনোভাবে ধামাচাপা দেওয়া যায়। এভাবে মানুষ নিজেকে সংশোধন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা না করে যতসব দুই নম্বরি উপায় নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদেরকে দেখে অন্যরাও একই কাজ করা শুরু করে। শুরু হয় সমাজের এবং দেশের পতন। মাঝখান থেকে তাদের ধর্মীয় বেশভূষায় করা অপকর্মের কারণে তাদের ধর্মের ব্যাপক বদনাম হয়ে যায় এবং মানুষ সেই ধর্মের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে।
শির্কের আরেকটি বড় সমস্যা হল, যেহেতু কিছু মানুষ অন্য কিছু মানুষকে বা জড় বস্তুকে তাদের থেকে মহান, আল্লাহর ‘কাছাকাছি’ কিছু বানিয়ে ফেলে, তখন শুরু হয় সমাজে শ্রেণিভেদ এবং স্বজনপ্রীতি। সমাজে এক শ্রেণীর কিছু উত্তম, পবিত্র মানুষ বা জড় বস্তু তৈরি হয় এবং এক শ্রেণীর কিছু অধম মানুষ তৈরি হয়। সেই অধম মানুষ গুলো ওই উত্তম মানুষ এবং বস্তুগুলোকে খুশি করার জন্য এমন কিছু নেই যেটা তারা করে না এবং ওদেরকে তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে তদবির করার মাধ্যম বানিয়ে ফেলে। এই সুযোগে সমাজের কিছু শ্রেণীর মানুষ বিরাট ব্যবসা শুরু করে দেয় ওই পবিত্র মানুষ এবং বস্তুগুলোকে নিয়ে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হয় নানা ধরণের মূর্তি বানিয়ে এবং সেই মূর্তি গুলো নদীতে ফেলে দিয়ে। কোটি কোটি টাকার জমজমাট ব্যবসা চলছে মাজারে, পীরের দরবারগুলোতে। ওইসব মন্দির, মাজারের কর্মচারীগুলোর কোনো পড়ালেখা করার দরকার পড়ে না, জীবনে আর কোনো কাজ করার দরকার হয় না। তারা ভক্তদের টাকা দিয়ে আরামে তাদের জীবন পার করে দেয়। এভাবে সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ তৈরি হয়, যাদের কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা দরকার হয় না, চাকরি বা ব্যবসা করতে হয় না, সমাজের উন্নতিতে কোনো অবদান রাখতে হয় না। যেখানে কি না নবী (সা) নিজে ব্যবসা করতেন সংসার চালানোর জন্য এবং ধর্ম শিখিয়ে কারো কাছ থেকে একটা টাকাও নিতেন না, সেখানে এই মানুষগুলো আরাম কেদারায় বসে ঝাড়ফুঁক করে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হয়ে যায়।
এই ‘পবিত্র’ মানুষগুলো তাদের এতো সহজ আয়ের ব্যবস্থা যে কোনো উপায়ে টিকিয়ে রাখার জন্য এমন কিছু নেই যেটা তারা করে না। এরা চেষ্টা করে সাধারণ মানুষ যেন কখনও আসল ধর্মীয় বই পড়ে সৃষ্টিকর্তার সঠিক সংজ্ঞা শিখে না ফেলে। কারণ সাধারণ মানুষ যদি তাদের সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ধর্মীয় বই নিজেরা পড়ে ফেলে, তাহলে তারা শিখে যাবে যে সৃষ্টিকর্তার কোনো প্রতিমা নেই, তার সমকক্ষ কেউ নেই, কেউ তার কাছে কারো হয়ে সুপারিশ, তদবির করতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা নিজে প্রতিটি মানুষের কথা শোনেন, নিজে কোনো উকিল ছাড়া প্রতিটি মানুষের বিচার করবেন, এবং তিনি নিজে প্রতিটি মানুষের কাজের রেকর্ড রাখছেন এক অভাবনীয় ব্যবস্থায়। তার কোনো ‘হেল্পার’ দরকার হয় না।
তোমরা যেখানেই থাকো তিনি তোমাদের সাথে আছেন। তিনি সব দেখেন তোমরা কি কর। [৫৭:৪]
আকাশ এবং পৃথিবীর সকল গোপন ব্যাপারে তাঁর জ্ঞান রয়েছে। তিনি কতই না পরিস্কার দেখেন এবং শোনেন! তিনি ছাড়া তাদের আর কোনো রক্ষাকারী নেই। তিনি তাঁর রাজত্বে আর কাউকে অংশ দেন না। [১৮:২৬]
শির্ক শুধু ইসলামেই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ নয়, এমনকি হিন্দু এবং খ্রিস্টান ধর্মেও মহাপাপ। যেমন বাইবেলে দেখুনঃ
Thou shalt have none other gods before me. Thou shalt not make thee any graven image, or any likeness of anything that is in heaven above, or that in the earth beneath, or that is in the water beneath the earth. Thou shalt not bow down thyself unto them, nor serve them; for I the Lord thy God am a jealous God. [The Bible, Deuteronomy 5:7-9]
হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ গুলোতে দেখুনঃ
There is no image of Him. [Yajurveda 32:3]
He is bodyless and pure. [Yajurveda 40:8]
They enter darkness, those who worship the natural elements. They sink deeper in darkness, those who worship sambhuti (created things). [Yajurveda 40:9]
Those whose intelligence has been stolen by material desires surrender unto demigods and follow the particular rules and regulations of worship according to their own natures. [Bhagavad Gita 7:20]
He is One only without a second. [Chandogya Upanishad 6:2:1]
Of Him there are neither parents nor lord. [Svetasvatara Upanishad 6:9]
There is no likeness of Him. [Svetasvatara Upanishad 4:19]
His form is not to be seen; no one sees Him with the eye. [Svetasvatara Upanishad 4:20]
খ্রিস্টান এবং হিন্দু ধর্মের মূল আদি গ্রন্থগুলোতে পরিস্কার করে বলা আছে যে সৃষ্টিকর্তা এক, তার কোনো প্রতিকৃতি, কোনো প্রতিমা বানানো যাবে না, কোনো জড় বা জীবের পুজা করা যাবে না, কোনো দেবদেবী নেই। কিন্তু এই মূল আদি গ্রন্থ গুলো সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বরং চার্চের পাদ্রি, মন্দিরের পণ্ডিত, আশ্রমের গুরুজি যা বলে, সেটাই সাধারণ মানুষ অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করে যায়। একই ঘটনা ঘটে মুসলমানদের বেলায়ও। আপনি খুব বেশি হলে গড়ে দশ জন মুসলমানের মধ্যে একজন পাবেন, যে কু’রআন পুরোটা একবার হলেও বুঝে পড়েছে। বাকি সবাই হয় কিছু হাদিসের বই পড়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই মান্ধাতা আমলের “আলেমদের” লেখা জাল হাদিস ভরা বই, না হলে মসজিদের অর্ধ শিক্ষিত ইমাম, গুরুজি, পীর বাবা যা বলেছে, সেটাই গভীর ভক্তি নিয়ে মেনে নিয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ্র পাঠানো ‘কিভাবে মুসলমান হতে হয়’ এর একমাত্র ম্যানুয়াল – কু’রআন, খুব কম মানুষকেই বুঝে পড়তে দেখা যায়। একারণে মুসলমানরাও বড় হয় হাজারো ধরণের ভুল ধারণা নিয়ে, যার কারণে তাদেরকেও এমন অনেক কাজ করতে দেখা যায় যা শির্কের মধ্যে পড়ে। যেমন পাথরের আংটি পড়ে ভাবা এই আংটির কারণে তার ব্যবসা ভালো যাবে, ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে; হাতে আয়াতুল কুরসি লেখা ব্রেসলেট পড়ে ভাবা সেটা তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে, গলায় তাবিজ পড়ে ভাবা উদ্দেশ্য হাসিল হবে; ঘরের দেওয়ালে সূরার ফলক টাঙিয়ে, দরজায় সূরা ঝুলিয়ে ভাবা তা খারাপ জিনিস দূরে রাখবে ইত্যাদি।
কোনো মানুষ বা বস্তুকে যে সৃষ্টিকর্তার ‘কাছে’ যাবার মাধ্যম বা সুপারিশের মাধ্যম করা যাবে না, তার জন্য কু’রআনে কঠিন নির্দেশ আছেঃ
সে দিনের ভয় কর যেদিন কোন সত্ত্বা অন্য কোন সত্ত্বার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না এবং তার থেকে কোন সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না এবং তার থেকে কোনো ক্ষতিপূরণও নেওয়া হবে না এবং তাদেরকে কোনই সাহায্য করা হবে না। [বাকারাহ ২:৪৮]
কোনো পীর, গুরু কিয়ামতের দিন কোনো মুরিদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। সেই সুযোগই তাকে দেওয়া হবে না। সে নিজের হিসাব দিতেই ব্যস্ত থাকবেঃ
সেদিন তাদের মুখ সিল করে দেওয়া হবে, তাদের হাত আমাকে বলে দিবে, তাদের পা আমাকে সাক্ষী দিবে, তারা (দুনিয়ায়) কি করতো। [ইয়াসিন ৩৬:৬৫]
আল্লাহর কোনো পীর, গুরুর কাছ থেকে জানার কোনো দরকার নেই তাদের ভক্তরা কি করতো, কারণ তিনি নিজেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন যেন মানুষের প্রতিটি কথা, কাজ, চিন্তা রেকর্ড হয়ঃ
পৃথিবীতে এমন কোনো প্রাণী নেই যার সংস্থানের দায়িত্ব আল্লাহর উপর নেই। তিনি জানেন কে কোথায় থাকে এবং তার শেষ পরিণাম কি। সবকিছু এক পরিস্কার রেকর্ডে আছে। [হুদ ১১:৬]
তুমি যেই অবস্থাতেই থাকো, যেটুকুই কু’রআন পড়, যে কাজই তোমরা করো, আমি উপস্থিত থাকি যখনি তোমরা তা করো। একটা ধূলিকণার সমান বা তার চেয়ে ছোট বা বড় যা কিছুই পৃথিবীতে বা আকাশে যেখানেই থাকুক না কেন, তা তোমার প্রভুর অগোচরে নেই। বরং সবকিছুই লেখা আছে এক পরিস্কার রেকর্ডে। [ইউনুস ১০:৬১]
এই সব সত্য মানুষের কাছে ফাঁস হয়ে গেলে সর্বনাশ! কোটি কোটি টাকার মূর্তি এবং মন্দিরের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, পাদ্রীর কাছে মানুষ তদবির করা বন্ধ করে দিবে, মাজারে আর কেউ মুরিদ হবে না, শেখের বয়াত নেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তখন সমাজের ওই সব ‘পবিত্র’ অর্ধ শিক্ষিত, অযোগ্য, প্রতারক মানুষগুলো এবং তাদের বিশাল সাগরেদ বাহিনী না খেয়ে মারা যাবে। তাদের আয়ের এতো সহজ ব্যবস্থা যেন কখনও বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য তারা ধর্মের নামে নানা ধরণের অলৌকিক, চমকপ্রদ, বানোয়াট কাহিনী বানিয়ে ভক্তদেরকে বিমোহিত করে রাখে। অনেকগুলো বিরাট সংগঠন দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে সাহিত্যিক দিক থেকে উচ্চমানের, পাঠ মধুর ‘ধর্মীয়’ বই লিখে বাজার ভরে ফেলার, যাতে করে মানুষ সেই সব বই থেকে ধর্ম শেখা শুরু করে এবং তাদের মুল ধর্মীয় গ্রন্থের ধারে কাছেও না যায়। তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে এমন একটি ধারণা প্রচলন করার যে – সাধারণ মানুষের জন্য মূল ধর্মীয় গ্রন্থ লেখা হয়নি; সাধারণ মানুষ মুল ধর্মীয় গ্রন্থ পড়লে ভুল বুঝবে। তার চেয়ে আমাদের এই বইগুলো পড়। আমরা সহজ, সরল ভাবে তোমাদেরকে সঠিক ধর্ম শিখিয়ে দিবো। এই বইগুলো তাদের আয়ের এক বিরাট উৎস। আর এই বইগুলো থেকেই শুরু হয় গণ মগজ ধোলাই। এভাবে যখন মগজ ধোলাই করে মানুষের উপর ধর্মীয় কর্তৃত্ব নিয়ে নেওয়া যায়, তখন মানুষকে দিয়ে ধর্মের নামে এমন কিছু নাই যা করানো যায় না। মানুষকে বিশ্বাস করানো যায় যে, অন্য ধর্মের মানুষরা হচ্ছে অপবিত্র, তাদেরকে হত্যা করা ধর্মীয় দিক থেকে একটি বড় পুণ্যের কাজ। মানুষকে বিশ্বাস করানো যায় যে অন্য ধর্মের উপাসনালয়গুলো সব ভেঙ্গে ফেলা শুধু জায়েজই না, বরং তা অনেক সওয়াবের কাজ। এভাবে শির্ক থেকে শুরু হয় ধর্মীয় কারণে চাঁদাবাজি, দলে দলে মারামারি, মানুষ গুম করে দেওয়া এবং একসময় পুরোদস্তুর মাফিয়া সংস্কৃতি।
মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় যাবতীয় সমস্যার সমাধানের প্রথম ধাপ হচ্ছে –
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ – আল্লাহ ছাড়া আর কোনই প্রভু নেই। [কু’রআন]
একাম এবাদ্বিতীয়ম, না তাস্য়ে প্রাতিমা আস্তি – তিনি এক, অদ্বিতীয়, তার কোনো প্রতিমা নেই। [উপানিষাদ]
Thou shalt have none other gods before me. [বাইবেল]
শির্ক এই প্রথম ধাপটিকেই ভেঙ্গে দেয় এবং মানুষের সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে সঠিক পথনির্দেশ চাইবার জন্য অত্যাবশ্যকীয় মানসিকতা নষ্ট করে দেয়। একারণেই যারা শির্ক করে, তাদেরকে যুক্তি দিয়ে কিছু বোঝানো যায় না। তারা সত্য দেখেও দেখে না, মানতে চায় না। তাদেরকে বাপ-দাদার অন্ধ অনুকরণ করা থেকে বের করে আনা যায় না। যার ফলে তাদের পক্ষে কখনই সঠিক ধর্ম অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। আর যারা সঠিক ধর্ম অনুসরণ করে না, তারা শুধু নিজেদেরকেই নয়, বরং তার আশেপাশের মানুষের, সমাজের, জাতির ধ্বংস ডেকে আনে – যা এক বিরাট অপরাধ।
যখন তাদেরকে বলা হয়, “যা আল্লাহ্ তোমাদেরকে পাঠিয়েছেন তা অনুসরণ কর।” তখন তারা বলে, “না, আমাদের বাপ-দাদা যা অনুসরণ করেছে, আমরাও সেটাই অনুসরণ করবো।” কি! যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই বুঝতো না এবং তারা সঠিক পথেও ছিলো না? [বাকারাহ ২:১৭০]
শির্কের আরেকটি সমস্যা হল সৃষ্টিকর্তাকে হেয় করা। এটা দুই ভাবে করা হয় – ১) মনে করা যে সৃষ্টিকর্তার কাছে চেয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না, তাই তাবিজ লাগাও, আংটি পড়, যাতে করে অন্য কোনো দৈব প্রক্রিয়ায় কাজটা আদায় করা যায় এবং ২) সৃষ্টিকর্তাকে কোনো কিছু ছাড়া খালি খালি ডাকলে তিনি আমাদের দিকে বেশি ‘মনোযোগ’ দেন না, তাই একটা মূর্তি ব্যবহার কর, পীর ধর, ইমাম ডেকে আনো, যাতে করে তাঁকে আরও ভালোভাবে ডাকা যায়, তাঁর মনোযোগ বেশি করে পাওয়া যায়। আপনি যদি কাউকে জিগ্যেস করেন, “ভাই কেন আপনি এই মূর্তিটার প্রতি উপাসনা করছেন?”, অথবা, “ভাই, কেন আপনি দেওয়ালে একটা কা’বার ছবি টাঙিয়ে রেখেছেন?”, অথবা, “ভাই, কেন আপনি এই ক্রসটা বুকে ধরে রেখেছেন?”, সে আপনাকে বলবে, “আসলে এটা কিছুই না, আমি এটা ব্যবহার করি আমার মনোযোগ বাড়ানোর জন্য।” তাহলে তো সেটা আপনার মনোযোগের সমস্যা! কেন আপনি সৃষ্টিকর্তাকে এমন এক রূপ দিচ্ছেন যা করার অনুমতি তিনি আপনাকে দেন নি, বরং উল্টো তিনি কঠিন ভাবে মানা করেছেন যেন তাঁকে কোনো রূপ দেওয়া না হয়, তাঁর কোনো প্রতিমা বানানো না হয়? যদি মনোযোগ বাড়াতেই হয়, তাহলে তাঁর অসাধারণ সৃষ্টি জগতের কথা ভাবুন, আকাশের দিকে তাকান, আপনার চারপাশের সৃষ্টিগুলোকে দেখুন, তিনি কতভাবে আপনার জীবনে কল্যাণ দিয়েছেন – সেগুলো কৃতজ্ঞতা নিয়ে ভাবুন। মেডিটেশন করুন, মনোযোগ বাড়াবার জন্য কত মানসিক ব্যায়াম আছে সেগুলো করুন। দিনরাত গান শোনা, টিভি দেখা, ভিডিও গেম, ফেইসবুক, ইউটিউব, মোবাইল ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফালতু আলাপ, মার্কেটে বেহুদা ঘুরে বেড়ানো, তারকাদের গসিপ, খেলার স্কোর, খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ার, খবরের কাগজে খুন, ধর্ষণ, দলাদলির খবর – এগুলো বন্ধ করুন, যাতে আপনার মগজ ভর্তি এসব অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিলবিল না করে মনের ভিতরে শান্তি এবং মৌনতা বিরাজ করে এবং প্রার্থনার সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন।
একইভাবে আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন, ভাই কেন আপনি পীরের মুরিদ হচ্ছেন, কেন শেখের বয়াত নিচ্ছেন, কেন ইমাম ভাড়া করে এনে মিলাদ পড়াচ্ছেন? সে বলবে, “ভাই, আমি তো অধম, পাপী। ওনাদের মতো পবিত্র মানুষরা আমার হয়ে দোয়া করলে আল্লাহ আরও বেশি করে শুনবেন।” তাহলে আপনি কেন অধম হয়ে থাকছেন? কেন পাপী হয়ে থাকছেন? আল্লাহ তো আপনাকে উত্তম বান্দা হবার সব ব্যবস্থাই শিখিয়ে দিয়েছেন। তিনি তো আপনার সকল পাপ মাফ করে নেওয়ার কত সুযোগই আপনাকে দিয়েছেন। সেগুলো চেষ্টা না করে কেন দুই নম্বরি, শর্টকাট ব্যবস্থার জন্য চেষ্টা করছেন? আপনার কি আল্লাহর বাণীর উপরে কোনো ভরসা নেই?
কিন্তু যারা তওবা করে, গভীরভাবে বিশ্বাস করে এবং সৎকাজ করে, আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পুণ্য দিয়ে বদলিয়ে দিবেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, নিরন্তর দয়ালু। [ফুরকান ২৫:৭০]
আকাশ এবং পৃথিবীর সবকিছুর মালিক আল্লাহ। তিনি যাকে চান তাকে মাফ করেন এবং যাকে চান তাকে শাস্তি দেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, নিরন্তর দয়ালু। [৩:১২৯]
সুত্রঃ
- শেখ ইয়াসির কাযি – নবী/পীর/শেখ, তাবিজ, দোয়ার ক্ষমতা।
- ডঃ বিলাল ফিলিপস – তাওহিদ
– ওমর আল জাবির
মূল: ড. মাজহার কাজি । অনুবাদ: মাওলানা ফয়জুলাহ− মুজহিরী। সম্পাদনা: এম মুসলেহ উদ্দিন
কুরআন মাজিদের একটি অনন্য দিক হল, তা এমন অসংখ্য আয়াত ধারণ করে কার্যকারণ, যুক্তি কিংবা সাধারণ বোধের মাধ্যমে যেগুলির ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। কুরআন মাজিদ এমন কিছু ঘটনা বা বিষয়ের বর্ণনা দেয়, আরব উপদ্বীপ কিংবা আরব সমাজের শারীরিক কিংবা পরিবেশগত অবস্থার সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই, যেখানে কুরআন মাজিদ সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়।
https://pratyabartan.com/%e0%a6%b0%e0%a6%b9%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%af-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4/