আকাইদ

আল্লাহর এককত্ব – তাওহিদ

এ পৃথিবীর বস্তুভিত্তিক জগতটাকে আমরা পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়ে বেষ্টণ করতে পারি, তবে অনুভূতির জগতটা অধরাই থেকে যায়। কচি কলাপাতার হালকা সবুজ রঙ, পাখির কলতান, হাসনাহেনার গন্ধ, আমের মধুর স্বাদ কিংবা নদী তীরের বাতাসের কোমল পরশ -এদের আমরা ধারণ করি চোখ-কান-নাক-মুখ-ত্বক দিয়ে। অথচ এরা আমাদের মনে যে ভালোলাগার বোধ তৈরি করে তাকে না যায় ছোঁয়া, না যায় দেখা। নাক বা কানের আওতায় পড়েনা সে বোধ। এটাই মানুষের অনুভূতির জগৎ, মানুষের মনুষ্যত্ব।

মানুষের মানবিক অংশের শ্রেষ্ঠত্ব এখানে যে সে সব ইন্দ্রিয়কেই নিয়ন্ত্রণ করে। এই মানবিকতা আবার নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু বিশ্বাস দিয়ে। এই বিশ্বাসগুলোর জন্ম হয় শৈশবকাল থেকে পেয়ে আসা শিক্ষা, সামাজিক আচার-আচরণ, পারিবারিক মূল্যবোধ, প্রভাবশালী দার্শনিকের মতবাদ, ব্যক্তির নিজের অভিজ্ঞতা ইত্যাদির সমষ্টি থেকে। অবশ্য পরবর্তীতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বিশ্বাসগুলো বদলে যেতেও পারে।

একজন মানুষের মনন যেমন অস্পৃশ্য তেমন তার বিশ্বাসও। মানুষের সৃষ্টিগত সীমাবদ্ধতার জন্য সে একাকি তার ইন্দ্রিয়ের সীমার বাইরের কিছু সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে পারেনা। অদৃশ্য-অস্পৃশ্য জগত নিয়ে সে যতই গবেষণা করুক না কেন তা কখনোই সম্পুর্ণ সঠিক হতে পারেনা কারণ সেটা কোন না কোনভাবে ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতা দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট হবেই। তাই এ জগত সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের যেতে হবে আমাদের স্রষ্টার কাছে যিনি স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য উভয় জগত সম্পর্কেই সম্পূর্ণ অবগত।

কেউ যদি শুধুমাত্র স্পৃশ্য জগত থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কোন বিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং অস্পৃশ্য জগতে তা প্রয়োগ করতে যায় তবে তা ভুল হবে। ভ্রান্ত বিশ্বাসধারী মানুষ নিজের এবং সমাজের ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে। যেমন মধ্যযুগে কিছু খ্রীষ্টধর্মীয় নেতা বিশ্বাস করতো মানসিক প্রতিবন্ধীতার কারণ শয়তান ভর করা। শয়তান তাড়াতে বংশগত জেনেটিক রোগে আক্রান্ত অসুস্থ নারী-পুরুষদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হত। আমাদের দেশে একটি মেয়ের স্বামী মারা গেলে, মেয়েটিকে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া হত পতিসেবা করার জন্য। মৃতদেহের সাথে জীবন্ত নারীদের দগ্ধ করার রীতি ‘সতীদাহের’ জন্মও এক মিথ্যা বিশ্বাস থেকে। মানুষের ভাবনা-কথা-কাজ কোন পথে চলবে তার মূল দিকনির্দেশনা দেয় তার বিশ্বাস। তাই কোন মানুষকে সংশোধন করতে হলে প্রথম কর্তব্য তার বিশ্বাসকে কলুষতামুক্ত করা।

ইসলাম নামের জ্ঞানভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে যে বিশ্বাসের উপরে তার নাম তাওহিদুল্লাহ বা আল্লাহর এককত্ব। মুসলিম হতে হলে আমাদের প্রথম কাজ ইসলামে প্রবেশ করবার এই দরজা সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান আহরণ করা এবং আমাদের জীবনে এই জানার কি প্রয়োগ আছে তা বোঝা। ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির প্রথমটির বর্ণনা দিতে গিয়ে রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো বলেছেন:

এই সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রকৃত মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রসুল। ১

কখনো বলেছেন:

শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা ও ত্বাগুতকে অস্বীকার করা। ১

আবার এও বলেছেন:

ইয়ুহ্‌হাদাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহকে তার বিশেষত্বের ক্ষেত্রে একক হিসেবে বাছাই করা। ১

তার মানে কালিমা তায়্যিবা -‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ এর অপর নাম তাওহিদ যা ইয়ুহ্‌হাদা ক্রিয়াটির বিশেষ্যরূপ। শুধু আমাদের রসুল মুহাম্মাদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নন, পৃথিবীর সমস্ত নাবি-রসুল জীবনভর মানুষকে তাওহিদের পথে ডেকে গেছেন। জীন আর মানুষের পৃথিবীতে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য-ইবাদাতে তাওহিদের বাস্তবায়ন। তাওহিদকে বাদ দিয়ে করা পৃথিবীর কোন ভাল কাজেরই পরকালে কোন মূল্য থাকেনা। তাওহিদটা সেই এক এর মত যার ডানে যত ভাল কাজের শূন্য বসাবে তার মান ততই বাড়বে। কিন্তু তাওহিদের এক না থাকলে কোটি কোটি শূন্যও মূল্যহীন। ইসলামের প্রথম যুগের পর যত সময় গড়িয়ে যেতে থাকলো, তাওহিদের শিক্ষা থেকে মানুষ তত দূরে সরে যেতে লাগলো। মুসলিম উম্মাহর বোঝার সুবিধার জন্য আলিমরা তাওহিদকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করলেন-

১. আল্লাহ্‌কে রব্‌ হিসেবে ‘এক’ জানা ও মানা:

সত্বা, চেতনা, ভাবনা, দেহ – সব সমেত এই যে আমি, এটা তো সত্যি তাইনা? এটাও সত্যি যে আমার এই অস্তিত্ব এবং সে অস্তিত্বের বোধ একসময় ছিলনা। অথচ এটা ‘নেই’ থেকে ‘আছে’- তে আমি আনিনি, আমার বাবা-মাও নন। তারা শুধুমাত্র একটি জৈবিক ক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করেছেন, যে প্রক্রিয়াতে প্রতিদিন কোটি কোটি নারী-পুরুষ লিপ্ত হয় কিন্তু সেগুলোর ফলাফল এই আমি নই। আমি অনন্য, অদ্বিতীয়। যিনি একটা গতানুগতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অতুলনীয় আমাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনলেন তিনিই আল্লাহ্‌। জন্ম প্রক্রিয়ার প্রাকৃতিক নিয়ম সবার জন্য একরকম হলেও প্রত্যেকটি মানুষ একে অপরের থেকে ভিন্ন অথচ তাদের দেহের অণুগুলো এক, সেগুলোর কাজ করার ধরণ এক। মানুষের সত্ত্বা ভিন্ন কারণ তার আত্মা ভিন্ন। এই অদেখা আত্মাগুলোর সৃষ্টিকর্তা অদৃশ্য আল্লাহ্‌।

আল্লাহ্‌ কিন্তু আবার আমাদের নিয়েও যাবেন। নিয়ে যে যাবেন তার উদাহরণ প্রতিদিন দেন, আমরা ধরতে পারিনা। কোন সুস্থ মানুষ কি পারবে, না ঘুমিয়ে ৪৮ ঘন্টা থাকতে? ৭২ ঘন্টা? ঘুম এক রকম মৃত্যু যখন আমাদের অস্তিত্ব আর আমাদের হাতে থাকেনা। যখন আমার অস্তিত্ববোধ আর কখনো আমার দেহকে চালাতে পারবেনা সেটাই পূর্ণাঙ্গ মৃত্যু। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নাস্তিকও নিদ্রা ও মৃত্যুর সামনে আত্মসমর্পণ করে – ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়। আমাদের পরিচিত অসংখ্য মানুষের এক সময় অস্তিত্ব ছিল, আজ নেই। তাদের দেহ নয় মাটিতে মিশে গেছে, পচে গেছে, কিন্তু অস্তিত্ববোধটা কোথায় গেল? আমার আমিত্বই সবেচেয়ে বড় প্রমাণ যে আল্লাহ্‌ সৃষ্টিকর্তা, একদিন আমার না থাকা আর চলে যাওয়াই সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে আল্লাহ্‌ আমার রব্‌।

আল্লাহ্‌কে রব্‌ হিসেবে ‘এক’ জানা মানে আল্লাহ্‌র কাজ, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতায় তাকে একক বলে বিশ্বাস করা। আকাশ-পাতাল এবং এর ভিতর-বাইরে যা কিছু আছে, যা কিছু আমরা দেখি আর যা কিছু আমরা দেখিনা সবকিছুকে আল্লাহ্‌ শূন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি শুধু সৃষ্টিকর্তাই নন বরং তিনি এই সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণও করেন। আল্লাহ্‌ এই সৃষ্টির উপর একটুও নির্ভরশীল নন বরং এই সৃষ্টি আল্লাহ্‌র উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ্‌র ক্ষমতার ছাড়া কারো কোন ক্ষমতা নেই। তিনি সবকিছুকে শক্তি দেন বলেই সবকিছু চলতে পারে। তিনি অনুমতি দেন দেখেই পদার্থ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর হতে পারে। আল্লাহ্‌র ইচ্ছার বাইরে কিছুই ঘটেনা। কখন কোথায় কি হয়েছিল, হচ্ছে এবং হবে তার সবকিছুই আল্লাহ্‌র জানা আছে।

আমরা যদি প্রতিদিনের জীবনের দিকে তাকাই তবে প্রতি পদে পদে আল্লাহ্‌র রুবুবিয়াতকে খুঁজে পাবো। শিক্ষিত বোকারা বলে কৃষকরা নাকি ফসল ফলায়। কৃষকরা চারা লাগায়, সার-পানি দেয় কিন্তু গাছকে কি কোন মানুষ তৈরী করতে পারে? প্রথম গাছটিকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ্‌। তাকে দাঁড়াবার জন্য মাটি দিয়েছেন, বেড়ে ওঠার জন্য সূর্য থেকে আলো, আকাশ থেকে পানি। বাজারে কত কত খাবার পাওয়া যায়; এর মধ্যে একটা পাওয়া যাবে কি যার পিছনে সূর্যের আলো নেই? এই সূর্যটাকে কি আমরা বানিয়ে আকাশে লাগিয়ে রেখে এসেছি? পার্শী-হিন্দু-গ্রীকরা এই সূর্যকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত। কিন্তু এই সূর্য একটা হাইড্রোজেন-হিলিয়াম গ্যাসের জ্বলন্ত গোলক মাত্র। পূজা তো করা উচিত ছিল সেই আল্লাহ্‌র যিনি এমন একটা প্রদীপ বানালেন যার নিচে কেন কয়েক কোটি

মাইলের মধ্যে কোন অন্ধকার নেই।

সোনারগাঁ হোটেলের সামনে কত মানুষ না খেয়ে রাত পার করে দেয়। ডাল-ভাত কিনে খাবার টাকা তাদের আল্লাহ্‌ দেননি। আবার কত বড়লোক টাকার উপর বসে থাকে কিন্তু রোগের ভয়ে কিছু খেতে পারেনা। একমাত্র আল্লাহ্‌ই মানুষকে খাবার খেতে দেন, যাকে যেভাবে খুশি দেন। মানুষসহ সকল জীব-জন্তুকে আল্লাহ্‌ আহার যোগান। যে আল্লাহ্‌কে রব্‌ হিসেবে জানে ও মানে সে রিযকের জন্য অস্থির হয়না, ঘুষ-সুদ-চুরি ইত্যাদি অন্যায়ে জড়িয়ে পড়েনা।

এই যে আমরা লিখছি, পড়ছি – এটা আল্লাহ্‌র দান। সবাই পড়তে পারেনা, সবার পড়াশোনা করবার মত বুদ্ধি থাকেনা। রাস্তায় কত টোকাই ঘুরে বেড়ায় যাদের পড়ার খুব ইচ্ছে আছে, মাথায় বুদ্ধিও আছে; কিন্তু এদের আল্লাহ্‌ সামর্থ্য দেননি বলে এরা লেখাপড়া করতে পারেনা। আবার অনেক বড়লোকের ছেলেরা, বুদ্ধিজীবির সন্তানেরা স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেনা। জ্ঞানের মালিক আল্লাহ্‌, তিনি যাকে জ্ঞান দেন শুধু সেই জ্ঞান পায়। যে আল্লাহ্‌কে রব্‌ হিসেবে জানে ও মানে সে জ্ঞান নিয়ে অহংকার করেনা, জ্ঞান লুকিয়ে রাখেনা, সত্যটা জেনেও মিথ্যা প্রচার করেনা।

বামপন্থীরা সমাজের শ্রেণীবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়, অথচ এ শ্রেণীবিভাগ আল্লাহ্‌র তৈরী। আল্লাহ্‌ মানুষকে বিভিন্ন পেশায় ভাগ করেছেন। কেউ বেশি টাকা আয় করে, কেউ অল্প – কিন্তু কারো কাজই ছোট নয়। যদি রিকশাওয়ালা রিকশা না টানতো তবে কত কষ্ট হত আমাদের! মুচি না থাকলে মানুষ ছেড়া জুতা নিয়ে বিপদে পড়ে যেত। যদি মেথর না থাকতো তবে চারপাশ ময়লায় ভরে যেত। যদি দোকানদার না থাকতো তবে জিনিসপত্র কিনতাম কোথা থেকে? আল্লাহ্‌ বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন ধরণের কাজ দিয়ে সুষ্ঠভাবে সমাজ পরিচালনা করেন। যে আল্লাহ্‌কে রব্‌ হিসেবে মানে সে নিজের পেশা নিয়ে আক্ষেপ করেনা, আবার অন্য কোন পেশার মানুষকে অসম্মানও করেনা।

আমাদের আল্লাহ্‌ চোখ দিয়েছেন দেখতে, শোনার জন্য দিয়েছেন কান। চলাফেরার জন্য পা, ধরার জন্য হাত। কত অন্ধ মানুষ আছে যারা এত সুন্দর পৃথিবীটা দেখতে পায়না, আছে বধিরেরা – তারা শোনেও না কথাও বলতে পারেনা। অনেকের হাত-পা নেই, কারো থেকেও নেই – শারীরিক প্রতিবন্ধী। এরা কিছু ধরতে পারেনা, হাঁটতে পারেনা। খুব ছোট বাচ্চার হাত, পা, চোখ, কান সব কিছু থাকার পরেও সে সেগুলো ব্যবহার করতে পারেনা। আল্লাহ্‌ তাকে শিক্ষা দেন কিভাবে তা ব্যবহার করতে হয়। কিভাবে কথা বলতে হয়-শুনতে হয়, হাটতে হয়, ধরতে হয় – এতো আল্লাহ্‌র শিক্ষা, কোন শিক্ষক তা শিখিয়ে দিয়ে যাননা। আবার মানুষ যখন অনেক বৃদ্ধ হয়ে যায় তখন সে আস্তে আস্তে এই শিক্ষা ভুলে যায়। শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শক্তি হারিয়ে ফেলে। এই শক্তি দেয়েছিলেন আল্লাহ্‌, তিনিই আবার তা ফিরিয়ে নেন – মানুষ ঠেকাতে পারেনা। যে ছেলেটা এই সত্যিটা বোঝে সে শক্তির বড়াই করেনা। যে মেয়েটা আল্লাহ্‌কে রব্‌ মানে সে আল্লাহ্‌র দান নিয়ে অহংকার করে ভাবেনা “আমি অনেক সুন্দরী”। সে মুখ-সৌন্দর্য, অঙ্গসৌষ্ঠব টিভি-পত্রিকায় বিক্রি করেনা, বরং আল্লাহ্‌র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

আমরা কবে কি অবস্থায় পড়বে তা সব আল্লাহ্‌ ঠিক করেন। আমাদের জীবনে যেসব ভাল ঘটনা ঘটে তা আল্লাহ্‌র উপহার। আমাদের জীবনে যেসব বিপদ নেমে আসে তাও আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকেই আসে। এই বিপদ দিয়ে আল্লাহ্‌ পরীক্ষা করেন, সৎ ব্যক্তিদের পাপমোচন করেন। কোন মানুষ অন্য কোন মানুষের ভাল-মন্দ করতে পারেনা। মানুষের ভাল-মন্দের মালিক শুধুই আল্লাহ্‌। কোন মানুষ যদি আমাদের উপকার করে তবে বুঝতে হবে আল্লাহ্‌ সেই মানুষটিকে দিয়ে আমাদের ভাল করিয়ে নিচ্ছেন। কেউ যদি আমাদের ক্ষতি করে তবে বুঝতে হবে এই ক্ষতিও আল্লাহ্‌ অনুমতি দিয়েছেন বলেই হচ্ছে। যে আল্লাহ্‌কে রব্‌ হিসেবে মেনে নিয়েছে সে বিপদেও হাসি মুখে ধৈর্য ধরে থাকে, আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ দেয় আরো বড় বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য।

অনেকে অসুখ হলে বিদেশে যায়, দামী দামী ঔষধ খায়; এরপরেও সেরে ওঠেনা। একই রোগে আক্রান্ত দু’জন রোগীকে একই ডাক্তার একই ঔষধ দিলেন – একজন ভাল হলো আর আরেকজন মারা গেল। যদি ডাক্তার বা ঔষধের সুস্থতা দেবার ক্ষমতা থাকতো তবে দু’জনই ভাল হয়ে যেত। ডাক্তার কিংবা ঔষধ রোগ ভাল হবার মাধ্যম মাত্র, প্রকৃতপক্ষে সুস্থতা কেবল আল্লাহ্‌র কাছ থেকেই আসে। আবার মৃত্যুর মালিকও আল্লাহ্‌। কে কবে, কোথায়, কিভাবে মারা যাবে তা আল্লাহ্‌ ঠিক করে রেখেছেন। আল্লাহ্‌ যদি কারো আয়ু রেখে থাকেন তাহলে কেউই তাকে মারতে পারবেনা। আর যদি আল্লাহ্‌ কারো মরণ রেখে থাকেন তাহলে কেউই তাকে বাঁচাতে পারবেনা। যে সত্যি আল্লাহ্‌কে রব্‌ হিসেবে বিশ্বাস করে তাকে কোন কিছুর ভয় দেখিয়েও সত্য বলা থেকে, সঠিক কাজ করা থেকে দূরে রাখা যায়না।

আমি বাজার থেকে একটা কলম কিনে সেটা ভেঙে ফেলতে পারি, আবার মখমলের কাপড়ে জড়িয়েও রাখতে পারি; কলমটা কি কোন আপত্তি তুলতে পারে? কলমের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কি কোন দাম আছে? ঠিক তেমন আল্লাহ্‌ আমাদের মালিক, সেটা আমরা মানি আর না মানি। আল্লাহ্‌ আমাদের নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারেন। এর বিরুদ্ধে কিছু বলার আমাদের এক্তিয়ারও নেই, ক্ষমতাও নেই। আমরা যদি তার ইচ্ছেটা মেনে নিই তবে সেটা আমাদের জন্যই মঙ্গল। আল্লাহ্‌র রুবুবিয়াতকে যে বুঝতে পেরেছে সে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যাই পাক তা নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়না। কারণ আল্লাহ্‌ যা দেন তা দয়া করে দেন – এর কোন বিনিময় তো আমরা আল্লাহ্‌কে দিতে পারিনা। আল্লাহ্‌ যা নিয়ে যান সেটাও তো তাঁরই, আমাদের না। তাই আমরা যার মালিক না, সেটা কেন আর আমাদের কাছে নেই -এ নিয়ে অহেতুক অনুযোগ করা বুদ্ধিমানের কাজ না।

আল্লাহ্‌ “আর-রব্‌” বা “রব্বুল ‘আলামিন”। রব্‌ মানে প্রভু, স্রষ্টা, স্বত্বাধিকারী, ব্যবস্থাপক, পরিচালক, পরিকল্পনাকারী, পরিচর্যাকারী, পালনকারী, নিরাপত্তা দানকারী ইত্যাদি। যা কিছুর অস্তিত্ব আছে তার সবের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য একমাত্র আল্লাহ্‌র কারণ তিনিই এর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনিই এর ধ্বংসকারী।

২. আল্লাহ্‌কে ইলাহ্‌ হিসেবে ‘এক’ জানা ও মানা:

একমাত্র আল্লাহ্‌কে রব্‌ হিসেবে মেনে নেয়ার পরেই যুক্তিসঙ্গতভাবে যে জিনিসটি আসে তা হল – কেন আল্লাহ আমাদের তৈরী করলেন? আল্লাহ্‌ যে আমাদের সৃষ্টি ও প্রতিপালন করেন তার বদলে তিনি চান আমরা যেন তাকে আমাদের একমাত্র ইলাহ্‌ হিসেবে মেনে নেই। ইলাহ্‌ মানে যার উপাসনা করা হয়, দাসত্ব করা হয়।

উপাসনা এবং দাসত্ব করতে হবে একমাত্র আল্লাহ্‌র কারণ একমাত্র তিনিই ইবাদাত পাবার যোগ্য। অনেক মানুষ গাছ পূজা করে, মূর্তি পূজা করে – এসব মানুষ চিন্তা করে দেখেনা যে এই গাছ যদি অন্য কেউ এসে কেটে ফেলে তবে গাছটি তা ঠেকাতে পারবেনা। ইবরাহিম(আঃ) তার এলাকার মন্দিরের সব মূর্তি ভেঙে বড় মূর্তিটির কাঁধে কুড়াল রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন মানুষেরা জিজ্ঞাসা করল কে এই কাজ করেছে তখন তিনি বড় মূর্তিটি দেখিয়ে বলেছিলেন ওকে জিজ্ঞাসা কর। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে মূর্তির নড়া-চড়ার ক্ষমতা নেই এমনকি কে অন্য মূর্তিগুলো ভেঙেছে সেই কথা বলবারও ক্ষমতা নেই সেই মূর্তিকে কেমন করে মানুষ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে – পূজা করে? একমাত্র আল্লাহ্‌ই ইবাদাতের বিনিময়ে মানুষকে পুরষ্কার দিতে পারেন, মানুষটি যা চাইছে তা দিতে পারেন। যে কবরকে সুন্দর করে লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে তার সামনে আগরবাতি-মোমবাতি জ্বালিয়ে কোন কিছু চায় তবে সে খুব বোকামি করে। কারণ এই মানুষটি নিজের মরণকে থামাতে পারেনি। সে কবরে শুয়ে আছে, পৃথিবীতে ফিরে এসে নিজের প্রিয়জনদের বিপদে সাহায্য করতে পারছেনা – এই মৃত মানুষ কিভাবে অন্যান্য মানুষদের উপকার করবে?

আল্লাহ্‌র ইবাদাত করতে গিয়ে কোন মধ্যস্থতাকারী ব্যবহার করা যাবেনা। কোন ভাল মানুষের কাছে দু’আ চাওয়া যায়, আল্লাহ্‌র সুন্দর সুন্দর নাম ধরেও তার কাছে দু’আ করা যায় আর নিজের কোন ভাল কাজকে উল্লেখ করেও আল্লাহ্‌র কাছে কিছু চাওয়া যায়। কিন্তু এর বাইরে আর কোন কিছুই মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যাবেনা। কোন পীর-ফকির আমার হয়ে আল্লাহ্‌র কাছে সুপারিশ করবে এ ধরণের বিশ্বাস রাখা মূর্খতা। কোন পীর-ফকিরের কথা যদি আমার চেয়ে আল্লাহ্‌ বেশি শুনতো তবে তো সে সব ভাল কিছু আল্লাহ্‌র কাছ থেকে নিজের জন্যই চেয়ে নিত, অন্য মানুষের কাছে ভিক্ষা করতোনা।

যে কাফির-মুশরিক সমাজে মুহাম্মদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রসুল হিসেবে এসেছিলেন সে সমাজের মানুষেরাও আল্লাহ্‌কে রব্‌ মানতো২ কিন্তু একমাত্র ইলাহ্‌ মানতো না। মক্কার কাফিরদের যখন জিজ্ঞাসা করা হল তোমরা যখন মানোই যে আল্লাহ্‌ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তবে তোমরা এই সব মূর্তির পূজা কর কেন? তখন তারা উত্তর দিয়েছিল – আমরা এগুলোর পূজা এই জন্য করি যেন এরা আমাদেরকে আল্লাহ্‌র কাছাকাছি নিয়ে যায়।৩ তাই তাদেরকে মুহাম্মদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিক্ষা দিলেন যে আল্লাহ্‌র কাছে চাইতে হবে সরাসরি, তিনি কোন মাধ্যমের মুখাপেক্ষী নন –

যখন আমার দাসেরা তোমার কাছে আমার ব্যাপারে জানতে চায় তখন তাকে বলে দাও আমি তাদের খুব কাছেই আছি। যারা আমাকে ডাকে তাদের প্রত্যেকের ডাক আমি শুনি। ৪

প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতিহাতে আমরা বলি – “ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন”। : হে আল্লাহ্‌ আমরা শুধুমাত্র তোমারই ইবাদাত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য চাই। সুখে-দুখে, বিপদে-আপদে আমরা একমাত্র আল্লাহ্‌কে ডাকবো। পরীক্ষা কি ব্যবসায় উন্নতি – সব দরকারেই একমাত্র আল্লাহ্‌কে ডাকতে হবে। মা’র অসুস্থতায় ডাক্তারকে গিয়ে যদি বলি “আমার মা’কে সুস্থ করে দিন” তাহলে ভুল হবে। যেহেতু ডাক্তার কেবল চিকিৎসা করতে পারেন কিন্তু সুস্থ করেন শুধুমাত্র আল্লাহ্‌ সেহেতু ডাক্তারকে একথা বলে কোন লাভই নেই। “আল্লাহ্‌, আমার মা’কে সুস্থ করে দিন” একথাটা মনে মনে আল্লাহ্‌কে বলতে হবে। এর সাথে সাথে অবশ্য চিকিৎসাও চালিয়ে যেতে হবে। ব্যবসায় উন্নতি করতে হলে পরিশ্রম করতে হবে। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য পড়াশোনা করতে হবে। আল্লাহ্‌র কাছে দু’আ এবং চেষ্টা করার পরেও যদি যা চাইছি তা না পাই তবে বুঝবো আল্লাহ্‌ যা দিচ্ছেননা তা ভালোর জন্যই আটকে রেখেছেন। আল্লাহর কাছে চাওয়ার ফল আমরা পাবেই – হয় ইহকালে নয়ত পরকালে।

ইবাদাত শুধুমাত্র নামায, রোজা, হাজ্ব, যাকাত এসবেই সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহ্‌ আমাদের যত আদেশ দিয়েছেন সেগুলো পালন করা এবং যে কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে খুশি মনে বিরত থাকাও ইবাদাত। আমাদের প্রত্যেকদিনের জীবনে, পরিবার বা রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের কর্তব্য আল্লাহ্‌র আইন মেনে নেয়া। যেমন মেয়েদের পর্দা করতে হবে বা ছেলেদের দাড়ি রাখতে হবে – এগুলো আল্লাহ্‌র হুকুম। আল্লাহ্‌ জানেন কোনটা আমাদের জন্য ভাল এবং তাই তিনি সেটা করতে আমাদের হুকুম করেছেন। আল্লাহ্‌র আদেশের কারণটা যদি আমরা নাও বুঝি তাও আমাদের দায়িত্ব হল সেই আদেশটা কোন প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নেয়া। আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে আল্লাহর সব আদেশের সুফলই আমরা বুঝে যাবো – এটা কি হয়? তাই তো ইসলাম মানে আত্মসমর্পণ।

একমাত্র আল্লাহ্‌র অনুগত হতে হবে। আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা করে কোন মানুষের কথা শোনা যাবেনা। কোন কিছু হালাল-হারাম ঘোষণা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহ্‌র যিনি তার রসুলের মারফত মানুষকে তা জানিয়ে দেন। যদি কেউ আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকে হালাল-হারাম নির্ধারণের ক্ষমতা দিয়ে দেয় তবে সে আনুগত্যের ক্ষেত্রে শির্ক করল। আমাদের সমাজে মেয়েদের সম্পত্তি যেভাবে আল্লাহ্‌ দিতে বলেছেন অর্থাৎ ছেলেদের যতটুকু দেয়া হবে তার অর্ধেক – সেভাবে দেয়া হয়না। এটা আল্লাহ্‌র আইনের লঙ্ঘন। আবার আমাদের সরকার যদি এমন নিয়ম করে যে ছেলে-মেয়ে সমান সম্পদ পাবে – সেটাও হবে আল্লাহ্‌র আইনের বিপরীত আইন। এমন আইন করা ও মানা ঠিক না। যারা আল্লাহ্‌র আইনের বাদ দিয়ে আইন তৈরী করে তাদের তাওহিদ আল ‘ইবাদাহ বুঝাতে হবে, আল্লাহ্‌র কাছে দু’আ করতে হবে যেন তাদের মন আল্লাহ্‌ ইসলামের পথে খুলে দেন, তাদের ইসলাম বোঝার সুযোগ দেন।

ভালোবাসা, ভরসা, ভয়, আশা ইত্যাদি অনুভুতিও আল্লাহ্‌র জন্য হতে হবে। আমরা যখন কোন ইবাদাত করবো তখন এই চিন্তা করে করবো‌ – যেহেতু আমরা আল্লাহ্‌কে ভালোবাসি এবং আল্লাহ্‌ একাজটিকে ভালোবাসেন সেহেতু আমরাও একাজটি করতে ভালোবাসি। একজন সত্যিকারের মুসলিম আল্লাহ্‌কে সকল কিছুর চেয়ে বেশী ভালবাসবে। যে আল্লাহ্‌র চেয়ে টাকা-পয়সাকে বেশি ভালবাসে সে নামাযের সময় কাজে ব্যস্ত থাকে, যাকাত দেয়না, সুদ খায় বা ঘুষ খায়। যে আল্লাহ্‌কে বেশি ভালোবাসে সে এ সমস্ত হারাম কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে।

আমরা যখন বিপদে পড়ব তখন শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করবো‌। কোন মানুষের উপর নির্ভর করলে সে সাহায্য করতেও পারে, নাও করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্‌র উপর ভরসা রাখলে আল্লাহ্‌ ঠিকই সাহায্য করেন। আমরা যখন কোন পাপ কাজ করতে যাব তখন মনে রাখব যে আল্লাহ্‌ আমাদের দেখছেন। সুতরাং আল্লাহ্‌ পাপ কাজের শাস্তি দিবেন এই ভয়ে আমরা পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবো।

আমরা যখন কোন ইবাদাত করবো‌ তখন মনে এ আশা থাকা উচিত যে এই ভাল কাজের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ খুশি হবেন এবং আমাদের পুরষ্কার দিবেন। নামায, রোযা, হাজ্ব, যাকাত, দান, ক্বুরবানি, কসম করা সবকিছু একমাত্র আল্লাহ্‌কে খুশি করার উদ্দেশে হতে হবে। যদি কেউ এই উদ্দেশ্যে নামায পড়ে যে লোকেরা তাকে দেখে ভাল মানুষ বলবে তাহলে সে আল্লাহ্‌র জায়গায় সাধারণ মানুষদের বসিয়ে শির্ক করলো।

আল্লাহ্‌ কিন্তু আমাদের কাছে খুব বেশি চাননি। তিনি চেয়েছেন আমরা যেন তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি – তাঁর জায়গায় অন্য কাউকে না বসাই। কিন্তু মানুষ খুব স্বেচ্ছাচারী। সে আল্লাহ্‌কে তাঁর প্রাপ্য সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা দেয়নি। প্রাণহীন পাথর, মাটি দেয়ে তৈরি মুর্তি, গাছ থেকে শুরু করে জীবিত-মৃত মানুষকে সে আল্লাহ্‌র স্থান দিয়েছে। সে দেয়ালের ছবির কাছে সাহায্য চেয়েছে, হাতের মাদুলির কাছে নিরাপত্তা চেয়েছে। আল্লাহ্‌ শির্ক অর্থাৎ এই অপরাধটা সবচেয়ে ঘৃণা করেন। যেই শির্ক করুক – সে যিশুকে প্রভু বলুক, কালীকে শক্তিদায়িনী “মা” ভাবুক বা আব্দুল কাদিরকে বিপদের একমাত্র উদ্ধারকারী হিসেবে আহবান করুক, সে আল্লাহ্‌র কাছে মুক্তি পাবেনা। যেখানে সব ক্ষমতার আধার আল্লাহ সেখানে তার বদলে অন্য কারো কাছে কিছু চাওয়া মানে সেই সর্বশক্তিমানকে অপমান করা, সৃষ্টির উদ্দেশ্যটাই মিথ্যা করে দেয়া।

মোটা দাগের একটা উদাহরণ দেই- আমার বাবা-মা তাদের সমস্ত স্বপ্ন-ভালোবাসা দিয়ে অনেক কষ্ট করে অনেক টাকা খরচ করে আমাকে বড় করে তুলছেন। আমি একটা ভালো ছেলে- যা করা উচিত তাই করি, আমার কাছে যা কিছু অন্যায় মনে হয় তা করিনা। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে আমার বাবা-মা’র সাথে সম্পর্ককে আমি অস্বীকার করি। তাদের সাথে কথা বলিনা, তাদের কোন কথা শুনিনা। যাদের বাড়িতে থাকি, যাদের খাবার খাই, সেই বাবা-মার জন্য আমার এক মূহুর্ত সময়ও নেই। কৃতজ্ঞতা নেই, ভালোবাসা নেই, আছে খালি উপেক্ষা।

এও কি সম্ভব? কোন মানুষ কি এটা করতে পারে? নিজেদের অস্থায়ী অভিভাবকদের ক্ষেত্রে এমনটি আসলেই কেউ কখনো করেনা। অথচ প্রকৃত অভিভাবকের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই এই অসম্ভবটি সম্ভব করে ফেলে। কোন সন্তান যদি এমন আচরণ করে তবে কোন বাবা-মা ই একদিনের বেশী সন্তানের এ ঔদ্ধত্য সহ্য করবেনা। কিন্তু আল্লাহ্‌ অসীম ধৈর্যে পৃথিবীতে মানুষের সব অকৃতজ্ঞতা সহ্য করেন, তাদের ভরণ-পোষণ দিয়েই যান।

তাওহিদের বিপরীত বিশ্বাস হল শির্ক। যেসব মানুষ শির্ক করে তারা যত নামায-রোযা করুক না কেন, তা তাদের কোন উপকারেই আসবেনা। শির্ক করা মানুষ ভুল বুঝে শির্ক থেকে ক্ষমা না চাইলে আল্লাহ্‌ এই পাপ কখনো ক্ষমা করেননা। যারা শির্ক‌ করে তারা চিরকাল আগুনে থাকবে।

কেউ ভাবতে পারে কোন এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কথা, মাদার তেরেসার কথা, ভারতের কোন এক দরিদ্র হিন্দু কৃষকের কথা। এরা সবাই তো খুব ভাল মানুষ, কারো ক্ষতি করেনি বরং উপকার করেছে। এরা কেন অনন্তকাল আগুনে জ্বলে কষ্ট পাবে? পাবে কারণ এরা মানুষ। এদেরকে বোধ-বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করেছেন। এই বোধ-বুদ্ধি-বিবেকের দাবী পুরণ করলে সে পুরস্কার পাবে, না করলে শাস্তি। এজন্যই গরু নামের চরম উপকারী প্রাণিটির জন্য কোন পরকাল নেই, কোন পুরস্কার নেই – কারন তার আত্ম-চেতনা নেই। তবে আল্লাহ্‌ ন্যায়বিচারক। কোন মুশরিক ভাল কাজ করলে তিনি এর প্রতিদান পৃথিবীতে দিয়ে দিবেন। মাদার তেরেসা নোবেল পেয়েছেন, অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। তাঁর মহতী কর্মের পুরষ্কার তিনি মৃত্যুর আগেই পেয়ে গিয়েছেন।

৩. আল্লাহ্‌র নাম ও গুণাবলীতে তাকে ‘এক’ জানা ও মানাঃ

আল্লাহ্‌কে আমরা দেখিনা কিন্তু তার সৃষ্টির মাধ্যমে তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারি। আল্লাহ্‌কে না দেখেও যেন তার সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি, তাকে চিনতে পারি সেজন্য আল্লাহ্‌ নিজের সম্বন্ধে কুর’আন এবং সহিহ হাদিসে অনেক কিছু বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ্‌ তার নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন তা অবিকৃতভাবে জানা ও মানাকে বলে তাওহিদ আল আসমা ওয়াস সিফাত। আল আসমা মানে আল্লাহ্‌র নাম সমূহ এবং আস সিফাত মানে আল্লাহ্‌র গূণসমূহ।

প্রথমত, আমরা যা কিছু দেখতে পারি, যা কিছু শুনেছি এবং যা কিছু কল্পনা করতে পারি- কোন কিছুর সাথেই আল্লাহ্‌র কোন মিল নেই, তুলনা নেই। যেহেতু মানুষকে আল্লাহ্‌ অনেক সীমাবদ্ধতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সেহেতু সে কখনোই অসীম আল্লাহ্‌ কেমন তা কল্পনা করতেও পারবেনা। তাই সে যেন আল্লাহ্‌ সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে আল্লাহ্‌রই কোন সৃষ্টিকে আল্লাহ্‌র স্থানে বসিয়ে না দেয় সেজন্য আল্লাহ্‌ শিখিয়ে দিলেন:

“কোন কিছুই তাঁর মত নয়, তিনি সবকিছু দেখেন ও শোনেন” ৫

কেউ যদি খুব উজ্জ্বল একটা আলো কল্পনা করে ভাবে আল্লাহ্‌ বুঝি এরকম তবে সাথে সাথে তাকে বুঝে নিতে হবে যেহেতু সে এটা চিন্তা করতে পারছে সেহেতু আল্লাহ্‌ সেরকম নন। আল্লাহ্‌ কি ধোঁয়ার মত কিছু? কিংবা সাদা দাড়িওয়ালা কোন বৃদ্ধ? কিংবা অনেক শুঁড়সহ কোন অতিকায় প্রাণী? না। মানুষ ভাবতে পারে এমন কিছুই আল্লাহ্‌র মত নয় এবং আল্লাহ্‌ এমন কিছুর মত নন।

আল্লাহর সত্ত্বা সম্পর্কে যেটুকু জানলে তাকে আমরা চিনতে পারবো, তার মহত্ব উপলব্ধি করতে পারবো সেটুকু আমাদের কুর’আন এবং সহিহ সুন্নাহতে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে আল্লাহ্‌র সত্ত্বা সম্পর্কে ভাবতে নিষেধ করা হয়েছে বরং আমাদের আল্লাহ্‌র সৃষ্টি যা আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি – সেগুলো নিয়ে ভাবতে বলা হয়েছে। আল্লাহ্‌র সুন্দর সুন্দর নাম এবং তাঁর গুণাবলী আল্লাহ্‌কে চেনার জন্য যথেষ্ট।

আল্লাহ্‌ সবকিছু দেখেন ও শোনেন। আবার মানুষও দেখে এবং শোনে। তাহলে কি মানুষের দেখা আর আল্লাহ্‌র দেখা একই? – না! কারণ মানুষ একই সাথে কয়েকটা জিনিসের বেশি দেখতে পারেনা। আবার কয়েকটা জিনিসের মধ্যে যখন একটা ভাল করে খেয়াল করে দেখতে হয় তখন মানুষ অন্যান্য জিনিসগুলো খেয়াল করে দেখতে পারেনা। আবার একটা দেয়ালের ওপারে কি আছে তা মানুষ দেখতে পারেনা। খোলা মাঠে দাড়ালে যতদূর চোখ যায় তার বেশি মানুষ দেখে না, মানুষের চোখের একটা সীমা আছে। আমরা অন্ধকারে কিছু দেখিনা। আমাদের হাতে লেগে থাকা অসংখ্য ছোট ছোট ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাস আমরা খালি চোখে দেখিনা। আবার গতকাল কি হয়েছিল তা মানুষ দেখতে পারেনা। আগামীকাল কি হবে তাও মানুষ দেখতে পারেনা।

কিন্তু আল্লাহ্‌ এই বিশ্বজগতের সবকিছু একসাথে দেখেন। কোন কিছুই তার দৃষ্টিকে আটকাতে পারেনা। তিনি সবকিছু একসাথে একই সময়ে দেখেন। তাই যদিও মানুষও দেখে আর আল্লাহ্‌ও দেখেন কিন্তু বুঝতে হবে মানুষের দেখা সীমিত আর আল্লাহ্‌র দেখা অসীম।

ঠিক তেমনই আল্লাহ্‌র শোনাও অসীম। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ প্রতিটি মূহুর্তে যা কথা বলছে, যত প্রাণি যত শব্দ করছে আল্লাহ্‌ সবকিছু একসাথে শুনতে পান। গভীর পানির নিচে কোন মাছ কিংবা জড় পাথরের কথাও আল্লাহ্‌ শোনেন, তাদের ভাষা তিনি বোঝেন। অথচ একজন মানুষ একসাথে দু’জন মানুষের কথা শুনে বুঝতে পারেনা। আল্লাহ্‌র দেখা এবং শোনার সাথে মানুষের দেখা এবং শোনার কোন তুলনাই চলেনা।

দ্বিতীয়ত, আল্লাহ্‌ কুর’আনে এবং মুহাম্মদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সহিহ হাদিসে যেভাবে আল্লাহ্‌র নাম এবং গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, ঠিক সেভাবেই তা বুঝতে হবে। যে শব্দের যে মানে আছে তার মানে বদলে দেয়া যাবেনা, তার বাইরে কোন ব্যাখ্যা দেয়া যাবেনা অর্থাৎ আল্লাহ্‌র নিজের দেয়া নামের যে অর্থ আছে তার বাইরে অন্য কোন অর্থ খোঁজা যাবেনা। যেমন আল্লাহ্‌ কুর’আনে বহু স্থানে বলেছেন যে তার হাত আছে।৬ আমাদের তাই বিশ্বাস করতে হবে যে আল্লাহ্‌র হাত আছে। আল্লাহ্‌র হাত কখনো আমাদের হাতের মত নয়। তাঁর হাত তাঁর জন্য যেমনভাবে প্রযোজ্য তেমন। অনেকে আল্লাহ্‌র হাত বলতে আল্লাহ্‌র শক্তিকে বুঝিয়ে থাকেন। এটা ভুল ধারণা। আল্লাহ্‌র শক্তি যেমন সত্য আল্লাহ্‌র হাত তেমন সত্য। আমরা লম্বা একটা পাঞ্জাবি পড়লে বলি – “এই পাঞ্জাবির হাতটা অনেক বড়” এখন ঐ পাঞ্জাবির হাত আর আমার হাতের মধ্যে কি তুলনা হয়? হয়না। কিন্তু তাই বলে কি আমার হাতটা মিথ্যা হয়ে যায়? যায়না। তাই যদিও আল্লাহ্‌র হাত আর মানুষ বা অন্যান্য প্রাণির হাতের মধ্যে কোন তুলনা চলেনা তবুও আল্লাহ্‌র হাত আছে এই কথা আমরা অস্বীকার করবোনা বা ‘হাত’ কথাটার অন্য মানে করবোনা। তেমনিভাবে আল্লাহ্‌র চোখ৭, চেহারা৮ ইত্যাদি আছে। এগুলো কেমন তা আমরা জানিনা। তবে এগুলো আছে তা আমরা মানি কারণ আল্লাহ্‌ নিজেই কুর’আনের বিভিন্ন স্থানে এগুলোর কথা বলেছেন।

আল্লাহ্‌ কুর’আনে বলেছেন যারা আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে খারাপ ধারণা করে তাদের উপর তিনি ক্রুদ্ধ হন।৯ অনেকের ধারণা রাগ যেহেতু মানুষের চরিত্রের দুর্বলতা সেহেতু আল্লাহ্‌র তো এই দুর্বলতা থাকার কথা না। সুতরাং আল্লাহ্‌ আসলে রাগেননা, এখানে রাগ মানে শাস্তি। কিন্তু এ ধারণা ভুল। এটা ঠিক যে মানুষের ক্রোধের সাথে আল্লাহ্‌র ক্রোধের কোন তুলনা চলেনা। শুধু রাগ নয়, আল্লাহ্‌র কোন গুণের সাথেই মানুষের কোন গুণের তুলনা চলেনা। মানুষের সবকিছুই সীমিত অথচ আল্লাহ্‌র সবকিছু অসীম। কিন্তু মানুষ রাগ করে তাই আল্লাহ্‌ রাগ করতে পারবেননা এধরণের ব্যাখ্যা দেয়া অনুচিত। রাগ আল্লাহ্‌র একটি বৈশিষ্ট্য যাকে ‘রাগ’ হিসেবেই বুঝতে হবে, একে ‘শাস্তি’ বলা যাবেনা।

তৃতীয়ত, আল্লাহ্‌ নিজের যেসব নাম এবং বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন তার বাইরে তাকে কোন নাম এবং বৈশিষ্ট্য দেয়া যাবেনা। যেমন যদিও আল্লাহ্‌ কুর’আনে বলেছেন যে তিনি রাগ করেন কিন্তু তাই বলে তাকে “আল-গাদিব” [রাগান্বিত] নামটি দেয়া যাবেনা কারণ এই নামে আল্লাহ্‌ নিজেকে ডাকেননি, এবং মুহাম্মদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্‌কে এই নামে ডাকেননি। এমনভাবেই “আন-নাসির” [সাহায্যকারী] এর অর্থ আল্লাহ্‌র গুণের সাথে মিলে গেলেও যেহেতু এই নাম আল্লাহ্‌ নিজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেননি সেহেতু এগুলোকে আল্লাহ্‌র নাম বলা যাবেনা। খ্রীষ্ট ধর্ম মতে আল্লাহ সব মানুষকে ভালোবাসেন। কিন্তু সবাইকে ভালোবাসা আল্লাহর বৈশিষ্ট্য নয়, এটা মানুষ নিজে বানিয়ে তা‌র উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। যারা আল্লাহ্‌ এবং তার প্রেরিত রসুলের আনুগত্য করে শুধু তাদেরই আল্লাহ ভালোবাসেন, পাপীদের নয়।

বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা আল্লাহ্‌কে গড, খোদা, ঈশ্বর, ভগবান ইত্যাদি নামে ডেকে থাকে। কিন্তু যেহেতু এ নামগুলো আল্লাহ্‌ নিজের জন্য বেছে নেননি তাই এসব নামে আমরা আল্লাহ্‌কে ডাকবোনা। আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রেও আমরা বুঝি যে আমাদের যে নাম আছে তার বাইরে কেউ যদি অন্য কোন নামে ডাকে তাহলে আমরা সাড়া দেইনা, বিরক্ত হই। তেমনি আল্লাহ্‌র নিজের নামের বাইরে অন্য কোন নামে ডাকলে তিনি খুশি হননা। আল্লাহ্‌র অনেক নাম রয়েছে। এর মধ্যে ৯৯ টি নাম কুর’আন এবং সুন্নাহের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে।

চতুর্থত, আল্লাহ্‌কে মানুষের বা অন্য কোন প্রাণীর কোন বৈশিষ্ট্য বা গুণ দেয়া যাবেনা। ইহুদি-খ্রীষ্টানরা মনে করে আল্লাহ্‌ ছয় দিনে এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করে সপ্তম দিন, শনিবারে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ইহুদিরা এজন্য শনিবার ছুটির দিন মনে করে। মানুষ টানা কাজ করে ক্লান্ত হয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহ্‌ হননা। আল্লাহ্‌ ক্লান্তি-ঘুম ইত্যাদি দুর্বলতা থেকে মুক্ত। সুতরাং আল্লাহ্‌ সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছিলেন এমন বিশ্বাস মুসলিম বিশ্বাসের বিরোধী। খ্রীষ্টান চিত্রকরেরা সিস্টিন চ্যাপলের ছাদে আল্লাহ্‌কে একজন বৃদ্ধ মানুষের চেহারা আর গঠন দিয়ে এঁকেছে। এটা তাওহিদ আল আসমা ওয়াস সিফাতে শির্ক।

পঞ্চমত, মানুষকে বা অন্য কোন সৃষ্টিকে আল্লাহ্‌র কোন গুণ বা বৈশিষ্ট্য দেয়া যাবেনা। অনেক শিয়া বিশ্বাস করে তাদের ইমামরা ভুল করতে পারেনা। কিন্তু এটা আল্লাহ্‌র বৈশিষ্ট্য যে তিনি ভুল করেননা, বাকি সবাই ভুল করতে পারে। এমনকি সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ভুল করেছেন, ভুলে গেছেন। আল্লাহ সাথে সাথে তাকে সংশোধন করেছেন। একথা ঠিক নাবি-রসুলদের আল্লাহ মাসুম বা নিষ্পাপ রেখেছেন, তাদের কোন গুণাহ হতে দেননি, কিন্তু তারাও ভুলের উর্ধ্বে ছিলেননা। সেখানে আমরা যদি কোন পীর-বুযুর্গকে অন্ধভাবে অনুসরণ করি এই মনে করে যে তারা ভুলের উর্ধ্বে তবে সেটা তাওহিদ বিরোধী কাজ হবে।

খ্রীষ্টানরা মনে করে ঈসা (আঃ) মানুষকে ক্ষমা করতে পারেন। এটাও শির্ক কারণ সবাইকে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা করতে কেবল আল্লাহ্‌ই পারেন। জ্যোতিষীরা মিথ্যা দাবী করে বলে তারা নাকি ভবিষ্যত জানে। কিন্তু ভবিষ্যতের জ্ঞান গায়িব বা অদৃশ্য, কোন মানুষের অধিকারে তা নেই। যে আল্লাহর বৈশিষ্ট্য নিজের জন্য দাবী করবে সে ত্বাগুত। ত্বাগুতকে অস্বীকার করা, তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা ঈমানের দাবী।

ষষ্ঠত, “আল্লাহ্‌ নিরাকার ও সর্বত্র বিরাজমান”- একথাটি তাওহিদের পরিপন্থী। আল্লাহ্‌ নিরাকার হলে তাকে কিভাবে দেখা যাবে? অথচ আল্লাহ্‌ বলেছেন:

“সেদিন কোন কোন মানুষের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে।” ১০

মহান আল্লাহ্‌ বলেন –

“আল্লাহ্‌ আকাশসমূহ এবং পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মাঝে সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন; তারপর তিনি আরশে উর্ধ্বারোহণ করেছেন।” ১১

আল্লাহ্‌র অবস্থান সাত আসমানের উপরে – আরশের উপর। আমাদের ভাল কাজ, দু’আ তাঁর কাছে উঠে যায়। আমাদের নাবি মুহাম্মদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাজের সময় আল্লাহ্‌র সাথে দেখা করতে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে উপরে উঠেছিলেন। আবার ফেরেশতারা তার কাছ থেকে হুকুম নিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে। মাঝে মাঝে আল্লাহ্‌ নিজেও আরশ থেকে নেমে আসেন। প্রতি রাতের তিন ভাগের এক ভাগ বাকি থাকতে আল্লাহ্‌ প্রথম আসমানে নেমে এসে বান্দাদের ডাকেন, কে কি চায় জিজ্ঞাসা করেন। অনেকে মনে করে আল্লাহ্ সর্বত্র:‌ গাছ-পালা, মানুষ, জীব-জন্তু, ঘর-বাড়ি পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যে আছেন। একথা মিথ্যা। আল্লাহ্‌ সবকিছু থেকে আলাদা, সব কিছুর উর্ধ্বে। তিনি আরশের উপর থাকেন। অনেকে মনে করে আল্লাহ্‌ মুমিনের অন্তরে থাকেন। এ কথাও মিথ্যা। আল্লাহ্‌ মানুষের খুব কাছাকাছি থাকেন – একথা সত্য। তিনি তাঁর জ্ঞানের দ্বারা, তাঁর দেখার দ্বারা, তাঁর শোনার দ্বারা সবসময় মানুষের খুব কাছে থাকেন। তিনি‌ মানুষের মনের সব খবর জানেন। তিনি ইচ্ছা করলে মানুষের মন বদলে দিতে পারেন। কিন্তু সেজন্য আল্লাহ্‌কে তাঁর সত্ত্বা নিয়ে মানুষের মনের ভিতর থাকতে হয়না। তিনি তাঁর ক্ষমতার দ্বারাই আসমানের উপর থেকেই সব কাজ পরিচালনা করেন।১২

সপ্তমত, আল্লাহ্‌র নামের আগে “আবদ” বা “দাস” যোগ না করে কোন মানুষের নাম রাখা ঠিক নয়। যেমন কারো নাম রহমান না রেখে ‘আব্দুর রহমান’ রাখা উচিত এবং তাকে ওই নামেই ডাকা উচিত। আবার আল্লাহ্‌র নাম নয় এমন নামের আগে “আবদ” বসানো যাবেনা। এজন্য ‘আব্দুন নবি’ বা ‘গোলাম রসুল’ বা ‘গোলাম মোস্তফা’ যার মানে ‘রসুলের দাস’ – এমন নাম রাখা অন্যায়। কারণ আমরা সবাই আল্লাহ্‌র দাস। আমাদের রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আল্লাহ্‌র দাস ছিলেন। আমাদের উচিত আল্লাহ্‌র দাসত্ব করা। আমাদের নাবি মুহাম্মদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের কাছে আনুগত্য চেয়েছেন, দাসত্ব চাননি। ‘গোলাম কাদের’, ‘গোলাম ফারুক’, ‘গোলাম আলি’, ‘গোলাম হোসেন’ বা ‘বন্দে আলি মিয়া’ – এই নামগুলো তাওহিদ আল আসমা ওয়াস সিফাতের পরিপন্থী।

আল্লাহ্‌র নামগুলো শিখে, গুণগুলো বুঝে যদি নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করা গেলে জীবনটা অনেক সুন্দর হবে।

তাওহিদের বিষয়টি অনেক গভীর। কিন্তু মোট কথা হল আল্লাহ ছাড়া কারোই ইবাদাত করা যাবেনা আর আল্লাহর সাথে কোন অবস্থাতেই কাউকে শরিক করা যাবেনা। তাওহিদ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পরকালে মুক্তির পাশাপাশি এই পৃথিবীতেও মানুষ পাবে শান্তি, নিরাপত্তা আর সুখের জীবন। এজন্যই আমরা ব্যক্তি পরিসরে কিংবা সামাজিক সবখানে আগে তাওহিদের ডাক দেই, তাওহিদ বুঝতে বলি, তাওহিদ মেনে নিতে বলি। তাওহিদের ধারণাটা পরিষ্কার হয়ে গেলে ইসলামের বাকি সব কিছুই ক্রমানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের নিজেদের জীবনে তাওহিদ সার্বিকভাবে বুঝে মানার তৌফিক দিন, মানুষকে তাওহিদের পথে ডাকার তৌফিক দিন। আমিন।

– শরীফ আবু হায়াত অপু

২রা শাবান, ১৪৩২ হিজরি

————————————————–

১ সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান

২ সুরা আল লুকমান আয়াত ২৫

৩ সুরা আয্‌ যুমার আয়াত ৩

৪ সুরা আল বাকারা আয়াত ১৮৬

৫ সুরা আশ শুরা আয়াত ১১

৬ সুরা সঅদ আয়াত ৭৫, সুরা মায়িদা আয়াত ৬৪

৭ সুরা আত তূর আয়াত ৪৮

৮ সুরা আর-রাহমান আয়াত ২৭

৯ সুরা আল ফাতহ্‌ আয়াত ৬

১০ সুরা আল কিয়ামাহ্‌ আয়াত ২২-২৩

১১ সুরা আস-সাজদা আয়াত ৪

১২ সুরা আস-সাজদা আয়াত ৫

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button