আকাইদ

অবিশ্বাসীদের নরকবাস – একটি খোলা চিঠি

আপু,

তুমি যে প্রশ্নটা করেছ তা বহু পুরনো। এ ব্যাপারটা একসময় আমার কাছেও অস্বস্তিকর মনে হয়েছিল যে একটা মানুষ শুধু ইহুদী বা খ্রিষ্টান বা অমুসলিম হবার কারণে অনন্তকাল নরকের আগুনে পুড়ে শাস্তি পাবে তা কিভাবে হয়? তার চেয়েও অনেক দুষ্ট কোন মানুষ মুসলিমের ঘরে জন্মগ্রহণ করার কারণে সব কিছুতে পার পেয়ে যাবে – এটা কি সুবিচার? এর উত্তরটা হয়ত খুব সহজে এক বাক্যেই দিয়ে দেয়া যেত কিন্তু তাতে তোমার মনের সংশয় যেতনা। আসল ব্যাপারটা যদি তুমি বুঝে নাও তবে তুমি নিজেই তোমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে।

তুমি একটা ছোট্ট ফুটফুটে শিশু ছিলে। তোমার বাবা-মার বড় আদরের সন্তান তুমি। তাদের সমস্ত স্বপ্ন তোমায় ঘিরে। তাদের সকল প্রচেষ্টা, উদ্বেগ আর পরিকল্পনার কেন্দ্রে তুমি। তাদের অর্থে তোমার শিক্ষালাভ হচ্ছে। তাদের ভালোবাসায় তোমার বেড়ে ওঠা।
এখন তোমার বয়স বাইশ। তুমি তোমার বাবা-মা’র যত্ন-আত্তিতে বড় হয়ে উঠেছ। এখন তুমি নিচের তিনটি প্রেক্ষাপট নিয়ে একটু ভাব –

১) তোমার বাবা-মা যা বলেন তার কিছু তুমি মান কিছু মাননা। তুমি জান যে তাঁরা অনেক জ্ঞানী-গুণী, অভিজ্ঞ মানুষ। তুমি এও জান তাঁরা যা বলেন তোমার ভালোর জন্যই বলেন। তাও তুমি তোমার খেয়াল খুশি মত চল – কখনো বাধ্য হও কখনো অবাধ্য।

২) তুমি একটা চমৎকার মানুষ হিসেবে বড় হয়ে উঠেছ- পড়াশোনায় ভাল, যা করা উচিত তাই কর, অন্যায় কিছু করোনা। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে তুমি তোমার বাবা-মা’র সাথে আর থাকনা। তুমি অন্য দু’জন মানুষকে তোমার বাবা-মা বানিয়ে নিয়েছ। যদিও তুমি তোমার আসল বাবার আয়ে চলছ, আসল মায়ের রান্না খাচ্ছ, কিন্তু তুমি রাতে থাকছ সেই নকল বাবা-মা’র সাথেই। তোমার প্রকৃত বাবা-মা’র স্থান, সম্মান, ভালোবাসা সেই নকল মানুষদুটোকে দিচ্ছ।

৩) তুমি একটা আদর্শ মানুষ। তোমার ঔচিত্যবোধ, বিবেকবোধ অসাধারণ। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে তুমি তোমার বাবা-মার অস্তিত্বকে অস্বীকার কর। তোমার ধারণা বাবা-মা বলে কিছু নেই, তুমি প্রাকৃতিক নিয়মে সৃষ্ট হয়েছ এবং বেড়ে উঠেছ, এখানে অন্য কারো কোন কৃতিত্ব নেই। তুমি অদ্যাবধি তোমার বাবার উপার্জনে বড় হচ্ছ, তোমার মা তোমার সেবায় প্রাণপাত করছেন তাও তুমি তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করনা, এমনকি তুমি স্বীকারই করনা যে তাঁরাই আছেন, এগুলো করছেন।

তুমি হয়ত ভাববে এও কি সম্ভব? কোন মানুষ কি এটা করতে পারে? প্রথমটা নাহয় কেউ কেউ করে ফেলে কিন্তু বাকি দু’টো নেহাতই অসম্ভব। নিজেদের বাবা-মা তথা অস্থায়ী অভিভাবকদের ক্ষেত্রে পরের দুটি আসলেই কেউ কখনো করেনা। কিন্তু প্রকৃত অভিভাবকের ক্ষেত্রে অনেকেই কিন্তু এই অসম্ভবটি সম্ভব করে ফেলে।

এবার আমাদের দৃষ্টিটা একটু গভীরে পাঠাই। মা তোমাকে ধারণ করেছেন, সৃষ্টি করেননি। বাবা যেই চাল এনে খাওয়াচ্ছেন তা কিন্তু তার কেনা, সৃষ্টি নয়। সৃষ্টিকর্তা কিন্তু আল্লাহ। এই যে তুমি ঘুরছ-চলছ, তোমার কোষগুলোর, অংগগুলোর ব্যবস্থাপনা কিন্তু তোমার নয়, আল্লাহর। যে বাতাস থেকে তুমি নিঃশ্বাস নিচ্ছ, যে পানিতে তোমার তৃষ্ণা মিটছে তাও কোন মানুষের তৈরী নয়, আল্লাহর তৈরি। আল্লাহর দেয়া চোখ দিয়ে দেখে,কান দিয়ে শুনে, বুদ্ধি দিয়ে ভেবে তুমি কখনো ভেবে বের করতে পারলেনা যে কে তোমাকে এগুলো দিল? সবাইতো এগুলো পেলনা, অন্ধকে জিজ্ঞেস করে দেখ, বধিরকে ইশারা করে জেনে নাও তারা কেন বঞ্চিত? তুমি সব পেয়েও ভাবলে এই সব সুযোগ-সুবিধা কেউ তোমাকে দেয়নি? তুমি শুধুই প্রাকৃতিক নিয়মে তৈরি নও। এজন্যই সবার জন্ম প্রক্রিয়া একরকম হলেও প্রত্যেকটি মানুষ একে অপরের থেকে ভিন্ন। তাদের সত্বা ভিন্ন, আত্মা ভিন্ন, চিন্তা ভাবনা ভিন্ন। তাই একি কোষের ডিএনএ ভাগ করা জমজ ভাইয়েরাও একে অপরের থেকে আলাদা। প্রতিটি মানুষ একেবারেই স্বতন্ত্র। বিবর্তনবাদ গোজামিল দিয়ে অনেক কিছু ব্যখ্যা করতে পারলেও এই ভিন্নতা এখনো ব্যাখ্যা করতে পারেনি। কখনো পারবেওনা।

যে মানুষ কখনো অস্বীকার করেনি তার একটা জন্মদাতা জন্মদাত্রী আছে সেই মানুষ কিভাবে তাঁর প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তাকে অস্বীকার করে? তৃতীয় প্রেক্ষাপটের নাম ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে কুফরি। ভুল বুঝে অনুতপ্ত হয়ে পূর্বের অবস্থান থেকে সরে না এলে এর কোন ক্ষমা নেই।

আল্লাহ কিন্তু আমাদের কাছে খুব বেশি কিছু চাননি। তিনি চেয়েছেন আমরা যেন তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তাঁর জায়গায় অন্য কাউকে না বসাই। আমাদের নিজেদের স্বার্থে তাঁর কথাগুলো মেনে চলি। আল্লাহ তাই আমাদের চারপাশে তাঁর অসংখ্য নিদর্শন দিয়ে বলেছেন তা নিয়ে চিন্তা করতে। তাহলে আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য বুঝতে পারব। তাঁর কথা মেনে নিব।

কিন্তু মানুষ খুব স্বেচ্ছাচারী। সে আল্লাহকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা দেয়নি। প্রাণহীন পাথর, মাটি দেয়ে তৈরি মুর্তি, গাছ থেকে শুরু করে অন্য মানুষ এমনকি মৃত মানুষকেও সে আল্লাহর স্থান দিয়েছে। সে দেয়ালের ছবির কাছে সাহায্য চেয়েছে, হাতের মাদুলির কাছে নিরাপত্তা চেয়েছে। আল্লাহ শিরক- এই অপরাধটা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেন। যেই শিরক করুক – সে যিশুকে প্রভু বলুক, কালীকে শক্তিদায়িনী “মা” ভাবুক বা বড়পীর আব্দুল কাদিরকে বিপদের একমাত্র উদ্ধারকারী হিসেবে আহবান করুক, সে আল্লাহর কাছে মুক্তি পাবেনা। দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটে যেমন বাবা-মা কখনোই তার সেই মেয়েকে ক্ষমা করবেনা, শিরকে জড়িত মানবসন্তানও তেমনি কখনো অনন্ত শাস্তি থেকে মুক্তি পাবেনা।

তুমি ভাবতে পার কোন এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কথা অথবা মাদার তেরেসার কথা, ভারতের কোন এক হিন্দু দানবীরের কথা। এরা সবাই তো খুব ভাল মানুষ, কারো ক্ষতি করেনি বরং উপকার করেছে। এরা কেন আগুনে জ্বলে কষ্ট পাবে? পাবে কারণ এরা মানুষ। এদেরকে বোধ-বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এই বোধ-বুদ্ধি-বিবেকের দাবী পুরণ করলে সে পুরস্কার পাবে, না করলে শাস্তি। এজন্যই গরু নামের চরম উপকারী প্রাণিটির জন্য কোন পরকাল নেই, কোন পুরস্কার নেই – কারন তার আত্ম-চেতনা নেই। তবে আল্লাহ ন্যায়বিচারক। কোন মুশরিক ভাল কাজ করলে তিনি এর প্রতিদান পৃথিবীতে দিয়ে দিবেন। মাদার তেরেসা নোবেল পেয়েছেন, অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। তাঁর মহতী কর্মের পুরষ্কার তিনি মৃত্যুর আগেই পেয়ে গিয়েছেন। দানবীর বড় খেতাব পেয়েছেন, বৌদ্ধ ভিক্ষু পেয়েছেন সম্মান।

মানুষকে বিবেক দেয়ার পরেও নিজের কথা মনে করিয়ে দিতে আল্লাহ সৃষ্টির সেরা মানুষদের পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে তার কথা শোনানোর জন্য। এমন কোন জনগোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যেখানে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী পৌছেনি। আল্লাহ বলেন –

“আমি রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকেই শাস্তি দেইনি” ১

রসুলুল্লাহ (সাঃ) গত হয়েছেন প্রায় পনেরশ বছর আগে, কিন্তু আজো তাঁর শিক্ষা মানুষের মাঝে আছে। যে চাবে সে ঠিকই খুঁজে পাবে। তারপরেও ধরে নিলাম আমাজনের অববাহিকায় দুর্গম অরণ্যের একটা ব-দ্বীপের কিছু মানুষ কখনো আল্লাহর একত্ববাদের আহবান শোনেনি। এমন মানুষদের শাস্তি দেবার আগে আল্লাহ শেষ বিচারের দিনে তাদের পরীক্ষা করে নেবেন। এরপর তাদের কৃতকর্মের ফলাফল দেয়া হবে, কারণ আল্লাহ কখনোই অন্যায় করেননা। আল্লাহ বলেছেন –

“এবং তারা আরো বলবেঃ যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম তাহলে আমরা জাহান্নাম বাসী হতাম না।” ২

যারা বুদ্ধিমান তারা চিন্তা করে আল্লাহকে চিনবে, মানবে। যারা ততটা বুদ্ধিমান নয় তারা অন্যের কথায় আল্লাহকে চিনবে, তারপর আল্লাহর আদেশ মেনে নিবে। আর যারা দু’টোর একটাও করবেনা তারা হতভাগা। তারা এত হতভাগা যে তাদের দুর্ভাগ্যের কথাটাও তারা জানেনা। তুমি জেনে রেখ পৃথিবীতে একমাত্র ধর্ম ইসলাম যেখানে প্রত্যেকটা মানুষকে নিজ থেকে জেনে বুঝে ইসলাম মানতে হবে। তুমি মুসলিমের ঘরে জন্মগ্রহণ করে একটা নাম পেতে পার, কিন্তু পরকালে মুক্তির সনদ পাবেনা। মনে রাখবে ইসলাম তোমার সম্পদ, সম্পত্তি নয়। এটা তোমার নিজেকে অর্জন করে নিতে হবে। তোমাকে তোমার ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝতে হবে, পালন করতে হবে। তারপর অন্যদের এ ধর্ম সম্পর্কে জানাতে হবে বুঝাতে হবে। এরপরে তোমার দায়িত্ব শেষ আর তাদের দায়িত্ব শুরু –

“যারা সৎপথ অবলম্বন করবে তারা তো নিজেদেরই মঙ্গলের জন্য সৎপথ অবলম্বন করবে এবং যারা পথভ্রষ্ট হবে তারা তো নিজেদের ধ্বংসের জন্যই পথভ্রষ্ট হবে এবং কেউ অন্য কারো ভার বহন করবেনা।” ৩

– শরীফ আবু হায়াত অপু


১,৩ – সুরা বানী ইস্রাইল, ১৭-১৫
২ – সুরা মুলক, ৬৭-১০

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button