সচেতনতা

লোকে কি বলবে!

আমরা যখন কালেমা পড়ে ঘোষণা দেই – লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ – তখন আমরা শপথ করি, “আমার জীবনে আল্লাহ্‌র থেকে বড় আর কেউ নেই। আজ থেকে আমার প্রতিটা সিদ্ধান্ত এবং কাজে আল্লাহ থাকবেন সবার আগে, তারপরে অন্য কিছু। আমি অন্য কোনো কিছুকে আল্লাহ্‌র থেকে বেশি গুরুত্ব দিবো না।” কিন্তু তারপর যা ঘটে তা হচ্ছে অনেকটা এরকমঃ

  • মেহমান এসেছে, তুমুল আড্ডা চলছে দেশের গণ জাগরণ নিয়ে, ওদিকে মাগরিবের সময় পার হয়ে যাচ্ছে, “আহ্‌ হা, মাগরিবের সময় দেখি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এখন উঠে গেলে ওরা আবার কি মনে করে। তারচেয়ে রাতে একবারে ঈশার সাথে পড়ে নিবো। আল্লাহ্‌ মাফ করুন।”
  • বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার আগে রঙবেরঙের সাজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, “মাথায় ঘোমটা দিলে কেমন খ্যাঁত মনে হচ্ছে। থাক, ঘোমটা ছাড়াই যাই, আত্মীয় স্বজনরা আবার কি সব বলাবলি করে। বান্ধবীরা দেখলে হাসা-হাসি করবে। ফুল হাতা ব্লাউজটাও একদম মানাচ্ছে না। দেখি হাফ হাতা পড়ি, স্মার্ট লাগবে। মাত্র এক রাতের ব্যাপার, কিছু হবে না, আল্লাহ্‌ মাফ করবেন।”
  • আমীর খানের ছবি লাগানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা ফুল-হাতা শার্ট আর একটা স্লিম-ফিট টি-শার্ট হাতে নিয়ে, “এই লম্বা জামাটা আজকাল আর চলে না, লোকজন খ্যাঁত বলে। তারচেয়ে এই টি-শার্টটাতে আমাকে অনেক স্মার্ট দেখায়। কিন্তু এটা পড়ে সিজদা দিলে তো আবার পিছনটা বের হয়ে যায়। যাক্‌গে কিছু হবে না।
  • বন্ধুর নতুন গাড়ির পাশে নিজের পুরনো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে, “নাহ্‌, এই ভাঙ্গা গাড়িটা ফেলে ব্যাংক থেকে গাড়ির লোণ নিয়ে এবার একটা নতুন গাড়ি কিনতেই হবে। এই গাড়ি নিয়ে বের হলে মানুষকে মুখ দেখাতে পারি না। প্রতিবেশীরা কেমন করে তাকায়, নিজেকে গরিব-গরিব মনে হয়। একটু সুদ দিলে কিছু হবে না। আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই আমার কষ্টের কথা বুঝবে।”
  • মাসের ভাড়া দিয়ে বাড়িওলার বাসা থেকে মুখ কালো করে ফেরত আসার পথে, “আর না, অনেক অপমান সহ্য করেছি, বন্ধু বান্ধবকে মুখ দেখাতে পারি না। মানুষকে বলতে হয় – ‘আমি ভাঁড়াটিয়া।’ এইবার ডিবিএইচের লোণটা নিয়ে একটা বাড়ি কিনবোই। পরে একসময় হজ্জ্ব করে আল্লাহ্‌র কাছে মাফ চেয়ে নিবো।”
  • রাস্তায় সার্জেন্টকে পাঁচশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিতে দিতে, “ছিছি, ঘুষ দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু না দিলে তো আবার গাড়ি নিয়ে যাবে। কি লজ্জার ব্যপার হবে যদি প্রতিবেশীরা জেনে ফেলে গাড়িটা দুই নম্বরি করে কেনা। থাক না, মাত্র পাঁচশ টাকা, আল্লাহ্‌ মাফ করেন।”

উপরের উদাহরণ গুলোতে যে ধরণের মানুষদের উপমা দেওয়া হল তারা এখনও এটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি যে, তাদের থেকে বড় কোনো ক্ষমতার অধীনে তারা আছে, যিনি তাদের প্রত্যেকটা কথা, কাজ এবং চিন্তার হিসাব রাখছেন। ‘লোকে কি বলবে’ এই ভয়ে তারা সুদের লোণ নিয়ে বাড়ি-গাড়ি কিনবে যেন সমাজে মুখ দেখাতে পারে, ঘুষ দিয়ে প্রমোশন নিবে, চুরি করে পরীক্ষায় পাস করবে। এমনকি তারা অর্ধ নগ্ন হয়ে মাথা, চুল, গলা, ঘাড়, বুক-পিঠের উপরের অংশ, যতটুকু পারে হাত বের করে রাস্তা ঘাটে চলাফেরাও করবে। তারা ‘লোকে কি বলবে’-কে এতই ভয় পায় যে, তারা কখনও চিন্তা করে দেখে না যে, তারা কি ঘোষণা দিয়েছিল, যখন তারা বলেছিলঃ

 লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ্‌ – আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কোনোই প্রভু/ঈশ্বর নেই।

বরং তাদের চিন্তা-ভাবনা, কথা, কাজের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন তারা ঘোষণা দিচ্ছেঃ

লা ইলাহা ইল্লা ‘লোকে কি বলবে’

কালেমা পড়ে কাকে তারা সবচেয়ে বড় প্রভু হিসেবে মেনে নিয়েছে – সেটা এখনও তারা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি। এধরণের মানুষের কাছে আল্লাহ্‌ সবচেয়ে বড় প্রভু নয়, বরং তাদের কাছে ‘লোকে কি বলবে’ আল্লাহ্‌র থেকেও বড় প্রভু। যখনি তাদের জীবনে কোনো পরিস্থিতি আসে যেখানে তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় – “আমি এটা করলে তো আল্লাহ্‌ রাগ করবে, কিন্তু না করলে লোকে কি বলবে?”, তখন তারা আল্লাহ্‌র থেকে ‘লোকে কি বলবে’ কে বেশি ভয় পায় এবং আল্লাহ্‌কে উপেক্ষা করে ‘লোকে কি বলবে’ ঠেকানোর জন্য যা করা দরকার সেটাই করে।

এরপরেও কিছু লোক আছে যারা অন্যকে আল্লাহর সমান মনে করে। তাকে তারা এমন ভাবে ভালবাসে, যেভাবে আল্লাহকে ভালবাসার কথা। কিন্তু যারা বিশ্বাসী তারা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। হায়রে যদি অন্যায়কারীরা দেখতে পেত যে, [যেটা তারা পাবে, যখন তারা  জাহান্নামের শাস্তির দিকে তাকিয়ে থাকবে] সকল ক্ষমতা আল্লাহর এবং আল্লাহ কঠিন শাস্তি দেন। [বাকারাহ ২ঃ১৬৫]

মজার ব্যপার হচ্ছে এধরনের মানুষরা ঠিকই স্বীকার করে যে, আল্লাহ্‌ হচ্ছেন তাদের সৃষ্টিকর্তা। সে ব্যপারে তাদের মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা আল্লাহ্‌কে ইলাহ্‌ (প্রভু) হিসেবে মেনে নিতে পারেনি – যাঁর সব নির্দেশ কোনো প্রশ্ন না করে, কোনো সন্দেহ না করে মেনে নিতে হবে। আল্লাহ্‌ যখন শয়তানকে বলেছিলেন আদমকে সিজদা দিতে, তখন শয়তান তা করতে অস্বীকার করেছিল। তারপর আল্লাহ্‌ যখন তাকে জিগ্যেস করলেন কেন সে তাঁর আদেশ মানলো না, তখন সে উত্তর দিলঃ

সে বলল, ‘আমি ওর থেকে বড়। আপনি আমাকে আগুন থেকে বানিয়েছেন, আর ওকে বানিয়েছেন মাটি থেকে’। [সাদ ৩৮:৭৬]

দেখুন এখানে কিন্তু শয়তান ঠিকই জানে যে আল্লাহ্‌ হচ্ছেন তার সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তার সমস্যা ছিলো যে, সে আল্লাহ্‌কে প্রভু হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। যার কারণে সে আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা করেছিলো, সে কাফির হয়ে গিয়েছিল। একজন আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা তখনি করে যখন সে আল্লাহ্‌র নির্দেশকে অস্বীকার করে। আর এই অস্বীকারকারিরা হচ্ছে কু’রআনের ভাষায় কাফির। আমরা যখন জেনে শুনে – “কু’রআনে কঠিন নির্দেশ আছে, আল্লাহ্‌ আমাকে সবসময় দেখছেন” – এটা জানার এবং বোঝার পরেও আল্লাহ্‌র নির্দেশ অমান্য করতে থাকি, তাঁর অবাধ্য হতে থাকি, তখন আমরা কু’রআনের ভাষায় কাফির হয়ে যাই। এধরণের মানুষদেরকে আল্লাহ্‌ প্রশ্ন করেনঃ

মানবজাতি, কি তোমাকে তোমার মহান প্রভুর ব্যাপারে ভুলিয়ে দিলো? [৮২ঃ৬]

একজন মানুষ যেই মামার কথা শুনে লোণ নেয় বাড়ি কেনার জন্য, যেই চাচার কথায় ঘুষ দেয় কাজ হাসিল করার জন্য, যেই শাশুড়ির ভয়ে বিয়েতে যায় অর্ধ নগ্ন হয়ে, যেই বন্ধুকে দেখানোর জন্য লোণ নিয়ে গাড়ি কেনে, যেই মডেলের ফ্যাশন সেন্সে মুগ্ধ হয়ে চিপা টি-শার্ট, প্যান্ট পড়ে; কিয়ামতের দিন সেই মামা, চাচা, শাশুড়ি, মডেল, বন্ধুরাই তাকে বলবে, “তুমি কে? আমিতো তোমাকে কিছু করতে বলিনি? তুমি দুনিয়াতে কি করেছো না করেছো, তাতে আমার কোনোই হাত নেই। সব দোষ তোমার।” –

যাদেরকে অন্যরা অনুসরণ করতো, তারা যখন তাদের অনুসারীদেরকে ত্যাজ্য/অস্বীকার করবে, যখন তারা সবাই জাহান্নামের কঠিন শাস্তির দিকে তাকিয়ে থাকবে, যখন তাদের মধ্যে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে; তখন অনুসারীরা বলবে, “হায়! যদি আমরা আর একটা বার সুযোগ পেতাম, তাহলে আজকে ওরা যেভাবে আমাদেরকে ত্যাজ্য/অস্বীকার করছে, ঠিক সেভাবে আমরাও ওদেরকে ত্যাজ্য/অস্বীকার করতাম।” এভাবে আল্লাহ্‌ তাদেরকে দেখাবেন তারা (দুনিয়ায়) কি করতো, যাতে করে তারা আফসোস করতে থাকে। তারা  জাহান্নামের আগুন থেকে বের হতে পারবে না। [বাকারাহ ২ঃ১৬৬-১৬৭]

আমরা মোটামুটি সবাই এই আয়াতটির সাথে পরিচিতঃ

আমি জ্বিন এবং মানব সৃষ্টি করেছি শুধুই আমার ইবাদত করার জন্য। [৫১ঃ৫৬]

এই আয়াতটি নিয়ে আমাদের অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে, এখানে আল্লাহ্‌ বলছেন – তিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন যেন আমরা শুধুই তাঁর ইবাদত করি অর্থাৎ শুধুই নামায পড়ি, রোযা রাখি, যাকাত দেই ইত্যাদি এবং অন্য কোনো কাজ না করি। ধর্মীয় কাজগুলো করাই হচ্ছে ইবাদত, বাকি সব ফালতু কাজ। ব্যপারটা তা নয়। ইবাদত শব্দটি এসেছে আ’বদ عبد থেকে যার অর্থ দাস। আমরা শুধুই আল্লাহ্‌র উপাসনা করি না, বরং আমরা আল্লাহ্‌র দাসত্ব করি।আল্লাহ্‌ যেটা করতে বলেছেন, সেটা করা এবং যেটা করতে মানা করেছেন, সেটা না করা হচ্ছে ইবাদত। আল্লাহ্‌ মানুষ এবং জ্বিন সৃষ্টি করেছেন যেন তারা আল্লাহ্‌ যা বলেছেন সেগুলো করে এবং যেটা করতে মানা করেছেন সেটা না করে। এমনটি নয় যে আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়লাম, রোযা রাখলাম, যাকাত দিলাম – ব্যাস, আল্লাহ্‌র সাথে আমাদের সম্পর্ক শেষ। এরপর আমি যা খুশি তাই করতে পারি। বরং আমরা সবসময় আল্লাহ্‌র দাস। ঘুম থেকে উঠার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটা কাজে, প্রতিটা কথায় আমাদেরকে মনে রাখতে হবে – আমরা আল্লাহ্‌র দাস এবং আমরা যে কাজটা করছি, যে কথাগুলো বলছি, তাতে আমাদের প্রভু সম্মতি দিবেন কিনা এবং প্রভুর কাছে আমি জবাব দিতে পারবো কি না। এরকম মানুষ দেখেছেন যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে পড়ে, কিন্তু ব্যাংকের একাউন্ট থেকে সুদ খায়, সুদের লোণ নিয়ে বাড়ি কিনে, কাউকে ভিক্ষা দেবার সময় বা মসজিদে দান করার সময় মানিব্যাগে সবচেয়ে ছোট নোটটা খোঁজে? বা এরকম মানুষ দেখেছেন যে হজ্জ করেছে, বিরাট দাড়ি রেখেছে কিন্তু বাসায় তার স্ত্রী, সন্তানদের সাথে ধমক না দিয়ে কথা বলতে পারে না? এরা আল্লাহর আবদ্‌ নয়। এরা আল্লাহ্‌র ইবাদত করছে না। এরা শুধুই উপাসনা করছে। উপাসনার বাইরে আল্লাহ্‌র প্রতি নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে আল্লাহ্‌র আবদ্‌ হয়ে তাঁর ইবাদত করতে এখনও বাকি আছে।

লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ্‌ একটি অদ্ভুত বাক্য। এটাকে যদি অনুবাদ করা হয়, তাহলে হবে – “কোনোই ঈশ্বর নেই, আল্লাহ্‌ ছাড়া।” প্রথমেই আল্লাহ্‌ আমাদেরকে বলছেন – লা ইলাহা – কোনো ধরণের ঈশ্বর, প্রভু, খোদা নেই। আমাদের মাথা ভর্তি নানা ধরণের ঈশ্বরের ধারণা আছে। কেউ মনে করেন ঈশ্বর হচ্ছে মুখ ভর্তি ঘন সাদা দাঁড়ি সহ বিশাল দেহী প্রবীণ একজন ভদ্রলোক, যিনি মেঘের উপরে এক বিশাল সিংহাসনে বসে আছেন। আবার কেউ মনে করেন ঈশ্বর হচ্ছে মহাবিশ্বের বাইরে ঘিরে থাকা আলোর তৈরি বিশাল এক অসীম সত্ত্বা। আবার কেউ কল্পনা করেন ঈশ্বর হচ্ছে এই মহাবিশ্বের প্রতিটি অণু পরমাণু, সবকিছুই তিনি। ‘লা ইলাহা’ দিয়ে আল্লাহ্‌ আমাদেরকে প্রথমেই বলছেন যে আমাদের মাথা পরিস্কার করতে হবে, কারণ কোনো ঈশ্বর নেই, আল্লাহ্‌ ছাড়া। ঈশ্বর, খোদা, গড বলতে আমাদের যত সব আজে বাজে ধারণা আছে, তার কোনটাই তিনি নন। তিনি আল্লাহ্‌, তিনি অদ্বিতীয়। কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনার যোগ্য নয়।

মনে রাখবেন, মুখে “লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ্‌” বললেই কেউ মুসলমান হয়ে যায় না। আরবি ‘মুসলিম’ শব্দটির অর্থ – যে আত্মসমর্পণ করেছে। একজন মানুষ মুসলমান তখনি হয় যখন সে মনে প্রাণে, কথায়, কাজে ঘোষণা দেয়, “আল্লাহ্‌ ছাড়া আমার আর কোনোই প্রভু নেই। আমার বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব, সমাজ, ফ্যাশন, স্ট্যাটাস কোনো কিছুই আমার কাছে আল্লাহ্‌র চেয়ে বড় নয়। আমি ‘লোকে কি বলবে’ তা ভয় পাই না, বরং ‘আমার প্রভু রাগ করবেন’ সেটা সবচেয়ে বেশি ভয় পাই।”

– ওমর আল জাবির

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button