হাওয়ার গম্বুজ
যায়িদ ইবন সাবিত। বয়সে একেবারে কিশোর।
রাসুল (সা) যখন প্রথম হিজরত করেন মদিনায়, তখন যায়িদের বয়স মাত্র এগার বছর।
রাসূল (সা্য) তখনও মদিনায় পৌঁছেননি।
অথচ রাসূলের (সা) ওপর বিশ্বাস এনে ইসলাম কবুল করলেন এগার বছরের এই কিশোর।
ইসলাম গ্রহণের পরপরই তিনি শুরু করলেন কুরআন অধ্যয়ন।
বয়সে কিশোর। কিন্তু নিয়মিত কুরআন পড়ার কারণে মদিনার মানুষ তাকে সম্মানের চোখে দেখতো।
যায়িদ ইবন সাবিত ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।
এই প্রখর ছিল তার মেধা যে, মাত্র এগার বছর বয়সে, রাসূলের (সা) মদিনায় আসার আগেই তিনি সতেরটি সূরার হাফেজ হয়েছিলেন।
যায়িদের স্মতি শক্তিও ছিল দারুণ।
আল কুরআনের যেটুকু পড়তেন, তা সবই মুখস্থ রাখতে পারতেন।
রাসূল (সা) হিজরত কনে মদিনায় এলেন।
তিনি মদিনায় পা রাখার পরই মদিনার মানুষ যায়িদকে সাথে করে নিয়ে গেল রাসূলের (সা) দরবারে।
রাসূল (সা) তাকে দেখেই বুঝে গেলেন যে, এ এক অসাধারণ মেধাবী কিশোর। আর রাসূল (সা) যখন জানলেন যে, এই কিশোর সতেরটি সূরার হাফেজ হয়ে গেছেন ইতিমধ্যেই, তখন তো তাঁর বিস্ময়ের আর সীমা রইলো না।
রাসুল (সা) অসম্ভব খুশি হলেন এ্ই সংবাদে।
এরপর রাসূল (সা) স্বয়ং তাকে কুরআন তিলাওয়াত করতে বললেন। যায়িদ রাসূলের (সা) আদেশ পালন করলেন।
তার কণ্ঠে কুরআনের সহীহ তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হলেন রাসূল (সা)।
মদিনায় আছেন রাসুল (সা)।
প্রতিদিনই এসময় তাঁর কাছে আসতে থাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে চিঠিপত্রের বহর।
এর মধ্যে আছে পার্শবর্তী দেশ ও এলাকার রাজা-বাদশা, গোত্রপতি, আমির-উমরাহদের চিঠি।
অধিকাংশ চিঠির ভাষাই ছিল সুরইয়ানী ও ইবরানী (হিব্রু)।
মদিনায় তখন এই দু’টি ভাষা জানতো কেবল ইহুদিরা।
কিন্তু ইহুদিরা কখনই মুসলমানকে ভালো চোখে দেখতো না। বরং দুশমনী করাই ছিল তাদের প্রধানতমকাজ।
মদিনার মুসলমানরও এই দু’টি ভাষা জানতো না।
ফলে বেশ সমস্যা দেখা দিল। কি করা যায়?
ভাবছেন রাসূল (সা)।
হঠাৎ তিনি ডাকলেন যায়িদ ইবনে সাবিতকে।
কাছে, একান্ত কাছে ডেকে নিয়ে রাসুল (সা) যায়িদকে বললেন ভাষা দু’টি শিখে নেবার জন্য।
রাসূলের (সা) নির্বাচন!
যায়িদ নিজেই বলছেন সেই স্মৃতিবাহী ঘটনার কথা।
‘রাসূল (সা) মদিনায় এলে আমাকে তাঁর সামনে হাজির করা হলো। তিনি আমাকে বললেন, ‘যায়িদ, আমার জন্য তুমি ইহুদিদের লেখা শেখ। আল্লাহর কসম! তারা আমার পক্ষ থেকে ইবরানী ভাষায় যা কিছু লিখছে, তার ওপর আমার আস্থা হয় না।’ রাসূলের (সা) নির্দেশে আমি ইবরানী ভাষা শিখলাম। মাত্র আধা মাসের মধ্যে এতে দক্ষতা অর্জন করে ফেললাম। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) ইহুদিদেরকে কিছু লেখার দরকার হলে আমিই লিখতাম এবং রাসূলকে (সা) কিছু লিখলে আমিই তা পাঠ করে শুনাতাম।’
হযরত যায়িদ!
কি অসাধারণ ছিল তার মেধা এবং স্মরণ শক্তি।
তার এই মহান গুণের জন্য, এই দক্ষতা অর্জনের জন্য রাসূল (সা) যাবতীয় লেখালেখির দায়িত্ব অর্পণ করেন যায়িদের ওপর।
যায়িদ আরবি ও ইবরানী- দুই ভাষাতেই লিখতেন।
রাসূলের (সা) সর্বপ্রথম সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন উবাই ইবন কাব আল আনসারী।
আর উবাই-এর অনুপস্থিতিতে রাসূলের (সা) েএই মহান দায়িত্ব পালন করতেন যায়িদ ইবন সাবিত।
তারা ওহী ছাড়াও লিখতেন রাসূলের (সা) চিঠিপত্র।
রাসূলের (সা) ওফাত পর্যন্ত যায়িদ এই দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে।
রাসূলের (সা) ওফাতের পর- হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা) খিলাফত কালেও যায়িদ এই দায়িত্ব পালন করেন।
রাসূলের (সা) সময়ে যখন চিঠিপত্র কিংবা ওহী লেখার প্রয়োজন হতো, তখন যায়িদ হাড়, চামড়া, খেজুরের পাতা প্রভৃতি ব্যবহার করতেন।
পবিত্র আল কুরআনই ইসলামের মূল ভিত্তি। এই পবিত্র আল কুরআন সংগ্রহ ও সংকলনের মহা গৌরবজনক সম্মানের অধিকারী হযরত যায়িদ ইবন সাবিতও।
রাসূলের ওফাতরে পর, প্রথম খলিফা হযরত আবুবকরের (রা) সময়ে আরব উপদ্বীপে একদল মানুষ মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগ কর) হয়ে মুসায়লামা আল কাজ্জাবের দলে যোগদেয়।
মুসায়লামা ইয়ামামায় নিজেকে নবী বলে ঘোষণা করে।
হযরত আবুবকর (রা) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
যদিও এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে এবং মুসায়লামা মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয়- তবে যুদ্ধে একে একে শহীদ হয়ে যায় সত্তরজন হাফেজে কুরআন।
একটি যুদ্ধে এত বিপুল সংখ্যক হাফেজে কুরআনের শাহাদাত কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে হযরত উমরকে (রা) শঙ্কিত করে তোলে।
তিনি খলিফা হযরত আবু বকর (রা) কে আল কুরআন সংরক্ষণের জন্য তা লিপিবদ্ধ খরার জন্য বিশেষভাবে পরামর্শ দেন।
হযরত আবুবকর (রা) হযরত উমরের (রা) এই পরামর্শ গ্রহণ করেন।
তিনি আল কুরআন লিপিবদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানালেন যায়িদ েইবন সাবিতকে। বললেন, ‘তুমি একজন বুদ্ধিমান নওজোয়ান। তোমার প্রতি সবার আস্থা আছে। রাসূলুল্লাহ (সা) জীবিতকালে তুমি ওহী লিখেছিলে। সুতরাং তু্মিই এই কাজটি সম্পাদন কর।’
হযরত আবুবকরের (রা) প্রস্তাবটি শোনার পর যায়িদ তার অনুভূতি ব্যক্ত করলেন এইভাবে:
‘আল্লাহর কসম! তারা আমাকে আল কুরআন সংগ্রহ করার যে নির্দেশ দিয়েছিল তা করার চেয়ে একটি পাহাড় সরানোর দায়িত্ব দিলে তা আমার কাছে অধিকতর সহজ হতো।’
আল কুরআন সংরক্ষণের কাজে হযরত যায়িদকে সহযোগিতার জন্য আবু বকর (রা) আরও একদল সাহাবাকে দিলেন। দলটির সংখ্যা ছিল পঁচাত্তর। তাদের মধ্যে উবাই ইবন কাব ও সাঈদ ইবনুল আসও ছিলেন।
যায়িদ খেজুরের পাতা, পাতলা পাথর ও হাড়ের ওপর লেখা কুরআনের সকল অংশ সংগ্রহ করলেন। এরপর হাফেজদের পাঠের সাথে তা মিলিয়ে দেখলেন।
যায়িদ নিজেও একজন আল কুরআনের হাফেজ ছিলেন এবং রাসূলের (সা) জীবিতকালে আল কুরআন সংগ্রহ করেছিলেন।
হযরত যায়িদ!
কি সৌভাগ্যবান এক আলের জ্যোতি।
রাসূলের (সা) ওহী লেখার দায়িত্ব যে বিশেষ সাহাবীদের ওপর ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যায়িদ ইবন সাবিত।
যায়িদ সকল সময় রাসূলের (সা) সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করতেন।
রাসূলের (সা) পাশে যখন বসতেন তখন কলম, দোয়াত, কাগজ, খেজুরের পাতা, চওড়া ও পাতলা হাড়, পাথর ইত্যাদি তার চারপাশে প্রস্তুত রাখতেন। যাতে করে রাসূলের (সা) ওপর ওহী নাযিলের সাথে সাথেই তিনি তা লিখতে পারেন।
রাসূলের (সা) প্রতি ছিল যায়িদের সীমাহীন ভালোবাসা। ছিল তাঁর প্রতি শর্তহীন আনুগত্য।
যায়িদের এই ভালোবাসার কারণে তিনি সকল সময় চেষ্টা করতেন প্রাণপ্রিয় রাসূলের (সা) কাছাকাছি থাকার জন্য।
ভোরে, যখন ফর্সা হয়নি দূরের আকাশ, যখন কিছুটা অন্ধকারে ঢেকে থাকতো সমগ্র পৃথিবী, ঠিক সেই প্রত্যুষে নীরবে, অতি সন্তর্পণে যায়িদ পৌঁছে যেতেন সেহরীর সময়ে।
দয়ার নবীজীও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন যায়িদকে।
বিস্ময়করই বটে!
রাসূলকৈ (সা) দেখার আগেই যায়িদ মাত্র এগার বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, সতেরটি সূরারও হাফেজের অধিকারী হলেন।
যখন বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তখন যায়িদের বয়স মাত্র তের বছর।
তার প্রবল ইচ্ছা ও বাসনা ছিল যুদ্ধে যাবার।
কিন্তু বয়স কম থাকার কারণে তাকে অনুমতি দেননি মহান সেনাপতি রাসুল (সা)।
কিন্তু যখন উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হলো, তখন যায়িদের বয়স ষোল বছর। এখন কে আর তাকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত রাখে!
না, কেউ তার গতিরোধ করেননি।
যায়িদ প্রবল প্লানের মত তরঙ্গ-উচ্ছ্বাসে যোগ দিলেন উহুদ যুদ্ধে। যুদ্ধ করলেণ প্রাণপণে। সাহসের সাথে।
যুদ্ধের ময়দানে যায়িদ। ষোল বছরের এক টগবগে যুবক।
যুবক তো নয় যেন আগুনের পর্বত, বারুদের ঘোড়া!
কম কথা নয়!
মাত্র এগার বছরে ইসলাম গ্রহণ।
সতেরটি সূরার হাফেজে কুরআন।
কাতেবে ওহীর মর্যাদা লাভ।
রাসূলের (সা) সেক্রেটারি হবার গৌরব অর্জন।
জিহাদের ময়দানে এক সাহসী তুফান।
রাসূলের নির্দেশে দু’টি নতুন ভাষা শেখার আনন্দ।
সম্পূর্ণ হাফেজে কুরআন।
রাসূলের (সা) একান্ত সাহচর্য ও ভালোবাসা লাভ- এসবই হযরত যায়িদের জন্য নির্মাণ করেছে মর্যাদাপূন্ণ এক গৌরবজনক সুশীতল হাওয়ার গম্বুজ।
যায়িদের (রা) মত এমন সৌভাগ্যের অধিকারী ক’জন হতে পারে?
তারাই হতে পারে সফল, যাদের হৃদয়ে আছে ঈমান, সাহস, ত্যাগ আর ইসলামের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা।
– মোশাররফ হোসেন খান