সাহসী মানুষের গল্প

তারিক মেহান্নার জবানবন্দীতে তার “সন্ত্রাসী” হয়ে ওঠার গল্প …

যদি জিজ্ঞেস করা হয় তারিক মেহান্না মানুষটি কেমন, তাহলে তার পরিচিত জনেরা বলে থাকেন, তিনি বিনয়ী, গুরুগম্ভীর, সহানূভূতিশীল, মহিমান্বিত এবং ডেডিকেটেড একজন মানুষ। কিন্তু আজ, তার যে পরিচয়টা আর সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে তিনি একজন সত্যভাষী মুসলিম। মুসলিম বিশ্বে নব্য ফের’আউন আমেরিকার নিষ্ঠুর আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার “অপরাধে” আজ স্পষ্টবাদী এই মানুষটিকে আজ ১৭ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে।

নিচের লেখাটি আদালতে তার জবানবন্দী। আমি জানিনা, তারিকের এই অশ্রুভেজা কথাগুলো আমাদের এই “আমিময়” ব্যাক্তিপূজারী স্বার্থপর সমাজে কতটুকু স্পন্দন সৃষ্টি করতে পারে। আমি জানিনা, তারিকের অল্প কথায় চিত্রায়িত এ বিশ্ব চরাচরের নিষ্ঠুর বাস্তবতা আপনাকে থমকে দেবে কিনা। হয়তো, তারিকের কথাগুলোই সত্যি, আজ আপনি না বুঝলেও, একসময় না একসময় বুঝবেন। পাঠকবৃন্দ, আমার অনুরোধ, দিনটি যেন সেইদিন না হয়, যেদিন আমার বা আপনার আফসোস ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

ঠিক চার বছর আগে এই সময়টাতে আমি আমার একটি স্থানীয় হাসপাতালের কাজ শেষে ফিরে যখন আমার গাড়ির দিকে হেঁটে আসছি ঠিক তখন দুই আমেরিকান এজেন্ট আমার পথরোধ করল। তারা বলল, আমার হাতে দুটো অপশন আছে: একটি সহজ, অপরটি কঠিন। তাদের ভাষায় “সহজ” অপশনটি ছিল যে আমি সরকারের পক্ষে তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করব আর এতে আমাকে কখনও আদালত বা কারাকক্ষের ত্রিসীমানায়ও যেতে হবে না, অন্যদিকে “কঠিন” অপশনটি ছিল এর ঠিক উল্টোটা, আমাকে সারাজীবন কারাগারেই কাটাতে হবে। তো গত চার বছরের অধিকাংশ সময় ধরে আমি এখানে আছি, কারাগারের ছোট একটা কক্ষে। আমাকে এখানে আটকে রাখা, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং সবশেষে আমাকে মৃত্যুদন্ডের দন্ডে দন্ডিতাদেশে অভিযুক্ত করার জন্য FBI এবং এই আইনজীবীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং সরকার কর থেকে লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয় করে আসছে।

এই মুহূর্ত পর্যন্ত নেতৃস্থানীয় গোছের অনেক মানুষের কাছ থেকে আমি “আমার কি বলা উচিত” টাইপের পরামর্শ পেয়েছি। অনেকে বলেছেন আমার ক্ষমা চেয়ে আত্মসমর্পণ করা উচিত যাতে করে শাস্তি লঘু হয়, কেননা তা না করলে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমি তা চাই না, আমি যেটা করতে চাই তা হল শুধু নিজের সম্পর্কে অল্প কয়েকটা মিনিটের জন্য কিছু কথা বলা, আর কিছু না।

যখন আমি সরকারের বেতনপুষ্ট এজেন্ট সংবাদদাতা হবার প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করলাম, সরকার আমাকে মুসলিম বিশ্বের সেইসব মুজাহিদীনদের সাহায্য করার “অপরাধে” আটক করল, যারা মুসলিম বিশ্বে আমেরিকা কর্তৃক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে, যাদেরকে সচরাচর “আখ্যা দেয়া হয় সন্ত্রাসী” হিসেবে। যদিও আমার জন্ম কোন মুসলিম দেশে ছিল না এবং আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা আমেরিকায়, তবুও আজ আমি যেমন তা নিয়ে অনেক মানুষ রীতিমত রাগান্বিত আমার ওপরে! তারা বিশ্বাস করতে পারে না, আমেরিকায় জন্ম নিয়েও আমি কিভাবে এমন অদ্ভূত চিন্তা এবং বিশ্বাসের (মুসলিমদের প্রতি আমার আনুগত্য এবং সাহায্য করার মানসিকতা) অধিকারী হলাম! একটা মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতায় যা দেখে তাই শেখে এবং এটাই তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তাই, আমি বলব, আজ আমি যা, তার কারণ আমেরিকা নিজে।

আমার বয়স যখন ছয়, তখন আমার কাছে কমিকস বইয়ের সুবিশাল সংগ্রহ ছিল। ব্যাটম্যান দেখে আমার মনে একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার হয়, তা হল এই বিশ্ব চরাচরে কিভাবে কি হয়ে আসছে; এখানে শোষক আছে, আছে শোষিত, এবং তাদের মাঝে আছে এমন কিছু মানুষ যারা নিপীড়িত শোষিত মানুষের পক্ষে অবস্থান নেয়। এই বাস্তবতা আমাকে এতটাই আন্দোলিত করেছিল যে আমার পুরো শৈশব জুড়ে আমি যেসব বইয়েই এ ধরণের সামাজিক বাস্তবতার কথা উঠে আসত সেগুলো সাগ্রহে পড়ে ফেলতাম, যেমন আংকেল টম’স কেবিন, ম্যালকম এক্স এর আত্মজীবনী, “ক্যাচার ইন দ্যা রাই” ইত্যাদি।

আমি যখন হাইস্কুলে সত্যিকারের ইতিহাস ক্লাসগুলো করতে শুরু করলাম, তখন আবিষ্কার করলাম শোষক-শোষিতের এই ঘটনাবলী উপন্যাসের সীমানা পেড়িয়ে আসলে আরো অনেক বেশি বাস্তব। আমি নেটিভ আমেরিকানদের ইতিহাস পড়লাম এবং জানতে পারলাম ঔপনিবেশিক ইউরোপিয়ানদের হাত ধরে তাদের উপর কি দুর্দশা নেমে এসেছিল। আবার এই ইউরোপিয়ানরাই কিভাবে রাজা জর্জ (তৃতীয়) এর হাতে শোষিত হয়েছিল তাও আমি জানতে পারলাম। আমি পল রেভার, টম পেইনদের সম্পর্কে জানলাম, জানলাম কিভাবে আমেরিকানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব করেছিল, আজকে আমরা যেটাকে আমেরিকান রেভ্যুলেশন ওয়ার হিসেবে উদযাপন করি, তার সম্পর্কেও। আমি জানতে পারলাম হ্যারিয়েট টাবম্যান, ন্যাট টার্নার, জন ব্রাউনদের গল্প, যাদের নেতৃত্বে এই দেশের দাসত্বের বিরুদ্ধে সংগঠিত যুদ্ধের কাহিনী। আমি আরো জানলাম ইমা গোল্ডম্যান, ইউজেন ডেবসদের নিয়ে লেবার ইউনিয়নগুলোর সংগ্রাম, জানলাম কর্মজীবি শ্রেণী এবং ভিন্নমতাবলম্বী হবার “দোষে” দুষ্ট জেলখানার বন্দীদের কাহিনী। আমি রোজা পার্ক, ম্যালকম এক্স, মার্টিন লুথার কিং দের নাগরিক অধিকার এর জন্য আন্দোলন সম্পর্কে পড়াশোনা করলাম। হো চি মিনহ সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে জানলাম কিভাবে ভিয়েতনামবাসীকে যুগ যুগ ধরে একের পর এক বৈদেশিক আক্রমণ এর বিরুদ্ধে দাড়াঁতে হয়েছে। আরো জানা হল নেলসন ম্যান্ডেলা আর তৎকালীন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সম্পর্কে। আমার বয়স যখন ছয় তখন থেকেই এই ব্যাপারগুলো শিখতে শুরু করি, এবং যখনই এসব গল্প পড়তাম, সবসময়ই আমি নিজেকে শোষিত মানুষের পাশে কল্পনা করতে দেখেছি। মনের অজান্তে একসময় আমি শোষিতদের পক্ষে রুখে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে সম্মান করতে শুরু করেছি, তারা যে ধর্ম বা জাতিরই ছিল না কেন। আমি আমার ক্লাস নোটগুলোকে কখনই অযত্নে ফেলে দিতাম না। ঠিক এই মুহুর্তে যখন আমি এখানে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছি, আমার বেডরুমের তাকে সেই ক্লাসনোটগুলো এখনও দিব্যি সাজানো আছে।

এই ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর মাঝে একজনকে আমি দেখলাম, যেন তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি ম্যালকম এক্স, তার অনেক কিছুই আমার ভাল লেগেছে, কিন্তু আমি মুগ্ধ হয়েছি তার ভাবনার রুপান্তরে, তার নিজের রুপান্তরে। ম্যালকম এক্সকে নিয়ে নির্মিত স্পাইক লি এর “এক্স” চলচ্চিত্রটা আপনারা দেখেছেন কিনা জানিনা, প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার একটা চলচ্চিত্র, যেখানে দেখা যায় শুরুর দিকটাতে যে ম্যালকম এক্স ছিলেন একজন অশিক্ষিত ক্রিমিন্যাল, শেষের দিকটাতে সেই ম্যালকমই একজন স্বামী, একজন পিতা, গণমানুষের স্বার্থ রক্ষাকারী একজন বাগ্মী নেতা, একজন নিয়মানুবর্তী মুসলিম যিনি হজ্জ করছেন এবং সবশেষে হলেন একজন শহীদ।

ম্যালকমের জীবন থেকেই আমি শিখেছিলাম ইসলামটা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কোন বিষয় নয়, এটা কোন সংস্কৃতি বা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ নয়, এটি একটি জীবনব্যবস্থা, এটা মানবমনের এমন এক পরিস্থিতি, যা যেকোন মানুষ যখন খুশি বেছে নিতে পারে, তার অবস্থান যাই হোক না কেন বা যেখানেই সে বেড়ে উঠুক না কেন। এটা দেখে আমি ইসলাম নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে গিয়ে হোচঁট খেলাম। যদিও আমি তখন কেবল একটা কিশোর, কিন্তু ইসলাম আমার সামনে সেসব প্রশ্নের উত্তর উন্মোচিত করলো, বড় বড় বিজ্ঞানীরা যার ধার ঘেঁষেও যেতে পারে নি, যে প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারার ব্যর্থতা অনেক ধনী আর বিখ্যাত মানুষকেও বিষাদ আর আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে, “”কি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য?”, “এই মহাবিশ্বে আমরা কেন, কি করতে এই আমরা বেঁচে আছি?”।“ এই যে আমাদের জীবনের এই এত এত কিছু, আমার জীবনে, আমার চারপাশের মানুষগুলোর জীবনে ইসলামের উপলক্ষ, এই পৃথিবীর জন্য ইসলামের কি দেয়ার আছে- তা জানতে গিয়ে আমি কুর’আন এবং রাসূল (সাঃ) এর শিক্ষাগুলো ঘাটঁতে শুরু করলাম সরাসরিই, খ্রিস্টানিটির মত পুরোহিতবাদ এবং যাজকতন্ত্রের জটিলতা এখানে ছিল না। যতই আমি জানতে লাগলাম ততই আমি ইসলামকে আবিষ্কার করলাম, এ যেন স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান। এমন চমৎকার বোধটি আমার মনে সৃষ্টি হয়েছিল যখন আমি একজন কিশোর, কিন্তু বহু বছর পর আজও, বিগত কয়েক বছরের ক্রমাগত চাপ থাকা সত্ত্বেও আমি যে কারো সামনে এবং আদালতে সবার সামনে সে বোধ নিয়েই একজন গর্বিত মুসলিম হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে পারি।

আমার মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু একসময় নিবদ্ধ হল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিমদের জীবনে কি ঘটে আসছে তার উপর। আমি যেখানেই দেখতাম, সেখানেই দেখতাম বড় বড় পরাশক্তিগুলো আমি যাদের ভালবাসতাম তাদের যেন ধ্বংস করতে তৎপর। আমি দেখেছি আফগানিস্তানের মুসলিমদের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন কি করেছে, দেখেছি চেচনিয়ার মুসলিমদের উপর রাশিয়ার অনাচার। আমি দেখলাম লেবাননের মুসলিমদের প্রতি ইসরায়েলের অনাচার এবং যা সে আজও চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনে, আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন এবং সহযোগিতায়। আমার এও অজানা ছিল না যে আমেরিকা নিজেই মুসলিমদের সাথে কি পরিমাণ অন্যায় করে আসছে। আমি উপসাগরীয় যুদ্ধ সম্পর্কে জানলাম, জানলাম কিভাবে ইউরেনিয়াম বোমা ব্যবহার করে ইরাক জুড়ে হাজার হাজার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং জন্ম দিয়েছে মরণব্যাধি ক্যান্সারের উচ্চমাত্রার। আমেরিকার নেতৃত্বে জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত Sanction এর কারণে ইরাকে খাদ্য, পানি এবং ঔষধপত্র ইরাকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় নি, যার ফলাফল ছিল ইরাকে অন্তত ৫ লক্ষ শিশুর হারিয়ে যাওয়া। আমার মনে আছে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখেছিলাম, “60 Minutes” প্রোগ্রামে, সেখানে ম্যাডেলিন অলব্রাইটের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ইরাকের এই মৃত শিশুরা নাকি এমন আচরণ পাবারই উপযুক্ত! আমি দেখলাম কিভাবে কিছু মানুষ এই নির্মম শিশু হত্যার ঘটনায় শান্ত থাকতে না পেরে এরোপ্লেন হাইজ্যাক করে ১১ সেপ্টেম্বেরে বিল্ডিং উড়িয়ে দিল।

তৎপরবর্তী সময়ে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া স্বরুপ আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে বসল। আবিষ্কার করলাম “Shock & Awe” (এক ধরণের আক্রমণাত্মক মিলিটারি tactic) এর পরিণতি, ইরাকের শিশুরা হাসপাতালের ওয়ার্ডে শুয়ে আছে, তাদের কপালে বিঁধে আছে মিসাইলের তীক্ষ্ণ Shrapnel। না, CNN এ এসবের কিছুই দেখায় নি। মেরিন সেনারা হাদীসা শহরে ২৪ জন ঘুমন্ত মুসলিমকে, তাদের মধ্যে ৭৬ বছর বয়স্ক হুইলচেয়ারে বসা একজন লোকও ছিলেন, আরও ছিল নারী এবং শিশু, গুলি করে হত্যা করে উড়িয়ে দিয়েছিল, তাদের বিছানাতেই। বোন আবীর-আল-জানাবিকে পাঁচজন আমেরিকার সেনা গণধর্ষণ করেছিল, তারপর হত্যা করেছে তাকে এবং তার পরিবারকে এবং মৃতদেহটাকেও ছেড়ে দেয়নি, পুড়িয়ে দিয়েছিল আগুনে। আমি আপনাদের একটা জিনিষ মনে করিয়ে দিতে চাই, একজন মুসলিম নারী কখনও তার চুল পর্যন্ত পরপুরুষের সামনে উন্মুক্ত করে না, আর কল্পনা করে দেখুন একটিবার, রক্ষণশীল পরিবারের এই ছোট্ট মেয়েটির কাপড় ছিড়ে ফেলা হচ্ছে, পাশবিকভাবে যৌন নির্যাতন করছে, একজন নয়, দুজন নয়, তিন বা চার জনও নয়, পাচ জন সৈনিক মিলে। এই আজও, আমি যখন বসে আছি কারাগারে, পাকিস্তান, সোমালিয়া আর ইয়েমেনে আমেরিকার চলমান ড্রোন হামলার খবর শুনছি। এইতো গত মাসেই, আমরা শুনলাম ১৭ জন আফগান মুসলিমকে, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন মা এবং তাদের বাচ্চা, তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং এরপর তাদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এগুলো হয়তো আপনার কাছে পত্রিকার খবর বৈ কিছু নয়, কিন্তু এই আমি, এরই মাঝে শিখেছি, ইসলামের আনুগত্য আর ভাতৃত্বের সংজ্ঞাটুকু, যে প্রতিটা মুসলিম নারী আমার বোন, আর প্রতিটা পুরুষ আমার ভাই, আর এই আমরা একসাথে একটা বিশাল পরিবার যারা একে অপরকে সাহায্য করে যাব। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমি আসলে আমার ভাইবোনদের উপর এমন নির্বিচার অত্যাচার দেখে চুপ বা “নিষ্ক্রিয়” থাকতে পারি নি, শোষিতের জন্য সম্মান আমার সবসময়ই ছিল, কিন্তু আজ যেন ব্যাপারটা একদমই নিজের, একেবারেই নিজের মানুষগুলোকে রক্ষার জন্য আমার সমবেদনা।

আমি পল রেভারের কথা উল্লেখ করেছি, যখন সে মধ্যরাতে টহল দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছিল স্যাম এডামস আর জন হ্যাংকককে (এ দুজন ছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রামের দুজন অগ্রপথিক) গ্রেপ্তার করতে লেক্সিংটনের দিকে আগত ব্রিটিশ সেনাদের ব্যাপারে। এরপর ব্রিটিশ সেনারা অভিমুখী হয় কনকর্ডের দিকে, সেখানে “মিনিটম্যান”দের (মিনিটম্যান হচ্ছে একদল আমেরিকান গেরিলা সশস্ত্রযোদ্ধা) কাছ থেকে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করতে। কনকর্ডে গিয়ে ব্রিটিশ সেনা মুখোমুখি হয়েছিল সেই সব মিনিটম্যানদের, তারা অস্ত্র হাতেই অপেক্ষা করছিল যুদ্ধের জন্য। ব্রিটিশরা যুদ্ধে পরাজিত হয়, আর এ বিজয়ের হাত ধরে আসে আমেরিকান রেভ্যুলেশন। আমেরিকার মিনিটম্যানরা ব্রিটিশদের সাথে যা করেছিল, তাকে আরবীতে বলা হয় “”জিহাদ””, যা নিয়ে আজ আমি বিচারের সম্মুখীন।

আমার বিরুদ্ধে জঙ্গিদের বক্তব্য এবং ভিডিও অনুবাদ নিয়ে যত ধরণের হাস্যকর অভিযোগ এসেছে, তার পুরোটা প্রকৃতপক্ষে একটা ব্যাপার নিয়েই, তা হল, আমি মনে করি, আজ মুসলিম মুজাহিদীনরা নিজেদের রক্ষা করতে আমেরিকার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক একই কাজটা করেছিল আমেরিকানরা, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। আমার ব্যাপারে আনীত অভিযোগগুলোর ব্যাপারে বলা যেতে পারে, এটা খুব স্ফটিক-স্বচ্ছ একটা ব্যাপার যে আমি কখনই শপিং মলে আমার বিরুদ্ধে আনীত সে গল্পগাঁথা, “American Killing”এর পরিকল্পনা করি নি, যা আমার বিরুদ্ধে পাতানো হয়েছে। সরকারদলীয় সাক্ষীদের সাক্ষ্যগুলোই এমন অভিযোগের বিপরীতে কথা বলে। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে অভিজ্ঞ আইনজ্ঞরা এই ব্যাপারে আমার লেখা ব্যবচ্ছেদ করে তাদের অভিযোগের পক্ষে কিছুই বের করতে পারেন নি। পরে, আমি যখন মুক্ত হলাম, তখন সরকার আমাকে ছদ্মবেশী চর প্রেরণ দিয়ে একটি “সন্ত্রাস পরিকল্পনা”র সাথে যুক্ত করার মিথ্যে প্রস্তাব পাঠিয়ে সাজানো নাটক তৈরি করে আমাকে এর মধ্যে জড়ানোর ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু আমি তাতে সাড়া দেই নি। রহস্যজনকভাবে, বিচারকরা সেটা শোনার চেষ্টা করেন নি।

তো যাই হোক, আমার বিরুদ্ধে যে বিচার কার্যক্রম চলছে তা আমেরিকার নাগরিকদেরকে হত্যা করা নিয়ে নয়। এ বিচার স্রেফ আমেরিকা কর্তৃক নির্বিচারে মুসলিম হত্যার বিরুদ্ধে আমার যে অবস্থান, তা নিয়ে। মুসলিমদেরকে অবশ্যই আমেরিকান হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে, হোক সে হানাদার সোভিয়েত বা আমেরিকা কিংবা মঙ্গলগ্রহ থেকে আগত- আমি এটাই বিশ্বাস করি, আমি সবসময় এমনটাই বিশ্বাস করতাম এবং সবসময় এমনটাই বিশ্বাস করে যাব। এটা সন্ত্রাসবাদ নয়, এটা চরমপন্থা নয়, এটা নিছক আত্মরক্ষা, নিজের ভূমিকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা। আমি আমার আইনজীবিদের সাথে এই মতের সাথে সহমত পোষণ করি না যখন তারা বলে, “আমার বিশ্বাসের সাথে তোমার একমত হওয়া জরুরি কিছু নয়”। না, অবশ্যই ব্যাপারটি নিজের যেমন খুশি তেমন মনে করার মত কোন বিষয় না। যার সামান্য কান্ডজ্ঞান এবং মানবতাবোধ আছে, আমার সাথে সে এই বিষয়ে একমত না হয়ে পারেই না। কেউ যদি আপনার বাসায় ডাকাতি করতে আসে এবং আপনার পরিবার পরিজনের ক্ষতি সাধন করে, সাধারণ যুক্তিই বলে আপনাকে এখন ডাকাত তাড়ানোর জন্য যা করণীয়, তা করতে হবে। কিন্তু যখন সেই ভূমি হয় “মুসলিম ভূমি” আর আক্রমণকারী বাহিনী হয় আমেরিকান সেনাবাহিনী, তখন নিজ মাতৃভূমিকে রক্ষা করার স্বাভাবিক অধিকারটা যেন বিলুপ্ত হয়ে যায়। নিজ ভূমি রক্ষার সাধারণ কান্ডজ্ঞান এর নাম তখন পালটে হয়ে যায় “সন্ত্রাসবাদ”; আর যারা নিজ ভূমিকে প্রতিরক্ষা করতে যুদ্ধ করে আকাশ আর সাগর পাড়ি দিয়ে আসা হানাদারদের সাথে, তারা হয়ে যায় “সন্ত্রাসী” এবং তাদেরকে আখ্যা দেয়া হয় “আমেরিকান হত্যাকারী, খুনী”।

আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে আমেরিকা ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে যেভাবে নিগৃহীত হয়েছিল, ঠিক একই মানসিকতার শিকার আজ মুসলিমরা, আমেরিকান সৈন্যদের হাতে। একেই বলে সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা। যখন সার্জেন্ট বেলস সে নিরীহ আফগানদেরকে হত্যা করেছিলেন তখন কি মিডিয়াতে দেখানো হয়েছিল ? মিডিয়াতে বারবার করে দেখানো হচ্ছিল সার্জেন্ট সাহেবের জীবন, তার উপর ক্রমাগত মানসিক চাপ, তার বন্ধককৃত বাড়ি, তার PTSD – পুরো ব্যাপারটায় তার জন্য এমনভাবে একটা সহানূভূতি তৈরি করা হয়, যেন সে-ই ভিক্টিম ! যাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে, তাদের প্রতি তেমন কোন সহানূভূতি দেখানো হয় নি, যেন এটা কোন ব্যাপারই নয়, আফগানরা তো আর মানুষ নয়! দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই ধরণের মানসিকতা আজ সবার মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে, সচেতন কিংবা অসচেতন চিত্তে। এমনকি আমার আইনজীবি যারা ছিলেন, তাদের এই ধরণের বদ্ধ চেতনার বাক্স থেকে বেড়িয়ে এসে “মুসলিমদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে”- এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে দু’বছর সময় লেগেছে এবং শেষ পর্যন্ত তারা উপর দিয়ে আমার সাথে একমত হয়েছে। দু’বছর ! আমি যখন দেখি এই ধরণের বিচক্ষণ আইনজীবিদের তাদের পুরোন ধ্যান-ধারণা ছেড়ে আত্মরক্ষার মৌলিক অধিকারের এই ব্যাপারটা বুঝতে দু’বছর সময় লেগে যায়, আমি যখন দেখি তারা কোনরকমে কিছু বিচারককে ধরে এনে বলে, “এরা নিরপেক্ষ এবং তোমার সমমনা”, তখন আমার ইচ্ছে হয় আমি বলি, “শোন, এই আমেরিকায় আমার সহজ স্বাভাবিক কথাগুলো বুঝতে পারার ক্ষমতাসম্পন্ন কোন বিচারক নেই”। এরই পরিণামস্বরুপ সরকার আমার বিরুদ্ধে তার মামলা অব্যাহত রেখেছে, সত্যি বলতে কি, এটা এজন্য নয় যে এটা করা তাদের খুব প্রয়োজন, বরং তারা এটা করেছে কারণ তারা এমনটা করার ক্ষমতা রাখে।

ইতিহাসের ক্লাস থেকে আমি আরো একটা জিনিষ শিখেছি, আমেরিকা হল সেই দেশ যারা ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে সবচেয়ে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল, এমন সব আচরণ তারা করত যেটা আইনেই নিষিদ্ধ ছিল, পরবর্তীতে তারাই আবার অবাক হয়ে ভাবত, “আরে, আমরা এমন ছিলাম!” দাসত্ব, জিম ক্রো আইন (কালোদের প্রতি একধরণের বৈষম্যমূলক আইন যা ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানীদের অন্তরীণ রাখা- এর প্রত্যেকটাই আমেরিকান সমাজ খুব স্বাভাবিকভাবে স্বীকৃত দিয়েছে এবং সুপ্রীম কোর্টও এই বৈষম্যমূলক আইনগুলো লালন করেছে। কিন্তু সময়ের সাথে আমেরিকা তার চেহারা পরিবর্তন করেছে, মানুষ এবং সরকার এখন অবাক হয়ে ভাবে,“ আরে, আমরা এমন ছিলাম!” নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ধরুন, তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করত, এবং তাকে মৃত্যুদন্ডের শাস্তিতে দন্ডিতও করেছিল। কিন্তু সময় গড়িয়েছে, বদলেছে বিশ্বের রুপ, মানুষ জানতে পেরেছে আসলে সরকারই শোষকের চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছিল, তারা আরো জেনেছে, ম্যান্ডেলা সন্ত্রাসী ছিল না। ম্যান্ডেলা পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতিও হয়েছিল। তো, পুরো ব্যাপারটা আসলে কোনভাবেই বস্তুনিষ্ঠ নয়, যে যেভাবে চায়, সেভাবেই “সন্ত্রাস” এবং “সন্ত্রাসী”দের সংজ্ঞায়িত করে। এই সংজ্ঞা বদলে যায় কাল,পাত্র ভেদে এবং সে সংজ্ঞা নির্ভর করে সেই কাল ও পাত্রে কোন পরাশক্তি ছিল তার উপরে।

হ্যাঁ, আপনার চোখে আমি আজ একজন সন্ত্রাসী। আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি একটা কমলা রঙের কারা পোষাকে, আর আমি এই পোষাকেই সারাটি জীবন কাটিয়ে দেব, এটাই আপনাদের কাছে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু একটা দিন আসবে, যেদিন এই আমেরিকা বদলে যাবে, বদলে যাবে এর মানুষগুলো, তারা বুঝবে আজকের এই দিনটিতে আসলে কি প্রহসন হয়েছিল। তারা আবিষ্কার করবে কিভাবে হাজার হাজার মুসলিমদের হত্যা করেছিল, পঙ্গু করেছিল আমেরিকান সেনাবাহিনী, আর তারপরেও তাদেরকে নয়, কিভাবে কিভাবে যেন কারাগারে যেতে হচ্ছে এই আমাকেই, “হত্যার ষড়যন্ত্রে”, কারণ আমি সমর্থন করেছিলাম সেইসব মুজাহিদীনদের, যারা যুদ্ধ করে যাচ্ছে তাদের মানুষগুলোকে রক্ষা করতে। তারা একদিন দেখবে, আমাকে “সন্ত্রাসী” সাজাতে সরকার কিভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, এরপরেও আমরা যদি বোন আবীর আল জানাবিকে মৃত থেকে জীবিত করতে পারতাম, যখন তাকে গণধর্ষণ করা হচ্ছিল, তখন যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হত, “বল তো সন্ত্রাসী কারা?”, আমি নিশ্চিত সন্ত্রাসী হিসেবে সে আমাকে অঙ্গুলিনির্দেশ করত না।

সরকার বলছে সহিংস কর্মকান্ডে আমার মন নাকি আচ্ছন্ন হয়ে আছে, আমেরিকান হত্যার চিন্তা নাকি আমায় আবিষ্ট করে রেখেছে। একজন মুসলিম হিসেবে এতটা শ্লেষাত্মক মিথ্যা, না, আমি কল্পনাও করতে পারি না।

১২ এপ্রিল, ২০১২


বইঃ কখনও ঝরে যেও না

-তারিক মেহান্না

প্রকাশক: সীরাত পাবলিকেশন

২টি মন্তব্য

  1. জিহাদ কুরআন ও হাদিসের একটি বিশেষ পরিভাষা। তাঁর অর্থ হল দ্বীন ইসলামের প্রতিরক্ষা ও সমুন্নত করার লক্ষ্যে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র দিয়ে লড়াই করা।
    জিহাদের সমস্ত ফজিলত দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের সাথে প্রয়োগ করা في سبيل الله جهاد (জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ) কে তাবলীগের সাথে ‘খাস’ করা বা في سبيل الله (ফি সাবিলিল্লাহ) কে ‘আম’ করে তাবলীগকেও এর উদ্দেশ্য বানানো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন দাবি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ কথাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বদা স্মরণ রাখা জরুরী।
    মোট কথা এই في سبيل الله (ফি সাবিলিল্লাহ) পরিভাষাটি কুরআন ও হাদীসে ‘আম’ (ব্যাপক) না ‘খাস’ (বিশেষ) এ ব্যাপারে মতানৈক্য আছে। তবে আলোচনা পর্যালোচনার পরে মাসরাফে যাকাতের (যাকাতের ব্যয়ের খাত) আলোচনায় এই কথাই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে في سبيل الله (ফি সাবিলিল্লাহ) একটি বিশেষ পরিভাষা অর্থাৎ ‘খাস’ এবং সকল মুহাদ্দিসীনের কর্ম পদ্ধতিও এটাই ছিল (অর্থাৎ সকল মুহাদ্দিসীন ফি সাবিলিল্লাহকে কে বিশেষ পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন)।
    তারা সকলেই في سبيل الله (ফি সাবিলিল্লাহ) শব্দ সম্বলিত সকল হাদীসকে কিতাবুল জিহাদ অর্থাৎ জিহাদ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। তার মানে তাদের নিকটও এটা বিশেষ পরিভাষা এবং এর সাথে সম্পৃক্ত ফযিলতসমূহ একটি বিশেষ কাজের জন্য নির্ধারিত।
    কিন্তু তাবলীগ জামাতের ভাইয়েরা في سبيل الله (ফি সাবিলিল্লাহ) সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে ‘আম’ করে ফেলেছেন। বরং তারা নিজেদের কাজকেই ঐ সকল হাদীসের مصداق বা প্রয়োগ ক্ষেত্র সাব্যস্ত করেছেন।
    তারা মেশকাতুল মাসাবীহ হাদীসের কিতাব থেকে তাবলীগী কাজের জণ্য যে মুস্তাখাব নির্বাচিত সংকলন রচনা করেছেন, তাতে জিহাদের অধ্যায় পুরোটাই শামিল করেছেন।
    এর দ্বারা স্পষ্ট উদ্দেশ্য এটাই যে , তাদের কাজও একটি জিহাদ। এ বিষয়ে মাওলানা ওমর পালনপুরী রহঃ এর সাথে অধমের আলোচনা ও চিঠি আদান প্রদান হয়েছে।
    হযরতের মনোভাব এমন ছিল যে, আমাদের তাবলীগী কাজও জিহাদ।
    তিনি এক চিঠিতে দলিল হিসাবে এ কথা আমাকে লিখেছেন যে, তিরমিযি শরীফের একটি রেওয়ায়েতে তাবেঈ উবায়াহ্‌ রহঃ মসজিদে যাওয়াকে في سبيل الله (ফি সাবিলিল্লাহ) এর প্রয়োগ ক্ষেত্রে সাব্যস্ত করেছেন। তাহলে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে কেন তা প্রয়োগ করা যাবে না? আমি উত্তরে লিখেছি যে —
    প্রথমতঃ
    উবায়াহ্‌ রহঃ কোন সাহাবী নন। হানফী আলেমদের নিকট সাহাবীদের কথা حخت বা দলিল। কিন্তু তাবেঈদের ব্যাপারে স্বয়ং ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর কথা হল هم رخال ونحن رخل — তারাও মানুষ আমরাও মানুষ।
    অর্থাৎ তাঁদের কথা আমাদের হানফী আলেমদের নিকট حخت বা স্বতন্ত্র দলিল নয়। যদি কোন সাহাবী এই পরিভাষাটি “আম” (ব্যাপক) করতেন তাহলে একটা কথা ছিল।
    দ্বিতীয়তঃ
    একমাত্র দাওয়াত ও তাবলীগই কেন এর প্রয়োগ ক্ষেত্র হবে? যদিও কোন কোন ভাইকে বলতে শুনা যায় — তাবলীগই দ্বীনি কাজ। হযরত ইলিয়াস রহঃ এমন বলতেন না। যদিও তিনি বলতেন তাবলীগও দ্বীনি কাজ। কিন্তু তাবলীগ জামাতের ভায়েরা “ও” কে “ই” দ্বারা পাল্টে দিয়েছেন।
    মোটকথা, তারা নিজেদের কাজকেই জিহাদ বলেন। বরং তারা হয়তো হাকীকী জিহাদকেও জিহাদ মনে করেন না। তাঁদের মতে জিহাদের ফজিলতগুলোও দাওয়াত ও তাবলীগের মাঝে সীমাবদ্ধ।
    তৃতীয়তঃ
    অন্য সকল দ্বীনি কাজ সম্পাদনকারীরা যেমন দ্বীনি শিক্ষাদান ও লেখালেখীতে ব্যস্ত আলেমরা নিজেদের কাজের জন্য في سبيل الله (ফি সাবিলিল্লাহ) ও জিহাদের ফজিলত সাব্যস্ত করেন না। এরপরেও কেন তাবলীগের ভাইরা এসকল হাদীসগুলোকে তাদের কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন?
    এই চিঠির পর মাওলানা ওমর পালনপুরী সাহেবের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে আর কোন চিঠি আসেনি। কোন এক চিঠিতে শ্রদ্ধেয় মাওলানা সাহেব একটি যুক্তি পেশ করেছিলেন যে, জিহাদ হল حسن لغيره অর্থাৎ সত্ত্বাগতভাবে ভালো নয় অন্য কারনে ভালো।
    বাহ্যিক দৃষ্টিতে জিহাদ হল জমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা। আর দাওয়াত তাবলীগ স্বয়ং حسن لذاته حسن (সত্ত্বাগত ভালো) এটা হল আল্লাহ তা’আলা ও সৎকাজের প্রতি দাওয়াত। সুতরাং যে সব ফজিলত ও সওয়াব حسن لغيره এর জন্যে তা حسن لذاته حسن এর জন্যে কেন হবে না?
    আমি উত্তরে আরজ করলাম এভাবে ক্বিয়াস (যুক্তি) দ্বারা সওয়াব সাব্যস্ত করা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ক্বিয়াসটা শরঈ আহকামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সওয়াব বা ফাজায়েল এবং এ জাতীয় অন্যান্য توقيفي বিষয়ে ক্বিয়াস চলে না।
    (তাওক্বীফী বলা হয় এমন বিষয়কে যার বাস্তবতা বান্দার বিবেক দ্বারা নিরূপণ করা যায় না। যেমন কোন সূরা পাঠে কি সওয়াব, কোন আমলে কি সওয়াব ও কোন আমলে কত গুনাহ এক্ষেত্রে আকল ব্যবহার করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছার অধিকার শরীয়ত কাউকে দেয়নি। বরং কুরআন ও হাদীসে যতটুকু বলা হয়েছে তা সেভাবেই বহাল রাখতে হবে )
    অর্থাৎ এসকম স্পষ্ট বিষয়ে কুরআন হাদীসের প্রমান আবশ্যক। তাছাড়া সওয়াবের কম বেশী কষ্টের অনুপাতে হয়ে থাকে। (যেমন হাদীসে দূর থেকে মসজিদে আগমনকারীর সওয়াবের কথা বলা হয়েছে) আর আল্লাহই ভালো জানেন, কোন কাজে কি পরিমাণ কষ্ট ও এর সওয়াব কি হবে। দুনিয়ার মানুষ এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।
    স্পষ্ট কথা হল, কষ্টের বিবেচনায় পারিভাষিক في سبيل الله جهاد (জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ) এর ধারে কাছেও তাবলীগী কাজ পৌছাতে পারবে না।
    এরপরও কিভাবে জিহাদের সওয়াব ও ফজিলত ঐ কাজের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। আজ পর্যন্ত মুহাক্কিক আলেমদের কেউই এ সকল বর্ণনাকে অন্য কোন দ্বীনি কাজে ব্যবহার করেন নি।
    ফায়দাঃ
    উপরোক্ত আলোচনায় “ও” এবং “ই” এর কথা হয়েছে (“তাবলীগও দ্বীনি কাজ”/ “তাবলীগই দ্বীনি কাজ” )। এটা একটা উদাহরণ দ্বারা ভালোভাবে বোঝা যায়। হিন্দুস্তানের একটি বড় হীরক খন্ড, কোহিনুর। এটা অত্যন্ত মূল্যবান হীরা। যদি তা হাত থেকে পড়ে ছোট বড় পাঁচ টুকরা হয়ে যায় তাহলেও এ টুকরাগুলো মুল্যহীন হবে না। প্রতিটি টুকরার কিছু না কিছু মূল্য থাকবেই।
    কিন্তু কোন টুকরার এ অধিকার নেই যে সে বলবে, “আমিই ঐ কোহিনুর”। হ্যাঁ, প্রতিটি টুকরা এই কথা বলতে পারবে যে, “আমিও কোহিনুর” মানে কোহিনুরের একটি অংশ।
    উক্ত উদাহরণ দ্বারা একথা স্পষ্ট হয় যে, নবী সাঃ এবং সাহাবায়ে কেরাম রাযিঃ এর সকল কাজ একটি পূর্ণ কোহিনুর ছিল। তাঁরা একই সাথে দাঈ, মুবাল্লিগ, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকিহ, মুজাহিদ ছিলেন এবং তাঁরা রাজ্যও চালাতেন।
    কিন্তু পরবর্তীতে এই সব কাজ পৃথক পৃথক হয়ে গেছে। সুতরাং যে কোন দ্বীনি কাজকারীরা এ কথা বলতে পারেন যে, আমিও সাহাবী ওয়ালা কাজ করি। কিন্তু কারোরই একথ আবলার অধিকার নেই যে, সে বলবে, আমিই একমাত্র সাহাবী ওয়ালা কাজ করি।
    আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে এ বিষয়টি বোঝার তাউফীক দান করুন এবং যে সব ভুল-ত্রুটি হচ্ছে তার সংশোধন করুন। আমীন।
    মুফতী সাইদ আহমাদ পালনপুরী (হাফিযাহুল্লাহ)
    শাইখুল হাদীস ও মুফতী দারুল উলুম দেওবন্দ
    -সূত্রঃ তোহফাতুল আলমায়ী।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button