সাহসী মানুষের গল্প

সোনার মখমল

এক দুঃসাহসী সাহাবীর নাম- আবু লুবাবা।

রাসূলের (সা) সাথে অধিকাংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আবু লুবাবা। বদর যুদ্ধের সময় তিনি বিশেষভাবে সম্মানও লাভ করেন। বদর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মুসলিম বাহিনী।

যুদ্ধের মহান সেনাপতি স্বয়ং রাসূলে করীম (সা)। সৈনিকের চেয়ে বাহনের সংখ্যা কম।

রাসূল (সা) এখানেও দেখালেন সমত ও মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

রাসূলের (সা) উটের ওপরও তিনজন সওয়ারী।

রাসূল (সা) ছাড়াও তাঁর উটে হওয়ার হলেন আবু লুবাবা ও আলী (রা)।

তাঁরা পালা করে উটের পিঠে ওঠানাম করছিলেন। রাসূল (সা) ও আলী যখন উটের পিঠে, তখন রশি হাতে হেঁটে চলছেন আবু লুবাবা।

এইভাবেই চলছে।

পথ অতিক্রম করছেন সত্যের মুজাহিদ।

এক সময় পালা এলো রাসূলের (সা)। উটের পিঠে বসবেন আবু লুবাবা এবং আলী (রা)।

আর রশি হাতে হেঁটে চলবেন স্বয়ং সেনাপতি রাসূল (সা)।

এতে রাসূল (সা) খুশি হলেও কেঁদে উঠলো আবু লুবাবার কোমল হৃদয়। কেঁদে উঠলো তার বিবেক। তিনি আরজ করে বিনয়ের সাথে বললেন, হে রাসূল (সা)! দয়ার নবীজী আমার! দয়া করে আপনি উটের পিঠে বসুন। আমি রশি হাতে হেঁটে চলি।

রাসুল (সা) শুনলেন আবু লুবাবার কথা। একটু হাসলেণ। তারপর বললেন, তোমরা আমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী নও। আর এমনও নয় যে, তোমাদের চেয়ে আমার বেশি সওয়াবের প্রয়োজন নেই। অতএব তোমরা দু’জন উটের পিঠে বসো। আর আমি রশি হাতে হেঁটে চলি।

এই হলো দয়ার নবীজীর (সা) সাম্য ও ভ্রতৃত্বের নমুনা।

এই হলো রাসূলের (সা) মানবতাবোধ। পৃথিবীর এমন কোনো শাসক, সেনাপতি কিংবা নেতা নেই, যিনি রাসূলের (সা) চেয়ে বেশি মানবতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন।

আবু লুবাবা নিজের জীবনের চেয়েও অধিক ভালোবাসতেন রাসূলকে (সা)। তাঁকে ভালবাসতেন পৃথিবর সকল কিছুর বিনিময়ে। রাসূল (সা) ঠিক তেমনি মহব্বত করতেন আবু লুবাবা- এই সত্যের সৈনিককে।

এজন্য হিজরি দ্বিতীয় সনের শাওয়াল মাসে মদিনার ইহুদি গোত্র বনু কায়নুকার সাথে সংঘটিত যুদ্ধে এবং একই সনের জিলহজ্জ মাসে সংঘটিত ‘সাবীক’ যুদ্ধে আবু লূবাবা যোগদান করতে পারেননি।

কারণ এই সময় রাসূল (সা) তাকে মদিনায় স্থলাভিষিক্ত করেন।

রাসূল (সা) পনের দিন যাবত বনু কায়নুকা অবরোধ করে রাখেন।

এই সময় আবু লূবাবা মদিনায় ইমারাত বা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন।

রাসূলের (সা) পক্ষ থেকে এই বিরল সম্মানের অধিকারী হলেন আবু লুবাবা।

আবু লুবাবার ঈমান ছিল পর্বতের মত অটুট। শক্ত। সামন্য ভুলের কারণেও তিনি মহান বারী তায়ালার কাছে এমনভাবে মাগফিরাত কামনা করতেন, যা ছিল সত্যিই বিরল।

একবার এমনি একটি ভুলের  কারণে নিজে অনুতপ্ত হয়ে ছুটে গেলেন মসজিদে নববীতে।

এরপর একটি মোটা ও ভারী বেড়ি দিয়ে নিজেই ঘোষণা দিলেন: যতক্ষণ আল্লাহপাক আমার তওবা কবুল না করেন, ততোক্ষণই এভাবে বাঁধা অবস্থায় থাকবো।

এভাবে কতদিন বাঁধা ছিলেন আবু লূবাবা?

কারো মতে দশ, আবারো কারো মতে বিশ দিন-রাত।

এসময়ে জরুরি প্রয়োজনে যেমন নামায ও অন্যান্য প্রয়োজনে তার স্ত্রী তাকে বেড়ি খুলে দিতেন। আবার প্রয়োজন মিটে গেলেই বেড়ি বেধে নিতেন।

এই অবস্থায় আবু লূবাবা আহার-পানাহার প্রায় ছেড়েই দিলেন। এতে করে তার শ্রবণ শক্তি কমে যায়।  দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়ে। আর দুর্বলতায় শরীর ভেঙ্গে যায়। দুর্বলতার কারণে একদিন তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

তবুও নিজেকে মুক্ত করলেন না আবু লুবাবা।

রাসূল (সা) জানেন সবকিছু। তিনিও অপেক্ষায় আছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশের। রাসূলে করীম (সা) আছেন উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামার (রা) ঘরে।

তখন শেষ রাত।

প্রভাতের আগেই নাযিল হলো আয়াত।

রাসূল (সা) হেসে উঠলেন।

রাসূলের (সা) হাসি দেখে উম্মু সালাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আপনাকে সকল সময় খুশি রাকুন। বলবেন কি আপনার হাসির কারণ কী?

রাসূর (সা) বললেন, আবু লুবাবার তওবা কবুল হয়েছে।

উম্মু সালামা জানতে চাইলেন, আমি কি এই সুসংবাদটি মানুষকে জানাতে পারি?

তখনো হেজাব বা পর্দার আয়াত নাযিল হয়নি। রাসূল (সা) বললেন, হ্যাঁ উম্মু সালামা, তুমি এই সুসংবাদটি সবাইকে জানাতে পারো।

রাসূলের (সা) সম্মতি পেয়ে তিনি হুজরার দরোজায় দাঁড়িয়ে সকলকে বিষয়টি জানালেন।

উপস্থিত সবাই ছুটে গেলেন আবু লূবাবাকে মুক্ত করার জন্য।

আবু লুবাবা তার সিদ্ধান্তে অটল। বললেন, না কক্ষনো নয়। রাসূল (সা) নিজে এসে যতক্ষণ আমার বেড়ি খুলে না দেবেন, ততোক্ষণই এভাবে থাকবো।

রাসূল (সা) ফজরের নামাজের জন্য এলেন মসজিদে। আর তখনই তিনি নিজে হাতে বেড়ি খুলে দিলেন আবু লুবাবার।

তওবা কবুল হওয়ায় দারুণ খুশি হলেন আবু লূবাবা।

হিজরী ৮ম শনে মক্কা বিজয় অভিযানে বনু আমর ইবন আওফের ঝান্ডা ছিল হযরত আবু লুবাবার হাতে।

এছাড়াও, রাসূলে (সা) সময়ে সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধেই অংশ নিয়েছিলেন আবু লুবাবা।

যুদ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন সকল সময়ই দুঃসাহসী এবং দুর্বার।

আবার যুদ্ধের বাইরেতিনি ছিলেন একজন বড় আবেদ।

আল্লাহ এবং রাসূলের (সা) মহব্বতে তিনি তার জীবনটি উৎসর্গ করে দেন। আবু লুবাবা ছিলেন ইসলামের পূর্ণ অণুসারী।

কুরআন ও সুন্নাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতেন পূর্ণভাবে। সেখানে কোনোরকম দুর্বলতার স্থান ছিল না।

কম কথা নয়, আবু লূবাবার তওবা কবুল হওয়ার ঘোষণা সম্বলিত আয়াত নাযিল করেছেন মহান রাব্বুল আলামীন।

এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়?

যাদের হয় তারা সবাই জ্যোতির অধিক।

হযরত আবু লুবাবা (রা)।

সারাটি জীবন যিনি মিথ্যার শেকল গলিয়েছেন সত্যের শিখায়।

আর শেষ পর্যন্ত যিনি হয়ে উঠেছেন কাঁটি সোনা। সোনার মখমল।

 

– মোশাররফ হোসেন খান

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button