পিতার হাতে বন্দি পুত্র
তিনি বেড়ে উঠেছেন সম্ভ্রান্ত এক সমান পরিবারে।
এমন খান্দানি পরিবার – যার নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে দূর থেকে বহু দূরে। নাম রিফায়া।
পিতার সাথে বের হলেন তিনি। পারপর মক্কায়গিয়ে আকাবার দ্বিীতয় বাইয়াতে অংশগ্রহণ করলেন পিতার সাথে। বাইয়াত করলেন রাসূলের (সা) পবিত্র হাতে।
রাসূলের (সা) হাতে!
যে হাতে রয়ে গেছ মহান বারী তা’আলার যাবতীয় কল্যাণ, বরকত ও রহমত।
রাসূলের (সা) সেই পবিত্র হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলেন রিফায়া।
যার ওপর সৌভাগ্যের পরশ ধারা ঝরে, এমনি করেই ঝরে। অঝোর ধারায়। শ্রাবণের বৃষ্টির মত।
রাসূলের সময়ে সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধেই অংশ নিয়েছেন রিফায়া।
শুধুই কি অংশ নেয়া?
না। প্রতিটি যুদ্ধেই রেখেছেন তার সাহস, ঈমান আর বীরত্বের স্মারক চিহ্ন।
এলা বদর।
কঠিনতম এক পরীক্ষার প্রান্তর।
যুদ্ধ চলছে সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে।
আলো এবং আঁধারের।
ন্যায় এবং অন্যায়ের মধ্যে। ঈমান এবং কুফরীর মধ্যে।
এই ভয়াবহ যুদ্ধে অন্যান্য সাহাবীদের সাথে আছেন অসীম সাহসী যোদ্ধা রিফায়া।
তিনিও লড়ে যাচ্ছেন সাহসের সাথে। জানবাজি রেখে। প্রাণপণে।
শত্রুর মুকাবেলায় রিফায়া যেন আগুনের কুন্ডলি। বারুদস্তম্ভ।
ক্রমাগত সামনে এগিয়ে চলেছে রিফায়া। ক্রমাগত।
ভত্রুর ব্যুহ ভেদ করে ঘোড়া দাবড়িয়ে ছুটে চলেছেন রিফায়া।
সামনে তার কেবল শাহাদাতের স্বপ্ন।
বিজয়ের স্বপ্ন।
যুদ্ধের সেনাপতি স্বয়ং রাসূলে করীম (সা)।
পেছনে রয়েছে পড়ে শঙ্কা আর যাবতীয ক্লান্তির বহর।
আর তো এখন পেছনে তাকাবার কোনো ফুসরতই নেই।
একটানা যুদ্ধ করে চলেছেন রিফায়া।
যুদ্ধ করতে করতে হঠাৎ শত্রুর নিক্ষিপ্ত একটি তীর এসে বিঁধে গেল তার দ্যুতিময় চোখের ভেতর।
চোখে আঘাত হেনেছে তীর।
কিন্তু বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে।
রাসূল!
দয়ার রাসূল (সা) এগিয় এলেন রিফায়ার কাছে। গভীর মমতায় চোখের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন রাসূল (সা) তাঁর পবিত্র একটু থুথু।
তারপর দুয়া করলেন প্রিয় সাহাবীর জন্য। প্রভুর দরবারে।
আর কী আশ্চর্য!
সাথে সাথে ভাল হয়ে গেল রিফায়ার আহত চোখটি।
রিফায়া আবারো ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুর মুকাবেলায়।
বদর যুদ্ধে তার সাথে একই কাতারে লড়ছেন আপন দুই ভাই খাল্লাদ ও মালিকও।
বদর প্রান্ত সেদিন এই তিন ভাইয়ের দৃপ্তপদভারে কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
আর ভয়ে ও আতঙ্কে মোচড় দিয়ে উঠছিল কাফেরদের কালো কালো হৃদয়গুলো।
কিন্তু ব্যতিক্রম হলো তার পুত্র ওয়াহাবের বিষয়টি।
তারই পুত্র ওয়াহাব।
পিতা রিফায়া লড়ছেন সত্যের পক্ষে। আর পুত্র ওয়াহাব যুদ্ধ করছে শত্রুপক্ষে।
কী বিস্ময়কর এক ঘটনা! একই যুদ্ধের ময়দান।
পিতা আর পুত্র- উভয়েই ভিন্ন শিবিরে। দুজনই মুখোমুখি।
দুজনই তার কাফেলার বিজয় প্রত্যাশী। কিন্তু পারলো না ওয়াহাব।
পারলো না সে পিতাকে পরাস্ত করতে। সেটা সম্ভবও নয়।
ফলে পরাস্ত হলো ওয়াহাব।
এবং নিজের পিতা রিফায়ার হাতে বন্দি হলো ওয়াহাব।
পুত্র ওয়াহাবকে নিজ হাতে বন্দি করতে এতটুকুও হাত কাঁপেনি রিফায়ার।
কাঁপেনি তার বুক কিংবা স্নেহের দরিয়া।
এযে সত্য-মিথ্যার লড়াই।
রিফায়া জানেন, ভালো করেই জানেন-
এই যু্ধ সত্য-মিথ্যার যুদ্ধ। এখানে তুচ্ছ রক্তের বাঁধন।
এখানে মূল্যহীন আবেগ আর জাগতিক সম্পর্ক।
সত্য কেবল ইসলাম। সত্য কেবল আল্লাহর হুকুম।
সত্য কেবল নবীর (সা) মুহাম্মত। এবং সত্য কেবল ঈমানের দাবি পূরণ করা।
পিতার হাতে বন্দি পুত্র।
কিক্ষণের জন্য থেমে গেল বাতাস। থেমে গেল মেঘ এবং পাখির চলাচল।
সবাই অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখলো এক অভাবনীয় দৃশ্য।
দেখলো আর ভাবলো, একেই বলে ঈমানের শক্তি।
একেই বলে প্রকৃত মুজাহিদ।
যেখানে সত্যের কাছে তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ হয়ে যায় একান্ত রক্তের বাঁধন। সন্তানের পরিচয়ও।
প্রকৃত অর্থে, আল্লাহ পাক তো এমনই ঈমান প্রত্যাশা করেন তাঁর প্রিয় বান্দার কাছে।
রাসূল (সা) তো চান এমনই শর্তহীন ভালবাসা।
আর ইসলাম তো চায় এমনই ত্যাগ, কুরবানি ও ঈমানের দুঃসাহসিক গরিমা।
হযরত রিফায়া।
রিফায়া পুত্রকে বদর প্রান্তরে নিজে হাতে বন্দি করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন ইসলামের সোনালি ইতিহাসে।
বিরল দৃষ্টান্ত!
অথচ প্রেরণাদায়ক আমাদরে জন্য।
প্রেরণাদায়ক প্রতিটি মুমিনের ক্ষেত্রে সকল সময় ও কালের জন্য।
– মোশাররফ হোসেন খান