সাহসী মানুষের গল্প

অবাক শিহরণ

তখন আরবের চারদিকে অন্ধকার। থক থক করছে আঁধারের কাদামাটি। কোথাও কোনো আলোর চিহ্ন নেই। নেই এতটুকু সত্যের বাতি।

একেই বলে জাহেলিয়াত যুগ!

আর মানেই তখন ভয়ঙ্কর এক জনপদ!

যেখানে মিথ্যা, কুসংস্কার আর ক্ষমতার দাপট।

মানুষ মানেই একেকটি চকচকে তলোয়ার। কিংবা হিংস্র বন্যপ্রাণী। আতঙ্কিত দুর্বল মানুষ।

তারা অপেক্ষায় প্রহর গোনে। কখন শেষ হবে এই নারকীয় পরিবেশের? কখন?

এক সময় শেষ হয়ে তাদের প্রতীক্ষার পালা।

মহান আল্লাহ তো দয়ার সাগর। তিনি মানুষের কল্যাণ চান। তিনিই মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন।

আল্লাহ পাক মিথ্যার কুহক থেকে পরিত্রাণের জন্য পাঠালেণ দয়ার নবীজী মুহাম্মদ (সা)

মানুষ সৃষ্টির সেরা।

আর মানুষেরভেতর সেরা নবী মুহাম্মদ (সা)।

যখন নবী এলেন দুনিয়ায়, তখন বদলে গেল পৃথিবীর চেহারা।

আর যখন তিনি নবুওয়াতপ্রাপ্ত হলেন, তখন তা চারদিকে বয়ে গেল পূর্ণিমা চাঁদের এক অসীম জোয়ার।

কেমন ফকফকা। কেনমঔজ্জ্বল্যে ভরপুর।

তিনি দু’হাত তুলে ডাকেন মানুষকে আল্লাহর দিকে। ইসলামের পথে। রাসূলেল (সা) দিকে।

শুধু কি ডাকেন?

তিনি বুঝান সত্য আর মিথ্যার প্রভেদ।

ভালো আর মন্দের ফারাক। বুঝান পুরষ্কার ও শাস্তির বিষয়-আশয়।

যারা বুদ্ধিমান- তারা ভাবেন, আর তবে দেরি কেন? এই তো সময় বটে সত্যকে গ্রহণ করে পুরষ্কার লাভের।

যারা সৌভাগ্যবান, তারা একে একে ছুটে আসেন।

ছুটে আসেন মিথ্যার মায়াজাল ছিন্ন করে আলোর পথে। সত্যের পথে। তারা পিপাসিত! তারা তৃষ্ণার্ত!

কিসের পিপাসা?

পান নয়। শরবত নয়।– সে এক অন্য পিপাসা।

সেই পিপাসা মেটাতে পারে একমাত্র ইসলামের আবে কাওসার।

ইসলাম!

কী এক ঝলমলে স্বপ্নপুরী!

ইসলাম গ্রহণ মানেই তো আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা নবীকে (সা) নিবিড়ভাবে পাওয়া ।

তাঁর ভালোবাসার পরশে ধন্য হওয়া।

আর?

আর জোসনার বৃষ্টিতে অবিরত গোসল করা।

কী সৌভাগ্যে ব্যাপার!

যারা হতভাগা, তাদের কথা আলাদা।

কিন্তু যারা বুদ্ধিমান, তারা তো এমন সুযোগ হাতছাড়া করতেই চাইবে না।

হলোও তাই।

রাসুল (সা) যখনই ডাক দিলে ইসলামের পথে, সত্য গ্রহণের। তখনই সাড়া দিলেন একে একে অনেক ভাগ্যবান আলোর মানুষ।

তখনও ইসলামের প্রথম যুগ।

প্রাথমিক ধাপ টপকে যাবার চেষ্টায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন রাসূলের (সা) সাথ অনেকেই।

দীনের দাওয়াত এগিয়ে চলেছে শ্যাওলা জমা পাপের নদী কেটে কেটে। ক্রমশ।

যতদূর সত্যের নৌকা যায়, ততদূরই চকচকে স্বচ্ছ পানি।

জীবন বাজি রেখে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে চলেছেন রাসূলে (সা) সাথে কতিপয় সত্যের সৈনিক।

লক্ষ্য তাদের আলোকি মঞ্চিল।

এই কাতারে একদিন শামিল হলেন টগবগে এক তরুণ।

চোখ তার প্রোজ্জ্বল। বুকে তার সাহসের ঢেউ।

স্বপ্নের তুফানে দোল খায় অষ্টপ্রহর।

কারণ তিনি আছেন আল্লাহর পথে। রাসূলের (সা) বাহুডোরে। ইসলামের ছায়াবৃক্ষের নিচে।

তার আর কিসের পরওয়া?

কিসের ভয়!

ভয় নয়। শঙ্কা নয়।–

বরং এক ধরনের শীতলতা ও প্রসন্নতায় তিনি আচ্ছন্ন। তিনি সকল পাপ আর তাপ থেকে নিজেকে নিরপদ মনে করলেন।

কেন করবেন না?

স্বয়ং আল্লাহ পাকই যে তার জিম্মাদার। আর রাসূল (সা) তার প্রিয়সাথী, বন্ধু-স্বজন। একন্ত আপন।

তরুণ একা নন।

সাথে তার স্নেহমীয় আম্মাও ইসলাম গ্রহণ করলেন।

ফলে তার মনের শক্তি আরো বেড়ে গেল শতগুণে। তিনি এখন প্রশান্ত মনে ইসলামের খেদমত করে যান।

দুনিয়ার যে কোনো শক্তিই তার কাছে এখন তুচ্ছ।

সকল বাধা আর বিপদই তার কাছে কেবল ঢেউয়ের বুদবুদ।

এই অসীম সাহসী তরুণের নাম শাম্মাস।

আর তার সৌভাগ্যবতী আম্মা হলেন –হযরত সাফিয়্যা।

মা এবং পুত্র- দু’জনই প্রথম দিকে ইসলাম কবুল করে নিজেদেরকে আলোকি করার সৌভাগ্য অর্জন কররেণ।

নামটা রেখেচিলেন তার মামা।

হযরত শাম্মাস!

জাহেলী যুগে একবার মক্কায় একজন খ্রিস্টান এলো। লোকটি দেখতে খুবই সুন্দর।

মুহূর্তের সাড়া পড়ে গেল মক্কায়।

সবাই বলাবলি করতে লাগলো, এমন সুন্দর চেহারার মানুষ তারা আর কখনো দেখেনি। একেবারে সূর্যের আলোর মত। তার চেহারা দিয়ে সূর্যের কিরণ চমকায়।

কথাটি শুনেই মামার ভেতর এক ধরনের জিদ এসে গেল।

এরা বলে কী? আমার ভাগ্নেই বা এই লোকটি থেকে কম কিসে? সে তো এর চেয়েও সুন্দর।

এক ধরনের প্রতিযোগিতাসুলভ জিদ থেকেই তার মামা ভাগ্নেকে উপস্থাপন করলেন তাদের সামনে। বললেন,

‘দেখ! দেখ, আমার প্রিয় ভাগ্নেটি কত সুন্দর! এই লোকটির থেকেও বেশি সুন্দর!’

তো সেই থেকেই এই ভাগ্নের নাম হয়ে গেল ‘শাম্মাস’। এর অর্থ অতিরিক্ত সূর্যকিরণ বিচ্ছুরণকারী।

প্রকৃত অর্থেই শাম্মাস চিলেন অত্যন্ত সুদর্শন এক যুবক।

দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ভরে যায় হৃদয়ের চাতাল।

আর ইসলাম কবুলের পরে তো তিনিও হয়ে গেলেন পূর্ণিমাপ্লাবিত এক মহাসাগরের ঢেউ।

কিন্তু সত্য গ্রহণ করলে যা হয়।

তখন তো গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায় কাফেরদের।

আর তখন তারা শুরু করে নির্যাতন আর নিপীড়ণের অগ্নিবৃষ্টি। নির্যাতিত এই সকল সাথীকে রাসূল (সা) নির্দেশ দিলেন হিজরতের।

শাম্মাসও হিজরত করলেন মদীনায়। সঙ্গে আছেন আম্মা সাফিয়্যাও। জন্মভূমি ছেড়ে যাচ্ছেন তারা।

কিন্তু তাদের মধ্যে  নেই বেদনার এতটুকু লেশ।

নেই বিন্দুমাত্র দুঃখ, কষ্ট কিংবা ক্ষোভ।

বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) সন্তুষ্টির কোমল বৃষ্টিতে তারা স্নাত এবং পুলকিত।

শাম্মাস ছিলেণ খুবই সাহসী। আর তেমনই জানা ছিল তার যুদ্ধের সকল প্রকার কলাকৌশল।

এলো বদরের যুদ্ধ।

শাম্মাস অত্যন্ত বীরত্বের পরিচয় দিলেন এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে।

তারপর এলা উহুদ যুদ্ধ।

এই যুদ্ধেও অসীম সাহসের সাথে লড়লেন শাম্মাস।

কিন্তু এক সময় মুসলিম বাহনীর মধ্যে বিপর্যয় দেখা দিলে উহুদ প্রান্তর হয়ে পড়লো প্রায় অরক্ষিত।

তখন রাসূলের (সা) চারপাশ ঘিরে যারা ঢালের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে দুঃসাহসী শাম্মাস চিলেন অন্যতম।

কোনো  দ্বিধা বা সংকোচও নয়।

বরং কী এক কঠিন প্রত্যয়ে শাম্মাস সেদিন রাসূলকে (সা) সুস্থ, অক্ষত এবং সুরক্ষিত রাখার সুদৃঢ় অঙ্গীকারে স্থির ছিলেন।

শত্রুর মুকাবেলায় তিনি নিজেকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

তার দুঃসাহসিকিতায় মুগ্ধ হলেন রাসুল (সা)।

সেই সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তের কথা স্মরণ করে রাসূল (সা) নিজেই বলতেন:

‘একমাত্র ঢাল ছাড়া আমি শাম্মাসের আর কোনো উপমা পাই না।’

সত্যিই তাই।

সেদিন রাসূল (সা) যেদিকেই দৃষ্টি দেন, কেবল শাম্মাসকেই দেখতে পান।

শাম্মাস সেদিন প্রকৃত অর্থেই রাসূলের (সা) ঢালে পরিণত হয়েছিলেন।

ঢাল তো নয়, যেন দুর্ভেদ্য পর্বত।

কিন্তু এর জন্য শাম্মাসের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল কাফেরদের আঘাতে।

যুদ্ধ শেষ।

অক্ষত আছেন রাসূল (সা)।

আর তাঁকে অক্ষত  রাখতে শাম্মাস যে জীবন বাজি রেখেছিলেন,  তাতে করে শাম্মাস শত্রুদের আঘাতে জর্জরিত হয়ে গেছেন।

অচেতন শাম্মাস।

সেই অবস্থায় তাকে যুদ্ধের ময়দান থেকে তুলে আনা হলো মদীনায়।

তখনো তিনি বেঁচে আছেন।

বেঁচে আছেন, কিন্তু মুমূর্ষ অবস্থা।

এভাবে আর কতক্ষণ?

অবশেষে তিনি একদিন পরই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পাড়ি জমালেন আল্লাহর দরবারে।

শহীদ হলেন হযরত শাম্মাস!

কিন্তু তার সেই দুঃসাহস আর সোনালি সূর্যকিরণ কি এখনও প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে কম্পন তোলে না?

তোলে বৈকি! সে এক সাহসে ভরা অবাক শিহরণ!

কারণ শহীদ হওয়া ছাড়া একজন মুমিনের চূড়ান্ত কামনা আর কিইবা থাকতে পারে?

আর এক্ষেত্রে শহীদ শাম্মাসের মত দুঃসাহসী নিবেদিত ও আলোকিত প্রাণই তো আমাদের জন্য সকল সময় প্রেরণার উৎস।

 

– মোশাররফ হোসেন খান

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button