তুমল তুফান
রাসূল (সা) চলেছন বদরের দিকে।
সাথে আছেন তাঁর একদল সাহসী যোদ্ধা।
যারা একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া ভয় করেন না অন্য কারো।
যাদের বুজে নেই শঙ্কার লেশ মাত্র।
যাদের চোখে নেই কোনো রকম জড়তার ছায়া।
পার্থিব কোনো স্বার্থ নয়, একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশির জন্যই তারা চলেছৈন প্রাণপ্রিয় রাসূলের (সা) সাথে।
বদর যুদ্ধে।
রাসূলও (সা) মাঝে মাঝে পাঠ করছেন প্রত্যেকটি আলোর আবাবিলকে। পাঠ করচেন আর পুলকিত হচ্ছেন।
খুশির দীপ্তির ঝরে ঝরে পড়ছে তাঁর জ্যোতির্ময়ী চেহারা দিয়ে।
মরুভূীমর উত্তপ্ত বালি, লুহাওয়া, সূর্যের প্রখর তেব- এসবই কেমন বাধ্য হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে গেল রাসূলের (সা) চলার পথে।
কষ্ট নয়, যন্ত্রণা নয়, বরং এক ধরনের আরামদায়ক আবহাওয়াই যেন দোল দিয়ে যাচ্ছে তাঁদের মাথার ওপর। সাথীদের নিয়ে রাসূল (সা) এগিয়ে চলেছৈন।
রাসূল!- মহান সেনাপতি!
তিনি চলছেন আর দেখছেন চারপাশ।
দেখছেন আর ভাবছেন।
ভাবছেন- কোথায়, কোথায় শিবির স্থাপন করা যায়। কোন্ জায়গাটি সবচেয়ে উত্তম?
স্থান নির্বাচনে তিনি বেশব্যস্ত।
মগ্ন আছেন দয়ার নবীজী (সা)।
হঠাৎ শোনা গেল মহান সেনাপতির আওয়াজ, থাম!
সেনাপতির নির্দেশ!
সবাই থেমে গেলেন। বদরের কাছাকাছি।
সাহাবীরা চারপাশে তাকালেন। ভালো করে দেখে নিলেন জায়গাটি। তারাও ভাবতে থাকলেন, এখানে শিবির স্থাপন করলে কেমন হবে?
সাহাবীরা কিছুটা চিন্তাক্লিষ্ট। এখানে শিবির স্থাপনের সুবিধা-অসুবিধা দুটো দিক নিয়েই তারা ভাবছেন।
তাদের মধ্যে একজন চিলেন, যিনি বিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ। নাম হুবাব ইবনুল মুনজির। পায়ে পায়ে তিন এগিয়ে গেলেন রাসূলের (সা) কাছে।
তার চোখে-মুখে শ্রদ্ধা এবং বিনয়ের নরম কুয়াশা।
কণ্ঠে সুমিষ্ট আবে জমজম।
বিনীত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, হে দয়ার নবীজী! এখানে শিবির স্থাপনের সিদ্ধান্ত কি আল্লাহর পক্ষথেকে, নাকি আপনার নিজের?
হুবাব! রাসূলের (সা) এক সুপ্রিয় সাহাবী।
তার জিজ্ঞাসায় বিরক্ত হলেন না মহান সেনাপতি রাসুল (সা)।
স্পষ্ট জিজ্ঞাসায় তাঁর চোখে জ্বলে উঠলো না কোনো ক্রোধের ফুলকি।
বিস্ময়ের কোনো মেঘও ছিল না তাঁর সাহসী ঠোঁটে।
হুবাবের জিজ্ঞাসায় একটু হাসলেন দয়ার নবীজী (সা)।
তারপর বললেন, না। এখানে শিবির স্থাপনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোনো নির্দেশ দেননি। বরং আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
রাসূলের (সা) জবাব শুনে হুবাব আবারও বিনয়ের সাথে বললেণ, হে প্রাণপ্রিয় রাসুল! তাহলে এখানে নয়। একানে শিবির স্থাপন করা আমাদের জন্য ভঅলো হবে না। চলূন না অন্য কোথাও।
অন্য কোথাও? সেটা কোথায়?
রাসূলের (সা) কণ্ঠে জিজ্ঞাসার বৃষ্টি।
হুবাব বললেন, হ্যাঁ। আমাদের নিয়ে চলুন শত্রুপক্ষের কাছাকাছি। যেখানে আছে সর্বশেষ পানির ঠিকানা। সেখানে আমরা নিজেরাই তৈরি করে নেব পানির হাউজ। সেই হাউজটি ভরে রাখবো পানিতে। পাত্র দিযে পানি উঠিয়ে আমরা পান করবো। সেই সাথে প্রাণপণে করে যাব শত্রুদের সাথে যুদ্ধ।অপর দিকে অন্যান্য সকল কূপের পানি আমরা ঘোলা করে দেব। আমরা হচ্ছি যোদ্ধা সম্প্রদায়। যুদ্ধের কলাকৌশলও আমাদের জানা।’
অবাক হয়ে সবাই শুনচেন হুবাবের কথা।
তারপর? তারপর?- সবাই শুনতে চান তার কথা।
হুবাব আবার তার পরিকল্পনার কথা বলতে শুরু করলেন: ‘হ্যাঁ এভাবে, এভাবে আমরা আমাদের কূপ থেকে পানি তুলে পান করবো আর যুদ্ধ করবো। আর অপর দিকে অন্য সকল কূপের পানি ঘোলা হবার কারণে শত্রুরা তা ব্যবহার করতে পারবে ন। যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে ছুটে যাবে পানির কাছে, তখন তারা পান করা মত কোনো পানিই কাছে পাবে না। পানি না পেয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়বে। ক্রমান্বয়ে তাবৎ ক্লান্তি, হতাশা আর বিষণ্ণতায় তারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। আর এভাবেই এক সময় তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পিঠটান দিতে বাধ্যহবে।’
হুবাবের যুক্তিপূরণ পরামর্শ।
সবাই তাকিয়ে আছেন মহান সেনাপতি রাসূলের (সা) দিকে।
তিনিও ভাবছেন। ভাবছেন বিষয়টি নিয়ে।
আর কোনো সংশয় নয়।
এবার রাসূল (সা) হুবাবকে ডেকে বললেন, ‘তোমার পরামর্শ ও মতটিই সঠিক। চলো, তেমনি একটি জায়গায় শিবির স্থাপন করি।’
রাসুল (সা) তাঁর সমগ্র বাহিনী নিয়ে এবার বদরের কুয়ার ধারে শিবির স্থাপন করলেন।
বদর!
বদর যুদ্ধে হুবাবের পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন দয়ার নবীজী।
শুধু বদর নয়, এমনি আরও অনেকবার তার সুচিন্তিত মতামত গৃহীত হয়েছিল রাসূলের (সা) কাছে।
মদীনার ইহুদি গোত্র বনু কুরায়জা ও বনী নাদীরের বিষয়ে সাহাবীদের কাছে রাসূল (সা) পরামর্শ চাইলেন।
হুবাব বলেন, ‘হে রাসুল! আমরা তাদের ঘর-বাড়ি ঘেরাও করে তাদের যাবতীয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলবৈা।’
দয়ার নবীজী (সা) হুবাবের পরামর্শ গ্রহণ করলেন।
যুদ্ধের ময়দানেও হুবাব ছিলেন বিচক্ষণ এবং সাহসী।
ছিলেন তিনি বারুদস্ফুলিঙ্গ।
বদরের প্রান্তর। যুদ্ধ চলছে ভীষণ বেগে।
হুবাব দেখলেন আবু কায়সকে।
নরাধম আবু কায়স!
যে মক্কায় দয়ার নবীকে (সা) নিদারুণ কষ্ট দিয়েছিল। তার উৎপীড়ন আর অত্যাচারের মাত্র ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে কোনো হিংস্র পশুকেও।
সেই আবু কায়স এসেছে যুদ্ধ করতে শত্রুপক্ষে।
হুবাব দেখলেন তাকে।
তারপর ছুটে গেলেন তার দিকে। এবং তাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিলেন হুবাব।
এরপর নাগালে পেয়ে গেলেন তিনি আলীর (রা) উৎপীড়ক উমাইয়্যা ইবন খালফকে। তিন তরবারির আঘাতে বিচ্ছিন্ন করে ফেললৈন তার একটি উরু।
এভাবে তিনি আম্মার ইবনে ইয়াসিরের সহযোগিতায় হত্যঅ করলেন উমাইয়্যার চেলে আলীকেও। আর বন্দী করলেন খাদ ইবন আল আলামকে।
উহুদ যুদ্ধ!
ও প্রান্ত থেকে ধেয়ে আসছে কুরাইশ বাহিনী।
ভীষণ শোরগোল পড়ে গেল গোটা মদীনায়।
মদীনার অনতিদূরে জুলহুলায়দায় কুরাইশ বাহিনী পৌঁছলে, রাসুল (সা) দু’জন গুপ্তচরকে পাঠালেন সেখানে। তাদের খবরাখবর নেবার জন্য।
তাদের পেছনে আবার পাঠালেন হুবাবকেও।
হুবাব সেখানে গিযে তাদের সৈন্যসংখ্যা, প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে রাসূলকে প্রদান করেন।
উহুদ যুদ্ধের একটি ভয়াবহ পর্যায়ে, যখন মুসলিম বাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, তখন যে পনেরজন সাহাবী নিজেদেরকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে দয়ার নবীকে (সা) ঘিরে রাখেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুঃসাহসী হযরত হুবাব।
শুধু যুদ্ধের ময়দানেই নয়।
হুবাব ঢালস্বরূপ কাজ করেছেন সারাটি জীবন ইসলামের জন্য।
তিনি নিজেকে, নিজের যাবতীয় যোগ্যতাকে, নিজের তাবৎ সামর্থকে কুরবানী করে দিয়েচিলেন আল্লাহর পথে। রাসূলকে (সা) ভালোবাসার সর্বোচ্চ নজরানা পেশ করতে তিনি চিলেন কুণ্ঠাহীন।
হুবাব ছিলেন যেমনি সাহসী যোদ্ধা আবার তেমনি ছিলেন একজন কবি ও সুবক্তা।
নানাবিধ যোগ্যতায় তিনি চিলেন পূর্ণ।
ছিলেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। আর ত্যাগ, কুরবানী ও সাহসের দিক থেকে তিনি ছিলেন এক তুমুল তুফান।
– মোশাররফ হোসেন খান