হলুদ পাগড়ির শিষ
খুব কম বয়স।
একেবারেই কিশোর।
কিন্তু শরীরে যেমন স্বাস্থ্য, তেমনি শক্তি। তাজি ঘোড়ার মত টগবগ করে ছুটে বেড়ান তিনি।
কাউকে পরোয়া করেন না।
সাহসের তেজ ঠিকরে বের হয়ে আসে তার দেহ থেকে। সমবয়সী তো দূরে থাক, অনেক বড় পালোয়ানও হার মানে তার সাথে মল্লযুদ্ধে।
সে এক অবাক করার মত দুঃসাহসী শক্তিশালী কিশোর।
নাম যুবাইর ইবনুল আওয়াম।
রাসূলের (সা) দাওয়াতের তখন মুখরিত চারদিক।
নবীজীর ডাকে সাড়া দিতে দলে দলে লোক ছুটে আসছে তাঁর কাফেলার দিকে। পুরো মক্কায় তখন ইসলামের দাওয়াতী আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে।
চারপাশে তার মৌ মৌ গন্ধ।
শান্তির সৌরভে ক্রমশ ভরে উঠছে বিশ্বাসীদের হৃদয়ের চাতাল।
যুবাইরও দেখছেন। দেখছেন আর শুনছেন ফিসফিস মধুর গুঞ্জন। তারও কানে বেজে উঠছে রাসূলের (সা) কণ্ঠ নিঃসৃত সেই মধুর এবং শাশ্বত ছন্দমুখর আহ্বান।
এসো আলোর পথে।
এসো সুন্দরের পথে।
এসো আল্লাহর পথে।
এসো রাসূলের (সা) পথে।
যুবাইরের বয়স তখন মাত্র ষোল।
বয়সে কিশোর। কিন্তু তার শরীরে বইছে যৌবনের জোয়ার। যে কোনো যুবকের চেয়েও তিনি অনেক বেশি সবল এবং সাহসী।
কান খাড়া করে যুবাইর শুনলেন রাসূলের (সা) আহবান।
আর দেরি নয়।
সাথে সাথে তিনি কবুল করলেন ইসলাম।
দয়ার নবীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন এক পরম প্রশান্তির ছায়ায়।
রাসূলও তাকে স্থান দিলেন স্নেহের বাহুডোরে।
রাসূলের (সা) প্রতি যুবাইরের ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সেই ভালোবাসার কোনো তুলনা চলে না।
একবার কে যেন রটিয়ে দিল, মুশরিকরা বন্দী অথবা হত্যা করেছে প্রাণপ্রিয় নবীকে।
একথা শুনার সাথে সাথেই বয়স্কদের মত জ্বলে উঠলেন যুবাইর।
অসম্ভব! অসম্ভব এ দুঃসাহস! আমার নবীজীকে কেউ হত্যা করতে পারে না। তিনি একটানে কোষমুক্ত করলেন তার তরবারি। তারপর যাবতীয় ভিড় ঠেলে, উর্ধশ্বাসে ছুটে গেলেন নবীজীর কাছে।
রাসূল তাকালেন যুবাইরের দিকে।
তিনি বুঝে গেলেন যুবাইরের হৃদয়ের ভষা। তিনি হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে যুবাইর?
যুবাইরের ভেতর তখনও বয়ে যাচ্ছে ক্রোধের কম্পন। তিনি বললেন,
‘হে রাসূল! খবর পেলাম, আপনি বন্দী অথবা নিহত হয়েছেন!’
রাসুল খুশি হলেন যুবাইরের আত্মত্যাগ আর ভালোবাসার নজির দেখে। তিনি খুশি হয়ে দোয়া করলেন তার জন্য।
এটাই ছিল প্রথম তরবারি, যা জীবন উৎসর্গের জন্য প্রথম একজন কিশোর কোষমুক্ত করেছিলেন।
ইসলাম গ্রহণের কারণে যুবাইরের ওপরও নেমে এসেছিল অকথ্য নির্যাতন।
তার চাচা- যে চাচাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন প্রাণ দিযে, সেও মুহূর্তে শত্রু হয়ে গেল কেবল সত্য গ্রহণের কারণে।
পাপিষ্ঠ চাচা!
নিষ্ঠুর চাচা!
হিংস্র পশুকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল সে। গরম, উত্তপ্ত পাথর! যে পাথরের ওপর ধান ছিটিয়ে দিলেও খই হয়ে যায়। এমন গরম পাথরের ওপর চিৎ করে শুইয়ে দিত ভাতিজা যুবাইরকে। আর বলতো ইসলাম ত্যাগ করার জন্র।
কিন্তু একবার যে পেয়ে গেছে সত্যের পরশ, সে কি আর বিভ্রান্ত হতে পারে কোনো অত্যাচার আর নির্যাতনে?
না! যুবাইরও চুল পরিমাণ সরে আসেননি তার বিশ্বাস থেকে। তার সত্য থেকে। বরং নির্যাতন যত বেড়ে যেত, ততোই বেড়ে যেত তার আত্মবিশ্বাস আর সাহসের মাত্রা।
তিনি কঠিন সময়েও পরীক্ষা দিতেন ঈমান আর ধৈর্যের।
তিনি ছিলেন হরিণের চেয়েও ক্ষিপ্রগতি, আর বাঘের চেয়েও দুঃসাহসী।
বদর যুদ্ধে দেখা গেল যুবাইয়ের সেই ভয়ঙ্কর চেহারা।
মুশরিকদের জন্য সেদিন ছিলেন বিভীষিকার চেয়েও ভয়ানক।
সেদিন মুশরিকদের সুদৃঢ় প্রতিরোধ প্রাচীল ভেঙ্গে তছনছ করে দেন তিনি।
একজন মুশরিকদের সৈনিক কৌশলে উঠে গেছে একটি টিলার ওপর। সেখঅন থেকে সেই ধূর্ত চিৎকার করে যুবাইরকে আহবান জানালো মল্ল যুদ্ধের।
ইচ্ছা ছিল যুবাইরকে পরাস্ত করা।
তার আহবানে সাড়া দিলেন যুবাইর।
উঠে গেলেন টিলার ওপর।
তারপর তাকে জাফটে ধরলেন আচ্ছা করে।
দু’জন টিলা থেকে গড়িয়ে নিচে।
রাসুল (সা) দেখছেন সবই। বললেন, “এদের মধ্যে যে প্রথশ ভূমিতে পড়বে, নিহত হবে সেই।”
কী আশ্চর্য!
রাসূলের (সা) কথা শেষ হতেই ভূমিতে প্রথম পড়লো সেই মুশরিকটি। আর সাথে সাথেই তরবারির একটি মাত্র আঘাতে তার মস্তকটি দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন যুবাইর।
যুবাইর মুখোমুখি হলেন আর একজন মুশরি- উবাইদা ইবনে সাঈদের। সে এমনভাবে বর্মাচ্ছাদিত ছিল যে তার চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
কুশলী এবং সতর্ক যুবাইর।
তিনি উবাইদার চোখ নিশানা করে তীর ছুঁড়লেন।
অব্যর্থ নিশানা।
বিদ্যুৎগতিতে তীরটি বিঁধে গেল উবাইদার চোখে। এফোঁড় –ওফোঁড় হয়ে তীরটি গেঁথে আছে তার চোখের মধ্যে।
যুবাইর ছুটে গেলেন উবাইদার কাছে। তারপর তার লাশের ওপর বসে তীরটি টেনে বের করে আনলেন।
তীরটি কিছুটা বেঁকে গেছে। সেই বাঁকা তীরটি রাসুল (সা) নিয়ে নিজের কাছে রেখেচিলেন স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।
রাসূলের (সা) ইন্তেকালের পর খলিফঅদের কাছেও রক্ষিত ছিল এই ঐতিহাসিক তীরটি।
হযরত উসমানের শাহাদাতের পর নিজের কাছেই আবার তীরটি নিয়ে নেন যুবাইর।
বদর যুদ্ধে তিনি জীবন বাজি রেখে এমনভাবে যুদ্ধ করেছিলেন যে ভোতা হয়ে গিয়েছিল তার তরবারিটি।
তিনিও আহত হয়েছিলেন মারাত্মকভাবে।
শরীরে একটি বিশাল গর্ত হয়ে গিয়েছিল।
তার ছেলে উরওয়া বলতেন, আমরা আব্বার শরীরে সেই গর্তে আঙ্গুল ঢুকিয়ে খেলা করতাম।
বদর যুদ্ধে যুবাইরের মাথায় ছিলহলুদ পাগড়ি।
রাসূল (সা) হেসে বলেছিলেন, “আজ ফেরেশতারাও এ বেশে এসেছে।’
উহুদ যুদ্ধ।
সত্য এবং মিথ্যার যুদ্ধ।
রাসূল (সা) কোষমুক্ত কররেন তার তরবারি। তারপর বললেন,
‘আজ কে এই তরবারির হক আদায় করতে পারে?’
রাসূলের (সা) আহ্বানেসকল সাহাবীই অত্যন্ত আনন্দের সাথে চিৎকার করে বললেন, ‘আমি! আমিই পারবো এই তরবারির হক আদায় করতে।’
সেখাকনে উপস্থিত ছিলেন যুবাইর। তিনি তিন তিন বার বললেন,
‘হে রাসুল (সা)! আমাকে দিন। আমিই এই তরবারির হক আদায় করবো।’
কিন্তু সেই সৌবাগ্র অর্জন করেন আর এক দুঃসাহসী সৈনিক আবু দুজানা। খন্দরেক যুদ্ধেও ছিল যুবাইরের অসাধারণ ভূমিকা।
যুদ্ধের সময় মদীনার ইহুদি গোত্র বনু কোরাইজা ভঙ্গ করলো মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তি।
তাদের অবস্থান জানার দরকার রাসূলেল (সা) তাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া জরুরি।
কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না।
রাসূল (সা) তাকালেন তার সাহাবদের দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে পারবে তাদের থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে আমাকে জানাতে’
তিনি তিনবার জিজ্ঞেস করলেন।
আর তিনবারই হাত উঁচু করে দাঁড়ালোন যুবাইর। বললেন,
‘হে রাসুল! আমি, আমিই পারবো সেখানে যেতে এবং প্রয়োজনীয় সংবাদ সংগ্রহ করে আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। দয়া করে আমাকে অনুমতি দিন হে রাহমাতুল্লিল আলামীন!’
যুবাইরের কথায় ভীষণ খুশি হলেন রাসূল (সা)। তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক নবীরই থাকে হাওয়ারী। আমার হাওয়ারী হলো যুবাইর।’
হযরত যুবাইর!
তিনি ছিলেন রাসূলের (সা) হাওয়ারী এবং নিত্যসহচর।
সাহস, সততা, আমানতদারি, দয়া, কোমলতা- এসবই ছিল তার পোশাকের মত অনিবার্য ভূষণ।
আল্লাহ, রাসূল (সা) এবং ইসলামের প্রতি ছিল তার দৃষ্টান্তমূলক ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগ।
সোনার মানুষ ছিলেন তিনি।
যে দশজন সাহাবী বেহেশতের আগাম সুসংবাদ দিয়েচিলেন দয়ার নবীজী, যুবাইর ছিলেন তাদেরই একজন, অন্যতম।
হযরত যুবাইর!
কী অসাধারণ ছিল তার চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব!
এখনও যেন হাওয়ায় দুলছে তার সেই দুঃসাহসী মস্তকের হলুদ পাগড়ির দুর্বিনীত শিষ।
– মোশাররফ হোসেন খান