আঁধার লুটায় পায়ের নিচে
বিশাল হৃদয়ের এক মানুষ আবদুর রহমান ইবনে আউফ।
যেমন তার ঈমানী দৃঢ়তা, তেমনি তার সাহস। কোমলতা, দানশীলতা আর মহানুভবতায় তিনি ছিলেন এক বিরল দৃষ্টন্তের অধিকারী।
কী অসাদারণ ছিল তার সেই হৃদয় উজাড় করা দানে মহিমা!
আত্মত্যাগের এক অনুপম স্বাক্ষর রেখে গেছেন আবদুর রহমান।
রেখে গেছেন ইসলামের জন্য ব্যাকুল হৃদয়ের সোনালি পশরা।
রাসূল (সা) পেয়ে গেছেন তখন মহান পুরস্কা- নবুওয়াত।
তিনি তখন তাওয়াদ দিচ্ছেন আশপাশে। পরিচিত মহলে।
চুপে চুপে ইসলাম গ্রহণ করছেন কেউ কেউ।
সেই প্রাথমিক পর্যায়ে যে ক’জন রাসূলের (সা) আহ্বান সাড়া দিয়েছিলেন, আবদুর রহমান ছিলেন তাদেরই একজন।
সেই তো প্রথম।
সেই তো প্রথম আত্মসমপর্পণ করা আল্লাহর কাছে।
ইসলামের কাছে।
রাসূলের (সা) ভালোবাসার কাছে। না, আর একবারের জন্যেও পেছন ফিরে তাকাননি তিনি।
সেই তো পথ চলা শুরু।
পথ চলা কেবলই আলোর দিকে।
কল্যাণের দিকে।
সত্যের দিকে।
সেই চলার ছিল না কোনো বিশ্রাম। ছিল না কোনো ক্লান্তি।
আবদুর রহমান।
শেষ জীবনেও তিনি ছিলেন বিশাল সম্পদশালী। সম্পদশালী ছিলেন ঈমান এবং অর্থের দিক থেকেও।
কিন্তু প্রথম দিকে তিনি ছিলেন অতিশয় নিঃস্ব এবং দরিদ্র। অভাবের সাথে পাঞ্জা লড়তেন প্রায় প্রতিনই। একেবারেই খালি হাতে তিনি হিজরত করে পৌঁছেছিলেন মদীনায়।
কী দুঃসহ জীবনটাই না ছিল তখন! তবুও হতাশ নন আবদুর রহমান। বরং কঠিন প্রত্যয় এবং শ্রমের মাধ্যমে সেই তিনি- যিনি মদীনায় শুরু করে ছিলেন ঘি ও পনির বেচা-কেনার সামান্য ব্যবসা- কালে কালে তিনিই হয়ে উঠলেন তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর একজন সেরা ব্যবসায়ী এবং বিশাল সম্পদশালী ব্যক্তি।
চেষ্টা, সাধনা, পরিশ্রম আর আল্লাহর ওপর অপরিসীম আস্থা থাকলে কি- না হয়! আবদুর রহমানই তার সাক্ষী।
কিন্তু কিভাবে এমনটি হলো?
সেও এক আলোকিত অধ্যায় বটে।
সম্পদশালী, কিন্তু বখিল কিংবা কৃপণ ছিলেন না আবদুর রহমান।
তার সম্পদ দু’হাতে তিনি দান করেন আল্লাহর রাস্তায়। তার সম্পদ দ্বারা সমূহ উপকৃত হয় ইসলাম।
আল্লাহর রাসূল (সা) জানেন এসব।
জানবেন না কেন!
তিনিই তো নিজ চোখে দেখেন আবদুর রহমানের দানের কারিশমা। দয়ার নবীজী (সা) খুশি হন প্রিয় সাহাবীর এই অনুণ্ঠ উদারতায়। তিনি দোয়া করেন তার জন্য। হাত তুলে দোয়া করেন মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে। তার সম্পদ বৃদ্ধির জন্য।
রাসূলের (সা) দোয়া বলে কথা!
বৃথা যাবে কেমন করে?
মহান রাব্বুল আলামীন কবুল করলেন রাসূলের (সা) দোয়া।
দয়ার নবীজীর (সা) দোয়ার বরকতে আল্লাহর রহমতে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হলেন আবদুর রহমান।
এত অর্থ! এত সম্পদ!
কিন্তু না, এসবের প্রতি সামান্যতম আকর্ষণও ছিল না তার। এই বিপুল সম্পদ তিনি দান করেছন একমাত্র আল্লাহর রাস্তায়। সত্যের পথে। রাসূলের (সা) ভালোবাসার নজরানায়। মানুষ ও মানবতার কাজে।
একজার রাসূল (সা) ডাকলেন তার প্রিয় সাথীদের। বললেন,
“আমি একটি অভিযানে সৈন্য পাঠানোর ইচ্ছা করছি। তোমরা সাহায্য করো।”
রাসূলের (সা) কথা শেষ হতেই এক দৌড়ে বাড়িতে এলেন আবদুর রহমান। তারপর দ্রুত, খুব দ্রুত ফিরে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে এই চার হাজার দীনার আছে। এর থেকে দু’হাজার করজে হাসানা দিলাম আমার রবকে। আর বাকি দু’হাজার রেখে দিলাম আমার পরিবার-পরিজনের জন্য।
রাসূল (সা) খুব খুশি হলেন। বললেন,
“তুমি যা দান করেছ এবং যা রেখে দিয়েছ, তার সব কিছুতেই আল্লাহ তা’আলা বরকত দান করুন।”
বিরাট শোরগোল পড়ে গেল মদীনায়। সবাই কানাকানি করছে, সিরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নিয়ে একটি বাণিজ্য কাফেলা উপস্থিত হয়েছে। শুধু উট আর উট।
জিজ্ঞেস করলেন হযরত আয়েশা (রা),
“এই সম্পদে বহর নিয়ে কে এলো? এই বাণিজ্য কাফেলাটি কার?”
উপস্থিত সকলেই জবাব দিল,
“কার আবার! আবদুর রহমানের।”
হযরত আয়েশা (রা) বললেন, “আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি, ‘আবদুর রহমানকে আমি যেন সরাতের ওপর একবার হেলে গিয়ে আবার সোজা হয়ে উঠতে দেখলাম।”
আমি শুনেছি। রাসূল (সা) বলতেন,
“আবদুর রহমান হামাগুড়ি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
হযরত আয়েশার (রা) কথাটি সময়মত কানে গেল আবদুর রহমানের। তিনি আহত হলেন কিছুটা। দৃঢ়তার সাথে বললেন,
“ইনশাআল্লাহ আমাকে সোজা হয়েই জান্নাতে প্রবেশ করতে হবে।”
এই আত্মবিশ্বাসের বাণী উচ্চারণের সাথে সাথেই তিনি তার উপার্জিত সকল বাণিজ্য-সম্পদ সাদকা করে দিলেন আল্লাহর রাস্তায়।
কী পরিমাণ ছিল সেই সম্পদ?
কেউ বলেন, পাঁচশো, কেউ বলেন সাত শো উটের পিঠে বোঝাই ছিল যত সম্পদ- তার সবই তিনি সাদকা করে দেন।
আবার কেউবা বলেন, শুধু সম্পদ নয়, সেই সাথে ঐ পরিমাণ উটের বহরকেও দান করে দিয়েছিলেন।
একবার তিনি চল্লিশ হাজার দীনারে বিক্রি করলেন তার কিছু জমি। বিক্রয়লব্ধ সম্পূর্ণ অর্থই তিনি বন্টন করে দিলেন বনু যুহরা, মুসলমান, ফকির মিসকিন, মুহাজির ও আযওয়ায়ে মুতাহহারাতের মধ্যে।
তিনি মোট তিরিশ হাজার দাস মুক্ত করে দিয়েছেন। এটাও এক বিরল দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে।
আবদুর রহমান ছিলেন রাসূলের (সা) ভালোবাসায় সিক্ত এক অনন্য অসাধাণ মানুষ।
বিশাল সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি জীবন যাপনে ছিলেন অতি সাধারণ। আল্লাহর সন্তুষ্টি, রাসূলের মহব্বত ছিল তার একমাত্র আরাধ্য বিষয়।
তিনি ছিলেন তাকওয়ার এক উজ্জ্ব নমুনা। মক্কায় গেলে তিনি তার আগের বাড়ির দিকে ফিরেও তাকাতেন না। কেউ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন,
“ওগুলি তো আম আমার আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিয়েছি। ওদিকে তাকাব কেন?”
একবার তিনি দাওয়াত দিলেন বন্ধুদেরকে।
সময়মত সবাই হাজির হলেন তার বাড়িতে।
তিনিও বসে আছেন তাদের মধ্যে। ইতোমধ্যে খাবার এলো ভেতর থেকে। কত ভাল খাবার! এতসব আয়োজন কেবল বন্ধুদের জন্য। এত খাবার সামনে এলেই তিনি কান্না শুরু করলেন। ডুকরে কাঁদছেন আবদুর রহমান।
বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলেন,
“কাদছো কেন? কী হয়েছে?”
তিনি সেই কাঁদো স্বরেই জবাব দিনে, “রাসূল (সা) বিদায় নিয়েছেন। তিনি নিজের ঘরে যবের রুটিও পেট ভরে খেতে পাননি।”
আর একদিন। তিনি রোযা ছিলেন। ইফতারের পর তার সামনে খাবার হাজির করলে তিনি অত্যন্ত ব্যাথাভরা কণ্ঠে বললেন,
“মুসয়াব ইবনে উমায়ের ছিলেন নামার থেকেও ভালো এবং উত্তম মানুষ। কিন্তু সেই সোনার মানুষটি হলে তার জন্য মাত্র ছোট্ট একখানা কাফনের কাপড় পাওয়া গিয়েছিল। সেই কাপড়টি ছিল এতই ছোট যে তার দিয়ে মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যাচ্ছিল, আবার পা ঢাকতে গেলে মাথা আলগা হচ্ছিল। তারপর মহান আল্লাহ আমাদের জন্য দুনিয়ার এইসব প্রাচুর্য দান করলেন। আমার ভয় হয়, না জানি আল্লাহ পাক আমাদের বদলা দুনিয়াতেই দিয়ে দেন।”
কথাগুলি বলতে গিয়েতিনি হাউমাউ করে শিশুদের মতহ জোরে কেঁদে ফেললেন।
কাঁদছেন আবদুর রহমান।
কাঁদছেন আল্লাহর ভয়ে।
আখিরাতের ভয়ে।
কিন্তু তিনি কেন কাঁদছেন
তিনি তো সেই ব্যীক্ত- যিনি নবম হিজরিতে, তাবুক যুদ্ধের সময় রাসূলের (সা) হাতে তুলে দেন আট হাজার দীনার। আর এই অঢেল অর্থ দান করা দেখে কেউ কেউ মন্তব্য করলো, এটা বাড়াবাড়ি। কেবল লোক দেখানোর জন্য। সে একজন রিয়াকার।
তাদের জবাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আত্তাওবার ৭১ নং আয়াতে বললেন,
“এতো সেই ব্যক্তি, যার ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হতে থাকবে।”
তার এই দানের হর দেখে রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন, “আবদুর রহমান, তোমার পরিবারের জন্য কিছু রেখেছ কি?”
তিনি জবাবে বললেন, “হ্যাঁ, রেখেছি হে দয়ার নবী (সা)! আমি যান দান করেছি, তার চেয়েও বেশ ও উৎকৃষ্ট জিনিস তাদের জন্য রেখে এসেছি।”
রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত’?
আবদুর রহমান বললেন, “আমার পরিবারের জন্য রেখে এসেছি তাই, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) যে রিজিক, কল্যাণ ও প্রতিদানের অঙ্গীকার করেছেন।”
সত্যের প্রতি ছিলেন পর্বতের মত সুদৃঢ়।
কোমল ছিলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেল (সা) প্রতি।
কিনতু তিনিই আবার ভীষণ ভয়ঙ্কর ছিলেন মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ছিলেন বৈশাখী ঝড়ের চেয়েও দুর্দম আর সমুদ্রের তুফানের চেয়েও ভয়ানক।
রাসূলের (সা) জীবদ্দশায় সংঘটিত বদর, উহুদ, খন্দকসহ প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন।
তার তলোয়ারের ধার দিয় ঝরে পড়তো কেবল সাহসের ফুলকি।
উহুদের যুদ্ধে তার শরীরে জমে গিয়েছিল একত্রিশটি আঘাতের হিহ্ন।
তারপরও তিনি ছিলেন বারুদস্ফুলিঙ্গ, কঠিন পর্বতশৃঙ্গ।
কেন নয়?
তিনি তো পান করেছিলেন রাসূলের (সা) হাত থেকে সেই এক সাহসের পানি, যে পানিতে ছিল কেবল আল্লাহর করুণার স্পর্শ।
ভয়ের কালিমা তাকে ছুঁয়ে যাবে, তা কেমন করে হয়!
বস্তুত, এমন সাহসী মানুষের পায়ের নিচেই তো হুমড়ি খেয়ে গড়াগড়ি যায় যত কুৎসিৎ আঁধার। আধারের ঢল।
– মোশাররফ হোসেন খান