আলোর মানুষ ফুলের অধিক
যেমন গাছ, তেমন ফল- কথাটা সর্বক্ষেত্রে সত্য নয়।
যেমন বিশাল বটবৃক্ষের ফল হয় খুব ছোট এবং মানুষের জন্য অখাদ্য। আবার একটি ছোট কাঠাল কিংবা আঙ্গুর গাছেও যেসব ফল হয়- তা যেমনি সুস্বাদু, তেমনি স্বাস্থ্যকর।
কিন্তু তাই বলে মানুষের ক্ষেত্রেও যে এমনটি ঘটবে, তার কোনো মানে নেই। বরং এর উল্টোটাই হয়ে থাকে প্রায় ক্ষেত্রে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যেমন পিতা, তেমন তার পুত্র হয়ে থাকে। ব্যতিক্রম যে আদৌ নেই, তা নয়।
কিন্তু সাঈদ বলে কথা।
হযরত সাঈদ ইবন যাইয়দ (রা)। তিনি তো ছিলেন সেই সৌভাগ্যবান বিরল পুরুষ, যিনি হযরত উমরের (রা) বেন ফাতিমার স্বামী ছিলেন এবং দু’জনই ইসলাম গ্রহণ করেন উমরের (রা) আগে। যখন রাসূল (সা) সবেমাত্র ইসলামের দাওয়াতে দেয়া শুরু করেছেন। সেই ইসলামের প্রথম ভাগেই।
কী খোষ নসীব।
সাঈদ এবং স্ত্রী ফাতিমা ইসলাম কবুল করেছন।
তাদের চোখ থেকে জমাট অন্ধকার সরে গিয়ে সূর্যের সোনালী রোদ্দুর চিকচিক করছে।
বুক ভরে নিচ্ছেন তারা ঈমানের শীলত বাতাস।
চারপাশ ঘিরে আছে কেবল কল্যাণের নিয়ামত।
কিন্তু অন্যদের মতো, ইসলাম গ্রহণের কারণে তাদের ওপরও নেমে এলো নির্যাতনের স্টিম রোলার।
দলিত মথিত হন তারা। শরীরে নেমে আসে ব্যথাভার অবসাত।
কিন্তু মনসাগরে দোলা দিয়ে যায় তখনও অন্য এক সাহসের ঢেউ।
প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও অনুভব করেন তারা হৃদয়ের এক অপার্থিব আরাম।
সেই প্রশান্তি, সেই আরাম, আর সেই সাহসের নাম- ঈমান।
হযরত উমর (রা)-
তখনও তিনি স্পর্শ করেননি আলোকিত পর্বত।
তখনও তিনি বঞ্চিত জোছনার দ্যুতি থেকে। তখনও তিনি দূরে, বুহুদূরে প্রশান্তির বৃষ্টি থেকে।
বরং তখনও তিনি ঠা ঠা রেদের ভেতর কেবলই ছুটে বেড়াচ্ছেন তৃষ্ণার পানির খোঁজে।
সেই পরিস্থিতিতে, উমরের জীবনে কী বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে গেল মুহূর্তেই। ঐ ভগ্নিপতি সাঈদ আর বোন ফাতিমার কারণে তিনিও গোসল করে নিলেন ঈমানের পূতপবিত্র ঝর্ণাধারায়।
ঈমান গ্রহণের পর আগের সেই উমর (রা) কোন্ উমরে পরিণত হয়েছিলেন, সে কথা তো লেখা আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
ইসলাম গ্রহণের পর হযরত সাঈদের বদলে গেল জীবন মিশন।
তার যৌবনের সকল শক্তি সকল ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা তিনি নিয়োগ করলেন কেবল ইসলামের খেদমতে।
সেখানে কোনো অলসতা ছিল না।
ছিল না কোনো ক্লান্তির ছাপ। কেবল কাজ আর কাজ।
কেবল চেষ্টার পর চেষ্টা।
ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য তার জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন একমাত্র আল্লাহর রাস্তায়।
রাসূলকৈ (সা) ভালোবেসে তিনি পূর্ণ করেছিলেন তার হদয়। দ্বিধাহীন, শঙ্কাহীন।
তিনি রাসূলেল (সা) সামনে পেশ করে দিয়েছিলেন নিজেকে, নিজের জীবনকে। এটাই ছিল তার ভালোবাসার উত্তম নজরানা।
হযরত সাঈদ!
রাসূলের (সা) নির্দেশে সিরিয়া থাকার কারণে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারেননি বদর যু্দ্ধে।
কিন্তু এছাড়া আর প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি ছিলেন অন্যতম সাহসী মুজাহিদ। পারস্যের কিসরা ও রোমের কাইসারের সিংহাসন পদানত করার ব্যাপারে হযরত সাঈদের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
মুসলমানদের সাথে তাদের যতগুলো যুদ্ধ হয়েছিল, তার প্রত্যেকটিতে তিনি ছিলেন সক্রিয়।
তার সেইসব অবদানের কথা স্মারণীয় হয়ে আছে আজও।
সাঈদ (রা) নিজেই বলেছেন:
‘ইয়ারমুকের যুদ্ধে আমরা ছিলাম ছাব্বিশ হাজার বা তার কাছাকাছি।’
অন্যদিকে রোমান বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল এক লাখ বিশ হাজার।
তারা অত্যন্ত দৃঢ়পদক্ষেপ পর্বতের মত অটল ভঙ্গিতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। তাদের অগ্রভাগে বিশপ ও পাদ্রি-পুরোহিতদের একটি বিশাল দল।
হাতে তাদের ক্রুশখচিত পতাকা। মুখে প্রার্থনাসঙ্গীত। পেছন থেকে তাদের সাথে সুর মিলাচ্ছিল বিশাল শক্তিশালী বাহিনী।
তাদের সেই সম্মিলিতি কণ্ঠস্বর তখন মেঘের গর্জনের মত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল।
রেমান বাহিনীর এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখছেন মুসলিম বাহিন।
রোমান বাহিনীর সংখ্যা বিপুল।
এই দৃশ্য দেখে মুসলিম বাহিনী কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন।
সেনাপতি আবু উবাইদা।
তিনি বিষয়টি বুঝতে পারলেন।
সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন এবং মুসলিম বাহিনীকে উজ্জীবিত করার জন্যে বললেন:
“হে আল্লাহর বান্দারা!
ধৈর্য ধারণ কর। ধৈর্য হলো কুফরী থেকে মুক্তির পথ। ধৈর্য হলো আল্লাহর রিজামন্দি হাসিলের পথ এবং যাবতীয় লজ্জা এবং অপমান প্রতিরোধক। তোমরা তীর বর্শা শানিত করে ঢাল হাতে প্রস্তুত হও। হৃদয়ে আল্লাহর জিকির ছাড়া অন্য সকল চিন্তা থেকে বিরত থাকো। সময় হলে আমি তোমাদের যুদ্ধের জন্য নির্দেশ দেব ইনশাআল্লাহ।”
মুসলিম বাহিনীর ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে আবু উবাইদাকে বললেন:
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই মুহর্তে আমি কুরবানী করবো আমার জীবনকে। রাসূলেল (সা) কাছে পৌঁছে দিতে হবে এমন কোনো বাণী কি আপনার আছে?”
আবু উবাইদা বললেন:
“হ্যাঁ আছে। রাসূলকে (সা) আমার ও মুসলিম বাহিনীর সালাম পৌঁছে দিয়ে বলবে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের রব আমাদের সাথে যে অঙ্গীকার করেছন, তা আমরা সত্যিই পেয়েছি।”
সাঈদ বলেন,
‘আমি তার কথা শুনা মাত্রই দেখতে পেলাম সে তার তরবারি কোষমুক্ত করে আল্লাহর শত্রুদের সাথে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হচ্ছে।
এই অবস্থায় আমি দ্রুত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাঁটুতে ভর দয়ে অগ্রসর হলাম এবং আমার বর্শা হাতে প্রস্তুত হলাম।
শত্রুপক্ষের প্রথম যে ঘোড় সওয়ার আমাদের দিকে এগিয়ে এলো, আমি তাকে আঘাত করলাম।
তারপর-
তারপর অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রুবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
আল্লাহ পাক আমার অন্তর থেকে সকল প্রকার ভয়ভীতি একেবারেই দূর করে দিলেন। অতঃপর মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর ওপর সরবাত্মক আক্রমণ চালালো। এবং তাদেরকে পরাজিত করলো।”
দিমাশক অভিযানেও অংশগ্রহণ করেন সাঈদ।
দিমাশক বিজয়ের পর আবু উবাইদা তাকে দেমাশকের ওয়ালী নিযুক্ত করলেন।
তিনিই হলেন দিমাশকের প্রথম মুসলিম ওয়ালী।
কিন্তু হযরত সাঈদ জিহাদের চেয়ে তিনি এই উচ্চ পদকে মোটেও সম্মানজনক মনে করলেন না।
তিনি কাজ করেন। প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। আর মনটা পড়ে থাকে তার জিহাদের ময়দানে।
তিনি আবু উবাইদাকে জানালেন হৃদয়ের সকল আকুতি। লিখলেন:
“আপনারা জিহাদ করবেন আর আমি বঞ্চিত হরো, এমন আত্মত্যাগ আর কুরবানী আমি করতে পারিনে। আমি শিগগিরই আপনার কাছে পৌঁছে যাচ্ছি।”
আবু উবাইদা বাধ্য হয়ে ইয়াযিদ ইবনে আবু সুফিয়ানকে দিমাশকের ওয়ালী নিযুক্ত করলেন এবং জিহাদের ময়দানে ফিরিয়ে আনলেন হযরত সাঈদকে।
এই হলেণ হযরত সাঈদ। যিনি ছিলেন সাহসে ও সংগ্রামের এক জ্বলন্ত বারুদ।
কেন নয়!
তার পিতা যায়িদও যে ছিলেন একজন সাহসী, সত্যানিষ্ঠপুরুষ। তিনি যে তারই সন্তান!
যায়িদের সৌভাগ্য হয়নি রাসূলের (সা) খেদমতে নিজেকে পেশ করার। কারণ, তখনও নবী মুহাম্মদ (সা) নবুওয়াতপ্রাপ্ত হননি।
কিন্তু যায়িদ, সেই জাহেলি যুগেও ছিলেন কলুষমুক্ত। ছিলেন রুচিসম্পন্ন, বুদ্ধিমান এবং সাহসী এক পুরুষ।
ইসলাম আগমনের আগেই তিনি নিজেকে দূরে রাখেন শিরক থেকে। কুফরী থেকে। পৌত্তলিকতা থেকে আর যত পাপাচার ও অশ্লীলতা থেকে।
নবওয়াত প্রাপ্তির আগে, ‘বালদাহ’ উপত্যকায় একবার রাসূলের (সা) সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।
রাসূলের (সা) সামনে খাবার আনা হলে তিনি খেতে অস্বীকৃতি জানালেন। যায়িদকে অনুরোধ করাহলে তিনিও অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন:
“তোমাদের দেব-দেবীর নামে যবেহকৃত পশুর গোশত আমি খাইনে।”
এটা সেই জাহেলি যুগের কথা।
যখন আরবে কন্যা সন্তান হলে জীবিত কবর দেয়া হতো।
যায়িদ খোঁজ খবর নিতেন, কোথায় সন্তান ভূমিষ্ট হচ্ছে। কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হবার খবর পেলেই তিনি সেখানে ছুটে যেতেন এবং সেই কন্যা সন্তানকে নিজের দায়িত্বে নিয়ে যেতেন। তারপর সে বড় হলে তাকি নিয়ে যেতেন তার অভিভাবকের কাছে। বলতেন, “এখন একে নিজের দায়িত্বে রাখতেও পারো, অথবা আমার দায়িত্বেও ছেড়ে দিতে পারো।”
যায়িদ সারাজীবন সত্য দীনকে অনুসন্ধান করে ফিরছেন। এই সত্য দীনকে খুঁজতে তিনি কত জায়গায়ই না গিয়েছেন। একবার তিনি শামে (সিরিয়া) গিয়ে একজনের সন্ধান পেলেন। যিনি আসমানী কিতাবে অভিজ্ঞ। তার কাচে তিনি মনের বাসনার কথা খুলে বললেন। তিনি যায়িদকে বললেন:
-হে মক্কাবাসী ভাই! আমার মনে হচ্ছে আপনি দীনে ইব্রাহীম অনুসন্ধান করছেন?
-হ্যাঁ, তাই।
তিনি বললেন:
“আপনি যে দীনের অনুসন্ধান করছেন, আজকের দিনে তো তা আর পাওয়া যায় না তবে সত্য আছে তো আপনার শহরেই। আপনার কওমের মধ্য থেকে আল্লাহ এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি দীনে ইব্রাহীম পুনরুজ্জীবিত করবেন। আপনি যদি তাঁকে পান তাহল তাঁরই অনুসরণ করবেন।”
রাহিবের একথা শুনার পর যায়িদ আবার মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন।
কোথায় সেই নবী?
কে সেই ভাগ্যবান মহাপুরুষ?
খুঁজতে হবে তাঁকে।
যায়িদ দ্রুত হাঁটছেন।
মক্কার দিকে।
মক্কা থেকে বেশ কিছু দূরে যায়িদ।
তখনই মুহাম্মদ (সা) নবুওয়াতপ্রাপ্ত হলেন।
কিন্তু আফসোস!
যায়িদ রাসূলের (সা) সাক্ষাৎ পেলেন না।
কারণ, মক্কায় পৌঁছার পূর্বেই একদল বেদুইন ডাকাত তাকে আক্রমণ করলো। শুধু আক্রমণ নয়, শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যাও করলো।
ইন্তেকাল করলেন যায়িদ।
তিনি বঞ্চিত হলেন রাসূলের (সা) দর্শন, হিদায়াত এবং ইসলামের খেদমত থেকে।
অপূর্ণ রয়ে গেল তার হৃদয়ের বাসনা।
মৃত্যুর আগে তিন আকাশের দিকে তাকিয়ে দুআ করলেন। বললেন:
“হে আল্লাহ! যদিও এই কল্যাণ থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন, আমার পুত্র সাঈদকে তা থেকে আপনি মাহরুম করবেন না।”
মহান রাব্বুল আলামীন কবুল করেছিলেন পিতা যায়িদের সেই দুআ।
সত্যি সত্যিই তার পুত্র সাঈদ কল্যাণ লাভ করেছিলেন রাসূলের (সা) ভালোবাসা আর আল্লাহর দীনের পথে সার্বিক ত্যাগের মাধ্যমে।
যেমন পিতা, তেমনি তার পুত্র।
হযরত সাঈদ!
কী অসাধারণ এক বেহেশতের আবাবিল!
বেহেশতের আবাবিল, কিংবা তার চেয়েও বড়- আলোর মানুষ, ফুলের অধিক।
– মোশাররফ হোসেন খান