মুমিন কিভাবে রাত অতিবাহিত করবে
মুমিনের সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর জন্য নিবেদিত হবে। তার প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত হবে আল্লাহর স্মরণে এবং তাঁর বিধান পালনের মাধ্যমে। তার সকল কর্ম সম্পাদিত হবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুসরণ-অনুকরণের মধ্য দিয়ে। যেমনভাবে মুমিনের দিন অতিবাহিত করার আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, অনুরূপভাবে রাত্রি অতিবাহিত করার আদব বা শিষ্টাচার ইসলাম বিশেষভাবে শিক্ষা দিয়েছে। ঐসব আদব কুরআন ও হাদীছে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। যাতে মুমিন প্রতিটি রাত আল্লাহর রেযামন্দী ও সন্তোষে অতিবাহিত করে সফলকাম ও কামিয়াব হ’তে পারে। এখানে আমরা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে মুমিনের রাত্রি যাপনের আদব ও আহকাম তথা শিষ্টাচার ও বিধান সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপনের চেষ্টা করব। যা পড়ে পাঠক অবহিত হ’তে পারবেন, রাত কিভাবে অতিক্রম করতে হয়।
রাত আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন :
রাত আল্লাহর সৃষ্টির এক বড় নিদর্শন (ইসরা ১৭/১২)। একে আল্লাহ মানুষের আরাম-আয়েশ ও প্রশান্তির উপায় হিসাবে সৃষ্টি করেছেন (আন‘আম ৬/৯৬; নাহল ১৬/৮৬)। আল্লাহ রাতকে মানুষের জন্য আবরণ বা আড়াল হিসাবে সৃষ্টি করেছেন (ফুরক্বান ২৫/৫৭)।
মহান আল্লাহ রাতের কোন অংশবিশেষ প্রকাশ না করে সর্বদা দিন কায়েমে সক্ষম। আবার দিনের কোন আভা বা আলোকচ্ছটা প্রকাশিত না করে সর্বদা রাত কায়েমে পূর্ণ ক্ষমতাবান (ক্বাছাছ ২৮/৭১-৭২)। যেমন মেরু অঞ্চলে ৬ মাস রাত ও ৬ মাস দিন থাকে।
রাত্রে সংঘটিত ইসলামের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় :
১. মানবতার হেদায়াতের দিক-দিশারী ও হক-বাতিলের পার্থক্যকারী মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম রাত্রে অবতীর্ণ হয়েছে।[1]
২. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইসরা ও মি‘রাজ রাত্রিকালে সংঘটিত হয়েছে (ইসরা ১৭/১)।
৩. রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন।[2]
তাই নীরবে-নিভৃতে মহান আল্লাহকে ডাকা ও তাঁর ইবাদত করার জন্য রাত অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়।
রাত্রিকালে পবিত্রতা
রাত্রে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হয়ে শয়ন করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ আমলের গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণনা করেছেন। যেমন-
১. ওযূ করে শয্যা গ্রহণ করা :
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ بَاتَ طَاهِرًا بَاتَ فِي شِعَارِهِ مَلَكٌ، لاَ يَسْتَيْقِظُ سَاعَةً مِنْ لَيْلٍ إِلاَّ قَالَ الْمَلَكُ : اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فُلاَنٍ، فَإِنَّهُ بَاتَ طَاهِرًا- ‘যে ব্যক্তি ওযূ করে শয্যা গ্রহণ করে, তার শরীরের সাথে থাকা বস্ত্রের মাঝে একজন ফেরেশতা রাত্রি যাপন করেন। যখনই সে ব্যক্তি জাগ্রত হয়, তখন ফেরেশতা বলেন, হে আল্লাহ! আপনি অমুক বান্দাকে ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয়ই সে ওযূ করে শয়ন করেছে’।[3] অন্য বর্ণনায় এসেছে, মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَبِيْتُ عَلَى ذِكْرٍ طَاهِرًا فَيَتَعَارُّ مِنَ اللَّيْلِ فَيَسْأَلُ اللهَ خَيْرًا مِنَ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ إِلاَّ أَعْطَاهُ إِيَّاهُ. ‘যে কোন মুসলমান রাতে যিকর-আযকার (দো‘আ পাঠ) করে এবং ওযূ করে শয়ন করে, সে যদি রাতে জাগ্রত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কোন কল্যাণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তাহ’লে আল্লাহ তাকে তা দান করেন’।[4]
২. ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে হাত ও মুখমন্ডল ধৌত করা :
নিদ্রা হ’তে জাগ্রত হওয়ার পর দু’হাত ও মুখমন্ডল ধৌত করা সু্ন্নাত। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَقَضَى حَاجَتَهُ ثُمَّ غَسَلَ وَجْهَهُ وَيَدَيْهِ ثُمَّ نَامَ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাতে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে কাযায়ে হাজত সেরে মুখমন্ডল ও দু’হাত ধৌত করে পুনরায় ঘুমাতেন’।[5]
৩. জুনুবী অবস্থায় ওযূ বা তায়াম্মুম করে ঘুমানো :
জুনবী বা অপবিত্র ব্যক্তি প্রথমে লজ্জাস্থান ধৌত করবে এবং পরে ওযূ করে ঘুমাবে। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَرَادَ أَنْ يَّنَامَ وَهْوَ جُنُبٌ، غَسَلَ فَرْجَهُ، وَتَوَضَّأَ لِلصَّلاَةِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জানাবাতের হালাতে বা অপবিত্রাবস্থায় যখন শয্যা গ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন তিনি স্বীয় লজ্জাস্থান ধৌত করতেন এবং ছালাতের ন্যায় ওযূ করতেন’।[6] আবার কখনও তায়াম্মুম করতেন’।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ওমর (রাঃ) রাতে জুনবী হওয়ার কথা রাসূলের নিকটে উল্লেখ করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, تَوَضَّأْ وَاغْسِلْ ذَكَرَكَ ثُمَّ نَمْ. ‘ওযূ কর ও লজ্জাস্থান ধৌত কর। অতঃপর ঘুমাও’।[8]
৪. রাত্রে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে মেসওয়াক করা :
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার প্রতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অতি সজাগ ও সচেতন ছিলেন। হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ يَشُوْصُ فَاهُ بِالسِّوَاكِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন রাতে ঘুম থেকে জাগ্রত হ’তেন, তখন তিনি মেসওয়াক করে স্বীয় মুখ পরিস্কার করতেন’।[9]
রাত্রিকালে আযান
সূর্যাস্তের পর থেকে রাত শুরু হয় এবং ফজর উদিত হওয়ার সাথে সাথেই রাতের পরিসমাপ্তি ঘটে। আযান দেওয়াও ইবাদত। রাতে বিভিন্ন আযান প্রচারিত হয়। যেমন-
ক. মাগরিবের আযান :
সূর্যাস্তের পর মাগরিবের সময় হয়। সালামা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে,كُنَّا نُصَلِّى مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم الْمَغْرِبَ إِذَا تَوَارَتْ بِالْحِجَابِ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে সূর্যাস্তের সাথে সাথে মাগরিবের ছালাত আদায় করতাম’।[10] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাফে‘ বিন খাদীজ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,كُنَّا نُصَلِّى الْمَغْرِبَ مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَيَنْصَرِفُ أَحَدُنَا وَإِنَّهُ لَيُبْصِرُ مَوَاقِعَ نَبْلِهِ. ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে মাগরিবের ছালাত আদায় করে এমন সময় ফিরে আসতাম যে, আমাদের কেউ (তীর নিক্ষেপ করলে) নিক্ষিপ্ত তীর পতিত হবার স্থান দেখতে পেত’।[11] বর্তমানে কেউ কেউ মাগরিবের আযান প্রচারে অত্যন্ত বিলম্ব করে থাকে, যা সুন্নাতের সম্পূর্ণ খেলাফ। বস্ত্ততঃ সূর্যাস্তের সাথে সাথেই মাগরিবের আযান দেওয়া অত্যাবশ্যক।
খ. এশার আযান :
পশ্চিম দিগন্তে শাফাক্ব বা লাল আভা মিলিয়ে যাওয়ার পর থেকেই এশার ওয়াক্ত শুরু হয়। শাফাক্ব বলতে সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে যে লাল চিহ্ন বা রেখা পরিদৃষ্ট হয়। এই শাফাক্ব মিলিয়ে যাওয়া হচ্ছে এশার ছালাতের আওয়াল ওয়াক্ত।[12] আর এশার শেষ সময় হচ্ছে অর্ধরাত পর্যন্ত[13] অথবা রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত।[14] প্রকাশ থাকে যে, শাফাক্ব অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর এশার আযান দেওয়া যায়। তবে এশার ছালাত দেরী করেও আদায় করা যায়।[15]
গ. সাহারীর আযান :
রামাযানে এবং অন্য মাসেও সাহারীর আযান দেওয়া সুন্নাত। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ بِلاَلاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ، فَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتَّى يُؤَذِّنَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُوْمٍ ‘বেলাল রাত্রে আযান দিলে তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ না আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূম আযান দেয়’।[16] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,وَكَانَ رَجُلاً أَعْمَى لاَ يُنَادِى حَتَّى يُقَالَ لَهُ أَصْبَحْتَ أَصْبَحْتَ ‘আব্দুল্লাহ বিন উম্মে মাকতূম (রাঃ) অন্ধ ছিলেন। তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত আযান দিতেন না, যতক্ষণ তাকে বলা না হ’ত যে, তুমি সকাল করে ফেললে, সকাল করে ফেললে’।[17] অপর একটি হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَذَلِكَ عِنْدَ السُّحُورِ يَا أَنَسُ إِنِّى أُرِيدُ الصِّيَامَ أَطْعِمْنِى شَيْئًا. فَأَتَيْتُهُ بِتَمْرٍ وَإِنَاءٍ فِيهِ مَاءٌ وَذَلِكَ بَعْدَ مَا أَذَّنَ بِلاَلٌ فَقَالَ يَا أَنَسُ انْظُرْ رَجُلاً يَأْكُلُ مَعِى. فَدَعَوْتُ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ فَجَاءَ فَقَالَ إِنِّى قَدْ شَرِبْتُ شَرْبَةَ سَوِيقٍ وَأَنَا أُرِيدُ الصِّيَامَ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَأَنَا أُرِيدُ الصِّيَامَ. فَتَسَحَّرَ مَعَهُ ثُمَّ قَامَ فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ خَرَجَ إِلَى الصَّلاَةِ.
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাহারীর সময় বললেন, হে আনাস! আমি ছিয়াম পালনের ইচ্ছা করছি, আমাকে কিছু খাওয়াও। আমি রাসূলের নিকটে খেজুর ও পানির পাত্র নিয়ে আসলাম। এটা বেলালের আযান দেওয়ার পরে ছিল। অতঃপর তিনি বলেন, হে আনাস! কোন লোককে খুঁজে দেখ, যে আমার সাথে আহার করবে। আমি যায়েদ বিন ছাবিতকে ডাকলে, তিনি এসে বললেন, আমি এইমাত্র ছাতুর শরবত পান করেছি এবং ছিয়াম পালনেরও ইচ্ছা করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমিও ছিয়ামের ইচ্ছা পোষণ করেছি। তখন তিনি রাসূলের সাথে সাহারী করলেন। অতঃপর দাঁড়িয়ে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে (ফজর) ছালাতের জন্য মসজিদ অভিমুখে গমন করলেন’।[18] এখানে রামাযান ও অন্যান্য মাসের কোন পার্থক্য করা হয়নি। বরং আনাস (রাঃ) বর্ণিত এ দীর্ঘ হাদীছে রামাযান ব্যতীত অন্য মাসের বিষয়টি সুস্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হয়েছে।
রাত্রে প্রচারিত উপরোক্ত সময় আযান দিয়ে মুমিন অশেষ ছওয়াবের অধিকারী হ’তে পারেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْمُؤَذِّنُ يُغْفَرُ لَهُ مَدَّ صَوْتِهِ وَيَشْهَدُ لَهُ كُلُّ رَطْبٍ وَيَابِسٍ وَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ صَلَّى وَشَاهِدُ الصَّلَاةِ يُكْتَبُ لَهُ خَمْسٌ وَّعِشْرُوْنَ صَلَاةً وَيُكَفَّرُ عَنْهُ مَا بَيْنَهُمَا- ‘মুয়াযযিনের কণ্ঠের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করা হবে এবং (ক্বিয়ামতের দিন) তার কল্যাণের জন্য প্রত্যেক সজীব ও নির্জীব বস্ত্ত সাক্ষ্য দিবে এবং এই আযান শুনে যত লোক ছালাত আদায় করবে সবার সমপরিমাণ নেকী মুয়াযযিনের হবে। আর যে ব্যক্তি ছালাত আদায়ের জন্য উপস্থিত হবে, তার জন্য পঁচিশ ছালাতের নেকী লেখা হবে এবং তার দুই ছালাতের মধ্যকার গুনাহ ক্ষমা করা হবে’।[19]
শয়নের আদব বা শিষ্টাচার
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের বিশ্রামের জন্য রাতকে সৃষ্টি করেছেন এবং নিদ্রাকে করেছেন ক্লান্তি দূরকারী। তিনি বলেন, وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا، وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا- ‘আর আমরা তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। আর রাত্রিকে করেছি আবরণ’ (নাবা ৭৮/৯-১০)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَهُوَ الَّذِيْ جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِبَاسًا وَالنَّوْمَ سُبَاتًا وَجَعَلَ النَّهَارَ نُشُوْرًا- ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য রাত্রিকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে করেছেন ক্লান্তি দূরকারী এবং দিবসকে করেছেন উত্থান সময়’ (ফুরক্বান ২৫/৪৭)। সুতরাং দিনের কর্মক্লান্তি দূর করতে মানুষকে রাত্রে শয্যা গ্রহণ করতে হয়, ঘুমিয়ে বিশ্রাম নিতে হয়। মুমিন বান্দা সুন্নাতী তরীকায় শয্যা গ্রহণ করবে এবং আল্লাহর যিকর করতে করতে সে ঘুমিয়ে যাবে। তাহ’লে এর মাধ্যমে সে ছওয়াব হাছিল করতে পারবে। নিম্নে শয্যা গ্রহণ ও ঘুমানোর কতিপয় আদব উল্লেখ করা হ’ল।-
১. ডান কাতে শয়ন : সাধারণভাবে এশার ছালাতের পূর্বে ঘুমানো ও এশার পরে (অপ্রয়োজনীয়) কথাবার্তা বলা উচিত নয়।[20] আর শয়নকালে ডান কাতে শয়ন করা সুন্নাত।[21]
২. দো‘আ পাঠ : শয়নকালে দো‘আ পাঠ করা যরূরী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَمَنِ اضْطَجَعَ مَضْجَعًا لاَ يَذْكُرُ اللهَ فِيهِ كَانَتْ عَلَيْهِ مِنَ اللهِ تِرَةً. ‘যে ব্যক্তি কোথাও শয়ন করার পর আল্লাহর নাম নিলো না, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বঞ্চনা নেমে আসবে’।[22] তাই শয্যা গ্রহণকালে মুমিন বলবে, بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ أَمُوْتُ وَأَحْيَا ‘বিসমিকাল্লা-হুম্মা আমূতু ওয়া আহ্ইয়া’ (হে আল্লাহ! তোমার নামে আমি মরি ও বাঁচি)। অর্থাৎ তোমার নামে আমি শয়ন করছি এবং তোমারই দয়ায় আমি পুনরায় জাগ্রত হব। আর ঘুম থেকে ওঠার সময় বলবে, اَلْحَمْدُ ِللهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ ‘আলহামদুলিল্লা-হিল্লাযী আহইয়া-না বা‘দা মা আমা-তানা ওয়া ইলাইহিন নুশূর’ (সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দানের পর জীবিত করলেন এবং ক্বিয়ামতের দিন তাঁর দিকেই হবে আমাদের পুনরুত্থান)।[23]
৩. সূরা ইখলাছ ও নাস-ফালাক্ব তেলাওয়াত : শয়নকালে সূরা ইখলাছ, নাস ও ফালাক্ব তেলাওয়াত করা সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) নিজে এই আমল করতেন এবং এ ব্যাপারে ছাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দিতেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন,
أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا أَوَى إِلَى فِرَاشِهِ كُلَّ لَيْلَةٍ جَمَعَ كَفَّيْهِ ثُمَّ نَفَثَ فِيهِمَا فَقَرَأَ فِيْهِمَا (قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ) وَ(قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ) وَ(قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ) ثُمَّ يَمْسَحُ بِهِمَا مَا اسْتَطَاعَ مِنْ جَسَدِهِ يَبْدَأُ بِهِمَا عَلَى رَأْسِهِ وَوَجْهِهِ وَمَا أَقْبَلَ مِنْ جَسَدِهِ يَفْعَلُ ذَلِكَ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ.
‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রতি রাতে যখন বিছানায় যেতেন, তখন দু’হাত একত্রিত করে তাতে সূরা ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস পড়ে ফুঁক দিতেন। অতঃপর মাথা ও চেহারা থেকে শুরু করে যতদূর সম্ভব দেহে তিনবার দু’হাত বুলাতেন’।[24] অন্য হাদীছে এসেছে, ওক্ববা বিন আমের (রাঃ) বলেন,أَمَرَنِى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ أَقْرَأَ بِالْمُعَوِّذَتَيْنِ فِى دُبُرِ كُلِّ صَلاَةٍ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে প্রতি ছালাতের শেষে সূরা ফালাক্ব ও নাস পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন’।[25]
৪. আয়াতুল কুরসী তেলাওয়াত : কুরআনের সর্বাধিক মর্যাদা সম্পন্ন আয়াত হচ্ছে আয়াতুল কুরসী। শয্যা গ্রহণের সময় এটা তেলাওয়াত করলে সকাল পর্যন্ত শয়তান কোন ক্ষতি করতে পারে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِذَا أَوَيْتَ إِلَى فِرَاشِكَ فَاقْرَأْ آيَةَ الْكُرْسِيِّ مِنْ أَوَّلِهَا {اللهُُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ} حَتَّى تَخْتِمَ الْآيَةَ فَإنَّهُ لَنْ يَزَالَ عَلَيْكَ مِنَ الله حَافِظٌ، وَلاَ يَقْرُبُكَ شَيْطَانٌ حَتَّى تُصْبِحَ،
‘তুমি যখন শয্যা গ্রহণ করবে, তখন ‘আয়াতুল কুরসী’ পড়বে (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহুয়া ওয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম) আয়াতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তাহ’লে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার নিকটে আসতে পারবে না’।[26]
৫. সূরা বাক্বারার শেষ দু’আয়াত তেলাওয়াত করা : রাতে সূরা বাক্বরার শেষ দু’আয়াত তেলাওয়াত করে শয়ন করা উত্তম। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, الآيَتَانِ مِنْ آخِرِ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ، مَنْ قَرَأَهُمَا لَيْلَةً كَفَتَاهُ- ‘সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত যে রাতে পড়বে তার জন্য তা যথেষ্ট হবে’।[27]
৬. সূরা মুলক তেলাওয়াত : শয়নকালে সূরা মুলক তেলাওয়াত করা সুন্নাত। জাবির (রাঃ) বলেন,كَانَ لاَ يَنَامُ حَتَّى يَقْرَأَ الم تَنْزِيْلُ وَتَبَارَكَ الَّذِيْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ- ‘নবী করীম (ছাঃ) সূরা সাজদা ও সূরা মুলক না পড়ে ঘুমাতেন না’।[28]
৭. তাসবীহ পাঠ করা : শয়নকালে তাসবীহ পাঠ করা অশেষ ছওয়াব লাভের মাধ্যম। আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, ফাতিমা (রাঃ) আটা পেষার কষ্টের কথা জানান। তখন তাঁর নিকটে সংবাদ পৌঁছে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে কয়েকজন বন্দী আনা হয়েছে। ফাতিমা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে একজন খাদেম চাওয়ার জন্য আসলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে পেলেন না। তখন তিনি আয়েশা (রাঃ)-এর নিকটে তা উল্লেখ করলেন। অতঃপর নবী করীম (ছাঃ) আসলে আয়েশা (রাঃ) তাঁর নিকটে বিষয়টি বললেন। (রাবী বলেন,) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদের নিকটে আসলেন। তখন আমরা শুয়ে পড়েছিলাম। আমরা উঠতে চাইলাম। তিনি বললেন, তোমরা নিজ নিজ জায়গায় থাক। আমি তাঁর পায়ের শীতলতা আমার বুকে অনুভব করলাম। তখন তিনি বললেন,
أَلاَ أَدُلُّكُمَا عَلَى خَيْرٍ مِمَّا سَأَلْتُمَاهُ، إِذَا أَخَذْتُمَا مَضَاجِعَكُمَا فَكَبِّرَا اللهَ أَرْبَعًا وَثَلاَثِينَ، وَاحْمَدَا ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، وَسَبِّحَا ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ، فَإِنَّ ذَلِكَ خَيْرٌ لَكُمَا مِمَّا سَأَلْتُمَاهُ.
‘তোমরা যা চেয়েছ, আমি কি তোমাদের জন্য তার চেয়ে উত্তম জিনিসের সন্ধান দেব না? যখন তোমরা বিছানায় যাবে, তখন তেত্রিশ বার ‘আল্লাহু আকবার’, তেত্রিশবার ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ ও তেত্রিশবার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। এটাই তোমাদের জন্য তার চেয়ে উত্তম, যা তোমার চেয়েছ’।[29]
রাতের ছালাত
রাত্রে দুই ধরনের ছালাত আদায় করা হয়। ১. ফরয ছালাত। যথা- মাগরিব ও এশার ছালাত। ২. নফল ছালাত তথা তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ।
মাগরিবের ছালাত :
মাগরিবের ছালাত তিন রাক‘আত ফরয।[30] সফরকালেও তিন রাক‘আতই পড়তে হয়।[31] সূর্যাস্তের পর মাগরিবের ছালাতের ওয়াক্ত হয়ে যায় এবং পশ্চিম আকাশে শাফাক্ব বা লাল আভা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত এর ওয়াক্ত অবশিষ্ট থাকে।
এশার ছালাত :
এশার ছালাত চার রাক‘আত ফরয।[32] মুছল্লীরা দ্রুত চলে আসলে তাড়াতাড়ি এবং বিলম্বে আসলে এশার জামা‘আত বিলম্বে করা যায়’।[33] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এশার ছালাত অর্ধ রাত পর্যন্ত বিলম্ব করে আদায় করতেন।[34] তবে যরূরী কারণ বশতঃ ফজরের পূর্ব পর্যন্ত এশার ছালাত আদায় করা জায়েয।[35] এশার ছালাতের ফযীলত হচ্ছে জামা‘আতের সাথে আদায় করলে অর্ধরাত্রি ছালাত আদায়ের ছওয়াব পাওয়া যায়।[36]
এশার ছালাত দেরী করে আদায় করা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পসন্দ করতেন। কষ্টকর না হ’লে এশার ছালাত রাতের এক-তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হওয়ার পর আদায় করা উত্তম।[37] আর মুনাফিকদের জন্য এশা ও ফজরের ছালাত আদায় করা অত্যন্ত কঠিন।[38]
মুসাফিরের জন্য মাগরিব ও এশার ছালাত জমা করা :
সফরে ছালাত ক্বছর ও জমা করা সুন্নাত। মু‘আয (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِىْ غَزْوَةِ تَبُوْكَ فَكَانَ يُصَلِّى الظُّهْرَ وَالْعَصْرَ جَمِيْعًا وَالْمَغْرِبَ وَالْعِشَاءَ جَمِيْعًا. ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে তাবূক যুদ্ধে বের হ’লাম। তিনি যোহর ও আছর ছালাত জমা (একত্রে) করে পড়তেন এবং মাগরিব ও এশা জমা করে আদায় করতেন।[39] মুকীম ব্যক্তিও বৃষ্টি, ভীতি ও বিশেষ কোন কারণে ছালাত জমা করতে পারেন।[40] ইবনু ওমর (রাঃ) বৃষ্টির সময় ছালাত জমা করে আদায় করতেন।[41]
এ সময় মাগরিব ও এশার ছালাতের মাঝে কোন সুন্নাত ছালাত আদায় করতে হবে না।[42]
মহিলারা রাতের আধারেও মসজিদে যেতে পারে :
মহিলাদের জন্য বাড়ীতে ছালাত আদায় করা উত্তম। তবে তারা মসজিদে গিয়েও ছালাত আদায় করতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের বাধা দেওয়া যাবে না। এমনকি রাস্তা নিরাপদ থাকলে তারা রাতেও মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করতে পারে। ইবনু ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে,إِذَا اسْتَأْذَنَكُمْ نِسَاؤُكُمْ بِاللَّيْلِ إِلَى الْمَسْجِدِ فَأْذَنُوا لَهُنَّ ‘তোমাদের স্ত্রীরা যদি রাতে মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায়ের অনুমতি চায়, তাহ’লে তোমরা তাদেরকে অনুমতি দিবে’।[43]
তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ :
তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই ছালাত। রামাযানে রাতের প্রথমাংশে এই নফল ছালাত আদায় করা হয়, এজন্য একে তারাবীহ বলা হয়। একে হাদীছের পরিভাষায় ‘ছালাতুল লায়ল’ ও ‘ক্বিয়ামে রামাযান’ বলা হয়। আর অন্য ১১ মাসে রাতের এই ছালাতকে ‘তাহাজ্জুদ’ বলা হয়। সুতরাং তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ পৃথক দু’টি ছালাত নয়।[44] এ ছালাত আদায় করার জন্য প্রত্যেক মুমিনের সচেষ্ট হওয়া উচিত। আবু উমামা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ فَإِنَّهُ دَأَبُ الصَّالِحِيْنَ قَبْلَكُمْ وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ وَمُكَفِّرَةٌ لِّلسَّيِّئَاتِ وَمَنْهَاةٌ عَنِ الْإِثْمِ- ‘তোমাদের জন্য ক্বিয়ামুল লায়ল বা রাতের ছালাত আদায় করা উচিত। রাতে ইবাদত করা হচ্ছে তোমাদের পূর্ববর্তী নেক লোকদের রীতি। তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের পন্থা, গুনাহ মাফের উপায় এবং অপরাধ, অশ্লীলতা হ’তে বিরত থাকার মাধ্যম’।[45] তিনি আরো বলেন,
رَحِمَ اللهُ رَجُلًا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّى ثُمَّ أَيْقَظَ امْرَأَتَهُ فَصَلَّتْ فَإِنْ أَبَتْ نَضَحَ فِيْ وَجْهِهَا الْمَاءَ وَرَحِمَ اللهُ امْرَأَةً قَامَتْ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّتْ ثُمَّ أَيْقَظَتْ زَوْجَهَا فَصَلَّى فَإِنْ أَبَى نَضَحَتْ فِيْ وَجْهِهِ الْمَاءَ-
‘আল্লাহ এমন ব্যক্তির প্রতি দয়া করেন যে ব্যক্তি রাতে উঠে ছালাত আদায় করে, স্বীয় স্ত্রীকেও জাগায় এবং সেও ছালাত আদায় করে। আর যদি সে উঠতে অস্বীকার করে তাহ’লে তার মুখের উপর পানি ছিটিয়ে দেয়। অনুরূপ আল্লাহ দয়া করেন সেই স্ত্রী লোকের প্রতি যে রাতে উঠে ছালাত আদায় করে। নিজের স্বামীকেও জাগায় এবং সেও ছালাত আদায় করে। আর যদি সে উঠতে অস্বীকার করে তাহ’লে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়’।[46] তিনি আরো বলেন,
إِنَّ فِي الْجَنَّةِ غُرَفًا يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرِهَا أَعَدَّهَا اللهُ لِمَنْ أَلَانَ الْكَلَامَ، وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَتَابَعَ الصِّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ-
‘জান্নাতের মধ্যে এমন মসৃণ প্রাসাদ রয়েছে যার বাইরের জিনিস সমূহ ভিতর হ’তে এবং ভিতরের জিনিস সমূহ বাহির হ’তে দেখা যায়। সেসব প্রাসাদ আল্লাহ এমন ব্যক্তির জন্য প্রস্ত্তত করে রেখেছেন যে ব্যক্তি মানুষের সাথে নরম কথা বলে, ক্ষুধার্তকে খেতে দেয়, নিয়মিত ছিয়াম পালন করে এবং রাতে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন ছালাত আদায় করে’।[47] অন্যত্র তিনি বলেন,إِذَا أَيْقَظَ الرَّجُلُ أَهْلَهُ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّيَا أَوْ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ جَمِيْعًا كُتِبَا فِي الذَّاكِرِيْنَ وَالذَّاكِرَاتِ- ‘যখন কোন ব্যক্তি রাতে স্বীয় স্ত্রীকে জাগায়, অতঃপর উভয়ে পৃথকভাবে অথবা একসাথে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণকারী ও স্মরণকারিণীদের অন্তর্ভুক্ত হয়’।[48]
রাত্রে যিকর-আযকার :
আল্লাহর যিকর করা ইবাদত। যা মুমিনের জন্য অতি উপকারী। আল্লাহ বলেন,وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِينَ ‘তুমি যিকর কর, কেননা যিকর মুমিনের উপকার করে’ (যারিয়াত ৫১/৫৫)। আল্লাহ আরো বলেন,الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ ‘(জ্ঞানী হ’ল সে সমস্ত লোক) যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আলে ইমরান ৩/১৯১)। আর রাত্রিকালে যিকর করার বিশেষ ফযীলত হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। ওবাদা বিন ছামিত (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَعَارَّ مِنَ اللَّيْلِ فَقَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ وَسُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ ثُمَّ قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِيْ أَوْ قَالَ ثُمَّ دَعَا اسْتُجِيْبَ لَهُ فَإِنْ تَوَضَّأَ وَصَلَّى قُبِلَتْ صَلَاتُهُ. ‘যে ব্যক্তি রাত্রে জেগে বলে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁরই রাজত্ব, তাঁরই জন্য প্রশংসা, তিনি সমস্ত বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান, আমি আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই, আল্লাহ অতি মহান, আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত আমার কোন শক্তি ও সামর্থ্য নেই’। অতঃপর বলে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমায়কে ক্ষমা কর। অতঃপর কোন প্রার্থনা করলে, আল্লাহ তার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেন এবং সে যদি ওযূ করে ছালাত আদায় করে, আল্লাহ তার সে ছালাত কবুল করেন’।[49]
উল্লেখ্য, আল্লাহর যিক্র করতে হবে নীরবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَاذْكُرْ رَبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ ‘তুমি তোমার প্রভুকে সকাল-সন্ধ্যায় আপন মনে অত্যন্ত বিনীত ও ভীত সন্ত্রস্তভাবে স্মরণ কর, উচ্চ শব্দে নয়’ (আ‘রাফ ৭/২০৫)। তিনি আরো বলেন,ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً ‘তোমাদের প্রভুকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এবং সংগোপনে ডাক’ (আ‘রাফ ৭/৫৫)। একদা এক সফরে ছাহাবীগণ আওয়াজ করে তাসবীহ পাঠ করলে রাসূল (ছাঃ) তাদের চুপে চুপে তাসবীহ পাঠের নির্দেশ দিয়ে বলেন ‘তোমরা এমন সত্তাকে ডাকছ যিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’।[50]
রাত্রে দো‘আ ও ইস্তেগফার :
রাতে এমন কিছু মুহূর্ত রয়েছে, যখন আল্লাহর দরবারে দো‘আ করলে, তা কবুল হয়। এজন্য রাতে জেগে আল্লাহর নিকটে দো‘আ করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা যরূরী। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُوْلُ مَنْ يَدْعُوْنِيْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِيْ فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَّسْتَغْفِرُنِيْ فَأَغْفِرَ لَهُ- ‘আমাদের প্রতিপালক প্রত্যেক রাতেই নিকটবর্তী আকাশে (১ম আকাশে) অবতীর্ণ হন, যখন রাতের শেষ তৃতীয় ভাগ অবশিষ্ট থাকে এবং বলতে থাকেন, কে আছে যে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে যে আমার নিকট কিছু চাইবে, আমি তাকে তা দান করব এবং কে আছে যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব’।[51] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, إنَّ فِي اللَّيْلِ لَسَاعَةً، لاَ يُوَافِقُهَا رَجُلٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ الله تَعَالَى خَيْراً مِّنْ أمْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ، إِلاَّ أعْطَاهُ إيَّاهُ، وَذَلِكَ كُلَّ لَيْلَةٍ- ‘রাত্রের মধ্যে এমন একটি সময় আছে, যদি কোন মুসলমান সে সময় লাভ করতে পারে এবং আল্লাহর নিকট ইহকাল ও পরকালের কোন কল্যাণ চায় আল্লাহ তাকে তা দান করেন। আর এই সময়টি প্রত্যেক রাতেই রয়েছে’।[52]
রাত্রিকালের আমলের পরিসমাপ্তি :
ফজরের ছালাত আদায়ের মাধ্যমে রাতের আমলের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফজর ছালাত আদায় না করলে মানুষ কলুষিত অন্তর নিয়ে জাগ্রত হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
يَعْقِدُ الشَّيْطَانُ عَلَى قَافِيَةِ رَأْسِ أَحَدِكُمْ إِذَا هُوَ نَامَ ثَلاَثَ عُقَدٍ، يَضْرِبُ كُلَّ عُقْدَةٍ عَلَيْكَ لَيْلٌ طَوِيلٌ فَارْقُدْ، فَإِنِ اسْتَيْقَظَ فَذَكَرَ اللهَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَإِنْ تَوَضَّأَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَإِنْ صَلَّى انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَأَصْبَحَ نَشِيطًا طَيِّبَ النَّفْسِ، وَإِلاَّ أَصْبَحَ خَبِيثَ النَّفْسِ كَسْلاَنَ-
‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন শয়তান তার ঘাড়ের পশ্চাদংশে তিনটি গিঁঠ দেয়। প্রতি গিঁঠে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত। অতএব তুমি শুয়ে থাক। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে তাহ’লে তার একটি গিঁঠ খুলে যায়। পরে ওযূ করলে আকেটি গিঁঠ খুলে যায়। অতঃপর ছালাত আদায় করলে আরেকটি গিঁঠ খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় প্রফুল্ল মনে ও নির্মল চিত্তে। অন্যথা সে সকালে উঠে কলুষিত মনে ও অলসতা নিয়ে’।[53]
পরিশেষে বলা যায়, মুমিন নারী-পুরুষকে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর স্মরণে, তাঁর বিধান মেনে ও রাসূলের দেখানো তরীকায় ব্যয় করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের আশায় বান্দার প্রতিটি কাজ সম্পাদিত হ’তে হবে। দিনের কর্মব্যস্ততায় মানুষ আল্লাহর ইবাদতে সময় কাটানোর সুযোগ কম পায়। কিন্তু মানুষ রাতে সাধারণত অবসর থাকে। এ সময় সে একাগ্রচিত্তে মহান আল্লাহর ইবাদত করতে পারে এবং তাঁর কাছে নিজের সকল আবেদন-নিবেদন ও চাওয়া-পাওয়া ব্যক্ত করতে পারে। তাই এ সময় যথাযথভাবে অতিবাহিত করার চেষ্টা করা যরূরী। আল্লাহ সবাইকে রাত্রিকালীন সময় তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যয় করার তাওফীক্ব দিন-আমীন!
– ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
[1]. দুখান ৪৪/৩; ক্বদর ৯৭/১; মুসনাদ আহমাদ ২/১১৩ পৃঃ।
[2]. বুখারী হা/৭৪৯৪; মুসলিম হা/৭৫৮।
[3]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/১০৫১; ছহীহাহ হা/২৫৩৯।
[4]. আবু দাঊদ হা/৫০৪২; মিশকাত হা/১২১৫, হাদীছ ছহীহ।
[5]. মুসলিম হা/৩০৪।
[6]. বুখারী হা/২৮৮; মুসলিম হা/৩০৫; আবুদাঊদ হা/২২২।
[7]. বায়হাক্বী ১/২০০; মুছন্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ ১০/৪৮; আদাবুয যিফাফ, পৃঃ ৪৬, সনদ ছহীহ।
[8]. বুখারী হা/২৯০; মুসলিম হা/৩০৬।
[9]. বুখারী হা/২৪৫।
[10]. বুখারী হা/৫৬১।
[11]. বুখারী হা/৫৫৯।
[12]. মুসলিম হা/৬১৩।
[13]. বুখারী হা/৫৭২; মুসলিম হা/৬১২।
[14]. বুখারী হা/৫৬৯, ৮৬৪; মুসলিম হা/৬১২-৬১৩।
[15]. বুখারী হা/৫৭১।
[16]. বুখারী হা/৬২৩।
[17]. বুখারী হা/৬১৭, ২৬৫৬।
[18]. নাসাঈ হা/২১৬৭, সনদ ছহীহ।
[19]. আহমাদ, আবু দাইদ, ইবনু মাজাহ; নাসাঈ, হা/৬৬৭; মিশকাত হা/৬৬৭, সনদ ছহীহ।
[20]. আবু দাউদ হা/৪৮৪৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৯১৫, সনদ ছহীহ।
[21]. বুখারী হা/২৪৭, ৬৩১১, ৬৩১৩; মুসলিম হা/২৭১০।
[22]. আবু দাউদ হা/৪৮৪৯; মিশকাত হা/২২৭২, সনদ ছহীহ।
[23]. বুখারী হা/৬৩১৫, ৬৩২৪; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৩৮২, ২৩৮৪, ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়।
[24]. বুখারী হা/৫০১৭, মুসলিম, মিশকাত হা/২১৩২।
[25]. তিরমিযী হা/২৯০৩; আহমাদ হা/১৭৪৫৩; আবুদাঊদ হা/১৫২৩; মিশকাত হা/৯৬৯।
[26]. বুখারী হা/৩২৭৫; মুসলিম হা/২৭২১; মিশকাত হা/২১১৩।
[27]. বুখারী হা/৪০০৮, ৫০৪০; মুসলিম হা/৮০৭; মিশকাত হা/২১২৫।
[28]. শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/২১৫৫, হাদীছ ছহীহ।
[29]. বুখারী হা/৩১১৩; মুসলিম হা/২৭২৭।
[30]. আবু দাউদ হা/১৯৩৩, সনদ ছহীহ।
[31]. তিরমিযী হা/৫৫২, সনদ ছহীহ, ছহীহ ইবনে হিববান ৪/১৮০; ছহীহ ইবনে খুযাইমা ২/৭১।
[32]. আহমাদ ৬/২৭২, হা/২৬৮৬৯; সনদ হাসান।
[33]. বুখারী হা/৫৬০।
[34]. বুখারী হা/৬৬১।
[35]. মুসলিম হা/১৫৬।
[36]. মুসলিম, মিশকাত হা/৬৩০।
[37]. বুখারী, মিশকাত হা/৫৯০-৯১।
[38]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৬২৯।
[39]. মুসলিম হা/৭০৬।
[40]. মুসলিম হা/৭০৫, ‘মুকীম অবস্থায় ছালাত জমা করা’ অনুচ্ছেদ।
[41]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৪৮১, ২/১৯৭।
[42]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৩৮।
[43]. বুখারী হা/৮৬৫।
[44]. নায়ল ২/২৯৫ পৃঃ; মির‘আতুল মাফাতীহ ২/২২৪ পৃঃ।
[45]. তিরমিযী, মিশকাত হা/১২২৭, হাদীছ ছহীহ।
[46]. নাসাঈ, মিশকাত হা/১২৩০।
[47]. বায়হাক্বী, মিশকাত হা/১২৩২, হাদীছ ছহীহ।
[48]. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১২৩৮, হাদীছ ছহীহ।
[49]. বুখারী হা/১১৫৪; মিশকাত হা/১১৪৫।
[50]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২৩০৩।
[51]. বুখারী হা/১১৪৫; মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩।
[52]. মুসলিম হা/৭৫৭; মিশকাত হা/১২২৪।
[53]. বুখারী হা/১১৪২; মুসলিম হা/৭৭৬।