বদর যুদ্ধ, ক্বিবলা পরিবর্তন ও ঈদ-উল-ফিতরের উৎসব
পূর্বের অংশ পড়ুন: রাসূল (ছাঃ) -এর মাদানী জীবন
বদর যুদ্ধের পরোক্ষ কারণ সমূহ :
২য় হিজরী সনের ১৭ই রামাযান (৬২৪ খৃঃ ১১ই মার্চ শুক্রবার (সুলায়মান মানছূরপুরী বলেন, ৩রা মার্চ মঙ্গলবার) ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যা ছিল মদীনায় হিজরতের মাত্র ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিন পরের ঘটনা। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মদীনা থেকে বের করে দেবার জন্য নানাবিধ অপচেষ্টা চালায়। যেমনভাবে তারা ইতিপূর্বে হাবশায় হিজরতকারী মুসলমানদের সেখান থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু সেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছিল প্রধানতঃ তিনটি কারণে। এক- সেখানে ছিল একজন ধর্মপরায়ণ খৃষ্টান বাদশাহ নাজ্জাশীর রাজত্ব। যিনি নিজে রাসূলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। দুই- মক্কা ও হাবশার মধ্যখানে ছিল আরব সাগরের একটি প্রশস্ত শাখা। যা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে হামলা করা সম্ভব ছিল না। তিন-হাবশার লোকেরা ছিল হিব্রুভাষী। তাদের সাথে কুরায়েশদের কোনরূপ আত্মীয়তা কিংবা পূর্ব পরিচয় ছিল না। ধর্ম, ভাষা ও অঞ্চলগত মিলও ছিল না।
পক্ষান্তরে ইয়াছরিব ছিল কুরায়েশদের খুবই পরিচিত এলাকা। যার উপর দিয়ে তারা নিয়মিতভাবে সিরিয়াতে ব্যবসার জন্য যাতায়াত করত। তাছাড়া তাদের সঙ্গে ভাষাগত মিল এবং আত্মীয়তাও ছিল। অধিকন্তু রাস্তা ছিল স্থলপথ, যেখানে নদী-নালার কোন বাধা নেই। দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি হ’লেও সেখানে যাতায়াতে তারা অভ্যস্ত ছিল। এক্ষণে আমরা বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পরোক্ষ কারণগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা করব।
(১) মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের নিকটে কুরায়েশ নেতাদের পত্র প্রেরণ। উল্লেখ্য যে, আব্দুল্লাহ তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। রাসূলের আগমনের কারণে তার ইয়াছরিবের নেতৃত্ব লাভের মোক্ষম সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় সে ছিল দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। রাসূলের প্রতি তার এই ক্ষোভটাকেই কুরায়েশরা কাজে লাগায় এবং নিম্নোক্ত কঠোর ভাষায় হুমকি দিয়ে তার নিকটে চিঠি পাঠায়।-
انكم آويتم صاحبنا وإنا نقسم بالله تقاتله أو لتجرجنه أو لنسيرن إليكم بأجمعنا حتى نقتل مقاتلتكم ونستبيح نساءكم-
‘তোমরা আমাদের লোকটিকে (মুহাম্মাদকে) আশ্রয় দিয়েছ। এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, হয় তোমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ও তাকে বের করে দিবে অথবা আমরা তোমাদের উপরে সর্বশক্তি নিয়ে হামলা করব এবং তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা করব ও মহিলাদের হালাল করে নেব’।
এই পত্র পেয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই দ্রুত তার সমমনাদের সাথে গোপনে বৈঠকে বসে গেল। কিন্তু সংবাদ রাসূলের নিকটে পৌঁছে গেল। তিনি সরাসরি তাদের বৈঠকে এসে হাযির হ’লেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি দেখছি কুরায়েশদের হুমকিকে তোমরা দারুণভাবে গ্রহণ করেছ। অথচ এর মাধ্যমে তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছ, কুরায়েশরা তোমাদের সেই পরিমাণ ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না। أتريدون أن تقاتلوا أبناءكم وإخوانكم ‘তোমরা কি তোমাদের সন্তান ও ভাইদের সাথে (অর্থাৎ মুসলমানদের সাথে) যুদ্ধ করতে চাও’? রাসূলের মুখে এ বক্তব্য শুনে বৈঠক ভেঙ্গে গেল ও দল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।[1] যদিও আব্দুল্লাহর অন্তরে হিংসার আগুন জ্বলতে থাকল। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুনাফিক ও ইহুদীদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলতে থাকেন। যাতে হিংসার আগুন জ্বলে না ওঠে।
(২) আওস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) ওমরাহ করার জন্য মক্কায় যান ও কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের অতিথি হন। উমাইয়ার ব্যবস্থাপনায় দুপুরে নিরিবিলি ত্বাওয়াফ করতে দেখে আবু জাহল তাকে ধমকের সুরে বলে, ألا أراك تطوف بمكة آمنا وقد آويتم الصباة؟ তোমাকে দেখছি মক্কায় বড় নিরাপদে ত্বাওয়াফ করছ। অথচ তোমরা বেদ্বীনগুলোকে আশ্রয় দিয়েছ! … আল্লাহর কসম! যদি তুমি আবু ছাফওয়ানের (উমাইয়া বিন খালাফের) সাথে না থাকতে, তবে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে না’। একথা শুনে সা‘দ চীৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, তুমি আমাকে এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ালে আমি তোমার জন্য এর চেয়ে কঠিন বাধা হয়ে দাড়াবো- আর সেটা হ’ল মদীনা হয়ে তোমাদের ব্যবসায়ের রাস্তা বন্ধ হবে’।[2]
(৩) কুরায়েশ নেতারা ইহুদীদের সাথে গোপনে অাঁতাত করলো। অতঃপর মুহাজিরগণের নিকটে হুমকি পাঠালো এই মর্মে যে, ‘মক্কা থেকে তোমরা নিরাপদে ইয়াছরিবে পালিয়ে যেতে পেরেছ বলে অহংকারে ফেটে পড়ো না। ওখানে গিয়েই আমরা তোমাদের ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা রাখি’। তাদের এই হুমকি কেবল ফাঁকা বুলি ছিল না। বরং তারা হর-হামেশা তৎপর ছিল মুহাজিরগণের সর্বনাশ করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতেন না। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রায়ই বিনিদ্র রজনী কাটাতেন। এক রাতে তিনি বললেন, لَيْتَ رَجُلاً صَالِحًا مِنْ أَصْحَابِىْ يَحْرِسُنِى اللَّيْلَةَ، ‘যদি আমার ছাহাবীগণের মধ্যে যোগ্য কেউ এসে আমাকে রাতে পাহারা দিত’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমরা এই অবস্থায় (আতংকের মধ্যে) কাটাচ্ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে? জবাব এল, আমি সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কি উদ্দেশ্যে আগমন? সা‘দ বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে আমার অন্তরে ভয় উপস্থিত হ’ল। তাই এসেছি তাঁকে পাহারা দেবার জন্য। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন ও ঘুমিয়ে গেলেন’।[3] এরপর থেকে এরূপ পাহারাদারির ব্যবস্থা নিয়মিত চলতে থাকে। যতক্ষণ না নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়- وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ، ‘আল্লাহ তোমাকে লোকদের হামলা থেকে রক্ষা করবেন’।[4] উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ انْصَرِفُوْا عَنِّى فَقَدْ عَصَمَنِى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ، ‘হে লোকেরা! তোমরা ফিরে যাও! মহান আললাহ আমাকে নিরাপত্তা দান করেছেন’। কুরায়েশদের অপতৎপরতা কেবল রাসূলের বিরুদ্ধেই ছিল না; বরং প্রত্যেক মুহাজির মুসলমানের বিরুদ্ধে ছিল। যেজন্য তারা সর্বদা ভয়ের মধ্যে থাকতেন এবং রাতের বেলা অস্ত্র নিয়ে ঘুমাতেন। যেমনটি হযরত উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে।
এ সময় ভীত-শংকিত ছাহাবীগণ রাসূলকে বলতে থাকেন, হে রাসূল! আমরা কি চিরকাল এভাবে ভয় ও ত্রাসের মধ্যে কাটাবো? জবাবে আয়াত নাযিল হয়- أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوْا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوْا حَتَّى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيْبٌ- ‘তোমরা কি ভেবেছ জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের উপরে এখনো সেইসব লোকদের মত অবস্থা আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে গত হয়ে গেছেন। যাদের উপরে এসেছিল নানাবিধ কষ্ট ও বিপদাপদ। আর সেই ভূমিকম্প সদৃশ বিপদে গ্রেফতার হয়ে তৎকালীন রাসূল ও তাঁর ঈমানদার সাথীগণ বলে উঠেছিলেন, مَتَى نَصْرُ اللهِ ‘কখন আল্লাহর সাহায্য পাব’। (তখনই সান্ত্বনা দিয়ে নাযিল হয়েছিল) أَلاَ إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيْبٌ، শোনো! আল্লাহর সাহায্য অতীব নিকটবর্তী’ (বাক্বারাহ ২/২১৪)। হাঁ আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী হ’ল। তবে তা অলৌকিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে নয় বরং মুসলমানদেরকে তাদের নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে। তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের অনুমতি দেওয়া হ’ল, যার পিছনে আল্লাহর সাহায্য ক্রিয়াশীল ছিল।
যুদ্ধের অনুমতি :
কুরায়েশদের সন্ত্রাসমূলক অপতৎপরতা ও প্রকাশ্যে হামলা সমূহ মুকাবিলার জন্য আল্লাহ পাক মুসলমানদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে এ সময় নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন, أُذِنَ لِلَّذِيْنَ يُقَاتَلُوْنَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوْا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيْرٌ- ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হ’ল ঐ লোকদের। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, একারণে যে, তারা অত্যাচারিত হয়েছে। আর তাদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে অবশ্যই আল্লাহ ক্ষমতাবান’ (হজ্জ ২২/৩৯)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটাই প্রথম আয়াত, যা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে নাযিল হয়।[5] আর জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল সমাজ থেকে যুলুম ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করা। যেমন পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيْهَا اسْمُ اللهِ كَثِيْراً وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ- ‘যদি আল্লাহ মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে খৃষ্টানদের নিরিবিলি গীর্জাসমূহ, তাদের সাধারণ উপাসনালয় সমূহ, ইহুদীদের উপাসনালয় সমূহ এবং মুসলমানদের মসজিদ সমূহ ধ্বংস হয়ে যেত। যেগুলোতে আল্লাহর নাম অধিক হারে স্মরণ করা হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেন, যারা আল্লাহকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা শক্তিধর ও পরাক্রান্ত’ (হজ্জ ২২/৪০)।
অন্যত্র আল্লাহ জালূত ও তালূত প্রসঙ্গে বলেন, وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الأَرْضُ وَلَـكِنَّ اللهَ ذُوْ فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِيْنَ- ‘যদি আল্লাহ একজনকে আরেকজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে গোটা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু বিশ্ববাসীর প্রতি আল্লাহ একান্তই দয়ালু ও করুণাময়’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)।
বস্ত্ততঃ জিহাদ হয়ে থাকে সন্ত্রাস দমনের জন্য। আর সন্ত্রাস হয় সমাজ ধ্বংসের জন্য। এই যুদ্ধ বা সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি দানের কারণ ছিল তিনটি :
(১) মুসলমানেরা ছিল মযলূম এবং হামলাকারীরা ছিল যালেম।
(২) মুহাজিরগণ ছিলেন নিজেদের জন্মস্থান ও বাসগৃহ হ’তে বিতাড়িত তাদের মাল-সম্পদ ছিল লুণ্ঠিত। তারা ছিলেন অপমানিত ও লাঞ্ছিত। স্রেফ বিশ্বাসগত পার্থক্যের কারণে। দুনিয়াবী কোন স্বার্থের কারণে নয় (হজ্জ ৪০)।
(৩) মদীনা ও আশপাশের গোত্রসমূহের সাথে রাসূলের সন্ধিচুক্তি ছিল। যাতে পরস্পরের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছিল। এক্ষণে পূর্বের ধারণা ও রীতি-নীতি পরিবর্তন করে মুসলমান হওয়ার কারণে অথবা মুসলমানদের সহযোগী হওয়ার কারণে যদি তাদের উপরে হামলা হয়, তাহ’লে চুক্তি ও সন্ধি রক্ষার স্বার্থে তাদের জান-মালের হেফাযতের জন্য রাসূলকে যালেমদের হামলা প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়াটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল। ফলে অসহায় মুসলমানদের বাধ্যগত অবস্থার প্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক তাদেরকে সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি প্রদান করেন। মুবারকপুরী বলেন, সঠিক কথা এই যে, জিহাদের এই অনুমতি হিজরতের পরে মদীনাতেই নাযিল হয়েছিল। এরপর ১ম হিজরীর রামাযান মাস থেকে কুরায়েশদের হামলা প্রতিরোধে মদীনার বাইরে নিয়মিত সশস্ত্র টহল অভিযান সমূহ প্রেরিত হয়ে থাকে। যা একবছর অব্যাহত থাকে। অতঃপর ২য় হিজরীর শা‘বানে নাখলা যুদ্ধের পর বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে জিহাদ ফরয হয় এবং উক্ত মর্মে সূরা বাক্বারার ২/১৯০-১৯৩ এবং সূরা মুহাম্মাদ ৪৭/৪-৭ ও ২০ আয়াত সমূহ নাযিল হয়।
বদর যুদ্ধের পূর্বেকার অভিযান সমূহ :
যুদ্ধের অনুমতি সংক্রান্ত আয়াত নাযিলের পরে কুরায়েশ বাহিনীর মুকাবিলার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা থেকে মদীনাভিমুখী রাস্তাগুলিতে নিয়মিত টহল অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তাঁর কৃত সন্ধি চুক্তি সমূহ খুবই ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়। যার এলাকা সমূহ মদীনা হ’তে মক্কার দিকে তিন মনযিল অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এইসব অভিযানের যেগুলিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বয়ং অংশ গ্রহণ করতেন, সেগুলিকে ‘গাযওয়াহ’ (غزوة) এবং যেগুলিতে নিজে যেতেন না, বরং অন্যদের পাঠাতেন, সেগুলিকে সারিইয়াহ (سريه) বলা হয়। এইসব অভিযানে যুদ্ধ প্রস্ত্ততি নিয়ে বের হ’লেও বলতে গেলে কোনটাতেই যুদ্ধ হয়নি। তবে মক্কায় খবর হয়ে গিয়েছিল যে, কুরায়েশদের হুমকিতে মুহাজিরগণ ভীত নন, বরং তারা সদা প্রস্ত্তত।
উল্লেখ্য যে, সকল অভিযানেই পতাকা থাকতো সাদা রংয়ের এবং পতাকাবাহী সেনাপতি থাকতেন পৃথক ব্যক্তি। এক্ষণে এই সময়ের মধ্যে প্রেরিত অভিযান সমূহ বিবৃত হ’ল, যা নিম্নরূপ-
(১) সারিইয়াতু সীফিল বাহর (سرية سيف البحر) বা সমুদ্রোপকুলে প্রেরিত বাহিনী : ১ম হিজরী সনের রামাযান মাসে (মার্চ ৬২৩ খৃঃ) হযরত হামযাহ্-র নেতৃত্বে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট এই মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয় সিরিয়া হ’তে আবু জাহলের নেতৃত্বে প্রত্যাবর্তনকারী তিনশত সদস্যের কুরায়েশ কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। উভয় বাহিনী মুখোমুখি হ’লেও জুহায়শ গোত্রের নেতা মাজদী ইবনু আমর, যিনি ছিলেন উভয় দলের মিত্র, তাঁর চেষ্টায় যুদ্ধ হ’তে পারেনি।
(২) সারিইয়াতু রাবেগ (سرية رابغ) : ১ম হিজরীর শাওয়াল মাসে ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ ইবনু মুত্ত্বালিব-এর নেতৃত্বে ৬০ জনের এই মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয়। এই অভিযানে রাবেগ উপত্যকায় আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ২০০ লোকের বাহিনীর মুখোমুখি হ’লে উভয় পক্ষে কিছু তীর নিক্ষেপ ব্যতীত তেমন কিছু ঘটেনি। তবে মাক্কী বাহিনী থেকে দু’জন দল ত্যাগ করে মুসলিম বাহিনীতে চলে আসেন। যারা গোপনে মুসলমান ছিলেন। যাদের একজন হ’লেন মিক্বদাদ বিন আমর এবং অন্যজন হ’লেন উৎবাহ বিন গাযওয়ান।
(৩) সারিইয়াহ খাররার (سرية الخرّار) : ১ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্ক্বাছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ২০ জনের এই মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয় কুরায়েশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। তারা জুহফার নিকটবর্তী খাররার উপত্যকা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসেন। কেননা মক্কার কাফেলা এখান থেকে একদিন আগেই চলে গিয়েছিল। মানছূরপুরী ঐ স্থানের নাম যাররার (ضرار) বলেছেন।
(৪) গাযওয়া ওয়াদ্দান (غزوة ودَّان) : ২য় হিজরীর ছফর মাসে মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বপ্রথম এই অভিযানে নিজেই নেতৃত্ব দেন, যাতে ৭০ জন মুহাজির ছিলেন। মদীনা থেকে ২৯ মাইল দূরবর্তী এই অভিযানে তিনি ১৫ দিন মদীনার বাইরে ছিলেন এবং যাওয়ার সময় খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহকে মদীনায় প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে যান। এই অভিযানেরও উদ্দেশ্য ছিল কুরায়েশ কাফেলার পথরোধ করা। কিন্তু বাস্তবে তাদের দেখা মেলেনি। তবে এই সফরে লাভ হয় এই যে, তিনি স্থানীয় বনু যামরাহ গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনে সমর্থ হন। এই চুক্তি সম্পর্কে মানুছূরপুরী বলেন, সে চুক্তিটি এ মর্মে হয় যে, তারা মুসলমান ও কুরায়েশ কোন পক্ষকে সাহায্য করবে না।[6] কিন্তু মুবারকপুরী চুক্তিনামাটি উদ্ধৃত করেছেন এই মর্মে যে, উভয় পক্ষ পরস্পরকে সাহায্য করবে।[7]
(৫) গাযওয়ায়ে বুওয়াত্ব (غزوة بواط) : ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মুতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে দু’শো ছাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং এ অভিযানে বের হন। উমাইয়া বিন খালাফের নেতৃত্বে একশ’ জনের কুরায়েশ কাফেলার গতিরোধ করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। কিন্তু কোন সংঘর্ষ হয়নি। এই অভিযানে বের হওয়ার সময় তিনি আওস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-কে মদীনার দায়িত্ব দিয়ে যান।
(৬) গাযওয়ায়ে সাফওয়ান (غزوة سفوان) : একই মাসে মক্কার নেতা কুরয বিন জাবের ফিহরী মদীনার চারণ ভূমি থেকে গবাদি-পশু লুট করে পালিয়ে গেলে ৭০ জন ছাহাবীকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেই তার পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং বদর প্রান্তরের কাছাকাছি সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত ধাওয়া করেন। কিন্তু লুটেরাদের ধরতে ব্যর্থ হন। এই অভিযানকে অনেকে গাযওয়ায়ে বদরে ঊলা বা বদরের প্রথম যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। এই সময় মদীনার আমীর ছিলেন যায়েদ ইবনু হারেছাহ (রাঃ)। উল্লেখ্য যে, এটাই ছিল মদীনার উপকণ্ঠে কুরায়েশদের প্রথম হামলা।
(৭) গাযওয়ায়ে যুল-‘উশাইরাহ (غزوة ذى العشيرة) : ২য় হিজরীর জুমাদাল ঊলা ও আখেরাহ মুতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে দেড়শ বা দু’শো ছাহাবীর একটি দল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি মূল্যবান রসদবাহী কুরায়েশ কাফেলার গতিরোধে বের হন। কিন্তু ইয়াম্বু‘-এর পার্শ্ববর্তী উশায়রা পর্যন্ত গিয়েও তাদের ধরতে ব্যর্থ হন। এ সময় মদীনার আমীর ছিলেন আবু সালামাহ (রাঃ)। এই কুরায়েশ কাফেলাটি বহাল তবিয়তে মক্কায় ফিরে যায় এবং এর ফলেই বদর যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয়। এই অভিযানকালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বনু মুদলিজ ও তাদের মিত্র বনু যামরাহর সাথে ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি সম্পাদন করেন।
(৮) সারিইয়াহ নাখলা (سرية نخلة) : ২য় হিজরীর রজব মাসে মোতাবেক ৬২৪ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে আব্দুল্লাহ বিন জাহশের নেতৃত্বে মাত্র ১২ জন ছাহাবীর একটি ক্ষুদ্র দল প্রেরিত হয়। তারা নাখলা উপত্যকায় পৌঁছে একটি কুরায়েশ কাফেলাকে আক্রমণ করেন ও তাদের নেতা আমর ইবনুল হাযরামীকে হত্যা করে দু’জন বন্দী সহ গনীমতের মালামাল নিয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বন্দীদের মুক্তি দেন ও নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের রক্ত মূল্য দেন। কেননা ঘটনাটি ঘটেছিল রজবের হারাম মাসের শেষ দিনে। এ সময় মুসলমানেরা হারাম মাসের বিধান লংঘন করেছে বলে মুশরিকদের রটনার জবাবে সূরা বাক্বারাহ ২১৭ নং আয়াতটি নাযিল হয়। তাতে বলা হয় যে, মুসলমানদের এই কাজের তুলনায় মুশরিকদের অপকর্ম সমূহ বহু গুণ বেশী অপরাধজনক। উল্লেখ্য যে, এর পরেই জিহাদ ফরয করে সূরা বাক্বারাহ ১৯০-১৯৩ এবং সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ ও ২০ আয়াত সমূহ নাযিল হয়। অতঃপর রামাযানে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
শেষোক্ত অভিযানে কুরায়েশদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। তারা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, তাদের আশংকাই সত্যে পরিণত হ’তে যাচ্ছে এবং মদীনা তাদের জন্য এখন বিপদ সংকুল এলাকায় পরিণত হয়েছে। তারা এটাও বুঝে নিল যে, যেকোন সময় মুহাজিরগণ মক্কা আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের হটকারিতা ও উদ্ধত আচরণ থেকে তারা বিরত হ’ল না। তারা সন্ধির পথে না গিয়ে যুদ্ধের পথ বেছে নিল এবং মদীনায় হামলা করে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলার উদ্দেশ্যে বদর যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
ক্বিবলা পরিবর্তন :
নাখ্লা অভিযান শেষ হবার পরেই ২য় হিজরীর শা‘বান মুতাবিক ৬২৪ খৃঃ ফেব্রুয়ারী মাসে ক্বিবলা পরিবর্তনের আদেশ সূচক আয়াতটি (বাক্বারাহ ১৪৪) নাযিল হয়। যাতে ১৬/১৭ মাস পরে বায়তুল মুক্বাদ্দাস হ’তে কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছালাত আদায়ের নির্দেশ জারি করা হয়। এই হুকুম নাযিলের মাধ্যমে কপট ইহুদীদের মুখোশ খুলে গেল। যারা মুসলমানদের কাতারে শামিল হয়েছিল স্রেফ ফাটল ধরানো ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য। এখন তারা তাদের নিজস্ব অবস্থানে ফিরে গেল এবং মুসলমানেরাও তাদের কপটতা ও খেয়ানত থেকে বেঁচে গেল। অন্যদিকে এর মধ্যে মুসলমানদের জন্য সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ছিল যে, এখন থেকে একটি নতুন যুগের সূচনা হ’তে যাচ্ছে, যা ফেলে আসা ক্বিবলা কা‘বা গৃহের উপরে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। একই সময়ে সূরা বাক্বারাহ ১৯০-১৯৩ আয়াত নাযিল হয়। যাতে বলা হয় وَأَخْرِجُوْهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوْكُمْ ‘যে স্থান হ’তে তারা তোমাদের বহিষ্কার করেছে, সে স্থান হ’তে তোমরাও তাদের বহিষ্কার কর’। অতঃপর যুদ্ধের নিয়মবিধি নাযিল হয় সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ আয়াতে। অতঃপর যুদ্ধ হ’তে ভীরু-কাপুরুষদের নিন্দা করে একই সূরার ২০ নং আয়াত নাযিল হয়। একই সময়ে পরপর এসব আয়াত নাযিলের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, হক ও বাতিলের মধ্যে একটা চূড়ান্ত বুঝাপড়ার সময়কাল অত্যাসন্ন। কেননা আল্লাহ কখনোই চান না যে, তাঁর পবিত্র গৃহ নাপাক মুশরিক ও পৌত্তলিকদের দখলীভুক্ত হয়ে থাকুক। বলা বাহুল্য ক্বিবলা পরিবর্তনের হুকুম নাযিলের পরে রাসূলের মধ্যে এবং সাধারণভাবে সকল মুসলমানের মধ্যে আশা ও আনন্দের ঢেউ জেগে ওঠে এবং তাদের অন্তরে মক্কায় ফিরে যাওয়ার আকাংখা ও উদ্দীপনা তীব্র হয়ে ওঠে, যা আসন্ন বদর যুদ্ধে তাদেরকে বিজয়ী হ’তে সাহায্য করে।
বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিরিয়া ফেরত মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাদের পুরা খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তালহা বিন উবায়দুল্লাহ ও সাঈদ বিন যায়েদকে প্রেরণ করেন। তারা ‘হাওরা’ (الحوراء) নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বিরাট এক ব্যবসায়ী কাফেলা সতবর ঐ স্থান অতিক্রম করবে; যাতে রয়েছে এক হাযার উট বোঝাই কমপক্ষে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রার মাল-সম্পদ এবং তাদের প্রহরায় রয়েছে আমর ইবনুল আছ সহ মাত্র ৪০ জন সশস্ত্র জোয়ান। উল্লেখ্য যে, এই বাণিজ্যে মক্কার সকল নারী-পুরুষ অংশীদার ছিল। তারা দ্রুত মদীনায় ফিরে এসে রাসূলকে এই খবর দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চিন্তা করলেন যে, এই বিপুল মাল-সম্পদ মক্কায় পৌঁছে গেলে তার প্রায় সবই ব্যবহার করা হবে মদীনায় মুহাজিরগণকে ধ্বংস করার কাজে। অতএব আর মোটেই কালক্ষেপন না করে তখনই বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন ওই কাফেলাকে আটকানোর জন্য।
বদর যুদ্ধের বিবরণ :
মাদানী বাহিনীর অগ্রযাত্রা : ২য় হিজরীর ১৭ রামাযান ৬২৪ খৃঃ ১১ মার্চ শুক্রবার (মানছূরপুরী ৩ মার্চ মঙ্গলবার বলেছেন)। বিগত অভিযানগুলির ন্যায় এ অভিযানেরও উদ্দেশ্য ছিল কুরায়েশ কাফেলাকে আটকানো। তাই অন্যান্য অভিযানের মতই এটাকে ভাবা হয়েছিল। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কাউকে অভিযানে যেতে বাধ্য করেননি। অবশেষে ৮ অথবা ১২ই রামাযান তারিখে ৩১৩, ১৪ বা ১৭ জনের কাফেলা নিয়ে সাধারণ প্রস্ত্ততি সহ তিনি রওয়ানা হ’লেন। যার মধ্যে ৮২, ৮৩ বা ৮৬ জন ছিলেন মুহাজির এবং বাকীগণ ছিলেন আনছার। আনছারগণের মধ্যে ৬১ জন ছিলেন আউস গোত্রের এবং ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজের। বি’রে সুক্বইয়া নামক স্থানে এসে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ক্বায়েস ইবনু আবী ছা‘ছা‘কে সংখ্যা গণনা করতে বললেন। পরে সংখ্যা জানতে পেরে রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বললেন, তালূতের সৈন্য সংখ্যাও তাই ছিল। এটা বিজয়ের লক্ষণ। তিন শতাধিক লোকের এই বাহিনীতে মাত্র ২টি ঘোড়া ছিল যুবায়ের ইবনুল আওয়াম এবং মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদের এবং ৭০টি উট ছিল। যাতে দু’তিন জন করে পালাক্রমে সওয়ার হয়ে চলতে হ’ত। রাসূল (ছাঃ), আলী ও মারছাদ বিন আবী মারছাদ গানাভীর জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। যাতে পায়ে হাঁটার পালা আসলে রাসূল (ছাঃ) নিজেও হাঁটতেন। এ সময় মদীনায় আমীর নিযুক্ত হন অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম। পরে ‘রাওহা’ بئر الروحاء নামক স্থানে পৌঁছে আবু লুবাবা ইবনু আবদিল মুনযিরকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করে পাঠানো হয়। অপর পক্ষে কাফেলার পতাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মদীনার প্রথম দাঈ মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে। ইতিপূর্বেকার সকল পতাকার ন্যায় আজকের এ পতাকাও ছিল শ্বেত বর্ণের। ডান বাহুর সেনাপতি নিযুক্ত হন যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম এবং বাম বাহুর জন্য মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ)। পুরা বাহিনীতে এ দু’জনেরই মাত্র দু’টি ঘোড়া ছিল। আর পশ্চাদ্ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত হন ক্বায়েস ইবনু আবী ছা‘ছা‘আহ (রাঃ)। এতদ্ব্যতীত মুহাজিরগণের পতাকা বাহক হন আলী (রাঃ) এবং আনছারগণের সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ)। আর সার্বিক কম্যান্ডের দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)।
কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা :
অন্যদিকে কুরায়েশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছিলেন। যাকেই পেতেন, তাকেই মদীনা বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি একটি সূত্রে জানতে পারলেন যে, কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য মুহাম্মাদ নির্দেশ দিয়েছেন। এ সংবাদে ভীত হয়ে আবু সুফিয়ান একজনকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন, যাতে দ্রুত সাহায্যকারী বাহিনী পৌঁছে যায়। এরপর বদর প্রান্তর অতিক্রম করার আগেই তিনি কাফেলা থামিয়ে দিয়ে নিজে অগ্রসর হন ও মদীনা বাহিনীর খবর নেন এবং জানতে পারেন যে, দু’জন উষ্ট্রারোহীকে তারা দেখেছিল, যারা টিলার পাশে তাদের উট বসিয়ে মশকে পানি ভরে নিয়ে চলে গেছে। সুচতুর আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে টিলার পাশে গিয়ে উটের গোবর থেকে খেজুরের অাঁটি খুঁজে পেয়ে বুঝে নিলেন যে, এটি মদীনার উট। ব্যস! তখনই ফিরে এসে কাফেলাকে নিয়ে বদরের পথ ছেড়ে ডান দিক দিয়ে উপকূলের পথে চলে গেলেন এবং এভাবে তিনি স্বীয় কাফেলাকে মদীনা বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হ’লেন। অতঃপর তিনি নিরাপদে পার হয়ে আসার খবর মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। যাতে ইতিপূর্বে পাঠানো খবরের রেশ ধরে তারা অহেতুক যুদ্ধে বের না হয়।
মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রা :
কিন্তু এখবর যখন পৌঁছল, তখন আবু জাহলের নেতৃত্বে ১৩০০ মাক্কী ফৌজ রওয়ানা হয়ে জুহফা নামক স্থানে পৌঁছে গেছে। অতঃপর আবু সুফিয়ানের এ খবর পেয়ে মাক্কী বাহিনীর সবাই মক্কায় ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করল। কিন্তু আবু জাহলের অহংকারের ফলে কারু মতামত গ্রাহ্য হ’ল না। তবু তার আদেশ অগ্রাহ্য করে আখনাস ইবনে শুরায়েক্ব (الاخنس بن شريق) -এর নেতৃত্বে বনু যোহরা (بنو زهرة) গোত্রের ৩০০ লোক মক্কায় ফিরে গেল। বনু হাশেমও ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু মুহাম্মাদ-এর স্বগোত্র হওয়ায় তাদের উপরে আবু জাহলের কঠোরতা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশী। ফলে তারা ক্ষান্ত হন। অতঃপর আবু জাহল বদর অভিমুখে রওয়ানা হন এবং দর্পভরে বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা বদরে যাব ও সেখানে তিনদিন থাকব ও আমোদ-ফূর্তি করে পান ভোজন করব। এর ফলে সমগ্র আরব জাতির উপরে আমাদের শক্তি প্রকাশিত হবে ও সকলে ভীত হবে। এই সময় সব মিলিয়ে মাক্কী বাহিনীতে এক হাযার ফৌজ ছিল। তন্মধ্যে দু’শো অশ্বারোহী, ছয়শো লৌহবর্ম ধারী এবং গায়িকা বাঁদী দল তাদের বাদ্যযন্ত্রাদি সহ ছিল। প্রতি মনযিলে খাদ্যের জন্য তারা ১০টি করে উট যবেহ করত। উল্লেখ্য যে, মাক্কী বাহিনীতে বনু ‘আদী ব্যতীত মক্কার সকল গোত্রের লোক বা তাদের প্রতিনিধি যোগদান করেছিল। অথবা যোগদানে বাধ্য করা হয়েছিল। যেমন রাসূলের চাচা আববাস, হযরত আলীর দু’ভাই তালেব ও আক্বীল। রাসূলের জামাতা আবুল ‘আছ সহ বনু হাশেমের লোকেরা। কেননা আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলায় সকল গোত্রের লোকদের মালামাল ছিল।[8]
রওয়ানাকালে আবু জাহল ও ইবলীসের ভূমিকা :
আবু জাহল মক্কা থেকে রওয়ানার সময় দলবল নিয়ে কা‘বা গৃহের গেলাফ ধরে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছিল,
اللهم انصر أقرانا للضيف وأوصلَنا للرحم وأفكَّنا للعاني، إن كان محمد على حق فانصره وان كنا على حق فانصرنا وروي انهم قالوا اللهم انصرنا أعلى الجندين وأهدى الفئتين واكرم الحزبين-
‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের মধ্যে সর্বাধিক অতিথি আপ্যায়নকারী, সর্বাধিক আত্মীয়তা রক্ষাকারী ও বন্দী মুক্তি দানকারী দলকে’। ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ যদি সত্যের উপরে থাকে তবে তুমি তাকে সাহায্য কর, আর যদি আমরা সত্যের উপর থাকি, তবে আমাদেরকে সাহায্য কর’। হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের দু’দলের মধ্যকার সেরা সেনাদলকে, সেরা হেদায়াত প্রাপ্ত ও সেরা সম্মানিত দলকে’।[9] এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আবু জাহল আল্লাহকে সর্বশক্তিমান হিসাবে বিশ্বাস করত। একে তওহীদে রুবূবিয়াত বলা হয়। এর ফলে কেউ মুসলমান হ’তে পারে না। কেননা মুসলিম হওয়ার জন্য তওহীদে ইবাদতের উপরে ঈমান আনা যরূরী।
অতঃপর রওয়ানা হওয়ার পরে তাদের মনে পড়ল বনু বকর গোত্রের কথা, যাদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল। পথিমধ্যে তারা হামলা করতে পারে। ফলে মাক্কী বাহিনী দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কিন্তু ইবলীস এ সময় বনু কিনানাহ গোত্রের নেতা সুরাক্বাহ বিন মালেক বিন জু‘শুম মুদলিজীর রূপ ধারণ করে এসে বলল, আমিও তোমাদের বন্ধু। আমি তোমাদের নিরাপত্তার যামিন হচ্ছি। এই আশ্বাস পাওয়ার পর কুরায়েশগণ মদীনাভিমুখে খুব দ্রুত বেগে বদর প্রান্তরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়।
মাদানী বাহিনীর অবস্থান ও পরামর্শ সভা :
আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলার নিরাপদে নিষ্ক্রমন এবং আবু জাহলের নেতৃত্বে মাক্কী বাহিনীর দ্রুত ধেয়ে আসা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাফরানে (ذفران) অবস্থান কালেই যথাসময়ে অবহিত হন। এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি এবং অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুকাবিলা কিভাবে করা যায়, এ নিয়ে তিনি উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ বৈঠক আহবান করলেন।
মুহাজিরগণের মধ্যে হযরত আবুবকর ও ওমর (রাঃ) তাদের মূল্যবান পরামর্শ দান করলেন। অতঃপর মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) দাঁড়িয়ে ওজস্বিনী ভাষায় বললেন, يارسول الله امض لما أراك الله فنحن معك والله لا نقول لك كما قالت بنو اسرائيل لموسى اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দেখানো পথে আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐরূপ বলব না, যেরূপ বনু ইস্রাঈল তাদের নবী মূসাকে বলেছিল যে, ‘তুমি ও তোমার রব যাও যুদ্ধ করগে! আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। বরং আমরা বলব, اذهب انت وربك فقاتلا انا معكما مقاتلون، ‘আপনি ও আপনার রব যান ও যুদ্ধ করুন, আমরা আপনাদের সাহায্যে যুদ্ধরত থাকব’।فو الذى بعثك بالحق لوسرت بنا إلى برك الغماد لجادلنا معك من دونه حتى تبلغه، সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে আবিসিনিয়ার ‘বারকুল গিমাদ’ (برك الغماد) পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাব’। মিক্বদাদের এই জোরালো বক্তব্য শুনে আল্লাহর রাসূল খুবই প্রীত হ’লেন এবং তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন’ (دعا له بخير)।[10]
সংখ্যালঘু মুহাজিরগণের উপরোক্ত তিন নেতার বক্তব্য শোনার পর সংখ্যাগুরু আনছারদের পরামর্শ চাইলে আউস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) বললেন, হে রাসূল! আপনি হয়ত আশংকা করছেন যে, আমাদের সঙ্গে আপনার চুক্তি অনুযায়ী আনছারগণ কেবল (মদীনার) শহরে অবস্থান করেই আপনাদের সাহায্য করা কর্তব্য মনে করে। জেনে রাখুন, আমি আনছারদের পক্ষ থেকেই বলছি, যেখানে ইচ্ছা হয় আপনি আমাদের নিয়ে চলুন। যার সঙ্গে খুশী আপনি সন্ধি করুন বা ছিন্ন করুন- সর্বাবস্থায় আমরা আপনার সাথে আছি। যদি আপনি অগ্রসর হয়ে হাবশার বারকুল গিমাদ পর্যন্ত চলে যান, তাহ’লে আমরা আপনার সাথেই থাকব। والله لئن استعرضت بنا هذا البحر فخضته لخضناه معك আর যদি আমাদেরকে নিয়ে আপনি এই সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ব’। ما تخلف منا رجل واحد، فسر بنا على بركة الله، ‘আমাদের একজন লোকও পিছনে থাকবে না। অতএব আপনি আমাদের নিয়ে আল্লাহর নামে এগিয়ে চলুন’। হযরত সা‘দের উক্ত কথা শুনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই খুশী হ’লেন ও উদ্দীপিত হয়ে বললেন, سيروا وأبشروا فان الله تعالى قد وعدنى إحدى الطائفتين، والله لكانى الآن انظر إلى مصارع القوم، ‘চলো এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দু’টি দলের কোন একটির বিজয় সম্পর্কে ওয়াদা দান করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি এখন ওদের বধ্যভূমিগুলো দেখতে পাচ্ছি’।[11]
একথাটি কুরআনে এসেছে এভাবে,
وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ- (الأنفال ৭-৮)-
‘আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদেরকে ওয়াদা করেছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে। আর তোমরা কামনা করছিলে যে, যাতে কোনরূপ কণ্টক নেই, সেটাই তোমাদের ভাগে আসুক (অর্থাৎ বিনা যুদ্ধে তোমরা বিজয়ী হও)। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফিরদের মূল কর্তন করে দিতে’। যাতে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপাচারীরা এটাকে অপসন্দ করে’ (আনফাল ৮/৭-৮)।
অবশ্য পরামর্শ সভায় আবু আইয়ূব আনছারীসহ কিছু ছাহাবী বাস্তব অবস্থার বিবেচনায় এবং এই অপ্রস্ত্তত অবস্থায় যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কেননা তাঁরা এসেছিলেন বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর জন্য, বড় ধরনের কোন যুদ্ধ করার জন্য নয়। কিন্তু আল্লাহ এতে নাখোশ হয়ে আয়াত নাযিল করেন,
كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِنْ بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيْقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِيْنَ لَكَارِهُوْنَ- يُجَادِلُوْنَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُوْنَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنْظُرُوْنَ (الأنفال ৫-৬)-
‘যেমনভাবে তোমাকে তোমার গৃহ থেকে তোমার পালনকর্তা বের করে এনেছেন সত্যের জন্য। অথচ মুমিনদের একটি দল তাতে অপসন্দকারী ছিল’। ‘তারা তোমার সাথে বিবাদ করছিল সত্য বিষয়ে তা প্রকাশিত হবার পর। তাদেরকে যেন মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তারা তা যেন স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে’।[12] অর্থাৎ নবীকে তার পালনকর্তা স্বীয় লালন সূলভ গুণের প্রকাশ ঘটিয়ে অসত্য প্রতিহত করার জন্য ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেভাবে মদীনার গৃহ থেকে বের করে এনেছেন, তেমনিভাবে তিনি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্ত্ততির জন্য এখন যা কিছু করছেন সবই আল্লাহর হুকুমে করছেন। অতএব তোমাদের উচিত তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করা।
পরামর্শ সভায় সবধরনের মতামত আসতে পারে। এটা কোন দোষের ছিল না। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরামের উচ্চ মর্যাদার সঙ্গে এই সামান্যতম ভীরুতাকে আল্লাহ পসন্দ করেননি। তাই উপরোক্ত ধমকিপূর্ণ আয়াত নাযিল হয়। যা ছাহাবায়ে কেরামের ঈমান শতগুণে বৃদ্ধি করে। ছহীহ বুখারীতে হযরত ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, বদর যুদ্ধে কাফেররা পরাজিত হবার পর আমরা বুঝলাম যে, আনফাল ৭ আয়াতে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের ওয়াদা করা হয়েছিল’।
মাদানী বাহিনীর বদরে উপস্থিতি :
পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বদর অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। অতঃপর বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন। বদর হ’ল মদীনা থেকে ৬০ মাইল পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত একটি বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম। যেখানে পানির প্রাচুর্য থাকায় স্থানটির গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। ২য় হিজরীর ১৭ রামাযান মোতাবেক ৬২৪ খৃষ্টাব্দের ১১ই মার্চ শুক্রবার এখানেই সংঘটিত হয় তাওহীদ ও শিরকের মধ্যকার প্রথম সশস্ত্র মুকাবিলা।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদর পৌঁছে শত্রুবাহিনীর তথ্য জানার জন্য পায়ে হেঁটে নিজেই রওয়ানা হন আবুবকর (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে। সেখানে এক বৃদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ হ’লে তিনি তার কাছে উভয় বাহিনী সম্পর্কে জানতে চান। বৃদ্ধ তাদেরকে তারা কোন বাহিনীর লোক সেকথা জানানোর শর্তে তথ্য দিল যে, আমি রওয়ানা হবার যে সংবাদ পেয়েছি, তাতে মুহাম্মাদের বাহিনী আজকে অমুক স্থানে রয়েছে এবং কুরায়েশ বাহিনী অমুক স্থানে রয়েছে। বৃদ্ধের অনুমান সঠিক ছিল। এবার শর্তানুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জবাব দিলেন, نحن من ماء ‘আমরা একই পানি হ’তে’ (অর্থাৎ একই বংশের)। রাসূলের এই ইঙ্গিতপূর্ণ জবাবে বৃদ্ধ কিছুই বুঝতে না পেরে বিড় বিড় করতে করতে চলে গেল।
এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলী, যুবায়ের ও সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছের নেতৃত্বে একটি গোয়েন্দা দল পাঠান শত্রু পক্ষের আরও তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য। তারা গিয়ে দেখেন যে, দু’জন লোক বদরের ঝর্ণাধারা থেকে পানির মশক ভরছে। তাঁরা তাদের পাকড়াও করে নিয়ে এলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদে ও সামান্য পিটুনী দেওয়ার পরে জানতে পারলেন যে, তারা কুরায়েশ বাহিনীর লোক এবং কুরায়েশ বাহিনী উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির গেড়েছে। তবে তারা সঠিক সংখ্যা বলতে পারল না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, দৈনিক কয়টা উট যবহ করা হয়? তারা বলল, নয়টি অথবা দশটি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে ওদের সংখ্যা নয়শত অথবা হাযার-এর মধ্যে হবে’। তারপর ওদের নেতৃবর্গের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি মক্কার সেরা ব্যক্তিবর্গের নামগুলি শুনে দুঃখে ও বিস্ময়ে বলে উঠলেনهذه مكة قد ألقت إليكم أفلاذ كبدها- ‘মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলোকে তোমাদের কাছে নিক্ষেপ করেছে’।[13]
এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশে মুসলিম বাহিনী দ্রুত গিয়ে এশার সময় বদরের উপরে দখল নেন, যা ছিল ঝর্ণাধারার পাশেই’। তখন এলাকা সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং সামরিক বিষয়ে দক্ষ ছাহাবী হোবাব ইবনুল মুনযির ইবনুল জামূহ (حباب بن المنذر) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এখানে কি আল্লাহর নির্দেশক্রমে অবতরণ করলেন, না যুদ্ধকৌশল বুঝে অবতরণ করলেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যুদ্ধকৌশল মনে করে’। তখন ছাহাবী বললেন, এটি উপযুক্ত স্থান নয়। কেননা এখান থেকে আগে বা পিছে যাবার কোন সুযোগ নেই’। অতএব আরো এগিয়ে কুরায়েশ শিবিরের নিকটবর্তী প্রস্রবণটি আমাদের দখলে নিতে হবে এবং সবগুলি ঝর্ণাস্রোত ঘুরিয়ে এক জায়গায় এনে পানি এক স্থানে সঞ্চয় করতে হবে। কুরায়েশরা টিলার মাথায় উচ্চভূমিতে অবস্থান করছে। যুদ্ধ শুরু হ’লে পানির প্রয়োজনে ওরা নীচে এসে আর পানি পাবে না। তখন পানির সঞ্চয়টি থাকবে আমাদের দখলে’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং এগিয়ে গিয়ে কুরায়েশ বাহিনীর নিকটবর্তী পানির প্রস্রবণ দখলে নিলেন। তারপর অন্যান্য সব ব্যবস্থা শেষ করলেন।
অতঃপর সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর প্রস্তাবক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে একটি উঁচু টিলার উপরে একটা কাপড় টাঙিয়ে তার নীচে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে তাঁর সাথে কেবল আবুবকর (রাঃ) রইলেন এবং পাহারায় রইলেন সা‘দ বিন মু‘আয ও তার সাথীবৃন্দ। সা‘দ সেখানে বিশেষ সওয়ারীও প্রস্ত্তত রাখলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, যদি আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই, তাহ’লে আপনি এই সওয়ারীতে করে দ্রুত মদীনায় চলে যাবেন। কেননা সেখানে রয়েছে আপনার জন্য আমাদের চাইতে অধিক জীবন উৎসর্গকারী ভাইয়েরা। (فقد تخلف عنك أقوام يا نبي الله ما نحن بأشد لك حبا منهم … يمنعك الله بهم يناصحونك ويجاهدون معك) যারা আমাদের চাইতে আপনাকে ভালোবাসায় অধিকতর অগ্রগামী। যারা যুদ্ধে কখনোই আপনার থেকে পিছনে থাকবে না। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে আপনাকে হেফাযত করবেন। তারা আপনার শুভাকাংখী এবং তারা আপনার সঙ্গে থেকে জিহাদ করবেন’। সা‘দের এ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত হ’লেন ও তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন (دعا له بخير)।’[14]
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী সেনাদলকে বিন্যস্ত করেন এবং সুষ্ঠুভাবে শিবির সন্নিবেশ করেন।
বর্ষাস্নাত রাত্রি ও গভীর নিদ্রা :
১৭ই রামাযান শুক্রবারের রাত, বদর যুদ্ধের পূর্বরাত। সৈন্যদের শ্রেণীবিন্যাস শেষ হয়েছে। সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। হঠাৎ বৃষ্টি এলো। মুসলিম বাহিনী ঘুমে এলিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাহিনীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এবং যুদ্ধের জন্য দেহমন প্রস্ত্তত হয়ে গেল। বালু-কংকর সব জমে শক্ত হয়ে গেল। ফলে চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য এলো। সেই সাথে অধিক হারে পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, إِذْ يُغَشِّيْكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّنَ السَّمَاءِ مَاءً لِّيُطَهِّرَكُمْ بِهِ وَيُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلَى قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الأَقْدَامَ- ‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন তোমাদের স্বস্তির জন্য তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করা হয় এবং তোমাদের উপরে তিনি আসমান হ’তে বারি বর্ষণ করেন। তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূরীভূত করার জন্য। তোমাদের হৃদয়গুলি পরস্পরে আবদ্ধ করার জন্য এবং তোমাদের পাগুলি দৃঢ় রাখার জন্য’ (আন‘ফাল ৮/১১)।
শয়তানের কুমন্ত্রণা ছিল এই যে, সে দুর্বলচিত্ত মুসলমানদের মধ্যে এই প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে, আমরা যদি ন্যায় ও সত্যের পথে থাকব, তাহ’লে আমরা এই নিম্নভূমিতে ধূলি-ময়লা ও নিগৃহীত অবস্থার মধ্যে কেন? এটা নিঃসন্দেহে আমাদের পরাজয়ের লক্ষণ। পক্ষান্তরে কোরায়েশরা পাহাড়ের উচ্চ ভূমিতে আছে। তারা উট যবেহ করে খাচ্ছে আর ফূর্তি করছে। এটা নিশ্চয়ই তাদের জন্য বিজয়ের লক্ষণ। সকালেই যেখানে যুদ্ধের সম্মুখীন হ’তে হবে, সেখানে রাতেই যদি মুষ্টিমেয় মুসলিম বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের বিভ্রান্তি ঢুকে যায়। তাহ’লে সেটা সমূহ ক্ষতির কারণ হবে। সেকারণ আল্লাহ তাদের বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে গভীর ঘুমে বিভোর করে দিলেন। ফলে ঘুম থেকে উঠে প্রফুল্লচিত্তে সবাই যুদ্ধে জয়ের জন্য একাট্টা হয়ে প্রস্ত্তত হয়ে গেল। হযরত আলী (রাঃ) বলেন যে, বদর যুদ্ধের রাতে এমন কেউ বাকী ছিল না যে, তিনি ঘুমাননি। কেবল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত। তিনি সারারাত জেগে ছালাতে রত থাকেন।
মাক্কী বাহিনীর অবস্থা :
প্রত্যুষে কুরায়েশ বাহিনী পাহাড় থেকে নীচে অবতরণ করে হতবাক হয়ে গেল। পানির উৎসের উপরে রাতারাতি মুসলিম বাহিনীর দখল কায়েম হয়ে গেছে। হাকীম বিন হেযাম সহ অতি উৎসাহী কয়েকজন কুরায়েশ সেনা সরাসরি রাসূলের টিলার সম্মুখস্থ পানির হাউযের দিকে অগ্রসর হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। ফলে যারা সেখান থেকে পানি পান করল, তারা সবাই পরে যুদ্ধে নিহত হ’ল। একমাত্র হাকীম পান করেনি। সে বেঁচে গেল। পরে সে পাক্কা মুসলমান হ’ল। এ ঘটনাকে স্মরণ করে হাকীম বিন হেযাম শপথ করার সময় সর্বদা বলতেন لا والذي نجاني يوم بدر ‘ঐ সত্তার কসম! যিনি আমাকে বদরের দিন পরিত্রাণ দিয়েছেন’। ঘটনাটি বহু পূর্বেকার তালূত বাহিনীর ঘটনার সাথে মিলে যায়। সেদিন যারা নদীর পানি পান করেছিল, তাদের কেউই তালূতের সাথে জালূতের বিরুদ্ধে জিহাদে শরীক হ’তে পারেনি’।[15]
কুরায়েশ নেতারা অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পারল এবং নিজেদের বোকামিতে দুঃখে-ক্ষোভে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। তারা মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ও অবস্থা নিরূপনের জন্য উমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী নামক একজন অশ্বারোহীকে প্রেরণ করল। সে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে এসে বলল, তিন শো বা তার কিছু কমবেশী হবে’। তবে আরেকটু সময় দাও, আমি দেখে আসি, ওদের পিছনে কোন সাহায্যকারী সেনাদল আছে কি-না। সে আবার ছুটলো এবং ফিরে এসে বলল, ওদের পিছনে কাউকে দেখলাম না। তবে সে বলল, يا معشر قريش : البلايا تحمل المنايا- ‘হে কুরায়েশগণ, বিপদ এসেছে মৃত্যুকে সাথে নিয়ে। তাদের হাতে তরবারি ছাড়া কিছু নেই’। والله ما أرى أن يقتل رجل منهم حتى يقتل رجل منكم … فرؤا رأيكم- ‘আল্লাহর কসম, তোমাদের একজন নিহত না হওয়া পর্যন্ত তাদের একজন নিহত হবে না’। … অতএব তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর’। তার এ রিপোর্ট শুনে হাকীম বিন হেযাম বয়োজ্যেষ্ঠ কুরায়েশ নেতা উৎবা বিন রাবী‘আহর কাছে এসে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার ব্যাপারে বুঝাতে লাগলেন। তিনি রাযী হ’লেন এমনকি ইতিপূর্বে নাখলা যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে যুলক্বা‘দাহর হারাম মাসে নিহত আমর ইবনুল হাযরামীর রক্তমূল্য তিনি নিজ থেকে দিতে চাইলেন। উৎবা বললেন যে, সমস্যা হ’ল ইবনুল হানযালিয়াহকে নিয়ে (আবু জাহলের মায়ের নাম ছিল হানযালিয়াহ)। তুমি তার কাছে যাও।
অতঃপর উৎবা দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বললেন, হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের সঙ্গে যুদ্ধ করায় তোমাদের কোন বাহাদুরী নেই। কেননা তাতে তোমরা তোমাদের চাচাতো ভাই বা খালাতো ভাই বা মামাতো ভাইয়ের বা নিজ গোত্রের লোকদের রক্তাক্ত চেহারা দেখবে, যা তোমাদের কাছে মোটেই পসন্দনীয় হবে না। فارجعوا وخلُّوا بين محمد وسائر العرب ‘অতএব তোমরা ফিরে চল এবং মুহাম্মাদ ও গোটা আরব দুনিয়াকে ছেড়ে দাও। যদি তারা তাকে মেরে ফেলে, তবে সেটা তাই-ই হবে, যা তোমরা চেয়েছিলে। আর যদি তা না হয়, তাহ’লে সে তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এজন্য যে, তোমরা তার সাথে সেরূপ ব্যবহার করোনি, যা তোমরা চেয়েছিলে’।
এদিকে হাকীম ইবনে হেযাম আবু জাহলের কাছে গিয়ে নিজের ও উৎবার মতামত ব্যক্ত করে মক্কায় ফিরে যাবার জন্য আবু জাহলকে অনুরোধ করলেন। এতে আবু জাহল ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, انتفخ والله سَحْرُهُ، উৎবার উপরে মুহাম্মাদের জাদু কার্যকর হয়েছে। كلا والله لا نرجع حتى يحكم الله بيننا وبين محمد- ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! আমরা ফিরে যাব না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মাঝে একটা ফায়ছালা করে দেন’। তিনি বললেন, ‘এতক্ষণে বুঝলাম যে, উৎবার পুত্র আবু হুযায়ফা যে মুসলমান হয়ে হিজরত করে আগে থেকেই মুহাম্মাদের দলে রয়েছে এবং যুদ্ধ বাধলে সে নিহত হবে, সেই ভয়ে উৎবা যুদ্ধ না করেই ফিরে যেতে যাচ্ছে’।
হাকীমের কাছ থেকে আবু জাহলের এইসব কথা শুনে উৎবার বিচারবোধ লোপ পেল। তার সুপ্ত পৌরুষ জেগে উঠলো। ক্ষুব্ধ চিৎকারে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ছুটে চললেন। ওদিকে আবু জাহল আমের ইবনুল হাযরামীকে গিয়ে বললেন, দেখছ কি! তোমার ভাই আমরের রক্তের প্রতিশোধ আর নেওয়া হ’ল না। ঐ দেখ কাপুরুষ উৎবা পালাচ্ছে। শীঘ্র উঠে আর্তনাদ শুরু কর’। একথা শোনামাত্র আমের তার সারা দেহে ধুলো-বালি মাখতে মাখতে এবং গায়ের কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে নাখলা যুদ্ধে নিহত ভ্রাতা আমর ইবনুল হাযরামীর নামে واعمراه واعمراه বলে আর্তনাদ করে বেড়াতে লাগল। আর যায় কোথায়। মুহূর্তের মধ্যে মুশরিক শিবিরে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল। রণোন্মত্ত কুরায়েশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ছুটে চলল।[16] হাকীম ইবনে হেযামের সকল প্রচেষ্টা ভন্ডুল হয়ে গেল কেবলমাত্র আবু জাহলের গোয়ার্তুমি ও ধূর্তামির কারণে। কুরায়েশরা দ্রুত ধেয়ে এল মুসলিম বাহিনীর দিকে।
মুসলিম বাহিনী সারিবদ্ধ হ’ল :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে বিজয়ের জন্য দো‘আ করলেন। অতঃপর লাল উটের উপরে সওয়ার উৎবা বিন রাবী‘আহর দিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, إن يطيعوه يَرْشُدُوْا ‘যদি তার দল তার আনুগত্য করত, তাহ’লে তারা সঠিক পথে থাকতো’।[17] অর্থাৎ যদি তারা উৎবাহর কথামত মক্কায় ফিরে যেত, তাহ’লে তাদের মঙ্গল হ’ত। এর মধ্যে রাসূলের শান্তিবাদী নীতি ফুটে ওঠে।
মাক্কী বাহিনী যখন মাদানী বাহিনীর নিকটবর্তী হ’ল, তখন আবু জাহল আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, اللهم أقطعَنا للرحم وآتانا بما لايعرف فأحنه الغداة- ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যকার অধিক আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী এবং অজানা বিপদ সমূহের আনয়নকারী যে দল, তুমি তাদেরকে আগামীকাল সকালে ধ্বংস করে দাও’। এভাবে তিনি নিজের প্রার্থনা দ্বারা নিজের উপর ধবংস ডেকে নিলেন।[18] অন্য বর্ণনায় এসেছে, যুদ্ধের শুরুতে তিনি বলেছিলেন, اللهم أينا كان احب اليك وأرضى عندك فانصره اليوم- ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে তোমার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় ও তুমি যার প্রতি সর্বাধিক সন্তুষ্ট, আজ তুমি তাকে সাহায্য কর’।[19] অন্য বর্ণনায় এসেছে, اللهم أينا كان أهجر وأقطع للرحم فأحنه اي فأهلكه- ‘হে আল্লাহ! আমাদের উভয়দলের মধ্যে যে দল অধিক আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, তুমি তাকে ধ্বংস করে দাও’![20]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের বাহিনীকে দ্রুত প্রস্ত্তত ও সারিবদ্ধ করে ফেললেন। এরি মধ্যে জনৈক সাওয়াদ ইবনু গাযিয়াহ (سواد بن غزية) সারি থেকে কিছুটা আগে বেড়ে এল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পেটে তীর দিয়ে টোকা মেরে পিছিয়ে যাবার ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, استو يا سواد সমান হয়ে যাও হে সাওয়াদ! সাথে সাথে সে বলে উঠলো, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। বদলা দিন! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন নিজের পেট আলগা করে দেন ও বদলা নিতে বলেন। তখন সে ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরলো এবং পেটে চুমু খেতে লাগলো’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, কিজন্য তুমি এরূপ করলে? সে বলল, আমাদের সামনে যে অবস্থা আসছে তাতো আপনি দেখছেন। সেজন্য আমি চেয়েছিলাম যে, আপনার সাথে আমার শেষ আদান-প্রদান যেন এটাই হয় যে, আমার দেহচর্ম আপনার দেহচর্মকে স্পর্শ করুক’। তার এ মর্মস্পর্শী কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন (دعا له بخير)।[21] রাসূলের এ কাজের মধ্যে মানবিক সাম্যের এক উত্তম নমুনা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে এক ঈর্ষণীয় বিষয়।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, চূড়ান্ত নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যুদ্ধ শুরু করবে না। ব্যাপক হারে তীরবৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কেউ তীর ছুঁড়বে না এবং তোমাদের উপরে তরবারি ছেয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তরবারি চালনা করবে না’। তিনি আরও বলেন যে, বনু হাশেমকে জোর করে যুদ্ধে আনা হয়েছে। তাদের সাথে আমাদের কোন যুদ্ধ নয়। অতএব তাদের কোন ব্যক্তি সামনে পড়ে গেলে তাকে যেন কেউ আঘাত না করে। আববাসকে যেন হত্যা না করা হয়। অনুরূপভাবে আবুল বুখতারী বিন হেশামকেও হত্যা করো না। কেননা এরা মক্কায় আমাদের কোনরূপ কষ্ট দিত না। বরং সাহায্যকারী ছিল।
উল্লেখ্য যে, বনু হাশিমের বিরুদ্ধে কুরায়েশদের বয়কট নামা যারা ছিঁড়ে ফেলেছিল, তাদের একজন ছিলেন আবুল বুখতারী। কিন্তু যুদ্ধে আবুল বুখতারী নিহত হয়েছিল তার নিজস্ব হঠকারিতার জন্য। সে তার সঙ্গী কাফের বন্ধুকে ছাড়তে চায়নি। ফলে যুদ্ধে তারা উভয়ে নিহত হয়। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) টিলার উপরে সামিয়ানার নীচে নিজ স্থানে চলে গেলেন। এই সময় বদর যুদ্ধের যে পতাকা রাসূলের হাতে ছিল, তা ছিল হযরত আয়েশার ওড়না দিয়ে তৈরী।
যুদ্ধ শুরু :
ইতিমধ্যে কুরায়েশ পক্ষের জনৈক হঠকারী আসওয়াদ বিন আব্দুল আসাদ আল-মাখযূমী দৌড়ে এসে বলল, আমি এই হাউয থেকে পানি পান করব, অথবা একে ভেঙ্গে ফেলব অথবা এখানেই মরব’। তখন হামযা (রাঃ) এসে তার পায়ে আঘাত করলেন। এমতাবস্থায় সে পা ঘেঁষতে ঘেঁষতে হাউযের দিকে এগোতে লাগল। হামযা তাকে দ্বিতীয় বার আঘাত করলে সে হাউযেই মরে পড়ল ও তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হ’ল। এরপর যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলো এবং সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরায়েশ পক্ষ মুসলিম পক্ষের বীরযোদ্ধাদের দ্বৈতযুদ্ধে আহবান করল। তাদের একই পরিবারের তিনজন সেরা অশ্বারোহী বীর উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ এবং অলীদ বিন উৎবা এগিয়ে এল। জবাবে মুসলিম পক্ষ হ’তে মু‘আয ও মু‘আবিবয বিন আফরা কিশোর দুই ভাই ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা তিনজন আনছার তরুণ যুবক বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কুরায়েশ পক্ষ বলে উঠলো হে মুহাম্মাদ! আমাদের স্বগোত্রীয় সমকক্ষদের পাঠাও’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, হে ওবায়দাহ, হে হামযাহ, হে আলী তোমরা যাও। অতঃপর আলী তার প্রতিপক্ষ অলীদ বিন উৎবাহকে, হামযাহ তার প্রতিপক্ষ শায়বাহ বিন রাবী‘আহকে এক নিমিষেই খতম করে ফেললেন। ওদিকে বৃদ্ধ ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ তার প্রতিপক্ষ উৎবা বিন রাবী‘আহর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হ’লেন। তখন আলী ও হামযাহ তার সাহায্যে এগিয়ে এসে উৎবাহকে শেষ করে দেন ও ওবায়দাহকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। কিন্তু অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে যুদ্ধশেষে মদীনায় ফেরার পথে ৪র্থ বা ৫ম দিন ওবায়দাহ শাহাদাত বরণ করেন।[22]
প্রথম আঘাতেই সেরা তিনজন বীরযোদ্ধা ও গোত্র নেতাকে হারিয়ে কুরায়েশ পক্ষ মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে আকুলভাবে নিম্নোক্ত প্রার্থনা করেন,
اللَّهُمَّ أَنْجِزْ لِىْ مَا وَعَدْتَنِىْ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَنْشُدُكَ عَهْدَكَ وَوَعْدَكَ … اللَّهُمَّ إِنْ تَهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لاَ تُعْبَدْ فِى الأَرْضِ بَعْدَ الْيَوْمِ أبَدًا-
‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছিলে তা পূর্ণ কর। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণের প্রার্থনা জানাচ্ছি। … হে আল্লাহ! যদি এই ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহ’লে আজকের দিনের পরে তোমার ইবাদত করার মত কেউ আর ভূপৃষ্ঠে থাকবে না’। তিনি প্রার্থনায় এমন আত্মভোলা ও বিনয়ী হয়ে ভেঙ্গে পড়লেন যে, তার স্কন্ধ হ’তে চাদর পড়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে আবুবকর ছুটে এসে তার চাদর উঠিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, حسبك يا رسول الله الححت على ربك হে রাসূল! যথেষ্ট হয়েছে, আপনার পালনকর্তার নিকটে আপনি চূড়ান্ত প্রার্থনা করেছেন’। এ সময় আয়াত নাযিল হ’ল- إِذْ تَسْتَغِيْثُوْنَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّيْ مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُرْدِفِيْنَ- ‘যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করলেন। আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাযার ফেরেশতা দ্বারা, যারা হবে ধারাবাহিক ভাবে অবতরণকারী’।[23]
ফেরেশতাগণের অবতরণ :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত অবস্থায় এক সময় সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি হাসতে হাসতে জেগে উঠে বলেন, أبشر أبا بكر! أتانا نصر الله، هذا جبريل آخذ بعنان فرسه، عليه أداة الحرب- আবুবকর! সুসংবাদ নাও। আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। ঐ যে জিব্রীল যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে টিলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর তিনি سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ- (‘সত্বর দলটি পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালাবে’)১৭ আয়াতটি পড়তে পড়তে সামিয়ানার বাইরে এলেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বাইরে এসে আঙ্গুলের ইশারা করে করে বলেন, ওটা আবু জাহলের বধ্যভূমি, ওটা অমুকের, ওটা অমুকের’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, তাদের কেউ ঐ স্থান অতিক্রম করতে পারেনি, যেখানে যেখানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইশারা করেছিলেন।
ফেরেশতাগণের অবতরণ :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত অবস্থায় এক সময় সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি হাসতে হাসতে জেগে উঠে বলেন, أبشر أبا بكر! أتانا نصر الله، هذا جبريل آخذ بعنان فرسه، عليه أداة الحرب- আবুবকর! সুসংবাদ নাও। আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। ঐ যে জিব্রীল যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে টিলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর তিনি سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ- (‘সত্বর দলটি পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালাবে’)[24] আয়াতটি পড়তে পড়তে সামিয়ানার বাইরে এলেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বাইরে এসে আঙ্গুলের ইশারা করে করে বলেন, ওটা আবু জাহলের বধ্যভূমি, ওটা অমুকের, ওটা অমুকের’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, তাদের কেউ ঐ স্থান অতিক্রম করতে পারেনি, যেখানে যেখানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইশারা করেছিলেন।[25]
তারপর তিনি এক মুষ্টি কংকরময় বালু হাতে নিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে ছুঁড়ে মারলেন আর বল্লেন, شاهت الوجوه ‘চেহারাগুলো বিকৃত হৌক’। ফলে শত্রুবাহিনীর মুশরিকদের এমন কেউ থাকলো না, যার চোখে ঐ বালু প্রবেশ করেনি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য। তাই আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَـكِنَّ اللهَ رَمَى- ‘তুমি যখন বালু নিক্ষেপ করেছিলে, প্রকৃতপক্ষে তা তুমি নিক্ষেপ করোনি, বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছিলেন’।[26] নিঃসন্দেহে এটি ছিল রাসূলের একটি মু‘জেযা ও অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা তিনি হোনায়েন যুদ্ধেও করেছিলেন।[27] ফারসী কবি বলেন,
محمد عربى كا بروئـے هر دو سراست
كسے كه خاك درش نيست خاك برسرأو
অনুবাদ: মুহাম্মাদ আরাবী হ’লেন দুনিয়া ও আখেরাতের মর্যাদার উৎস। কেউ যদি তার পায়ের ধূলা হ’তে না পারে, তার মাথা ধূলি ধূসরিত হৌক!’
মুসলিম নামধারী একদল মুশরিক মা‘রেফতী পীর-ফকীর এই ঘটনা দ্বারা রাসূলকে আল্লাহ বানিয়েছে এবং তারাও নিজেদেরকে আল্লাহর অংশ বলে থাকে। তারা সূতায় অথবা পাতায় ফুঁক দিলে এবং তা দেহে বাঁধলে বা পকেটে রাখলে শত্রু তাকে দেখতে পাবে না বলে মিথ্যা ধারণা প্রচার করে। এভাবে তারা সরলমনা ও ভক্ত জনগণের ঈমান নষ্ট করে ও সেই সাথে ভক্তির চোরাগলি দিয়ে তাদের পকেট ছাফ করে।
বালু নিক্ষেপের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় বাহিনীকে জান্নাতের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বলেন, قُوْمُوا إلَى جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ- ‘তোমরা এগিয়ে চলো ঐ জান্নাতের পানে যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত’। রাসূলের এ আহবান মুসলমানের দেহমনে ঈমানী বিদ্যুতের চমক এনে দিল। তিনি আরও বললেন, وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يُقَاتِلُهُمُ الْيَوْمَ رَجُلٌ فَيُقْتَلُ صَابِرًا مُحْتَسِبًا مُقْبِلًا غَيْرَ مُدْبِرٍ إلاَّ أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ- ‘যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন নিহিত, তার কসম করে বলছি, যে ব্যক্তি আজকে দৃঢ়পদে নেকীর উদ্দেশ্যে লড়াই করবে, পিছপা হবে না, সর্বদা সম্মুখে অগ্রসর হবে, অতঃপর যদি সে নিহত হয়, তবে আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’।
জান্নাত পাগল মুমিন মৃত্যুকে পায়ে দলে শতগুণ শক্তি নিয়ে সম্মুখে আগুয়ান হ’ল। এমন সময় জনৈক ছাহাবী উমায়ের বিন হোমাম বাখ বাখ (بخ بخ) বলে উঠলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি জান্নাতবাসী হ’তে চাই’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সুসংবাদ দিয়ে বললেন, فَإِنَّكَ مِنْ أَهْلِهَا ‘নিশ্চয়ই তুমি তার অধিবাসী’। একথা শুনে ছাহাবী থলি হ’তে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। কিন্তু জান্নাত পাগল এই ছাহাবীর তর সইছে না। এক সময় বলে উঠলেন, لَئِنْ أَنَا حَيِّيْتُ حَتَّى آكُلَ تَمَرَاتِيْ هَذِهِ إِنَّهَا لَحَيَاةٌ طَوِيْلَةٌ، ‘যদি আমি এই খেজুরগুলি খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে সেটাতো দীর্ঘ জীবন হয়ে যাবে’ বলেই সমস্ত খেজুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে শহীদ হয়ে গেলেন’।[28]
ফেরেশতাগণের যুদ্ধে যোগদান :
মুসলিম বাহিনীর এই হামলার প্রচন্ডতার সাথে সাথে যোগ হয় ফেরেশতাগণের হামলা। ইকরিমা বিন আবু জাহল (যিনি ঐ যুদ্ধে পিতার সাথে শরীক ছিলেন এবং মক্কা বিজয়ের পরে মুসলমান হন) বলেন, ঐদিন আমাদের লোকদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যেতো, অথচ দেখা যেতো না কে মারলো (তাবাক্বাতে ইবনু সা‘দ)। আবু দাঊদ আল-মাযেনী বলেন, আমি একজন মুশরিক সৈন্যকে মারতে উদ্যত হব। ইতিমধ্যে তার ছিন্ন মস্তক আমার সামনে এসে পড়ল। আমি বুঝতেই পারলাম না, কে ওকে মারল’। রাসূলের চাচা আববাস যিনি বাহ্যিকভাবে মুশরিক বাহিনীতে ছিলেন, জনৈক আনছার তাকে বন্দী করে আনলে, তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে এ ব্যক্তি বন্দী করেনি। বরং যে ব্যক্তি বন্দী করেছে, তাকে এখন দেখতে পাচ্ছি না। তিনি একজন চুল বিহীন মাথাওয়ালা ও সুন্দর চেহারার মানুষ এবং বিচিত্র বর্ণের একটি সুন্দর ঘোড়ায় তিনি সওয়ার ছিলেন। আনছার বললেন, হে রাসূল! আমিই এনাকে বন্দী করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উক্ত আনছারকে বললেন, اسكت فقد أيدك الله بملك كريم চুপ কর। আল্লাহ এক সম্মানিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাকে সাহায্য করেছেন’। কোন কোন হাদীছে এসেছে যে, ফেরেশতারা কোন মুশরিকের উপরে আক্রমণ করার ইচ্ছা করতেই আপনা-আপনি তার মস্তক দেহ হ’তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত (হাকেম)। কোন কোন ছাহাবী জিবরীলের আওয়ায শুনেছেন যে, তিনি أَقْدِمْ حَيْزُوْمُ ‘হায়যূম আগে বাড়ো’ বলেছেন (‘হায়যূম’ হ’ল জিবরীলের ঘোড়ার নাম)। কেউ কতক ফেরেশতাকে সরাসরি দেখেছেন।[29] ঐদিন ফেরেশতাদের মাথার পাগড়ী ছিল সাদা। তবে জিব্রীলের মাথার পাগড়ী ছিল হলুদ বর্ণের।[30]
উপরোক্ত ঘটনাবলী এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে যে, কিছু কিছু কাজের মাধ্যমে ফেরেশতাগণ মুসলমানদের আশ্বস্ত করেছেন যে, তারাও যেন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। এতে তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধি করা।
ফেরেশতা নাযিলের উদ্দেশ্য :
এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَمَا جَعَلَهُ اللهُ إِلاَّ بُشْرَى لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوْبُكُمْ بِهِ وَمَا النَّصْرُ إِلاَّ مِنْ عِنْدِ اللهِ الْعَزِيْزِ الْحَكِيْمِ- ‘(তোমাদের নিকটে ফেরেশতা প্রেরণের বিষয়টি ছিল) কেবলমাত্র তোমাদের জন্য সুসংবাদ হিসাবে এবং যাতে তোমাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। আর সাহায্য কেবলমাত্র মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে’ (আলে ইমরান ৩/১২৬)।
এর দ্বারা একথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, মুসলমানগণ যেন এ বিশ্বাস অটুট রাখে যে, আল্লাহর ফেরেশতারা তাদের সাহায্যার্থে প্রস্ত্তত হয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সেজন্য আল্লাহর হুকুমে তারা যৎসামান্য সাহায্য করছে। প্রকৃতপক্ষে এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মনোবলকে বর্ধিত করা, তাদের দ্বারা যুদ্ধ করানো নয়। কেননা ফেরেশতারা সরাসরি জিহাদ করলে মুমিনদের ছওয়াব থাকে না। তাছাড়া সেটা হ’লে তো এক হাযার (আনফাল ৮/৯), তিন হাযার বা পাঁচ হাযার (আলে ইমরান ৩/১২৪-২৫)। কেন একজন ফেরেশতাই যথেষ্ট ছিল কুরায়েশ বাহিনীকে খতম করার জন্য। যেভাবে জিব্রীল (আঃ) একাই লূত্বের কওমকে নিমেষে ধ্বংস করেছিলেন (হূদ ১১/৮২; হিজর ১৫/৭৩-৭৪)। এ জগতে যুদ্ধ ও জেহাদের দায়িত্ব মানুষকে অর্পণ করা হয়েছে। যাতে তারা তার ছওয়াব ও উচ্চ মর্যাদা লাভে ধন্য হয়। ফেরেশতা বাহিনী দ্বারা যদি দেশ জয় করা বা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা আল্লাহর ইচ্ছা হ’ত, তাহ’লে পৃথিবীতে কাফেরদের রাষ্ট্র দূরে থাক, তাদের অস্তিত্বই থাকতো না। বরং আল্লাহর বিধান এই যে, দুনিয়াতে কুফর ও ঈমানের সংঘর্ষ চলতেই থাকবে। ঈমানদারগণ সর্বদা আল্লাহর সাহায্য পাবেন। তারা ইহকালে ও পরকালে মর্যাদামন্ডিত হবেন। কিন্তু কাফেররা আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে এবং ইহকালে ও পরকালে ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হবে। নমরূদ ও ইবরাহীম, ফেরাঊন ও মূসা কি এর বাস্তব প্রমাণ নয়? আজও ফেরাঊন ও মূসার দ্বন্দ্ব চলছে এবং ক্বিয়ামত অবধি চলবে।
ময়দান হ’তে ইবলীসের পলায়ন :
ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কা হ’তে বের হওয়ার সময় বনু বকরের ভয়ে বের হবে কি হবে না এরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সময় ইবলীস স্বয়ং সোরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলেজীর রূপ ধারণ করে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে অভয় দিয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে আবু জাহল বদর অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিল। এযাবত যে আবু জাহলের সঙ্গে থেকে তাকে সর্বদা গাইড করেছে এবং রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সর্বদা প্ররোচিত করেছে। কিন্তু এখন যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতাদের দেখতে পেয়ে সে আতংকিত হয়ে পালাতে থাকে। হারেছ বিন হেশাম তাকে আটকাতে চাইলে সে তার বুকে জোরে এক ঘুষি মেরে দে ছুট। তখন মুশরিকেরা তাকে তাচ্ছিল্য করতে থাকলে জবাবে সে বলে, إِنِّيْ بَرِيْءٌ مِّنْكُمْ إِنِّيْ أَرَى مَا لاَ تَرَوْنَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ وَاللهُ شَدِيْدُ الْعِقَابِ- ‘আমি তোমাদের থেকে মুক্ত। আমি যা দেখছি, তোমরা তা দেখছ না। আল্লাহকে আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে। তিনি কঠিন শাস্তির মালিক’ (আনফাল ৮/৪৮)। এই বলে দ্রুত সে পালিয়ে গেল ও সমুদ্রের মধ্যে ডুব দিয়ে হারিয়ে গেল।[31]
মাক্কী বাহিনীর পলায়ন :
সুরাক্বা বেশী ইবলীসের পলায়নে এবং মুসলিম বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমনে পর্যুদস্ত মুশরিক বাহিনী প্রাণভয়ে পালাতে থাকল। এ দৃশ্য দেখে তাদের ধরে রাখার জন্য আবু জাহল তার লোকদের উদ্দেশ্যে জোরালো ভাষণ দিয়ে বলে উঠলো, সোরাক্বার পলায়নে তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না। সে আগে থেকেই মুহাম্মাদের চর ছিল। ওৎবা, শায়বা, ওয়ালীদের মৃত্যুতেও ভীত হওয়ার কারণ নেই। কেননা তাড়াহুড়োর মধ্যে তারা মারা পড়েছেন। লাত ও উযযার শপথ করে বলছি, ওদেরকে শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। অতএব তোমরা ওদেরকে মেরো না। বরং ধরো এবং বেঁধে ফেল’।
কিন্তু আবু জাহলের এই তর্জন-গর্জন অসার প্রমাণিত হ’ল। বর্ষিয়ান ছাহাবী আব্দুর রহমান বিন ‘আওফকে আনছারদের বানু সালামাহ গোত্রের কিশোর দু’ভাই মু‘আয ও মু‘আউভিয বিন ‘আফরা পৃথকভাবে এসে জিজ্ঞেস করল يا عم أرني أبا جهل! أُخْبِرْتُ أَنَّهُ يَسُبُّ رَسُوْلَ الله صلى الله عليه وسلم- ‘চাচাজী! আবু জাহল লোকটিকে আমাকে দেখিয়ে দিন। সে নাকি আমাদের রাসূলকে গালি দেয়’? তারা প্রত্যেকে পৃথকভাবে গোপনে এসে চাচাজীর কানে কানে একই কথা বলল। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ বলেন, আমি ওদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু ওরা নাছোড় বান্দা। ফলে বাধ্য হয়ে দেখিয়ে দিলাম। তখন ওরা দু’জন তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং মু‘আয প্রথম আঘাতেই আবু জাহলের পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। এ সময় তার কাঁধে ইকরিমা বিন আবু জাহলের তরবারির আঘাতে মু‘আযের একটি হাত কেটে ঝুলতে থাকলে সে নিজের পা দিয়ে চেপে ধরে এক টানে সেটাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তারপর ছোট ভাই মু‘আউভিযের আঘাতে আবু জাহল ধরাশায়ী হ’লে তারা উভয়ে রাসূলের কাছে এসে গর্বভরে বলে উঠলো হে রাসূল! আবু জাহলকে আমি হত্যা করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের তরবারি মুছে ফেলেছ কি? তারা বলল, না। তারপর উভয়ের তরবারি পরীক্ষা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, كلاكما قتله ‘তোমরা উভয়ে তাকে হত্যা করেছ’। অবশ্য এই যুদ্ধে মু‘আউভিয বিন আফরা পরে শহীদ হন এবং মু‘আয বিন আফরা হযরত ওছমানের খেলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
জানা আবশ্যক যে, মু‘আয ও মু‘আউভিয উভয়ে তাদের বীরমাতা ‘আফরা’-র দিকে সম্বন্ধিত হয়ে ইবনু ‘আফরা নামে পরিচিত।[32]
পরে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ গিয়ে দেখেন আবু জাহলের তখনও নিঃশ্বাস চলছে। তিনি তার দাড়ি ধরে মাথা কেটে নেবার জন্য ঘাড়ে পা রাখলে সে বলে ওঠে, রে বকরীর রাখাল, তুই এতদূর বেড়ে গিয়েছিস? উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মক্কায় বকরীর রাখাল ছিলেন। তারপর বলল, فَلَوْ غَيْرَ أَكَّارٍ قَتَلَنِيْ! ওহ্! আমাকে যদি (মদীনার) ঐ চাষারা হত্যা না করে অন্য কেউ হত্যা করতো![33] অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, ইবনু মাসঊদ তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, اخزاك الله يا عدو الله ‘আল্লাহ তোকে ধিকৃত করুন রে আল্লাহর শত্রু! জবাবে আবু জাহল বলে ওঠে, بماذا أخزانى؟ أَعْمَدُ من رجل قتلتموه ‘কেন তিনি আমাকে ধিকৃত করবেন? সেরা ব্যক্তিকে তোমরা হত্যা করছ’। এখন বল, لمن الدائرةُ اليوم ‘আজ কারা জিতলো’। ইবনে মাসঊদ বললেন, لله ولرسوله ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দল’।[34] বলেই তার মাথাটা কেটে নিয়ে রাসূলের দরবারে হাযির হ’লেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে ওঠেন, آالله الذى لا إله إلا هو ‘আল্লাহর শপথ, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। একথা তিনবার বলার পরে তিনি বললেন, اللهُ اَكْبَرُ اَلْحَمْدُ للهِ الَّذِيْ صَدَقَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَهُ- ‘আল্লাহু আকবার, যাবতীয় প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য, যিনি তাঁর ওয়াদা বাস্তবায়িত করেছেন, তার বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং শত্রু সেনা দলকে একাই পরাভূত করেছেন’। এই দো‘আটি হজ্জ বা ওমরাহ কালে ছাফা-মারওয়া সাঈ করার শুরুতে ছাফা পাহাড়ে উঠে কা‘বা গৃহের দিকে ফিরে দু’হাত উঠিয়ে তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলার পর পাঠ করতে হয় মূলতঃ মক্কা বিজয়ের স্মৃতি মনে করিয়ে দেবার জন্য।[35]
এভাবে মক্কার বড় ত্বাগূতটা শেষ হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার মৃতদেহ দেখার পর বলেন, رحم الله ابنى عفراء فهما شركاء فى قتل فرعون هذه الأمة ‘আল্লাহ আফরার দুই পুত্রের উপর রহম করুন! তারা এই উম্মতের ফেরাঊনকে হত্যায় অংশীদার ছিল। অন্য অংশীদার ছিলেন ফেরেশতা এবং ইবনু মাসঊদ’।[36]
যুদ্ধের ফলাফল :
এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার শহীদ হন। কাফের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয়। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধময় কূপে (القليب) নিক্ষেপ করা হয়। তাদের মধ্যে হিজরতের প্রাক্কালে মক্কায় রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহল সহ ১৪ নেতার ১১ জন এই যুদ্ধে নিহত হয়। বাকী তিনজন আবু সুফিয়ান, জুবায়ের বিন মুতব‘ইম ও হাকীম বিন হেযাম পরে মুসলমান হন।
বদর যুদ্ধের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা :
(১) যুদ্ধ শুরুর পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, অনেক লোককে আবু জাহল যবরদস্তি করে যুদ্ধে এনেছে। অথচ তারা মোটেই যুদ্ধে ইচ্ছুক ছিল না। অতএব তোমরা বনু হাশিমের কাউকে এবং বিশেষ করে আববাসকে কোনভাবেই আঘাত করবে না। অনুরূপভাবে আবুল বুখতারী বিন হেশামকে যেন হত্যা করো না। পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জানতে পারেন যে, কুরায়েশ নেতা উৎবাহ বিন বারী‘আহর পুত্র আবু হুযায়ফা (রাঃ) যিনি আগেই মুসলমান হয়ে মদীনায় হিজরত করেন এবং বদরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি বলেছেন যে, আমরা আমাদের পিতা ও ভ্রাতাদের হত্যা করব, আর আববাসকে ছেড়ে দেব? তা হ’তে পারে না। আল্লাহর কসম! আমার সামনে পড়ে গেলে আমি অবশ্যই আববাসকে হত্যা করব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন ওমর (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, হে আবু হাফ্ছ! রাসূলের চাচার মুখের উপরে তরবারির আঘাত করা হবে? জবাবে ওমর (রাঃ) বলেন, আমকে ছাড়ুন, আমি এখুনি ওর গর্দান উড়িয়ে দিয়ে আসি’। পরে আবু হুযায়ফা এতে অনুতপ্ত হন।
তিনি বলতেন যে, ঐদিন মুখ ফসকে যে কথা বেরিয়ে গিয়েছিল, সেই থেকে আমি কোনদিন মনে স্বস্তি পাইনি, সর্বদা ভাবতাম, শাহাদাত লাভই এর একমাত্র কাফফারা হ’তে পারে। পরে তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফত কালে ভন্ড নবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে শহীদ হন।
(২) বেলাল (রাঃ)-কে নির্যাতনকারী এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্মুখে ও পিছনে নিন্দাকারী নরাধম উমাইয়া বিন খালাফ-এর সাথে আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ)-এর জাহেলী যুগে বন্ধুত্ব ছিল। বদর যুদ্ধ শেষে সে আব্দুর রহমান বিন ‘আওফকে বলল, আমাকে তুমি বন্দী করে নিয়ে চল। তাহ’লে তোমরা রক্তমূল্য হিসাবে বহু দুগ্ধবতী উষ্ট্রী পাবে। ছাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে ‘আওফ তাকে ও তার পুত্র আলীকে নিয়ে রাসূলের দরবারে চললেন। পথিমধ্যে বেলাল তাকে দেখতে পেয়ে চীৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, ওহে আল্লাহর সাহায্যকারীগণ! শীর্ষ কাফের উমাইয়া এখানে। হয় আমি থাকব, নয় সে থাকবে’। তার ডাকের সাথে সাথে চারদিক থেকে লোকেরা এসে ঘিরে ফেলল। আব্দুর রহমান শত চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারলেন না। ফলে পিতা-পুত্র দু’জনেই সেখানে নিহত হ’ল।
(৩) এই যুদ্ধে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তার মামা ‘আছ ইবনু হিশাম ইবনু মুগীরাহকে হত্যা করেন।
(৪) হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) স্বীয় পুত্র আব্দুর রহমানকে ডাক দিয়ে বলেন, أين مالي يا خبيث ‘রে দুরাচার! আমার মাল-সম্পদ কোথায়? ঐ সময় সে মাক্কীদের পক্ষে যুদ্ধে এসেছিল। পরে সে মুসলমান হয়ে যায়।
(৫) মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)-এর ভাইকে বন্দী করতে দেখে জনৈক আনছার ছাহাবীকে তিনি বলেন, ওকে ভালভাবে বেঁধে নিয়ে যাও। ওর মা খুব ধনী মহিলা। অনেক রক্তমূল্য পাবে। তখন তার ভাই আবু উযায়ের ইবনু উমায়ের বলল, আমার ব্যাপারে এটাই কি তোমার শেষ কথা? মুছ‘আব বললেন, إنه الأنصاري أخي دونك এই আনছারীই এখন আমার ভাই। তুমি নও’। উল্লেখ্য যে, ইসলাম কবুল করার অপরাধে মুছ‘আবের মা তার খানাপিনা বন্ধ করেছিল এবং পরে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবার পর তাকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
(৬) উক্কাশা বিন মিহছান (রাঃ)-এর তরবারি ভেঙ্গে গেছে। তিনি এলেন রাসূলের কাছে তরবারি চাইতে। রাসূলের কাছে বাড়তি কোন তরবারি নেই। তাই একটা ভাঙ্গা কাষ্ঠখন্ড দিয়ে বললেন, قاةل بهذا يا عكاشة ‘এটা দিয়ে যুদ্ধ কর হে উক্কাশাহ’! সেটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই লম্বা চকচকে ধারালো তরবারিতে পরিণত হয়ে গেল। তারপর তিনি সেটা ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি সেটা দিয়ে যুদ্ধ করেন এবং আবুবকর (রাঃ)-এর সময়ে ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে রিদ্দার যুদ্ধকালে তিনি ঐ তরবারির সাহায্যে যুদ্ধ করেন এবং শাহাদাত বরণ করেন। ঐ তরবারিকে ‘আল-‘আওন’ (العون) বা ‘আল্লাহর সাহায্য’ বলা হ’ত। নিঃসন্দেহে এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যতম মু‘জেযা।
(৭) মুশরিক নেতাদের মৃত দেহগুলি কূয়ায় নিক্ষেপকালে উৎবা বিন বারী‘আহর লাশ টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে তার পুত্র আবু হুযায়ফা (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, يا أبا حذيفة لعلك قد دخلك من شأن أبيك شيء- ‘হে আবু হুযায়ফা! তোমার পিতার এ অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই তোমার অন্তরে খারাব লাগছে’? জবাবে আবু হুযায়ফা বললেন, لا والله يا رسول الله ما شككت في أبي ولا مصرعه ولكنى كنت أعرف في أبي رأيا وحلما وفضلا فكنت ارجو أن يهديه ذلك إلى الإسلام- ‘আল্লাহর কসম! তা নয় হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা ও তার নিহত হওয়ার ব্যাপারে আমার মনে কোন ভাবান্তর নেই। তবে আমার পিতার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, দূরদর্শিতা ও কল্যাণময়তা ছিল। আমি আশা করতাম এগুলি তাঁকে ইসলামের দিকে পথ দেখাবে। কিন্তু এখন তার কুফরী হালতে মৃত্যু দেখে দুঃখিত হয়েছি’। এ জবাব শুনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন এবং তার সম্পর্কে ভাল মন্তব্য করলেন।
(৮) তিনদিন অবস্থানের পর বিদায় কালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কার মৃত নেতাদের উদ্দেশ্যে গভীর রাতে কূয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, يا أهل القليب بئس عشيرة النبي كنتم لنبيكم! كذبتموني وصدقني الناس، أخرجتموني وآواني الناس، قاتلتموني ونصرني الناس- هل وجدتم ما وعدكم ربكم حقا؟ فإني قد وجدت ما وعدني ربي حقا- ‘হে কূয়ার অধিবাসীগণ! কতই না মন্দ আত্মীয় ছিলে তোমরা তোমাদের নবীর জন্য। তোমরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছিলে, আর লোকেরা আমাকে সত্যবাদী বলেছিল। তোমরা আমাকে বের করে দিয়েছিলে, আর লোকেরা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। তোমরা আমার সাথে লড়াই করেছ, অথচ লোকেরা আমাকে সাহায্য করেছে। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন, তা কি তোমরা সত্যরূপে পেয়েছ? কেননা আমাকে আমার পালনকর্তা যে ওয়াদা দিয়েছিলেন, তা সত্যরূপে পেয়েছি’। ওমর (রাঃ) বললেন, হে রাসূল! তিনদিন পরে আপনি ওদের ডাকছেন। ওরা কি শুনতে পাচ্ছে? অথচ আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি শুনাতে পারো না কোন মৃতকে’ (নমল ৮০)। জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, والذي نفسي بيده ما أنتم بأسمع لما أقول منهم ولكن لا يستطيعون أن يجيبوا، ‘যার হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা তাদের চাইতে অধিক শ্রবণকারী নও, যা আমি বলছি। কিন্তু তারা জওয়াব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না’। এর ব্যাখ্যায় ক্বাতাদাহ বলেন, আল্লাহ তাদেরকে সাময়িকভাবে জীবিত করেন, যাতে তারা নবীর ধিক্কারবাণীগুলি শুনতে পায় ও লজ্জিত হয়’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, إنما قال النبي صلى الله عليه وسلم إنهم الآن ليعلمون أن الذي كنت أقول لهم هو الحق ثم قرأت الآية- ‘নবী (ছাঃ) বলেছেন যে, নিশ্চয়ই তারা এখনি জানতে পারবে যে, আমি তাদেরকে যা বলেছি, তা সত্য’ অতঃপর তিনি আয়াত দু’টি পাঠ করেন (নমল ৮০, ফাতির ২২)।[37] মূলতঃ জীবিতদের শোনানোই হ’ল মূল উদ্দেশ্য। যুগ যুগ ধরে যাতে কাফির-মুনাফিকরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।
মক্কায় পরাজয়ের খবর ও তার প্রতিক্রিয়া :
হায়সামান ইবনু আবদুল্লাহ খুযাঈ (الحيسمان بن عبد الله الخزاعي) সর্বপ্রথম মক্কায় পরাজয়ের খবর পেঁŠছে দেয়। এ খবর তাদের উপরে এমন মন্দ প্রভাব ফেলল যে, তারা শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে গেল এবং সকলকে বিলাপ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। যাতে মুসলমানেরা তাদের দুঃখ দেখে আনন্দিত হবার সুযোগ না পায়। যুদ্ধ ফেরত ভাতিজা আবু সুফিয়ান বিন হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবকে দেখে আবু লাহাব সাগ্রহে যুদ্ধের খবর কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা এমন একটা দলের সঙ্গে মুকাবিলা করেছি, যাদেরকে আমরা আমাদের কাঁধগুলি পেতে দিয়েছি। আর তারা ইচ্ছামত হত্যা করেছে ও বন্দী করেছে। এতদসত্বে্ও আমি আমাদের লোকদের তিরষ্কার করছি না এ কারণে যে, প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের মুকাবিলা এমন কিছু শুভ্রবসন লোকের সঙ্গে হয়েছিল, যারা আসমান ও যমীনের মাঝখানে সাদা-কালো মিশ্রিত (خيل بلق) ঘোড়ার উপরে সওয়ার ছিল। আল্লাহর কসম! না তারা কোন কিছুকে ছেড়ে দিচ্ছিল, না কেউ তাদের মুকাবিলায় দাঁড়াতে পারছিল’ (والله ما تليق شيئا ولا يقوم لها شيء) একথা শুনে পাশেই দাঁড়ানো আবু রাফে‘, যিনি হযরত আববাস-এর গোলাম ছিলেন এবং মুসলমান ছিলেন, বলে ওঠেন ةلك والله الملائكةُ ‘আল্লাহর কসম! ওঁরা ফেরেশতা’। একথা শুনে ক্ষুব্ধ আবু লাহাব তার গালে ভীষণ জোরে এক চড় বসিয়ে দিল। তখন উভয়ে লড়াই শুরু হয়ে গেল। আবু লাহাব আবু রাফে‘-কে মাটিতে ফেলে দিয়ে মারতে লাগল। তখন হযরত আববাস-এর স্ত্রী উম্মুল ফযল (রাঃ) এসে তাঁবুর একটা খুঁটি নিয়ে আবু লাহাবকে ভীষণ জোরে পিটুনি দিয়ে বললেন, استضفته أن غاب عنه سيده ‘ওর মনিব বাড়ী নেই বলে ওকে তুমি দুর্বল ভেবেছ? এতে লজ্জিত হয়ে আবু লাহাব উঠে গেল। এর মাত্র সাতদিনের মধ্যেই আল্লাহর হুকুমে সে আদাসাহ (عدسه) নামক মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেহ পচে গলে মারা পড়ল। গুটি বসন্তের ন্যায় এই রোগকে সে যুগে মানুষ কু-লক্ষণ ও সংক্রামক ব্যাধি বলে জানত। ফলে তাকে বাড়ী থেকে দূরে নির্জন স্থানে রেখে আসা হয়। সেখানেই সে নিঃসঙ্গভাবে মৃত্যুবরণ করে। এ অবস্থায় তিনদিন লাশ পড়ে থাকলেও কেউ তার কাছে যায়নি। অবশেষে লোকেরা পাশেই গর্ত করে লাঠি দিয়ে ঠেলে ফেলে তার উপর মাটি ও পাথর ছুঁড়ে পুঁতে দিল দুর্গন্ধের ভয়ে। এই ভাবে এই দুরাচার নরাধম দুনিয়া থেকে বিদায় হ’ল। ছাফা পাহাড়ের বক্তৃতার দিন রাসূলকে تبا لك سائر اليوم ‘সর্বদা তুমি ধ্বংস হও’ বলার ১৫ বছর পরে তার এই পরিণতি হয়।
আবু লাহাবের চার পুত্র ছিল। তন্মধ্যে দু’জন আবু লাহাবের জীবদ্দশায় কুফরী হালতে মৃত্যুবরণ করে। বাকী দু’জন পুত্র ও এক কন্যা মুসলমান হয়ে যায়। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে আসতে গিয়ে হঠাৎ পড়ে যায় এবং বোঝা বাঁধার রশি গলায় ফাঁস লেগে ঘটনাস্থালই মৃত্যুবরণ করে। তাদের অগাধ ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তাদের কোনই কাজে আসেনি।[38] এভাবেই কুরআনের সূরা লাহাবে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়।
মদীনায় বিজয়ের খবর :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা আনছারীকে মদীনার উচ্চ ভূমিতে এবং যায়েদ ইবনু হারেছাহকে নিম্নভূমিতে পাঠিয়ে দেন মদীনায় দ্রুত বিজয়ের খবর পৌঁছানোর জন্য। ঐ সময় রাসূলের কন্যা ও হযরত ওছমানের স্ত্রী রুক্বাইয়া (রাঃ)-কে দাফন করে মাটি সমান করা হচ্ছিল। যার অসুখের কারণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ওছমান ও উসামা বিন যায়েদকে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন তার সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য।
অন্য দিকে ইহুদী ও মুনাফিকেরা রাসূলের পরাজয় এমনকি তাঁর নিহত হবার খবর আগেই রটিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর নিশ্চিত খবর জানতে পেরে মুহাজির ও আনছার ছাহাবীগণ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার ধবনিতে মদীনা মুখরিত করে তোলেন এবং রাসূলকে অভ্যর্থনার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন।
গনীমত বণ্টন :
যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদরে তিনদিন অবস্থান করেন। এরি মধ্যে গনীমতের মাল নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়, যা এক সময়ে চরমে ওঠে। যারা শত্রুদের পিছু ধাওয়া করেছিল ও কাউকে হত্যা ও কাউকে বন্দী করেছিল, তারা সব মাল দাবী করল। আরেক দল যারা গনীমত জমা করেছিল, তারা সব মাল তাদের বলে দাবী করল। আরেক দল যারা রাসূলকে পাহারা দিয়ে হেফাযত করেছিল, তারাও সব নিজেদের বলে দাবী করল। এ সময় সূরা আনফাল নাযিল হয় এবং সেমতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সব মাল তার নিকটে জমা করতে বলেন। অতঃপর বদর থেকে রওয়ানা দিয়ে ছাফরা (الصفراء) গিরি সংকট অতিক্রম করে একটি টিলার উপরে গিয়ে বিশ্রাম করেন এবং সেখানে বসে গনীমতের সমস্ত মালের এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী মাল সৈন্যদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দেন। এর পূর্বে ছাফরা গিরিসংকটে কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী দুষ্টমতি নযর বিন হারিছকে রাসূলের আদেশক্রমে হযরত আলী (রাঃ) হত্যা করেন। এই শয়তান ইরাকের ‘হীরা’ থেকে নাচগানে পারদর্শী সুন্দরী নর্তকী খরিদ করে এনে মক্কাবাসীদের বিভ্রান্ত করত। যাতে কেউ রাসূলের কথা না শোনে ও কুরআন না শোনে। এরপর ইরকুয যাবিয়াহ (عرق الظبية) নামক স্থানে পৌছে আরেক শয়তানের শিখন্ডী রাসূলকে ছালাতরত অবস্থায় ঘাড়ে পা মাড়িয়ে গলায় চাদর পেঁচিয়ে এবং পরে একবার মাথায় উটের ভুঁড়ি চাপিয়ে হত্যা প্রচেষ্টাকারী উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বকে হত্যার নির্দেশ দেন। একে মারেন আছেম বিন ছাবিত আনছারী। মতান্তরে হযরত আলী (রাঃ)। এই দু’জন ব্যক্তি বন্দীর মর্যাদা পাবার যোগ্য ছিল না। কেননা তারা ছিল আধুনিক পরিভাষায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী (من مجرمى أكبر)।
মদীনায় অভ্যর্থনা :
মদীনার উপকণ্ঠে রাওহা (الروحاء) নামক স্থানে পৌঁছলে মদীনা থেকে আগমনকারী অগ্রবর্তী অভ্যর্থনাকারী দলের সাথে প্রথম মুলাকাত ঘটে। তারা বিপুল উৎসাহে বিজয়ী রাসূলকে অভ্যর্থনা করে। অভ্যর্থনার উচ্ছ্বাস দেখে রাসূলের সাথী ছাহাবী সালামা বিন সালামাহ (سلمة بن سلامة) বলেন,ما الذى تهنئوننا فوالله إن لقينا إلا عجائز صُلْعًا كالبدن- ‘আপনারা কিজন্য আমাদের মুবারকবাদ দিচ্ছেন’? ‘আল্লাহর কসম! আমরা তো কিছু টেকো মাথা বুড়োদের মুকাবিলা করেছি, যারা ছিল উটের মত’। তার কথা বলার ঢং দেখে রাসূল (ছাঃ) মুচকি হেসে বললেন, يا ابن أخى أولئك الملأ ‘হে ভাতিজা! ওরাই তো নেতা’। এ সময় ছাহাবী উসায়েদ বিন হুযায়ের আনছারী (أسيد بن حضير) যিনি বদর যুদ্ধে শরীক ছিলেন না, তিনি সাক্ষাৎ করে বললেন, হে রাসূল (ছাঃ)! সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আপনাকে বিজয় দান করেছেন ও আপনার চক্ষুকে শীতল করেছেন। হে রাসূল! আল্লাহর কসম! আমি একথা ভেবে বদরে গমন হ’তে পিছনে থাকিনি যে, আপনার মুকাবিলা শত্রুদের সাথে হবে। আমি তো ভেবেছিলাম এটা স্রেফ বাণিজ্য কাফেলার বিষয়। ولو ظننت أنه عدو ما تخلفت ‘যদি বুঝতাম যে, এটা শত্রুদের বিরুদ্ধে মুকাবিলা, তাহ’লে আমি কখনো পিছনে থাকতাম না’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, (صدقت) ‘তুমি সত্য বলেছ’। পরবর্তী ওহোদ যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে আনছার বাহিনীর মধ্যে আউসদের পতাকাবাহী নিযুক্ত করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রবেশ করেন। যা মদীনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহে শত্রু-মিত্র সকলের মধ্যে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এ সময় আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার সাথীরা বাহ্যিকভাবে ইসলাম কবুল করে। এছাড়া বহু লোক দলে দলে এসে মুসলমান হ’তে থাকে। একদিকে কন্যা হারানোর বেদনা অন্যদিকে যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ এরি মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন।
যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে ফায়ছালা :
রাসূল (ছাঃ)-এর আগমনের একদিন পরে বন্দীদের কাফেলা মদীনায় পৌছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে ছাহাবীগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের আদেশ দেন। তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হয় এবং ছাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খাওয়ান। কেননা ঐ সময় মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল মূল্যবান খাদ্য। অতঃপর তিনি ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন। আবুবকর (রাঃ) তাদেরকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিতে বলেন। কেননা এর ফলে কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের হেদায়াত নছীব করতে পারেন এবং তারা আমাদের জন্য সাহায্যকারী হ’তে পারে। কিন্তু ওমর ফারূক (রাঃ) স্ব স্ব আত্মীয়কে স্ব স্ব হস্তে হত্যা করার পরামর্শ দেন। দয়ার নবী আবু বকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং অধিকাংশ বন্দীকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দেন। আবুল ‘আছ সহ কয়েকজনকে রক্তমূল্য ছাড়াই মুক্তি দেন। আবুল ‘আছ ছিল খাদীজার সহোদর বোনের ছেলে এবং রাসূল কন্যা যয়নবের স্বামী। কয়েকজনকে মাথা প্রতি ১০ জনকে লেখাপড়া শিখানোর বিনিময়ে মদীনাতেই রেখে দেন। তাদের মেয়াদ ছিল উত্তম রূপে পড়া ও লেখা শিক্ষা দান করা পর্যন্ত। এর দ্বারা শিক্ষা বিস্তারের প্রতি রাসূলের আকুল আগ্রহের প্রমাণ মেলে। যা কোন যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের ইতিহাসে নযীর বিহীন।
রাসূলের জামাতা আবুল ‘আছের রক্তমূল্য বাবদ তাঁর কন্যা যয়নবের যে কণ্ঠহারটি পেশ করা হয়, তা ছিল হযরত খাদীজার দেওয়া। তা দেখে রাসূল (ছাঃ) কেঁদে ফেলেন এবং সবাইকে অনুরোধ করেন রক্তমূল্য ছাড়াই তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। বিনিময়ে কন্যা যয়নবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়ার শর্ত করা হয় এবং তা যথারীতি পূরণ হয়। হিজরতকালে হিবার ইবনুল আসওয়াদ (هبار بن الأسود) তাঁকে বর্শা দিয়ে আঘাত করে। যার ফলে উটের পিঠ হ’তে একটি পাথরের উপর পতিত হ’লে যয়নবের গর্ভপাত হয়ে যায়। এ মর্মান্তিক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুঃখ করে বলেছিলেন, أفضل بناتى أصيبت فىَّ ‘সে আমার সেরা মেয়ে। আমার জন্য সে বিপদগ্রস্ত হয়েছে’। উল্লেখ্য যে, হিবার মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন। পরবর্তীতে ৬ষ্ঠ হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে আবুল ‘আছ মুসলমান হয়ে মদীনা এলে যয়নবকে তিন বছরের কিছু পরে তার স্বামীর কাছে ন্যস্ত করা হয়। যয়নব ৮ হিজরীতে এবং আবুল ‘আছ ১২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
বন্দী মুক্তির পরের দিনই সূরা আনফালের ৬৭ ও ৬৮ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে হযরত ওমরের পরামর্শের প্রতি আল্লাহর সমর্থন প্রকাশ পায়। যাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) ক্রন্দন করতে থাকেন। উক্ত আয়াতে বলা হয়,
مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ الآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ- لَوْلاَ كِتَابٌ مِّنَ اللهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيْمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ- (الأنفال ৬৭-৬৮)-
‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান আখেরাতের কল্যাণ। আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’। ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ, তজ্জন্য তোমাদেরকে ভয়ংকর শাস্তি গ্রেফতার করত’ (আনফাল ৮/৬৭-৬৮)।
উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখিত পূর্ব বিধানটি ছিল নিম্নরূপ:
فَإِذا لَقِيْتُمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّى إِذَا أَثْخَنْتُمُوْهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنّاً بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذَلِكَ وَلَوْ يَشَاءُ اللهُ لاَنْتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُمْ بِبَعْضٍ وَالَّذِيْنَ قُتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَلَنْ يُّضِلَّ أَعْمَالَهُمْ- (محمد ৪)-
‘অতঃপর যখন তোমরা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের গর্দান মার। অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত কর, তখন তাদেরকে শক্ত করে বেঁধে ফেল। অতঃপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের থেকে মুক্তিপণ লও। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না শত্রু অস্ত্র সমর্পণ করে.. (মুহাম্মাদ ৪৭/৪)।
উল্লেখ্য যে, নাখলা যুদ্ধের পরে ও বদর যুদ্ধের পূর্বে শা‘বান মাসে যুদ্ধ ফরয করে সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ ও ২০ আয়াত সমূহ নাযিল হয়। যাতে যুদ্ধের বিধি-বিধান সমূহ বর্ণিত হয়। এজন্য এ সূরাকে ‘সূরা ক্বিতাল’ বলা হয়। তবে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে সূরা হজ্জের ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয় হিজরতের অব্যবহিতকাল পরেই, কুরায়েশদের অব্যাহত সন্ত্রাস ও হামলা মুকাবিলার জন্য।
উক্ত সূরা মুহাম্মাদ ৪ আয়াতে অনুগ্রহ অথবা মুক্তিপণের কথা বলা হয়েছে। সেই বিধান মতেই বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সূরা আনফালে বর্ণিত ধমকির আয়াতটি সঙ্গে সঙ্গে নাযিল না হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরে নাযিল হওয়ার মধ্যে আল্লাহর অশেষ করুণা নিহিত ছিল। যাতে বনু হাশেম সহ মুসলমানদের অনেক হিতাকাংখী বন্দী মুক্তি পান ও পরে তারা প্রকাশ্যে মুসলমান হয়ে যান। এই সময় বন্দী বিনিময়ের ঘটনাও ঘটে। যেমন হযরত সা‘দ ইবনু নু‘মান (রাঃ) ওমরাহ করার জন্য গেলে আবু সুফিয়ান তাকে আটকে দেন। পরে বদর যুদ্ধে বন্দী আমর ইবনু আবী সুফিয়ানকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে তাকে মুক্ত করা হয়।
বিজয়োৎসব :
২য় হিজরী সনে রামাযানের ছিয়াম ও যাকাতুল ফিৎর ফরয করা হয়। এছাড়া যাকাতের নিছাব সমূহ বর্ণিত হয়। যা আশ্রিত ও দুস্থ মুসলমানদের জন্য আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দেয়। অতঃপর বদর যুদ্ধের কয়েক দিন পরেই ঈদুল ফিৎরের উৎসব পালিত হয়, যা মদীনার মুসলমানদের নিকটে সত্যিকারের বিজয়োৎসবে পরিণত হয়।
কুরআনী বর্ণনা :
বদর যুদ্ধ বিষয়ে সূরা আনফাল নাযিল হয়। উক্ত সূরায় মুসলমানদের দুর্বলতা এবং আল্লাহর গায়েবী মদদের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি উক্ত যুদ্ধের মহৎ উদ্দেশ্যের কথাও বর্ণিত হয়েছে। যার দ্বারা জাহেলী যুগের যুদ্ধের সাথে এ যুদ্ধের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখানে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বণ্টনরীতি যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি ইসলাম যে কেবল একটি বিশ্বাসের নাম নয়, বরং একটি বাস্তব রীতি-নীতি সমৃদ্ধ সমাজদর্শনের নাম সেটাও বলে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে ইসলামী খেলাফতের অধীনে বসবাসকারী ও তার বাইরে বসবাসকারী লোকদের মধ্যেকার পার্থক্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ মুসলমানদের প্রতি তাঁর রহমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
وَاذْكُرُوْا إِذْ أَنْتُمْ قَلِيْلٌ مُّسْتَضْعَفُوْنَ فِي الأَرْضِ تَخَافُوْنَ أَنْ يَّتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُمْ بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ- (الأنفال ২৬)-
‘আর স্মরণ কর যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প, পৃথিবীতে তোমরা দুর্বল বলে গণ্য হ’তে, তোমরা আশংকা করতে যে, লোকেরা তোমাদের অকস্মাৎ উঠিয়ে নিয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের আশ্রয় দেন ও তোমাদেরকে নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন এবং তোমাদেরকে উত্তম বস্ত্ত সমূহ জীবিকারূপে দান করেন যাতে তোমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও’ (আনফাল ৮/২৬)।
বদর যুদ্ধের গুরুত্ব :
(১) এটাই ছিল মুসলমানদের সাথে মুশরিকদের সর্বপ্রথম মুখোমুখি সশস্ত্র সংঘর্ষ।
(২) এটি ছিল ইসলামের টিকে থাকা না থাকার ফায়ছালাকারী যুদ্ধ
(৩) এটি ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী অথচ একটি অসম যুদ্ধ। কেননা একটি সুসজ্জিত এবং সংখ্যায় তিনগুণ অধিক ও প্রশিক্ষিত সেনাদলের সাথে অপ্রস্ত্তত, অসজ্জিত এবং সংখ্যায় তিনগুণ কম এবং বাস্ত্তভিটা হারা মুহাজির ও নওমুসলিম আনছারদের এ যুদ্ধে জয় লাভ ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার। এ কারণেই এ যুদ্ধের দিনটিকে পবিত্র কুরআনে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ‘ফায়ছালাকারী দিন’ (আনফাল ৮/৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে ।
(৪) বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হ’তে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)। উল্লেখ্য যে, ‘বদর’ নামটি কুরআনে মাত্র একটি স্থানেই উল্লেখিত হয়েছে।
(৫) বদরের যুদ্ধ ছিল কাফেরদের মূল কর্তনকারী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানকারী। এ যুদ্ধের পরে কাফের সমাজে এমন আতংক প্রবেশ করে যে, তারা আর কখনো বিজয়ের মুখ দেখেনি। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُّحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ- ‘আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে আর তোমরা কামনা করছিলে যাতে কোনরূপ কণ্টক ছাড়াই সেটা তোমাদের হাতে আসে। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফেরদের মূল কর্তন করে দিতে’। ‘যাতে করে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপীরা তাতে নাখোশ হয়’ (আনফাল ৮/৭-৮)।
(৬) এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। এমনকি মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলে বাধ্য হয়। শত্রুরা ভীত হয়ে চুপসে যায়।
(৭) বদরের যুদ্ধের বিজয় ছিল মক্কা বিজয়ের সোপান স্বরূপ। এই সময় শা‘বান মাস থেকে কা‘বার দিকে কিবলা পরিবর্তিত হয় এবং বদর যুদ্ধের মাত্র ছয় বছর পরেই ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান তারিখে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে যা পূর্ণতা লাভ করে।
শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ (২২):
(১) মক্কায় পরিবেশ প্রতিকূলে থাকায় সেখানে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে মদীনায় পরিবেশ অনুকূলে থাকায় এবং এখানে সবাই রাসূলের নেতৃত্ব মেনে নিতে মৌখিক ও লিখিতভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার ফলে মুসলমানেরা চালকের আসনে থাকায় রাসূলকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়। এতে বুঝা যায় যে, বিজয়ের সম্ভাবনা ও পরিবেশ না থাকলে যুদ্ধের ঝুঁকি না নিয়ে ছবর করতে হবে। যেমনটি মাক্কী জীবনে করা হয়েছিল।
(২) বদরের যুদ্ধ ছিল মূলতঃ আত্মরক্ষামূলক। আবূ জাহলকে বদরে মুকাবিলা না করলে সে সরাসরি মদীনায় হামলা করার দুঃসাহস দেখাত। যা ইতিপূর্বে তাদের একজন নেতা কূরয বিন জাবের ফিহরী সরাসরি মদীনার উপকণ্ঠে হামলা করে গবাদিপশু লুটে নেবার মাধ্যমে জানিয়ে গিয়েছিল। এতে বুঝা যায় যে, আত্মরক্ষা এবং ইসলামের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোন কারণে কাফেরদের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি নেই।
(৩) সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশী বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং আল্লাহর উপরে দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুল হ’ল বিজয়ের মূল হাতিয়ার। পরামর্শ সভায় কয়েকজন ছাহাবী বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার পরামর্শ দিলে আল্লাহ ধমক দিয়ে আয়াত নাযিল করেন (আনফাল ৮/৫-৬)। এতে বুঝা যায়, আল্লাহর গায়েবী মদদ লাভই হ’ল বড় বিষয়।
(৪) যুদ্ধের উদ্দেশ্য হ’তে হবে জান্নাত লাভ। যেটা যুদ্ধ শুরুর প্রথম নির্দেশেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। অতএব চিন্তাক্ষেত্রের যুদ্ধ হৌক বা সশস্ত্র মুকাবিলা হৌক ইসলামের সৈনিকদের একমাত্র লক্ষ্য থাকতে হবে জান্নাত লাভ। কোন অবস্থাতেই দুনিয়া হাছিলের জন্য মুসলমানের চিন্তাশক্তি বা অস্ত্র শক্তি ব্যয়িত হবে না।
(৫) স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে নামলে আল্লাহ স্বীয় ফেরেশতা মন্ডলী পাঠিয়ে সরাসরি সাহায্য করে থাকেন। যেমন বদর যুদ্ধের শুরুতে রাসূলের বালু নিক্ষেপের মাধ্যমে (আনফাল ৮/১৭) অতঃপর ফেরেশতাদের সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাহায্য করা হয়েছিল (আনফাল ৮/৯)।
(৬) যুদ্ধে গনীমত লাভের মাধ্যমে দুনিয়া অর্জিত হ’লেও তা কখনোই মুখ্য হবে না। বরং সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী সেনাপতির অনুগত থাকতে হবে। বদর যুদ্ধে গনীমত বণ্টন নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হ’লেও তা সাথে সাথে নিষ্পত্তি হয়ে যায় রাসূলের নির্দেশে এবং আয়াত নাযিলের মাধ্যমে (আনফাল ৮/১)।
(৭) কাফিররা মুসলমানদের সংখ্যা ও অস্ত্র শক্তিকে ভয় পায় না। বরং তারা ভয় পায় মুসলমানের ঈমানী শক্তিকে। বদরের যুদ্ধের পরে সে ভয় সমস্ত কুফরী শক্তিকে গ্রাস করেছিল। এ কারণেই পরবর্তী ওহোদের যুদ্ধে তারা মহিলাদের সাথে করে এনেছিল। যাতে পুরুষেরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে না পালায়।
(৮) বদর যুদ্ধের বড় শিক্ষা এই যে, কুফর ও ইসলামের মুকাবিলায় মুসলমান নিজের সীমিত শক্তি নিয়ে আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল করে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর এভাবেই চিরকাল ঈমানদার সংখ্যালঘু শক্তি বেঈমান সংখ্যাগুরু শক্তির উপরে বিজয়ী হয়ে থাকে (বাক্বারাহ ২/২৪৯)। এ ধারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।
পরবর্তী অংশ পড়ুন: রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুদ্ধ ও অভিযান সমূহ
[1] আবুদাঊদ, হা/৩০০৪, ‘খারাজ’ অধ্যায়।
[2] বুখারী, হা/৩৯৫০ ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ২ পরিচ্ছেদ।
[3] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬১০৫।
[4] মায়েদাহ ৫/৬৭; তিরমিযী হা/৩৩২০ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[5] নাসাঈ, হা/৩০৮৫ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ১ অনুচ্ছেদ।
[6] রাহমাতুল লিল আলামীন ২/১৮৬।
[7] আর-রাহীক্ব ১৯৮।
[8] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬১৮-১৯।
[9] কাশশাফ, নাসাফী, বাহরুল মুহীত্ব, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ১৯ আয়াত; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৮২।
[10] আহমাদ হা/৮৪৭; ছহীহাহ হা/৩৩৪০।
[11] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬১৫ পৃঃ।
[12] আনফাল ৮/৫-৬; ঐ, তাফসীর ইবনে কাছীর; ফাৎহুল বারী হা/৩৭৩৬ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; হায়ছামী বলেন, ত্বাবারাণী বলেছেন, সনদ হাসান।
[13] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬১৬-১৭; আহমাদ হা/৯৪৮ সনদ ছহীহ- আহমাদ শাকির।
[14] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২০-২১।
[15] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২২; বাক্বারাহ ২/২৪৯।
[16] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২৩; আল-বিদায়াহ ওয়ান নেহায়াহ ৩/২৬৯।
[17] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২১।
[18] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২৮।
[19] আর-রাহীক্ব পৃঃ ২১৬।
[20] হাকেম ২/৩২৮; কাশশাফ প্রভৃতি।
[21] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৭০-৭১।
[22] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৭২।
[23] তাফসীর সূরা আনফাল ৮/৯; তিরমিযী হা/৩০৮৯, সনদ হাসান।
[24] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২৭; বুখারী, মিশকাত হা/৫৮৭২-৭৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় মু‘জেযা অনুচ্ছেদ-৭; ক্বামার ৫৪/৪৫।
[25] মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৭১।
[26] আনফাল ৮/১৭; হাদীছটির সনদ মুরসাল। কিন্তু ইবনু কাছীর বলেন, আয়াতটি যে বদর যুদ্ধের ঘটনায় নাযিল হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। বিদ্বানগণের নিকট যা মোটেই গোপন নয়। ঐ, তাফসীর; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২৮।
[27] তাফসীর ত্বাবারী হা/১৫৮২৩, সনদ মুরসাল; তাফসীর ইবনু কাছীর আনফাল ১৭ আয়াত; মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৯১।
[28] মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[29] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৩৩; মুসলিম মিশকাত হা/৫৮৭৪।
[30] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৩৩।
[31] তাফসীর ইবনে কাছীর, আনফাল ৪৮; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৮৩।
[32] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৩৪-৩৫; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪০২৮।
[33] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪০২৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৭ অনুচ্ছেদ।
[34] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৩৫-৩৬।
[35] মুক্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪০২৮-২৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৭ অনুচ্ছেদ।
[36] আবু দাঊদ, নাসাঈ, বায়হাক্বী দালায়েল ৩/৮৮ পৃঃ সনদ মুনক্বাতি‘। তবে এর বহু শাওয়াহেদ রয়েছে। হাশিয়া কুরতুবী হা/৫০২; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৮৯।
[37] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৯৩-৮৪।
[38] মানছূরপুরী, রহমাতুল লিল আলামীন ৩/৩০৬।
ঈদ-উল-ফিৎর-এর নামাজ কি বদর যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালনের জন্য দ্বিতীয় হিজরী থেকে চালু হয়েছিল নাকি তার আগে থেকেই চালু ছিল দয়া করে জানাবেন।
[email protected]
PARBIN