তাবুক যুদ্ধের পর মক্কায় রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াতী জীবনের নতুন অধ্যায়
পূর্বের অংশ পড়ুন: ইসলামের যুদ্ধনীতি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর যুদ্ধ সমূহের উপর পর্যালোচনা
বাদশাহদের নিকটে পত্র প্রেরণ
রাসূল (ছাঃ)-এর পুরা জীবনটাই ছিল দাওয়াত ও জিহাদের জীবন। মাক্কী জীবন ছিল এককভাবে দাওয়াতী জীবন। মাদানী জীবনে সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি পেলেও তার মধ্যে তিনি সবসময় দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়েছেন। বিভিন্ন গোত্রে দাওয়াতী কাফেলা পাঠিয়েছেন। কখনও সফল হয়েছেন, কখনো বিফল হয়েছেন। ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে আযাল ও ক্বারাহ গোত্রে আছেম বিন ছাবিত (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ১০ জনের এবং নাজদের বনু সুলায়েম গোত্রে মুনযির বিন আমের (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৭০ জনের যে তাবলীগী কাফেলা পাঠান, তারা সবাই আমন্ত্রণকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে মর্মান্তিকভাবে শহীদ হয়ে যান। শেষোক্তটি বি’রে মাঊনার ঘটনা হিসাবে পরিচিত (সারিইয়া ক্রমিক সংখ্যা ২৪ ও ২৫)। আবার ৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাসে সিরিয়ার দূমাতুল জান্দালের বনু কালব খৃষ্টান গোত্রের নিকটে আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে যে তাবলীগী কাফেলা পাঠানো হয়, তা সফল হয় এবং খৃষ্টান গোত্র নেতাসহ সবাই মুসলমান হয়ে যান (সারিয়াহ ক্রমিক সংখ্যা ৪৪)। এছাড়া নবী ও ছাহাবীগণ সকলে ব্যক্তিগতভাবে সর্বদা দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করতেন। কেননা দাওয়াতই হ’ল ইসলামের প্রচার ও প্রসারের সর্বপ্রধান হাতিয়ার। মাদানী জীবনে মুশরিক-মুনাফিক ও ইহুদীদের অবিরতভাবে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধবাদী কর্মকান্ডের ফলে ইসলামের সুস্থ দাওয়াত বাধাগ্রস্ত হয়।
৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে প্রধান প্রতিপক্ষ কুরায়েশদের সাথে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরের ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানদের জীবনে অনেকটা স্বস্তি ফিরে আসে। ফলে এই সময়টাকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইসলামের দাওয়াত প্রসারের জন্য একটি মহতী সুযোগ হিসাবে কাজে লাগান। এই সময় তৎকালীন আরব ও পার্শ্ববর্তী রাজা-বাদশা ও গোত্রনেতাদের নিকটে পত্র প্রেরণের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত প্রসারে তিনি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। পত্র বাহকের মাধ্যমে পত্রসমূহ প্রেরিত হয় এবং সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী পত্রের শেষে সীলমোহর ব্যবহার করা হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর আংটিতে মুদ্রিত সীলমোহরটি ছিল রৌপ্য নির্মিত এবং যাতে ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’ খোদিত ছিল। নীচে মুহাম্মাদ, তার উপরে রাসূল এবং তার উপরে আল্লাহ এইভাবে লিখিত ছিল (محمد رسول الله)।[1]
মানছূরপুরীর হিসাব মতে ৭ম হিজরীর ১লা মুহাররম তারিখে এইসব পত্র বিভিন্ন প্রাপকের নিকটে প্রেরিত হয়। তবে আমাদের ধারণা মতে সকল পত্র একই দিনে প্রেরণ করা হয়নি। যেমন ওমান সম্রাটের নিকটে পত্রবাহক হিসাবে আমর ইবনুল আছকে পাঠানো হয়। অথচ তিনি ইসলাম গ্রহণের জন্য মদীনায় আসেন ৭ম হিজরীর প্রথম ভাগে। অতএব ওমানের পত্রটি বেশ পরে পাঠানো হয় বলে অনুমিত হয়। এলাকার ভাষায় অভিজ্ঞ এমন ব্যক্তিকেই পত্রবাহক নিযুক্ত করা হ’ত। যাতে তাদের নিকটে তিনি উত্তমভাবে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরতে সক্ষম হন। নিম্নে পত্রসমূহের কিছু নমুনা তুলে ধরা হ’ল:
১. আছহামা নাজাশীর নিকটে পত্র (الكتاب إلى النجاشي ملك الحبشة) : আমর ইবনে উমাইয়া যামরী (রাঃ)-এর মাধ্যমে হাবশার সম্রাট আছহামা ইবনুল আবজার (أصْحَمَة بن الأبْجَر) -এর নিকটে প্রেরিত পত্রের ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ :
هذا كتاب من محمد رسول الله إلى النجاشي، الأصحم عظيم الحبشة، سلام على من اتبع الهدي، وآمن بالله ورسوله، وشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، لم يتخذ صاحبة ولا ولداً، وأن محمدًا عبده ورسوله، أدعوك بدعاية الإسلام، فإني أنا رسوله، فأسلم تسلم، {يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلَمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلاَ يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضاً أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوْا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ} فإن أبيت فعليك إثم النصارى من قومك-
‘এটি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ-এর পক্ষ হ’তে প্রেরিত পত্র হাবশার সম্রাট আছহামা নাজাশীর নিকটে। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনেন এবং সাক্ষ্য দেন যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি কোন স্ত্রী বা সন্তান গ্রহণ করেন না। আর মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। নিশ্চয়ই আমি তাঁর রাসূল। অতএব ইসলাম গ্রহণ করুন। নিরাপদ থাকুন। (আল্লাহ বলেন, হে নবী!) ‘আপনি বলুন, হে কিতাবধারীগণ! এসো এমন একটি কথার দিকে, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে সমান এবং তা এই যে, আমরা আল্লাহ ব্যতীত কারু ইবাদত করব না। আমরা তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করব না এবং আল্লাহ ব্যতীত আমরা কাউকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করব না। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদের বলে দাও, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলমান’ (আলে ইমরান ৩/৬৪)। অতঃপর যদি আপনি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেন, তাহ’লে আপনার উপরে আপনার খৃষ্টান সম্প্রদায়ের পাপ বর্তাবে’।[2] মানছূরপুরী ত্বাবারীর বরাতে যে পত্র উদ্ধৃত করেছেন, তার সাথে অনেকটা গরমিল রয়েছে।
পত্রবাহক আমর ইবনে উমাইয়া যামরী (রাঃ) পত্রখানা বাদশাহ নাজাশীর হাতে সমর্পণ করলে তিনি শ্রদ্ধাভরে পত্রখানা নিজের দু’চোখের উপরে রাখেন। অতঃপর সিংহাসন থেকে নেমে ভূমিতে উপবিষ্ট হয়ে জাফর ইবনে আবু তালিবের হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে জওয়াবী পত্র লেখেন। যা নিম্নরূপ:
بِسْمِ اللهِ الرّحْمَنِ الرّحِيمِ إلَى مُحَمّدٍ رَسُولِ اللهِ مِنَ النّجَاشِيّ أَصْحَمَةَ سَلاَمٌ عَلَيْك يَا نَبِيَّ اللهِ مِنَ اللهِ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ- اللهُ الّذِيْ لاَ إلَهَ إلاَّ هُوَ أَمّا بَعْدُ : فَقَدْ بَلَغَنِي كِتَابُك يَا رَسُولَ اللهِ فِيمَا ذَكَرْتَ مِنْ أَمْرِ عِيسَى فَوَرَبِّ السّمَاءِ وَالْأَرْضِ إنّ عِيسَى لاَ يَزِيْدُ عَلَى مَا ذَكَرْتَ ثُفْرُوْقًا إنّهُ كَمَا ذَكَرْتَ وَقَدْ عَرَفْنَا مَا بُعِثْتَ بِهِ إلَيْنَا وَقَدْ قَرّبْنَا ابْنَ عَمِّك وَأَصْحَابَهُ فَأَشْهَدُ أَنّكَ رَسُولُ اللهِ صَادِقًا مُصَدِّقًا وَقَدْ بَايَعْتُك وَبَايَعْتُ ابْنَ عَمَّك وَأَسْلَمْتُ عَلَى يَدَيْهِ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْن-
‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে’- ‘আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি আছহামা নাজাশীর পক্ষ হ’তে। আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রেরিত আল্লাহর নবী! আপনার উপরে শান্তি এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হৌক। আল্লাহ সেই সত্তা, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতঃপর হে আল্লাহর রাসূল! আমার নিকটে আপনার পত্র পৌঁছেছে, তার মধ্যে আপনি ঈসা সম্পর্কে যা কিছু উল্লেখ করেছেন, আসমান ও যমীনের পালনকর্তার কসম! নিশ্চয়ই ঈসা আপনার বর্ণনার চাইতে কণামাত্র অধিক ছিলেন না। নিশ্চয়ই তিনি সেরূপ ছিলেন, যেরূপ আপনি বলেছেন। অতঃপর আপনি যা কিছু নিয়ে আমাদের নিকটে প্রেরিত হয়েছেন, আমরা তার সবকিছু জেনেছি এবং আপনার চাচাতো ভাই ও তার সাথীদের আমরা নিকটবর্তী করে নিয়েছি। অতঃপর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল। আপনি সত্যবাদী ও সত্যায়নকারী। আমি আপনার নিকটে বায়‘আত করেছি এবং বায়‘আত করেছি আপনার চাচাতো ভাইয়ের নিকটে এবং আমি তার হাতে ইসলাম কবুল করেছি বিশ্বপালক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য’।[3]
এখানে পত্রের বক্তব্য হিসাবে ঈসা (আঃ) সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, সেটা রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে জা‘ফরের বক্তব্য হ’তে পারে। যেমন ইতিপূর্বেকার নাজাশীর প্রশ্নের জবাবে রাসূল (ছাঃ)-এর বরাত দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, هُوَ عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ وَرُوْحُهُ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إلَى مَرْيَمَ الْعَذْرَاءِ الْبَتُوْلِ ‘তিনি ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল, তাঁর রূহ ও কলেমা, যা তিনি নিক্ষেপ করেছিলেন কুমারী সতী-সাধ্বী মরিয়ামের প্রতি’।[4] উল্লেখ্য যে, এ সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বিভিন্ন খৃষ্টান নেতার কাছে লিখিত পত্রে পূর্বে বর্ণিত সূরা আলে ইমরানের ৬৪ আয়াতটি উল্লেখ করতেন।[5]
অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ মতে নাজাশী দু’টি নৌকা করে পত্র বাহক আমর বিন উমাইয়া যামরীর সাথে হযরত জাফর, হযরত আবু মূসা আশ‘আরী প্রমুখ ছাহাবীগণকে মদীনায় পাঠিয়ে দেন। তারা সেখান থেকে খায়বরে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সম্রাট আছহামা নাজাশী ৯ম হিজরীর রজব মাসে ইন্তেকাল করলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার মৃত্যুর দিনেই সবাইকে অবহিত করেন এবং গায়েবানা জানাযা আদায় করেন’। আর এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গায়েবানা জানাযা।
ফায়েদা :
তাফসীরবিদগণের আলোচনায় আরেকটি বিষয় প্রতিভাত হয় যে, ৫ম নববী বর্ষে মুহাজিরগণের দ্বিতীয় যে দলটি হাবশায় হিজরত করেন, তাদের সাথে হযরত জাফর বিন আবু তালেব সম্ভবতঃ দু’বছর হাবশায় অবস্থান করেন এবং নাজাশী ও তাঁর সভাসদ মন্ডলী এবং পাদরী-বিশপসহ রাজ্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের নিকটে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। এ সময় নাজাশীর দরবারে জাফরের দেওয়া ভাষণ নাজাশী ও তার সভাসদদের অন্তর কেড়ে নেয়। ইসলামের সত্যতা ও শেষনবীর উপরে তাদের বিশ্বাস তখনই বদ্ধমূল হয়ে যায়। অতঃপর হাবশার মুহাজিরগণ যখন মদীনায় যাওয়ার সংকল্প করেন। তখন সম্রাট নাজাশী তাদের সাথে ৭০ জনের একটি ওলামা প্রতিনিধি দল মদীনায় প্রেরণ করেন। যাদের মধ্যে ৬২ জন ছিলেন আবিসিনীয় এবং ৮ জন ছিলেন সিরিয়। এরা ছিলেন খৃষ্টান সম্প্রদায়ের সেরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। সংসার ত্যাগী দরবেশ সূলভ পোষাকে এই প্রতিনিধিদলটি রাসূলের দরবারে পেঁŠছলে রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে সূরা ইয়াসীন পাঠ করে শুনান। সূরা ইয়াসীন শ্রবণকালে তাদের দু’চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হ’তে থাকে। তারা বলে ওঠেন ইনজীলের বাণীর সাথে কুরআনের বাণীর কি অদ্ভূত মিল! অতঃপর তারা সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেন।
প্রতিনিধি দলটির প্রত্যাবর্তনের পর সম্রাট নাজাশী প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেন। যদিও প্রথম থেকেই তিনি শেষনবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু ধর্মনেতাদের ভয়ে প্রকাশ করেননি। অতঃপর তিনি একটি পত্র লিখে স্বীয় পুত্রের নেতৃত্বে আরেকটি প্রতিনিধি দল মদীনায় পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ জাহাযটি পথিমধ্যে ডুবে গেলে আরোহী সকলের মর্মান্তিক সলিল সমাধি ঘটে।
উক্ত খৃষ্টান প্রতিনিধিদলের মদীনায় গমন ও ইসলাম গ্রহণের প্রতি ইঙ্গিত করেই সূরা মায়েদাহ ৮২ হ’তে ৮৫ চারটি আয়াত নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
لَتَجِدَنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَدَاوَةً لِلَّذِيْنَ آمَنُوا الْيَهُودَ وَالَّذِيْنَ أَشْرَكُوْا وَلَتَجِدَنَّ أَقْرَبَهُمْ مَوَدَّةً لِلَّذِيْنَ آمَنُوا الَّذِيْنَ قَالُوْا إِنَّا نَصَارَى ذَلِكَ بِأَنَّ مِنْهُمْ قِسِّيْسِيْنَ وَرُهْبَانًا وَأَنَّهُمْ لاَ يَسْتَكْبِرُوْنَ، وَإِذَا سَمِعُوْا مَا أُنْزِلَ إِلَى الرَّسُوْلِ تَرَى أَعْيُنَهُمْ تَفِيْضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوْا مِنَ الْحَقِّ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِيْنَ-
‘নিশ্চয়ই আপনি সব লোকের চাইতে ঈমানদারগণের অধিক শত্রু পাবেন ইহুদী ও মুশরিকদের এবং নিশ্চয়ই আপনি সব লোকের চাইতে ঈমানদারগণের অধিক নিকটবর্তী পাবেন ঐসব লোকদের, যারা বলে আমরা নাছারা। এটা এজন্য যে, তাদের মধ্যে রয়েছে অনেক আলেম ও দরবেশ এবং তারা অহংকার করে না’। ‘আর যখন তারা শ্রবণ করে ঐ বস্ত্ত যা রাসূলের প্রতি নাযিল হয়েছে, তখন আপনি দেখবেন যে, তাদের চক্ষুসমূহ দিয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হচ্ছে একারণে যে, তারা সত্যকে চিনতে পেরেছে। অতঃপর তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা আমরা ঈমান এনেছি। অতএব তুমি আমাদেরকে ঈমানের সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে লিপিবদ্ধ করে নাও’ (মায়েদাহ ৫/৮২-৮৩)।
সম্রাট নাজাশীর উপরোক্ত পদক্ষেপ সমূহের কারণে এবং তাঁর প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলের খবর জানতে না পারায় ও তাঁর প্রেরিত পত্র হস্তগত না হওয়ায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁকে ইসলাম কবুলের আহবান জানিয়ে পত্র লেখেন এবং যা তিনি শ্রদ্ধাভরে কবুল করেন।
মুবারকপুরীর তাহকীক্ব মতে আল্লাহর নবী (ছাঃ) বাদশাহ নাজাশীর নিকটে তিনবারে তিনটি চিঠি লেখেন। প্রথমটি ছিল মক্কায় থাকাকালীন সময়ে ৫ম নববী বর্ষের রজব মাসে যখন সেখানে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ১২ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলার প্রথম হিজরত অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর ৮৩ জন পুরুষ ও ১৯ জন মহিলা হিজরত করেন। পত্র বাহক ছিলেন জা‘ফর ইবনে আবু তালিব (রাঃ)। সেখানে বক্তব্য ছিল, … وَقَدْ بَعَثْتُ إِلَيْكُمْ ابْنَ عَمِّيْ جَعْفَرَاً وَمَعَهُ نَفَرٌ مِّنَ الْمُسْلِمِيْنَ، فَإِذَا جَاءَكَ فَأَقَرَّهُمْ وَدَعِ التَّجْبَرَ ‘আমি আপনার নিকটে আমার চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালেবকে পাঠালাম। তার সাথে মুসলমানদের একটি দল রয়েছে। অতএব যখন সে আপনার নিকটে যাবে, আপনি তাকে আশ্রয় দিবেন এবং কোনরূপ যবরদস্তি করবেন না’।
অতঃপর দ্বিতীয় পত্রটি ছিল ৭ম হিজরীর ১লা মুহাররম তারিখে যা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। সবশেষে তৃতীয় পত্রটি ছিল ৯ম হিজরীর রজব মাসে। আছহামা নাজাশীর মৃত্যুর পরে সিংহাসনে আসীন নতুন নাজাশীর নিকটে।
শেষোক্ত পত্রে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নতুন বাদশাহর নাম উল্লেখ করেননি। তিনি ইসলাম কবুল করেছিলেন কি-না তাও জানা যায়নি।[6]
২. মিসর রাজ মুক্বাউক্বিসের নিকটে পত্র (الكتاب إلى المقوقس ملك مصر) : মিসর ও আলেকজান্দ্রিয়ার (الإسكندرية) খৃষ্টান সম্রাট জুরায়েজ বিন মাত্তা (جُرَيْج بن مَتَّي) (ডঃ হামীদুল্লাহ এঁর নাম বলেছেন, বেনিয়ামীন (البنيامين) ওরফে মুক্বাউক্বিসের (المقوقس) নিকটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি পত্র লেখেন। যার বাহক ছিলেন হযরত হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ (রাঃ)। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ :
بِسْمِ اللهِ الرّحْمَنِ الرّحِيمِ مِنْ مُحَمّدٍ عَبْدِ اللهِ وَرَسُوْلِهِ إلَى الْمُقَوْقِسِ عَظِيمِ الْقِبْطِ سَلاَمٌ عَلَى مَنْ اتّبَعَ الْهُدَى أَمّا بَعْدُ فَإِنّي أَدْعُوْكَ بِدِعَايَةِ الْإِسْلاَمِ أَسْلِمْ تَسْلَمْ وَأَسْلِمْ يُؤْتِكَ اللهُ أَجْرَكَ مَرّتَيْنِ فَإِنْ تَوَلّيْت فَإِنّ عَلَيْكَ إثْمَ الْقِبْطِ { يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاّ نَعْبُدَ إِلاَ اللهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلاَ يَتّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ فَإِنْ تَوَلّوْا فَقُولُوْا اشْهَدُوْا بِأَنّا مُسْلِمُوْنَ-
‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে’- ‘আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে ক্বিবতীদের সম্রাট মুক্বাউক্বিসের প্রতি’। শান্তি বর্ষিত হৌক তাঁর প্রতি, যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন। অতঃপর আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন। নিরাপদ থাকুন। ইসলাম গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ ছওয়াব দান করবেন। কিন্তু যদি আপনি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহ’লে ক্বিবতীদের (অর্থাৎ মিসরীয়দের ইসলাম গ্রহণ না করার) পাপ আপনার উপরে বর্তাবে। (আল্লাহ বলেন,) ‘হে কেতাবধারীগণ! তোমরা এস…’ (আলে ইমরান ৩/৬৪)।
হযরত হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ (রাঃ) পত্র খানা সম্রাটের হাতে সমর্পণ করার পর বললেন, আপনার পূর্বে এই মিসরে এমন একজন শাসক গত হয়ে গেছেন, যিনি বলতেন, أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى، فَأَخَذَهُ اللهُ نَكَالَ الْآخِرَةِ وَالْأُوْلَى ‘আমিই তোমাদের বড় পালনকর্তা’। অতঃপর আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেন’ (নাযে‘আত ৭৯/২৪-২৫)। হাতেব বলেন, فَاعْتَبِرْ بِغَيْرِك وَلاَ يَعْتَبِرُ غَيْرُك بِك ‘অতএব আপনি অন্যের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং অন্যেরা যেন আপনার থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে’। জওয়াবে মুক্বাউক্বিস বললেন, إنّ لَنَا دِيْنًا لَنْ نَدَعَهُ إلاّ لِمَا هُوَ خَيْرٌ مِنْهُ ‘নিশ্চয়ই আমাদের একটি দ্বীন রয়েছে। আমরা তা ছাড়তে পারি না, যতক্ষণ না তার চাইতে উত্তম কিছু পাই’। হাতেব (রাঃ) বললেন, আমরা আপনাকে ইসলামের দিকে আহবান জানাচ্ছি। যার মাধ্যমে আল্লাহ বিগত দ্বীনসমূহের অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দান করেছেন। আমাদের নবী সকল মানুষকে আহবান জানিয়েছেন। কুরায়েশরা শক্তভাবে বিরোধিতা করে, ইহুদীরা শত্রুতা করে। কিন্তু নাছারাগণ নিকটবর্তী থাকে। আমার জীবনের কসম! ঈসার জন্য মূসার সুসংবাদ ছিল যেমন, মুহাম্মাদের জন্য ঈসার সুসংবাদও ছিল তেমন। কুরআনের প্রতি আপনাকে আমাদের আহবান ঐরূপ, যেমন ইনজীলের প্রতি তাওরাত অনুসারীদেরকে আপনার আহবান। যখন কোন নবীর আবির্ভাব ঘটে, তখন সেই যুগের সকল লোক তার উম্মত হিসাবে গণ্য হয়। তখন তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় তাঁর আনুগত্য করা। আপনি তাদের মধ্যেকার একজন, যিনি বর্তমান নবীর যুগ পেয়েছেন। আমরা মসীহের দ্বীন থেকে আপনাকে নিষেধ করছি না। বরং আমরা তাঁর দ্বীনের প্রতিই আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি’।
মুক্বাউক্বিস বললেন, আমি এ নবীর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। আমি তাকে পেয়েছি এভাবে যে, তিনি কোন অপসন্দনীয় কাজের নির্দেশ দেন না। আমি তাঁকে ভ্রষ্ট জাদুকর বা মিথ্যুক গণৎকার হিসাবে পাইনি। আমি তাঁর সাথে নবুঅতের এই নিদর্শন পাচ্ছি যে, তিনি গায়েবী খবর প্রকাশ করছেন এবং পরামর্শের (মাধ্যমে কাজ করার) নির্দেশ দিচ্ছেন। অতএব আমি ভেবে দেখব’। অতঃপর তিনি পত্রখানা সসম্মানে হাতীর দাতের দ্বারা নির্মিত একটি বাক্সে রাখলেন এবং সীলমোহর দিয়ে যত্নসহকারে রাখার জন্য দাসীর হাতে দিলেন। অতঃপর আরবী জানা একজন কেরানীকে ডেকে নিম্নোক্ত জওয়াবী পত্র লিখলেন-
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ لِمُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ مِنْ الْمُقَوْقِسِ عَظِيمِ الْقِبْطِ سَلاَمٌ عَلَيْك أَمّا بَعْدُ فَقَدْ قَرَأْتُ كِتَابَك وَفَهِمْتُ مَا ذَكَرْتَ فِيهِ وَمَا تَدْعُو إلَيْهِ وَقَدْ عَلِمْتُ أَنَّ نَبِيًّا بَقِيَ وَكُنْتُ أَظُنُّ أَنّهُ يَخْرُجُ بِالشَّامِ وَقَدْ أَكْرَمْتُ رَسُوْلَك وَبَعَثْتُ إلَيْك بِجَارِيَتَيْنِ لَهُمَا مَكَانٌ فِي الْقِبْطِ عَظِيمٌ وَبِكِسْوَةٍ وَأَهْدَيْتُ إلَيْك بَغْلَةً لِتَرْكَبَهَا وَالسَّلاَمُ عَلَيْك-
‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে’ ‘মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহর জন্য ক্বিবতীসম্রাট মুক্বাউক্বিসের পক্ষ হ’তে- আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হউক! অতঃপর আমি আপনার পত্র পাঠ করেছি এবং সেখানে আপনি যা বর্ণনা করেছেন ও যেদিকে আহবান জানিয়েছেন, তা অনুধাবন করেছি। আমি জানি যে, একজন নবী আসতে বাকী রয়েছেন। আমি ধারণা করতাম যে, তিনি শাম (সিরিয়া) থেকে আবির্ভূত হবেন। আমি আপনার দূতকে সম্মান করেছি এবং আপনার নিকটে দু’জন দাসী পাঠিয়েছি, ক্বিবতীদের মাঝে যাদের উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। আপনার জন্য পোষাক এবং বাহন হিসাবে ব্যবহারের জন্য একটি খচ্চর উপঢৌকন স্বরূপ পাঠালাম। আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক!’
মুক্বাউক্বিস এর বেশী কিছু লেখেননি, ইসলামও কবুল করেননি। দাসী দু’জন ছিল মারিয়াহ (مَارِيَةُ) এবং শিরীন (سِيْرِينُ)। মারিয়া ক্বিবতিয়ার গর্ভে রাসূল (ছাঃ)-এর শেষ সন্তান ইবরাহীমের জন্ম হয়। শিরীনকে কবি হাসসান বিন ছাবিত আনছারীকে দেওয়া হয়। ‘দুলদুল’ নামক উক্ত খচ্চরটি মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যামানা পর্যন্ত জীবিত ছিল’।[7]
৩. পারস্য সম্রাট কিসরার নিকটে পত্র (الكتاب إلى كسرى ملك فارس) :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পারস্য সম্রাট খসরু পারভেযের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন, যিনি ছিলেন অর্ধেক প্রাচ্য দুনিয়ার অধিপতি এবং মজূসী বা যারদাশতী ধর্মের অনুসারী, যারা অগ্নিপূজক ছিলেন। পত্রবাহক ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন হুযাফা সাহমী (عَبْدُ اللهِ بْنُ حُذَافَةَ السَّهْمِيُّ)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পত্রটি ছিল নিম্নরূপ:
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ إلَى كِسْرَى عَظِيمِ فَارِسَ سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى وَآمَنَ بِاَللهِ وَرَسُوْلِهِ وَشَهِدَ أَنْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ أَدْعُوْكَ بِدِعَايَةِ اللهِ فَإِنِّيْ أَنَا رَسُوْلُ اللهِ إلَى النَّاسِ كَافّةً لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِيْنَ- أَسْلِمْ تَسْلَمْ فَإِنْ أَبَيْتَ فَعَلَيْكَ إثْمُ الْمَجُوْسِ-
‘…আমি আপনাকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। কেননা আমি আল্লাহর পক্ষ হ’তে সকল মানব জাতির জন্য প্রেরিত রাসূল’। ‘যাতে তিনি জীবিতদের (জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শন করেন এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়’ (ইয়াসীন ৩৬/৭০)। ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন। যদি অস্বীকার করেন, তাহ’লে মজূসীদের পাপ আপনার উপরে বর্তাবে’।
পত্রবাহক সাহমী (রাঃ) পত্রখানা (কিসরার গভর্ণর) বাহরায়নের শাসকের নিকটে হস্তান্তর করেন। অতঃপর পত্রটি গভর্ণর তার লোকদের মারফত পাঠান, না সাহমী (রাঃ)-কেই পাঠান, সে বিষয়টি সম্পর্কে মুবারকপুরী নিশ্চিত নন। যাই হোক পত্রটি যখন কিসরাকে পাঠ করে শুনানো হয়, তখন তিনি পত্রটি ছিঁড়ে ফেলেন ও দম্ভভরে বলেন, عَبْدٌ حَقِيْرٌ مِنْ رَعِيَّتِيْ يَكْتُبُ اسْمَهُ قَبْلِيْ ‘আমার একজন নিকৃষ্ট প্রজা তার নাম লিখেছে আমার নামের পূর্বে’। এ খবর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছলে তিনি বলেন, مَزَّقَ اللهُ مُلْكَهُ ‘আল্লাহ তার সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন’! ভবিষ্যতে সেটাই হয়েছিল। কিসরা তার অধীনস্থ ইয়ামনের গভর্ণর বাযান (باذان) -এর কাছে লিখলেন, ‘হেজাযের এই ব্যক্তিটির নিকটে তুমি দু’জন শক্তিশালী লোক পাঠাও। যাতে তারা ঐ ব্যক্তিকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসে’। বাযান সে মোতাবেক দু’জন লোককে একটি পত্রসহ মদীনায় পাঠান, যাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের সাথে কিসরার দরবারে চলে যান। তারা গিয়ে রাসূলের সাথে বেশ ধমকের সুরে কথা বলল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, বেশ তোমরা কাল এসো। এরি মধ্যে ইরানের রাজধানীতে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে যায়। পুত্র শিরওয়াইহ (شيرويه) পিতা খসরু পারভেযকে হত্যা করে রাতারাতি সিংহাসন দখল করে নেয়। ৭ম হিজরীর ১০ জুমাদাল ঊলা মঙ্গলবারের রাতে এ আকস্মিক ঘটনা ঘটে যায়। পরদিন সকালে ঐ দু’জন লোক রাসূলের দরবারে এসে ঘটনা শুনে অবিশ্বাস করে বলে উঠল, আমরা আপনার এই বাজে কথা সম্রাটের কাছে লিখে পাঠাব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তবে তাকে একথা বলো যে,
وقولا له : إن ديني وسلطاني سيبلغ ما بلغ كسرى وينتهي إلى منتهي الخف والحافر، وقولا له : إن أسلمت أعطيتك ما تحت يدك، وملكتك على قومك من الأبناء-
‘আমার দ্বীন ও শাসন ঐ পর্যন্ত পৌঁছবে, যে পর্যন্ত কিসরা পৌঁছেছেন এবং সেখানে গিয়ে শেষ হবে। যার পরে আর উট ও ঘোড়ার পা যাবে না’। তাকে একথাও বলো যে, ‘যদি তিনি মুসলমান হয়ে যান, তবে তার অধিকারে যা কিছু রয়েছে, সব তাকে দেওয়া হবে এবং তাকে তোমাদের জাতির জন্য বাদশাহ করে দেওয়া হবে’।[8] লক্ষণীয় বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পত্রে أَسْلِمْ تَسْلَمْ ‘ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন’ কথাটি লিখেছিলেন, যা ছিল এক প্রকার ভবিষ্যদ্বাণী স্বরূপ। কিসরা প্রকাশ্যে অস্বীকার করেন ও পত্রটি ছিঁড়ে ফেলে চরম বেআদবী করেন। ফলে তার রাজনৈতিক নিরাপত্তা দ্রুত ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে একই কথা তিনি খৃষ্টান রাজা নাজাশীকে লিখলে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং তার রাজ্য নিরাপদ ও সুদৃঢ় হয়। অপর খৃষ্টান রাজা মুক্বাউক্বিস ইসলাম কবুল না করলেও প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর পত্র ও পত্রবাহক দূতকে সম্মান করেন ও মদীনায় মূল্যবান উপঢৌকনাদি পাঠান। ফলে তার রাজ্য নিরাপদ থাকে।
বলা বাহুল্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদত্ত উক্ত আগাম খবরে বাযান ও ইয়ামনে বসবাসরত পারিসকরা সবাই মুসলমান হয়ে যায় ও তাদের শাসিত এলাকার অধিকাংশ লোক মুসলমান হয়ে যায়।
৪. রোম সম্রাট ক্বায়ছার হেরাক্লিয়াসের নিকটে পত্র (الكتاب إلى قيصر ملك الروم) : রোম সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের শাসক কনষ্ট্যান্টিনোপলের বিখ্যাত খৃষ্টান সম্রাট হেরাকল এ সময় যেরুযালেমে অবস্থান করছিলেন।[9] পত্রবাহক দেহিয়া বিন খালীফা কালবী ওরফে দেহিয়াতুল কালবী (রাঃ) সরাসরি গিয়ে তাকে রাসূলের পত্রটি হস্তান্তর করেন। তবে মুবারকপুরী বলেন, রাসূলের নির্দেশ মতে তিনি পত্রটি বছরার শাসনকর্তার নিকটে হস্তান্তর করেন এবং তিনি এটা রোম সম্রাটকে পৌঁছে দেন। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ :
بسم الله الرحمن الرحيم. من محمد عبد الله ورسوله إلى هرقل عظيم الروم، سلام على من اتبع الهدي، أسلم تسلم، أسلم يؤتك الله أجرك مرتين، فإن توليت فإن عليك إثم الأريسيين {يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ الخ-
‘… ইসলাম কবুল করুন! নিরাপদ থাকুন। ইসলাম কবুল করুন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ ছওয়াব দান করবেন। যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহ’লে আপনার উপরে প্রজাবৃন্দের পাপ বর্তাবে। (আল্লাহ বলেন,) হে কিতাবধারীগণ’!…।
মনছূরপুরীর মতে সম্রাট রাসূল (ছাঃ)-এর দূতকে খুব সমাদর করেন এবং জাঁকজমকপূর্ণ দরবারে তাকে অনেক বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে অধিক জানার জন্য মক্কা থেকে আগত কোন ব্যবসায়ীকে দরবারে আনার নির্দেশ দেন। ইমাম বুখারী (রহঃ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণনা করেন যে, ঘটনাক্রমে ঐ সময় আবু সুফিয়ান একটি ব্যবসায়ী কাফেলা নিয়ে শামে অবস্থান করছিলেন। তাঁকে দরবারে ডেকে আনা হয়। হেরাক্বল তার দোভাষীর মাধ্যমে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কথিত নবীর সবচাইতে নিকটাত্মীয় কে? আবু সুফিয়ান বললেন, আমি। আবু সুফিয়ান বলেন, অতঃপর আমাকে তিনি কাছে ডেকে নিলেন এবং আমার সাথীদের পিছনে বসালেন। অতঃপর তিনি আমার সাথীদের বললেন, আমি এঁকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করব। মিথ্যা বললে, তোমরা ধরে দিবে’। আবু সুফিয়ান তখন ইসলামের শত্রুদের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, যদি আমাকে মিথ্যুক বলে আখ্যায়িত করার ভয় না থাকত, তাহ’লে আমি অবশ্যই মুহাম্মাদ সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলতাম। ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হেরাকল ও আবু সুফিয়ানের মধ্যকার কথোপকথন ও হেরাকলের মন্তব্য সমূহ নিম্নে তুলে ধরা হ’ল:
প্রশ্ন-১ : নবীর বংশ মর্যাদা কেমন? উত্তর : উচ্চ বংশীয়।
(হেরাকলের মন্তব্য) : হ্যাঁ। এরূপই হয়ে থাকে। যাতে তাঁর প্রতি আনুগত্যে কারু মনে সংকোচ সৃষ্টি না হয়।
প্রশ্ন-২ : তোমাদের মধ্যে ইতিপূর্বে কেউ নবুঅতের দাবী করেছেন কি?
উত্তর : না’। মন্তব্য : হ্যাঁ। এরূপ হ’লে বুঝতাম যে, বাপ-দাদার অনুকরণে এ দাবী করেছেন।
প্রশ্ন-৩ : নবুঅতের দাবী করার পূর্বে ইনি কি কখনো মিথ্যা বলেছেন বা তার উপরে মিথ্যার অপবাদ দেওয়া হয়েছিল?
উত্তর : না’। মন্তব্য : ঠিক। যে ব্যক্তি মানুষকে মিথ্যা বলে না, সে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলতে পারে না।
প্রশ্ন-৪ : নবীর বাপ-দাদাদের মধ্যে কেউ কখনো বাদশাহ ছিলেন কি? উত্তর : না’। মন্তব্য : এটা থাকলে আমি বুঝতাম যে, নবুঅতের বাহানায় বাদশাহী হাছিল করতে চায়।
প্রশ্ন-৫ : তাঁর অনুসারীদের মধ্যে গরীব ও দুর্বল লোকদের সংখ্যা বেশী, না অভিজাত শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা বেশী?
উত্তর : গরীব ও দুর্বল লোকদের সংখ্যা বেশী’। মন্তব্য : প্রত্যেক নবীর প্রথম অনুসারী দল দুর্বলেরাই হয়ে থাকে।
প্রশ্ন-৬ : এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, না কমছে?
উত্তর : বাড়ছে’। মন্তব্য : ঈমানের এটাই বৈশিষ্ট্য যে, আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায় ও ক্রমে পূর্ণতার স্তরে পেঁŠছে যায়।
প্রশ্ন-৭ : কেউ কি তাঁর দ্বীন ত্যাগ করে চলে যায়?
উত্তর : না’। মন্তব্য : ঈমানের প্রভাব এটাই যে, একবার হৃদয়ে বসে গেলে তা আর বের হয় না।
প্রশ্ন-৮ : এই ব্যক্তি কখনো অঙ্গীকার বা চুক্তি ভঙ্গ করেছেন কি?
উত্তর : না’। তবে এ বছর আমরা (হোদায়বিয়ার) সন্ধিচুক্তি করেছি। দেখি তার ফলাফল কি দাঁড়ায়।’ আবু সুফিয়ান বলেন, একথাটুকুই মাত্র যুক্ত করেছিলাম। কিন্তু হেরাকল সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বললেন, নবীরা কখনো চুক্তি ভঙ্গ করেন না। কেবল দুনিয়াদাররাই চুক্তি ভঙ্গ করে থাকে। আর নবীগণ কখনোই দুনিয়াপূজারী হন না।
প্রশ্ন-৯ : এই ব্যক্তির সঙ্গে তোমাদের কখনো যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছি কি?
উত্তর : হয়েছে।
প্রশ্ন-১০ : তার ফলাফল কি ছিল?
উত্তর : কখনো তিনি বিজয়ী হয়েছেন (যেমন বদরে), কখনো আমরা বিজয়ী হয়েছি (যেমন ওহোদে)। মন্তব্য : আল্লাহর নবীদের এই অবস্থাই হয়ে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নবীগণই লাভ করে থাকেন’।
প্রশ্ন-১১ : তাঁর শিক্ষা কি?
উত্তর : এক আল্লাহর ইবাদত কর। বাপ-দাদার তরীকা (মূর্তি পূজা) ছেড়ে দাও। ছালাত, ছিয়াম, সত্যবাদিতা, পবিত্রতা, আত্মীয়তা রক্ষার অপরিহার্যতা অবলম্বন কর।’ মন্তব্য : প্রতিশ্রুত নবীর এইসব নিদর্শনই আমাদের বলা হয়েছে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, নবীর আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম না যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে হবেন। শুনে রাখ আবু সুফিয়ান! فَإِنْ كَانَ مَا تَقُوْلُ حَقًّا فَسَيَمْلِكُ مَوْضِعَ قَدَمَيَّ هَاتَيْنِ، فَلَوْ أَنِّيْ أَعْلَمُ أَنِّيْ أَخْلُصُ إِلَيْهِ لَتَجَشَّمْتُ لِقَاءَهُ، وَلَوْ كُنْتُ عِنْدَهُ لَغَسَلْتُ عَنْ قَدَمَيْهِ- ‘যদি তুমি সত্য কথা বলে থাক, তবে সত্বর তিনি আমার পায়ের তলার মাটিরও (অর্থাৎ শাম ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের) অধিকার লাভ করবেন’। ‘যদি আমি জানতাম যে, আমি তাঁর কাছে পৌঁছতে পারব, তাহ’লে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য সাধ্যমত কষ্ট স্বীকার করতাম’। ‘আর যদি আমি তাঁর কাছে পৌঁছতে পারতাম, তাহ’লে আমি তাঁর দু’ পা ধুয়ে দিতাম’।
অতঃপর হেরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রেরিত পত্রটি নিয়ে পাঠ করলেন। পত্র পাঠ শেষ হ’লে (ভক্তির আবেশে) সভাসদগণের কণ্ঠস্বর ক্রমেই উচ্চ মার্গে উঠতে লাগল এবং এ সময়ে আমাদেরকে চলে যেতে বলা হ’ল।
আবু সুফিয়ান বলেন যে, রাজদরবার থেকে বেরিয়ে এসে আমি সাথীদের বললাম,لَقَدْ أَمِرَ أَمْرُ ابْنِ أَبِيْ كَبْشَةَ إِنَّهُ يَخَافُهُ مَلِكُ بَنِي الْأَصْفَرِ ইবনু আবী কাবশার ব্যাপারটি মযবুত হয়ে গেল। আছফারদের সম্রাট তাকে ভয় পাচ্ছেন’।[10] আবু সুফিয়ান বলেন, এরপর থেকে আমার বিশ্বাস বদ্ধমূল হ’তে থাকল যে, সত্বর তিনি বিজয় লাভ করবেন। অবশেষে আল্লাহ আমার মধ্যে ইসলাম প্রবেশ করিয়ে দিলেন’।[11] অর্থাৎ পরের বছর ৮ম হিজরীর ১৭ রামাযানে মক্কা বিজয় হয় এবং আবু সুফিয়ান সেদিনই ইসলাম কবুল করেন।
রাসূল (ছাঃ)-এর পত্র রোম সম্রাটের উপরে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছিল, উপরোক্ত ঘটনায় তা প্রতীয়মান হয়। পত্রবাহক দেহিয়া কালবীকে রোম সম্রাট বহুমূল্য উপঢৌকনাদি দিয়ে সম্মানিত করেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য মূল্যবান হাদিয়া প্রেরণ করেন। আল্লাহ পাকের এমনই কুদরত যে, রাসূলের দুশমনের মুখ দিয়েই আরেক অবন্ধু সম্রাটের সম্মুখে তার সত্যায়ন করালেন এবং সম্রাটকে হেদায়াত দান করলেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
৫. বাহরায়নের শাসক মুনযির বিন সাওয়া-র নিকটে পত্র (الكتاب إلى المنذر بن ساوى ملك البحرين ) :
পারস্য সম্রাটের গভর্ণর বাহরায়নের শাসক মুনযির বিন সাওয়ার নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ‘আলা ইবনুল হাযরামী (রাঃ)-কে পত্রবাহক হিসাবে প্রেরণ করেন। পত্র পেয়ে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং বাহরায়েনের অধিকাংশ লোক মুসলমান হয়ে যায়। অতঃপর তিনি জবাবী পত্রে রাসূল (ছাঃ)-কে লেখেন, হে রাসূল! বাহরায়েন বাসীদের অনেকে ইসলাম পসন্দ করেছে ও কবুল করেছে, অনেকে অপসন্দ করেছে। আমার এ মাটিতে অনেক মজূসী (অগ্নিউপাসক) ও ইহুদী রয়েছে। অতএব এদের বিষয়ে আপনার নির্দেশ কি আমাকে জানাতে মর্যী হয়। তখন রাসূল (ছাঃ) তার জওয়াবে লিখলেন,
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرّحِيمِ مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ إلَى الْمُنْذِرِ بْنِ سَاوَى سَلاَمٌ عَلَيْكَ فَإِنّي أَحْمَدُ إلَيْك اللهَ الَّذِيْ لاَ إلَهَ إلاّ هُوَ وَأَشْهَدُ أَنْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَأَنّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ أَمّا بَعْدُ فَإِنّيْ أُذَكّرُكَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ فَإِنّهُ مَنْ يَنْصَحْ فَإِنّمَا يَنْصَحُ لِنَفْسِهِ وَإِنّهُ مَنْ يُطِعْ رُسُلِيْ وَيَتَّبِعْ أَمْرَهُمْ فَقَدْ أَطَاعَنِيْ وَمَنْ نَصَحَ لَهُمْ فَقَدْ نَصَحَ لِيْ وَإِنّ رُسُلِيْ قَدْ أَثْنَوْا عَلَيْكَ خَيْرًا وَإِنّي قَدْ شَفَعْتُكَ فِيْ قَوْمِك فَاتْرُكْ لِلْمُسْلِمِيْنَ مَا أَسْلَمُوْا عَلَيْهِ وَعَفَوْتُ عَنْ أَهْلِ الذُّنُوبِ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَإِنَّكَ مَهْمَا تُصْلِحْ فَلَنْ نَعْزِلَكَ عَنْ عَمَلِك وَمَنْ أَقَامَ عَلَى يَهُوْدِيَّةٍ أَوْ مَجُوْسِيَّةٍ فَعَلَيْهِ الْجِزْيَةُ-
‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে মুনযির বিন সাওয়ার প্রতি। আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! অতঃপর আমি আপনার নিকটে আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল। অতঃপর আমি আপনাকে মহান আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। কেননা যে ব্যক্তি উপদেশ গ্রহণ করে, সে তার নিজের জন্যই তা করে। যে ব্যক্তি আমার প্রেরিত দূতদের আনুগত্য করে ও তাদের নির্দেশের অনুসরণ করে, সে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করে। যে ব্যক্তি তাদের প্রতি সদাচরণ করে, সে আমার প্রতি সদাচরণ করে। আমার দূতগণ আপনার সম্পর্কে উত্তম প্রশংসা করেছে। আপনার জাতি সম্পর্কে আমি আপনার সুফারিশ কবুল করলাম। অতএব মুসলমানদেরকে তাদের অবস্থার উপরে ছেড়ে দিন। অপরাধীদের আমি ক্ষমা করলাম। আপনিও ক্ষমা করুন। অতঃপর যতদিন আপনি সংশোধনের পথে থাকবেন, ততদিন আমরা আপনাকে দায়িত্ব হ’তে অপসারণ করব না এবং যে ব্যক্তি ইহুদী বা মজূসী ধর্মের উপরে দন্ডায়মান থাকবে, তার উপরে জিযিয়া কর আরোপিত হবে’।[12]
৬. ইয়ামামার খৃষ্টান শাসক হাওযাহ বিন আলীর নিকটে পত্র (الكتاب إلى هَوْذَة بن على صاحب اليمامة) :
পত্রবাহক সালীত্ব বিন আমর আল-আমেরী (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর মোহরাংকিত পত্রখানা নিয়ে সরাসরি প্রাপকের হাতে সমর্পণ করেন। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ :
بِسْمِ اللهِ الرّحْمَنِ الرّحِيمِ مِنْ مُحَمّدٍ رَسُولِ اللّهِ إلَى هَوْذَةَ بْنِ عَلِيّ سَلاَمٌ عَلَى مَنْ اتّبَعَ الْهُدَى وَاعْلَمْ أَنّ دِينِي سَيَظْهَرُ إلَى مُنْتَهَى الْخُفِّ وَالْحَافِرِ فَأَسْلِمْ تَسْلَمْ وَأَجْعَلْ لَكَ مَا تَحْتَ يَدَيْكَ-
‘… আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে হাওযাহ বিন আলীর প্রতি। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন। আপনি জানুন যে, আমার দ্বীন বিজয়ী হবে যতদূর উট ও ঘোড়া যেতে পারে। অতএব আপনি ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন। আপনার অধীনস্থ এলাকা আপনাকে প্রদান করব’।
ওয়াক্বেদী বর্ণনা করেন, এই সময় দামেষ্কের খৃষ্টান নেতা আরকূন (أركون) হাওযাহর নিকটে বসে ছিলেন। তিনি তাকে শেষনবী (ছাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে হাওযাহ বলেন, তাঁর চিঠি আমার কাছে এসেছে। তিনি আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু আমি আমার ধর্মে দৃঢ় থাকতে চাই। তাছাড়া আমি আমার জাতির নেতা। যদি আমি তাঁর অনুসারী হই, তাহ’লে নেতৃত্ব হারাবো’। আরকূন বললেন, হ্যাঁ। তবে আল্লাহর কসম! যদি আপনি তাঁর অনুসারী হন, তাহ’লে অবশ্যই তিনি আপনাকে শাসনক্ষমতায় রাখবেন। অতএব আপনার জন্য কল্যাণ রয়েছে তাঁর আনুগত্যের মধ্যে। নিশ্চয়ই তিনি সেই আরবী নবী, যার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন ঈসা ইবনে মারিয়াম। আর আমাদের ইনজীলেও লিখিত আছে, মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’।
অতঃপর হাওযাহ পত্রবাহককে যথাযোগ্য আতিথ্য ও সম্মান প্রদর্শন করেন এবং পত্রের জওয়াবে তিনি লেখেন-
مَا أَحْسَنَ مَا تَدْعُو إلَيْهِ وَأَجْمَلَهُ وَالْعَرَبُ تَهَابُ مَكَانِي فَاجْعَلْ إلَيّ بَعْضَ الْأَمْرِ أَتْبَعُك-
‘কতই না সুন্দর ও উত্তম বিষয়ের দিকে আপনি আমাকে আহবান জানিয়েছেন। আরব জাতি আমার উঁচু স্থানকে ভীতির চোখে দেখে। অতএব আপনার রাজত্বের কিছু অংশ আমাকে দান করুন, তাহ’লে আপনার আনুগত্য করব’। মানছূরপুরী ‘অর্ধেক রাজত্ব (آدهي حكومت) ’ বলেছেন।
অতঃপর হিজরের তৈরী মূল্যবান পোষাক ও উপঢৌকনাদি পত্রবাহককে প্রদান করেন। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَوْ سَأَلَنِيْ سَيَابَةً مِنْ الْأَرْضِ مَا فَعَلْتُ، بَادَ وَبَادَ مَا فِيْ يَدَيْهِ ‘যদি সে আমার নিকটে এক টুকরা শুকনা মাটিও চায়, তাও আমি তাকে দিব না। সে নিজে ধ্বংস হ’ল এবং যেটুকু তার অধীনে ছিল তাও হারালো’। অর্থাৎ নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়াটাই তার ধ্বংসের কারণ।
পরের বছর মক্কা বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন প্রত্যাবর্তন করেন, তখন জিব্রীল (আঃ) এসে তাঁকে খবর দেন যে, হাওযাহ মৃত্যু বরণ করেছে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَمَا إنّ الْيَمَامَةَ سَيَخْرُجُ بِهَا كَذّابٌ يَتَنَبّأُ يُقْتَلُ بَعْدِي ‘সত্বর ইয়ামামা হ’তে একজন ভন্ড নবীর আবির্ভাব ঘটবে, আমার পরে যাকে হত্যা করা হবে’। জনৈক ব্যক্তি বলে উঠল, কে তাকে হত্যা করবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,أَنْتَ وَأَصْحَابُك ‘তুমি ও তোমার সাথীরা’।[13] রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর সময়ে সেটা বাস্তবায়িত হয়েছিল এবং হামযা (রাঃ)-এর হত্যাকারী ওয়াহ্শী ভন্ডনবী মুসায়লামা কাযযাবকে হত্যা করেন। এদিকে ইঙ্গিত করেই সম্ভবতঃ রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ে জান্নাতবাসী হবে, যা দেখে আল্লাহ হাসবেন’।[14]
৭. দামেষ্কের খৃষ্টান শাসক হারেছ বিন আবু শিম্র আল-গাসসানীর নিকটে পত্র (الكتاب إلى الحارث بن أبي شمر الغساني صاحب دمشق) : সিরিয়ার বনু আসাদ বিন খোযায়মা গোত্রভুক্ত ছাহাবী শুজা বিন ওয়াহাব আল-আসাদীকে পত্রবাহক হিসাবে প্রেরণ করা হয়। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ :
بِسْمِ اللهِ الرّحْمَنِ الرّحِيْمِ مِنْ مُحَمّدٍ رَسُولِ اللهِ إلَى الْحَارِثِ بْنِ أَبِيْ شِمْرٍ سَلاَمٌ عَلَى مَنْ اتّبَعَ الْهُدَى وَآمَنَ بِاَللهِ وَصَدّقَ وَإِنّي أَدْعُوْكَ إلَى أَنْ تُؤْمِنَ بِاَللهِ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ يَبْقَى لَكَ مُلْكُك-
‘… আমি আপনাকে আহবান জানাচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুন। যিনি একক, যার কোন শরীক নেই। তিনি আপনার রাজত্ব বাকী রাখবেন’।
পত্র পাঠে হারেছ সদম্ভে বলে উঠলেন,مَنْ يَّنْزِعُ مُلُكِيْ مِنِّيْ؟ أَنَا سَائِرٌ إِلَيْهِ ‘কে আমার রাজ্য ছিনিয়ে নেবে? আমি তার দিকে সৈন্য পরিচালনা করব’। তিনি ইসলাম কবুল করলেন না।
মানছূরপুরী বলেন, পত্র পাঠে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি বলেছিলেন, আমি মদীনায় হামলা করব’। পরে ঠান্ডা হয়ে পত্রবাহককে সসম্মানে বিদায় করেন। কিন্তু মুসলমান হননি।
৮. ওমানের সম্রাটের নিকটে পত্র (الكتاب إلى ملك عُمَان) : ওমানের খৃষ্টান সম্রাট জায়ফার ও তার ভাই আবদ-এর নামে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) পত্র লেখেন। পত্রবাহক ছিলেন হযরত আমর ইবনুল আছ (রাঃ)। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ :
بِسْمِ اللهِ الرّحْمَنِ الرّحِيمِ مِنْ مُحَمّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ إلَى جَيْفَرَ وَعَبْدٍ ابْنَيْ الْجُلَنْدَى سَلاَمٌ عَلَى مَنْ اتّبَعَ الْهُدَى أَمّا بَعْدُ فَإِنّي أَدْعُوكُمَا بِدِعَايَةِ الْإِسْلاَمِ أَسْلِمَا تَسْلَمَا فَإِنّي رَسُولُ اللهِ إلَى النّاسِ كَافّةً لِأُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيّا وَيَحِقّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ فَإِنّكُمَا إنْ أَقْرَرْتُمَا بِالْإِسْلاَمِ وَلّيْتُكُمَا وَإِنْ أَبَيْتُمَا أَنْ تُقِرّا بِالْإِسْلاَمِ فَإِنّ مُلْكَكُمَا زَائِلٌ عَنْكُمَا وَخَيْلِيْ تَحُلّ بِسَاحَتِكُمَا وَتَظْهَرُ نُبُوَّتِيْ عَلَى مُلْكِكُمَا-
‘… আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে জালান্দীর দুই পুত্র জায়ফার ও আবদের প্রতি। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যে হেদায়াতের অনুসরণ করে। অতঃপর আমি আপনাদের দু’জনকে ইসলামের দিকে আহবান জানাচ্ছি। আপনারা ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন। আমি মানবজাতির সকলের প্রতি আল্লাহর রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছি, যাতে আমি জীবিতদের (জাহান্নামের) ভয় দেখাই এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অতঃপর যদি আপনারা ইসলাম কবুল করেন, তবে আপনাদেরকেই আমি গভর্ণর নিযুক্ত করে দেব। আর যদি ইসলাম কবুলে অস্বীকার করেন, তাহ’লে আপনাদের রাজত্ব শেষ হয়ে যাবে এবং আমার ঘোড়া আপনাদের ময়দানে প্রবেশ করবে এবং আমার নবুঅত আপনাদের রাজ্যে বিজয়ী হবে’।
আমর ইবনুল আছ (রাঃ) বলেন, পত্রটি নিয়ে আমি ওমান গেলাম এবং ছোট ভাই আবদের নিকটে আগে পেঁŠছলাম। কেননা ইনি ছিলেন অধিক দূরদর্শী ও নম্র স্বভাবের মানুষ। আমি তাকে বললাম যে, ‘আমি আপনার ও আপনার ভাইয়ের নিকটে আল্লাহর রাসূলের দূত হিসাবে এসেছি’। তিনি বললেন, বয়সে ও রাজত্বে ভাই আমার চেয়ে বড়। আমি আপনাকে তাঁর নিকটে পৌঁছে দিচ্ছি, যাতে তিনি আপনার পত্র পাঠ করেন। অতঃপর তিনি বললেন, وما تدعو إليه؟ ‘কোন দিকে আপনি আমাদের দাওয়াত দিচ্ছেন’? আমি বললাম, আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। যিনি একক, যার কোন শরীক নেই এবং তিনি ব্যতীত অন্য সকল উপাস্য হ’তে আপনি পৃথক হয়ে যাবেন এবং সাক্ষ্য দিবেন যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি বললেন, হে আমর! আপনি আপনার গোত্রের নেতার পুত্র। বলুন, আপনার পিতা কেমন আচরণ করেছেন? কেননা তাঁর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় রয়েছে। আমি বললাম, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এমতাবস্থায় যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেননি। কতই না ভাল হ’ত যদি তিনি ইসলাম কবুল করতেন ও রাসূলকে সত্য বলে জানতেন। আমিও তাঁর মতই ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ আমাকে ইসলামের পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি বললেন, কবে আপনি তাঁর অনুসারী হয়েছেন? আমি বললাম, অল্প কিছুদিন পূর্বে।[15]
তিনি বললেন, কোথায় আপনি ইসলাম কবুল করলেন? বললাম, নাজাশীর দরবারে এবং আমি তাকে এটাও বললাম যে, নাজাশীও মুসলমান হয়ে গেছেন। তিনি বললেন, তাঁর রাজত্বের ব্যাপারে তাঁর সম্প্রদায় কি আচরণ করল? আমি বললাম, তারা তাঁকে স্বপদে রেখেছে ও তাঁর অনুসারী (মুসলমান) হয়েছে। তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, বিশপ ও পাদ্রীগণও তাঁর অনুসারী হয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, হে আমর! আপনি কি বলছেন ভেবে-চিন্তে দেখুন। কেননা মিথ্যা বলার চাইতে নিকৃষ্ট স্বভাব মানুষের জন্য আর কিছুই নেই। আমি বললাম, আমি মিথ্যা বলিনি এবং আমাদের ধর্মেও এটা সিদ্ধ নয়। অতঃপর তিনি বললেন, আমার ধারণা হেরাক্বল নাজাশীর ইসলাম কবুলের খবর জানেন না। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি জানেন। তিনি বললেন, কিভাবে এটা আপনি বুঝলেন? আমি বললাম, নাজাশী ইতিপূর্বে তাঁকে খাজনা দিতেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি বললেন, وَاَللهِ لَوْ سَأَلَنِي دِرْهَمًا وَاحِدًا مَا أَعْطَيْتُهُ ‘আল্লাহর কসম! এখন যদি তিনি আমার নিকটে একটি দিরহামও চান, আমি তাকে দেব না’। হেরাক্বলের নিকটে এখবর পৌঁছে গেলে তার ভাই ‘নিয়াক্ব’ (نياق) তাকে বলেন, আপনি ঐ গোলামটাকে ছেড়ে দেবেন, যে আপনাকে খাজনা দেবে না। আবার আপনার ধর্ম ত্যাগ করে একটা নতুন ধর্ম গ্রহণ করবে? জবাবে হেরাক্বল বললেন, একজন লোক একটি ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং তা নিজের জন্য পসন্দ করেছে। এক্ষণে আমি তার কি করব? وَاَللهِ لَوْلاَ الضَّنَّ بِمُلْكِيْ لَصَنَعْتُ كَمَا صَنَعَ ‘আল্লাহর কসম! যদি আমার রাজত্বের খেয়াল না থাকত, তবে আমিও তাই করতাম, যা সে করেছে’। আবদ বললেন, ভেবে দেখুন আমর আপনি কি বলছেন? আমি বললাম, وَاَللهِ صَدَّقْتُكَ আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে সত্য বলছি’। আব্দ বললেন, এখন আপনি বলুন, তিনি কোন কোন বিষয়ে নির্দেশ দেন ও কোন কোন বিষয়ে নিষেধ করেন? আমি বললাম, তিনি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দেন এবং তাঁর অবাধ্য হ’তে নিষেধ করেন। তিনি সৎকাজের ও আত্মীয়তা রক্ষার আদেশ দেন এবং যুলুম, সীমা লংঘন, ব্যভিচার, মদ্যপান, পাথর, মূর্তি ও ক্রুশ পূজা হ’তে নিষেধ করেন।
আব্দ বললেন, مَا أَحْسَنَ هَذَا الَّذِيْ يَدْعُو إلَيْهِ ‘ইনি কত সুন্দর বিষয়ের দিকেই না আহবান করেন! যদি আমার ভাই আমার অনুগামী হ’তেন, তাহ’লে আমরা দু’জনে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দরবারে গিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতাম ও তাঁকে সত্য বলে ঘোষণা করতাম’। কিন্তু আমার ভাই এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে স্বীয় রাজত্বের জন্য অধিক ক্ষতিকর প্রমাণিত হবেন এবং আপাদ মস্তক গোনাহগার হবেন’। আমি বললাম, যদি তিনি ইসলাম কবুল করেন, তবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁকে বাদশাহ হিসাবে বহাল রাখবেন। তিনি কেবল ধনীদের নিকট থেকে ছাদাক্বা গ্রহণ করবেন ও গরীবদের মধ্যে তা বণ্টন করবেন। তিনি বললেন, এটা খুবই সুন্দর আচরণ। তবে ছাদাক্বা কি জিনিষ? তখন আমি তাকে বিভিন্ন মাল-সম্পদের এমনকি উটের যাকাত সম্পর্কে বর্ণনা করলাম, যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ফরয করেছেন। তিনি বললেন, হে আমর! আমাদের চতুষ্পদ জন্তু সমূহ থেকেও ছাদাক্বা নেওয়া হবে, যারা স্বাধীনভাবে ঘাস পাতা খেয়ে চরে বেড়ায়? আমি বললাম, হ্যঁা। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমার মনে হয় না যে, আমার কওম তাদের রাজ্যের প্রশস্ততা ও লোক সংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও এটা মেনে নিবে’।
আমর ইবনুল আছ (রাঃ) বলেন, আমি সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করলাম। তিনি তাঁর ভাইয়ের কাছে গেলেন ও আমার ব্যাপারে তাকে সবকিছু অবহিত করলেন। অতঃপর একদিন তিনি (অর্থাৎ সম্রাট) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ভিতরে প্রবেশ করলে তার প্রহরীগণ আমাকে দু’বাহু ধরে নিয়ে গেল। তিনি বললেন, ওকে ছেড়ে দাও। আমাকে ছেড়ে দেওয়া হ’ল। আমি বসতে গেলাম। কিন্তু তারা আমাকে বসতে দিল না। আমি তখন সম্রাটের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, আপনার প্রয়োজন সম্পর্কে বলুন। তখন আমি মোহরাংকিত পত্রটি তাঁর নিকটে দিলাম। তিনি সীলমোহরটি ছিঁড়লেন অতঃপর পত্রটি পড়ে শেষ করলেন। অতঃপর সেটা তার ভাইয়ের হাতে দিলেন। তিনিও সেটা পাঠ করলেন। আমি দেখলাম যে, তার ভাই তার চাইতে অধিকতর কোমল হৃদয়ের।
অতঃপর সম্রাট আমাকে কুরায়েশদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, تَبِعُوْهُ إمَّا رَاغِبٌ فِي الدِّيْنِ وَإِمَّّا مَقْهُوْرٌ بِالسَّيْفِ ‘তারা তাঁর অনুগত হয়েছে কেউ দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, কেউ তরবারির দ্বারা পরাভূত হয়ে’। তিনি বললেন, তাঁর সাথে কারা আছেন? আমি বললাম, যারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং অন্য সবকিছুর উপরে একে স্থান দিয়েছেন এবং আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াতের সাথে সাথে নিজেদের জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করেছেন যে, তারা ইতিপূর্বে ভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলেন’। এতদঞ্চলে আপনি ব্যতীত আর কেউ (অর্থাৎ আর কোন সম্রাট তার দ্বীনে প্রবেশ করতে) বাকী আছেন বলে আমার জানা নেই। আজ যদি আপনি ইসলাম কবুল না করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুগামী না হন, তাহ’লে অশ্বারোহী বাহিনী আপনাকে পদদলিত করবে এবং আপনার শস্যক্ষেত সমূহ ধ্বংস করবে। অতএব আপনি ইসলাম কবুল করুন। নিরাপদ থাকুন। আপনাকে আপনার জাতির উপরে তিনি গভর্ণর নিযুক্ত করবেন এবং আপনার এলাকায় অশ্বারোহী বা পদাতিক বাহিনী প্রবেশ করবে না। সম্রাট বললেন, دَعْنِيْ يَوْمِيْ هَذَا وَارْجِعْ إلَيَّ غَدًا ‘আজকের দিনটা আমাকে সময় দিন। কাল আপনি পুনরায় আসুন’।
সম্রাটের দরবার থেকে বেরিয়ে আমি পুনরায় তাঁর ভাইয়ের কাছে ফিরে গেলাম। তিনি বললেন, يَا عَمْرُو إنِّيْ لَأَرْجُو أَنْ يُسْلِمَ إنْ لَمْ يَضِنَّ بِمُلْكِهِ ‘হে আমর! আমি মনে করি সম্রাট মুসলমান হবেন, যদি তাঁর রাজত্বের কোন ক্ষতি না হয়’।
কথামত দ্বিতীয় দিন সকালে আমি দরবারে গেলাম। কিন্তু তিনি অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেন। আমি তার ভাইয়ের কাছে ফিরে গিয়ে বিষয়টি বললাম। তখন তিনি আমাকে পৌঁছে দিলেন। তখন সম্রাট আমাকে বললেন, আমি আপনার আবেদনের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। দেখুন: যদি আমি এমন এক ব্যক্তির নিকটে আমার রাজত্ব সমর্পণ করি, যার অশ্বারোহীদল এখনো এখানে পৌঁছেনি, তাহ’লে আমি ‘আরবদের দুর্বলতম ব্যক্তি’ (أَضْعَفُ الْعَرَبِ) হিসাবে পরিগণিত হব। আর যদি তার অশ্বারোহী দল এখানে পৌঁছে যায়, তাহ’লে এমন লড়াইয়ের সম্মুখীন তারা হবে, যা ইতিপূর্বে তারা কখনো হয়নি।’ একথা শুনে আমি বললাম, বেশ, আগামীকাল তাহ’লে আমি চলে যাচ্ছি (فَأَنَا خَارِجٌ غَدًا) ।
অতঃপর যখন তিনি আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হ’লেন, তখন তার ভাইকে নিয়ে একান্তে বৈঠক করলেন। ভাই তাকে বললেন, مَا نَحْنُ فِيْمَا قَدْ ظَهَرَ عَلَيْهِ وَكُلُّ مَنْ أَرْسَلَ إلَيْهِ قَدْ أَجَابَهُ ‘আমরা তাদের তুলনায় কিছুই নই, যাদের উপরে তিনি বিজয়ী হয়েছেন এবং যার নিকটে তিনি দূত পাঠিয়েছেন, তিনি তা কবুল করে নিয়েছেন’।
পরদিন সকালে সম্রাট আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং সম্রাট ও তাঁর ভাই উভয়ে ইসলাম কবুল করলেন ও রাসূল (ছাঃ)-কে সত্য বলে ঘোষণা করলেন। অতঃপর তারা আমাকে ছাদাক্বা গ্রহণ ও এ বিষয়ে লোকদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য ঢালাও অনুমতি দিলেন এবং আমার বিরুদ্ধাচারীদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী হলেন। অতঃপর প্রজাদের অধিকাংশ মুসলমান হয়ে যায়’।[16]
মুবারকপুরী বলেন, উপরোক্ত ঘটনা পরম্পরায় একথা প্রমাণিত হয় যে, অন্যান্য রাজা-বাদশাদের নিকটে পত্র প্রেরণের অনেক পরে উক্ত দু’ভাইয়ের নিকটে পত্র প্রেরণ করা হয় এবং সর্বাধিক ধারণা মতে এটি মক্কা বিজয়ের পরের ঘটনা (والأغلب أنه كان بعد الفتح)।
এভাবে তৎকালীন বিশ্বের ক্ষমতাধর অধিকাংশ রাজা-বাদশাদের নিকটে পত্রের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। দু’একজন বাদে প্রায় সকলেই তাঁর দাওয়াত কবুল করেছিলেন। যারা অস্বীকার করেছিল, তাদের কাছেও রাসূল ও ইসলাম পরিচিতি লাভ করে। এভাবে ইসলাম সর্বজন পরিচিত বিশ্ব ধর্মে পরিণত হয়।
পরবর্তী অংশ: রাসূল (ছাঃ)-এর নবগঠিত মাদানী রাষ্ট্রে যাকাত আদায়কারী নিয়োগ
লেখক: ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব
[1] ইমাম বুখারী আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে উক্ত আংটি হযরত আবুবকর, পরে ওমর এবং তার পরে ওছমান (রাঃ) ব্যবহার করেন। কিন্তু তাঁর খেলাফতের শেষ দিকে এক সময় আংটিটি ‘আরীস’ (اريس) কুয়ায় পড়ে যায়। সাধ্যমত খুঁজেও তা আর পাওয়া যায়নি; বুখারী হা/৫৮৭৩ ‘আংটি খোদাই’ অনুচ্ছেদ।
[2] বায়হাক্বী ইবনু ইসহাক হ’তে।
[3] যাদুল মা‘আদ ৩/৬০৩।
[4] আহমাদ হা/১৭৪০; ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১১৫, সনদ ছহীহ; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৯৬।
[5] রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৫০।
[6] আর-রাহীক্ব ৩৫৩ পৃঃ।
[7] যাদুল মা‘আদ ৩/৬০৪।
[8] ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ৩৬২, সনদ যঈফ।
[9] পারস্য সম্রাট খসরু পারভেয স্বীয় পুত্রের হাতে নিহত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন কিসরা রোম সম্রাটের সাথে সন্ধি করেন এবং তাদের অধিকৃত এলাকাসমূহ ফেরৎ দেন। এ সময় তাদের ধারণা মতে হযরত ঈসাকে হত্যা করার কাজে ব্যবহৃত ক্রুশটিও ফেরৎ দেওয়া হয়। এই অভাবিত সন্ধিতে খুশী হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য রোম সম্রাট যেরুযালেম আসেন এবং ক্রুশটিকে স্বস্থানে রেখে দেন। ৭ম হিজরীতে (মোতাবেক ৬২৯ খৃষ্টাব্দে) এ ঘটনা ঘটে।
[10] (ক) ‘আবু কাবশার ছেলে’ বলতে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। এই উপনামটি রাসূলের দুধ পিতার অথবা তার দাদা বা নানা কারু ছিল। এটি একটি অপরিচিত নাম। আরবদের নিয়ম ছিল, কাউকে হীনভাবে প্রকাশ করতে চাইলে তার পূর্বপুরুষদের কোন অপরিচিত ব্যক্তির দিকে সম্বন্ধ করে বলা হ’ত। আবু সুফিয়ান সেটাই করেছেন। (খ) ‘বানুল আছফার’ বলতে রোমকদের বুঝানো হয়েছে। ‘আছফার’ অর্থ হলুদ। আর রোমকরা ছিল হলুদ রংয়ের।
[11] বুখারী হা/৭; মুসলিম হা/১৭৭৩।
[12] হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম প্রণীত যাদুল মা‘আদ ৩/৬০৫ পৃষ্ঠা হ’তে উদ্ধৃত উপরোক্ত পত্রটি সম্প্রতি ডঃ হামীদুল্লাহ (প্যারিস) কর্তৃক প্রচারিত মূল পত্রের ফটোকপির সাথে হুবহু মিল রয়েছে। কেবলমাত্র একটি শব্দ ‘হুয়া’-এর পরিবর্তে ‘গায়রুহু’ ব্যতীত। অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লা হুয়া-র পরিবর্তে ফটোকপিতে ‘গায়রুহু’ রয়েছে। উভয়ের অর্থ একই।
[13] যাদুল মা‘আদ পৃঃ ৩/৬০৭-৬০৮।
[14] মুত্তাফাক্ব আলইহ, মিশকাত হা/৩৮০৭ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[15] আর-রাহীক্ব, পৃঃ ৩৪৭ ও টীকা পৃঃ ৩৪৮।
[16] যাদুল মা‘আদ ৩/৬০৬-৬০৭।