ইমান/আখলাক

রাগটা আমার বেশিই তবে তোমার কেন বদমেজাজ?

জনৈক বাবার বক্তব্য:

“…সেদিন আমার ছেলেটা খাওয়ার সময় প্লেট হাতে নিয়ে চেয়ার টানাটানি করতে গিয়ে খাবারের একটা টুকরো মাটিতে পড়ে যাওয়ায় আমি একটু বেশিই রেগে গেলাম। আমি সবকিছু নিয়মমাফিক ধীরস্থিরভাবে করার ব্যাপারে একটু বেশি সতর্ক, এ ব্যাপারে নিজের সম্পর্কে কিছুটা উচ্চ-ধারণাও রাখি। বাচ্চাদের ডিসিপ্লিনের দিকটা কড়াকড়িভাবে দেখি।

দুদিন পর আমার হাত থেকে সব খাবার সহ খাবারের গোটা প্লেট পড়ে যায়। আমার মত একটা পূর্ণবয়স্ক ‘সদা-সতর্ক’ ও ‘নিয়মতান্ত্রিক’ মানুষের হাত থেকে কিভাবে তা পড়ল? তাৎক্ষনিকভাবে আমি এর পিছনে বিভিন্ন তত্ত্ব দাঁড় করালাম, যেমন যেখানে প্লেট রেখেছিলাম সেই সারফেসটা ঢালু হওয়া ইত্যাদি… কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আমার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি জন্ম নিল: আমরা নিজেদের জন্য অজুহাত খাড়া করতে পটু কিন্তু অন্যদেরকে কোন ছাড় দিতে চাই না…”

মসজিদে একবার একটি ১০-১২ বছরের ছেলেকে ফরয নামায শেষে হুড়মুড় করে বের হয়ে আসতে দেখে আমার পাশের চল্লিশোর্ধ্ব মুসল্লী চোখে-মুখে ঘৃণা নিয়ে বলে উঠল: “শয়তান!” আমি তাকে বললাম: ছেলেটি নামায পড়তে এসেছে সে কারণে তাকে উৎসাহ দেয়া উচিৎ। লোকটি আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বলে উঠল: “এই নামাযের কোন দরকার নাই!” আমি হতবাক অবস্থায় শুধু এতটুকুই স্বগতোক্তি করতে পারলাম: “আমরা এই বয়সে কতই না ফেরেশতা ছিলাম!”

নিজেকে অন্যের আসনে বসিয়ে দেখতে পারা সন্তান প্রতিপালন, পারিবরিক সম্পর্ক এবং মানুষকে কোন কিছু শেখানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরী বিষয়।

মানুষের স্বভাব বড় বিচিত্র। আমরা নিজেদের বড় বড় অন্যায় কাজকে যাবতীয় অজুহাতের মোড়কে কতই না হালকা করে দেখি, কিন্তু অন্যের ছোটখাট অপরাধ ক্ষমা করতে পারি না! হোক সে সন্তান, স্ত্রী, কর্মচারী বা কাজের লোক।

জনৈক স্বামীর বক্তব্য:

“আমি সব কাজ ঘড়ির কাটায় করার চেষ্টা করি। যেমন ৮টার সময় বের হওয়ার কথা থাকলে ঠিক ৮টায় পরিবারের সবার রেডি থাকা চাই। যদি বের হওয়ার মুহূর্তে কেউ টয়লেট বা পানি খাওয়া কিংবা অন্য কোন কাজের কথা বলে, তবে আমার ভীষণ রাগের উদ্রেক হয় এবং আমি ‘উচিৎ কথা’ শুনিয়ে দিতে দেরী করি না। কিন্তু একদিন যখন আমার বের হওয়ার মুহূর্তে অদম্য প্রাকৃতিক বেগ আসায় ২-৪ মিনিট নয়, ১৫ মিনিট দেরী হয়ে গেল – সেদিন আমি বুঝতে পারলাম যে ‘মিস্টার পারফেক্ট’ হওয়ার শ্রেষ্ঠত্ববোধ মূলত এক ধরনের অহংকার যা থেকে আমার অবশ্যই নিজেকে মুক্ত করতে হবে।”

আমাদের মনে রাখা উচিৎ মানুষ খাঁটি ফেরেশতা কিংবা খাঁটি শয়তান নয়। বরং আমরা সবাই ভাল ও মন্দের মিশ্রণ। তাই প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গী ক্ষতিকর। আসুন আমরা নিচের কয়েকটি পদক্ষেপে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী শুধরে নিই:

প্রথমতঃ নিজেদের অপরাধকে বড় করে দেখতে অভ্যস্ত হওয়া উচিৎ। অবশ্য সেটাও মাত্রাতিরিক্ত হওয়া ঠিক নয়। কেননা নিজেকেও কখনও অজুহাত দেয়ার প্রয়োজন আছে। তবে সাধারণভাবে নিজের দোষের বেলায় দৃষ্টিভঙ্গী হবে: আমি অন্যায় করেছি, কিন্তু আমি ভবিষ্যতে নিজেকে সংশোধন করে নেব, ফলে আমি আল্লাহর ক্ষমা ও সাহায্যের প্রত্যাশী।

দ্বিতীয়তঃ অন্যের বেলায় অজুহাত বের করতে শিখি। নিশ্চয়ই সে অমুক কারণে এই অন্যায়টা করে ফেলেছে, কিংবা তার অনেক অপরাধ থাকলেও বেশ কিছু ভাল দিকও আছে, অথবা এই পরিস্থিতিতে আমি হলে আরও বড় ধরনের অন্যায় করে ফেলতাম – ইত্যাদি। এর অর্থ উপদেশ দেয়া বন্ধ করা নয়, বরং অন্যের অজুহাত দেখার প্রবণতা আমাদের উপদেশ-বাক্য থেকে অন্তরের বিদ্বেষ-প্রসূত উত্তাপকে বের করে একে করবে শীতল, কোমল ও মর্মস্পর্শী।

তৃতীয়তঃ আমাদের সবসময় স্মরণ করা উচিৎ যে আমার জীবনে এমন একটি দিন আসবে যেদিন আমি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অপার ক্ষমা ও উপেক্ষার মুখাপেক্ষী হব। সেদিন আল্লাহর কাছ থেকে যে আচরণ আমি আশা করি, আজ আমার কি উচিৎ নয় ছোট মাত্রায় হলেও সৃষ্টির সাথে এর অনুরূপ আচরণ করা?

আমরা মানুষের সাথে যেমন আচরণ করব, আল্লাহ তাআলাও আমাদের সাথে অনুরূপ আচরণ করবেন – আল্লাহ তাআলার এই রীতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে দুএকটা হাদীস দেখা যাক। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

যে কোন মুমিনের দুনিয়াবী বিপদের মধ্যে কোন একটি বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ তার কিয়ামতের দিনের বিপদের মধ্যে একটি বিপদ দূর করবেন। যে ঋণগ্রস্তের ঋণ আদায়কে সহজ করে দেবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়াদি সহজ করে দেবেন। যে কোন মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তার সাহায্য করতে থাকেন।… [মুসলিম(২৬৯৯)]

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

অতীতে এক লোক মানুষকে ঋণ প্রদান করত। সে তার কর্মচারীকে বলে দিত, তুমি কোন অভাবগ্রস্তের নিকট টাকা আদায় করতে গেলে তাকে মাফ করে দিও। হয়ত আল্লাহ এ কারণে আমাদেরকে ক্ষমা করবেন। তিনি [নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বললেন, এরপর যখন সে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করল, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। [বুখারী(৩৪৮০), মুসলিম(১৫৬২)]

চতুর্থতঃ সন্তানদের সাথে সহজতার মুহূর্তে নিজের দোষগুলো কিংবা এর একাংশ স্বীকার করা উচিৎ। তেমনি সন্তানদের প্রতি অন্যায় আচরণ করে থাকলে অন্তত দুঃখ প্রকাশ করা উচিৎ, যেন তাদের মনে ক্ষোভ সঞ্চিত হওয়ার সুযোগ না পায়। মনে রাখতে হবে, যারা আমাদের চেয়ে ছোট বা অধীনস্ত, তারা তাদের আপত্তি স্পষ্টভাবে জানাতে না পারার কারণে তাদের অন্তরে ক্ষোভ সঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা দীর্ঘ সময় পরে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মত অনাকাঙ্ক্ষিত কোন পন্থায় বিস্ফোরিত হলে এর পরিণতি আমাদের কারও জন্যই ভাল নয়।

_______

– মুহাম্মাদ নাসীল শাহরুখ (পরিচালক, ঈমান অ্যারাবিক স্কুল)।

মন্তব্য করুন

Back to top button