মুনাফিকী থেকে বাঁচার পথ
পূর্বের অংশ পড়ুন: মুনাফিক -এর বৈশিষ্ট্য
একজন মুসলিম নিজকে মুনাফিকী থেকে পূতপবিত্র রাখতে চাইলে তাকে অবশ্যই সদগুণাবলী ও সৎকর্মে বিভূষিত হ’তে হবে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা তুলে ধরা হ’ল :
১. ছালাতের জামা‘আতে আগেভাগে হাযির হওয়া এবং তাকবীরে তাহরীমা পাওয়া : আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ صَلَّى لِلَّهِ أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا فِى جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيْرَةَ الأُوْلَى كُتِبَتْ لَهُ بَرَاءَتَانِ بَرَاءَةٌ مِنَ النَّارِ وَبَرَاءَةٌ مِنَ النِّفَاقِ.
‘যে ব্যক্তি প্রথম তাকবীর প্রাপ্তিসহ একাধারে চল্লিশ দিন (পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত) জামা‘আতে আদায় করবে তার জন্য দু’টি মুক্তিপত্র লিখে দেওয়া হবে। একটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি, দ্বিতীয়টি মুনাফিকী থেকে মুক্তি’।[14]
জাহান্নাম থেকে মুক্তি (براءة من النار) অর্থ জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবে। যেমন বলা হয়, بَرَأَ مِنَ الدِّيْنِ وَالْعَيْبِ : خَلَصَ ‘অমুক ঋণ ও দোষ থেকে মুক্তি পেয়েছে; অর্থাৎ খালাস পেয়েছে। দোষ থেকে তার মুক্তি মিলেছে অর্থাৎ নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছে। নিফাক থেকে মুক্তি মেলা (براءة من النفاق) প্রসঙ্গে আল্লামা তিবী বলেছেন, ঐ লোকটি তার ছালাতের বদৌলতে দুনিয়াতে মুনাফিকের মত আমল করা থেকে নিরাপদ থাকবে এবং একনিষ্ঠ মুখলিছের মত আমল করার তাওফীক লাভ করবে। আর আখিরাতে সে মুনাফিকের জন্য বরাদ্দ শাস্তি থেকে নিরাপদে থাকবে। সে যে মুনাফিক ছিল না তৎসম্পর্কে সাক্ষ্য দেওয়া হবে। অর্থাৎ বলা হবে মুনাফিকরা যখন ছালাতে দাঁড়াত তখন আলসেমি করত। কিন্তু এই লোকটা ছিল তাদের বিপরীত। মিরকাত গ্রন্থে এমনটাই বলা হয়েছে।[15]
২. সদাচার ও দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ :
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم خَصْلَتَانِ لاَ تَجْتَمِعَانِ فِىْ مُنَافِقٍ حُسْنُ سَمْتٍ وَلاَ فِقْهٌ فِى الدِّيْنِ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘দু’টি আচার কোন মুনাফিকের মধ্যে মেলে না- সদাচার ও দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞান’।[16]
হাদীছটিতে উদ্ধৃত حُسْنُ سَمْتٍ অর্থ কল্যাণের পথের অনুসন্ধান এবং নেককার লোকদের গুণে গুণান্বিত হওয়া, সেই সঙ্গে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবরকম দোষ থেকে দূরে থাকা। وَلاَ فِقْهٌ فِى الدِّيْنِ বাক্যটি لاَ অব্যয় যোগে পূর্বের বাক্যের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। কেননা حُسْنُ سَمْتٍ বাক্যাংশটি নেতিবাচক অর্থের অঙ্গীভূত। এজন্যই وَلاَ فِقْهٌ فِى الدِّيْنِ বাক্যাংশেও لاَ বা নাবাচক অব্যয়টি আগের নাবাচকতাকে জোরদার করেছে মাত্র।[17]
৩. দানশীলতা :
عَنْ أَبِىْ مَالِكٍ الأَشْعَرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الطُّهُوْرُ شَطْرُ الإِيْمَانِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلأُ الْمِيْزَانَ، وَسُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلآنِ أَوْ تَمْلأُ مَا بَيْنَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَالصَّلاَةُ نُوْرٌ وَالصَّدَقَةُ بُرْهَانٌ وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ، كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَائِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوْبِقُهَا.
আবু মালিক আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক। একবার আল-হামদুলিল্লাহ উচ্চারণে দাঁড়িপাল্লা (ছওয়াবে) ভরে যায়; আর সুবহানাল্লাহ এবং আল-হামদুলিল্লাহ বলায় আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী সমুদয় স্থান (ছওয়াবে) ভরে যায়। (মানুষের জন্য) ছালাত হ’ল আলো, দান হ’ল প্রমাণ এবং ধৈর্য হ’ল জ্যোতি। আর কুরআন মাজীদ (ক্বিয়ামতে) হয় তোমার পক্ষে প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে অথবা তোমার বিরুদ্ধে। ভোর বেলায় (ঘুম থেকে জাগরণের মাধ্যমে) প্রত্যেকটা মানুষ নিজেকে (আমলের নিকট) বেঁচে দেয়। তারপর ভাল আমলের মাধ্যমে হয় সে নিজকে মুক্ত করে অথবা খারাপ আমলের মাধ্যমে নিজকে ধ্বংস করে’।[18]
ইমাম নববী (রহঃ) বলেছেন, দান-ছাদাক্বা দাতার ঈমানের প্রমাণ। কেননা মুনাফিক দান-ছাদাক্বা থেকে হাত গুটিয়ে রাখে, সে দান-ছাদাক্বায় বিশবাসী নয়। সুতরাং যে দান করে সে তার দানের মাধ্যমে তার ঈমানের সত্যতা জ্ঞাপন করে।[19]
৪. রাত জেগে ছালাত আদায় :
কাতাদা (রহঃ) বলেন, মুনাফিক খুব কমই রাত জাগে (قلما ساهر الليل منافق)।[20] তার কারণ মুনাফিকরা লোকদের দেখিয়ে দেখিয়ে সৎকাজ করতে আনন্দ পায়। নিরিবিলি থাকাকালে তাই সে সৎ কাজ করার উদ্দীপনা অনুভব করে না। সুতরাং কোন ব্যক্তি যখন রাত জেগে ছালাত আদায় করে, তখন তা তার মুনাফিক না হওয়ার এবং সত্য মুমিন হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
৫. আল্লাহর পথে জিহাদ :
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِّفَاقٍ ‘যে ব্যক্তি যুদ্ধ-জিহাদ না করে অথবা নিজের মনে যুদ্ধ-জিহাদের সংকল্প না করে মারা যাবে, সে মুনাফিকীর একটি শাখার উপর মারা যাবে’।[21]
ইমাম নববী বলেছেন, মুনাফিকরা যুদ্ধে যোগদান না করে বাড়ি বসে থাকে। তাই যে উক্ত হাদীছ মত কাজ করবে সে মুনাফিকদের সদৃশ হয়ে যাবে। কেননা জিহাদ তরক করা মুনাফিকীর একটি শাখা বা পর্যায়। এ হাদীছ থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি কোন কাজের নিয়ত বা ইচ্ছা করল কিন্তু তা করার আগেই সে মারা গেল, তার ক্ষেত্রে ঐ নিন্দা-সাজা প্রযোজ্য হবে না যা সেই কাজের নিয়ত না করেই মৃত্যুবরণকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।[22]
৬. বেশী বেশী আল্লাহর যিকির করা :
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলার কথা বেশী বেশী স্মরণ করলে মুনাফিকী থেকে মুক্তি মেলে। কেননা মুনাফিকরা আল্লাহকে কম স্মরণ করে। আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের এহেন আচরণ সম্পর্কে বলেছেন, وَلاَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ إِلاَّ قَلِيْلاً ‘তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)।
কা‘ব (রাঃ) বলেছেন, যে আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করে সে মুনাফিকী থেকে মুক্ত হয়ে যায়। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল-মুনাফিকূন-এর উপসংহার টানতে গিয়ে বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا لاَ تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلاَ أَوْلاَدُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَمَنْ يَّفْعَلْ ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُوْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির/স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে না দেয়। আর যারাই এমনটা করবে তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত’ (মুনাফিকূন ৬৩/৯)। মুনাফিকরা আল্লাহর স্মরণ সম্পর্কে উদাসীন বনে যাওয়ার কারণে মুনাফিকীর খপ্পরে পড়েছিল। তাই এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদারদের যিকির থেকে উদাসীন বা বেখেয়াল হওয়া সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
জনৈক ছাহাবীকে খারেজীরা মুনাফিক কি-না জিজ্ঞেস করা হ’লে, তিনি বললেন, ‘না, তারা মুনাফিক নয়; কেননা মুনাফিকরা আল্লাহকে খুব অল্পই স্মরণ করে’। সুতরাং অল্প-স্বল্প যিকর মুনাফিকীর চিহ্ন ও প্রতীক এবং বেশী বেশী যিকরে মুনাফিকীর খপ্পরে পড়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যিকররত অন্তরকে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকীর পরীক্ষার মুখোমুখি করেন না, এ পরীক্ষা কেবল তাদের জন্য যারা আল্লাহ তা‘আলার যিকরে উদাসীন।[23]
৭. দো‘আ :
জুবায়ের ইবনু নুফায়ের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সিরিয়ার হিমছ শহরে আবুদ দারদা (রাঃ)-এর বাড়িতে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন দেখলাম, তিনি তাঁর ছালাতের জায়গায় দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছেন। যখন তিনি বসে আত্তাহিয়্যাতু পড়া শেষ করলেন তখন মুনাফিকী থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করতে লাগলেন। তাঁর ছালাত শেষ হ’লে আমি বললাম, হে আবুদ দারদা আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন! মুনাফিকী নিয়ে আপনার ভাবনা কেন? তিনি অবাক সুরে বললেন, আল্লাহ মাফ কর! আল্লাহ মাফ কর! আল্লাহ মাফ কর! বালা-মুছীবতের হাত থেকে কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে? বালা-মুছীবতের হাত থেকে কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে? আল্লাহর কসম! একজন মানুষ মুহূর্তের মধ্যে বিপদে পড়তে পারে এবং সেজন্যে তার দ্বীন-ধর্মও ত্যাগ করতে পারে।[24]
৮. আনছারদের ভালবাসা :
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, آيَةُ الإِيْمَانِ حُبُّ الأَنْصَارِ، وَآيَةُ النِّفَاقِ بُغْضُ الأَنْصَارِ ‘ঈমানের নিদর্শন আনছারদের প্রতি ভালবাসা এবং মুনাফিকীর নিদর্শন আনছারদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা’।[25]
৯. আলী ইবনু আবু তালিব (রাঃ)-কে ভালবাসা :
যির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী ইবনু আবু তালিব (রাঃ) বলেছেন,
وَالَّذِى فَلَقَ الْحَبَّةَ وَبَرَأَ النَّسَمَةَ إِنَّهُ لَعَهْدُ النَّبِىِّ الأُمِّىِّ صلى الله عليه وسلم إِلَىَّ أَنَّهُ لاَ يُحِبُّنِى إِلاَّ مُؤْمِنٌ وَلاَ يُبْغِضُنِى إِلاَّ مُنَافِقٌ
‘যে মহান সত্তা ফসল উদগত করেন এবং জীবকে অস্তিতবহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দান করেন তাঁর কসম! আমার সপক্ষে নিরক্ষর নবী (ছাঃ)-এর অছিয়ত রয়েছে যে, মুমিন ছাড়া আমাকে কেউ ভালবাসবে না এবং মুনাফিক ছাড়া কেউ আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে না’।[26]
মুনাফিকদের মুকাবেলায় মুসলমানদের ভূমিকা :
মুনাফিকদের ক্ষেত্রে কোন ঢিলেমি না করা ফরয। তাদের পক্ষ থেকে আগত বিপদকে খাট করে দেখাও বৈধ নয়। বর্তমানে মুনাফিকরা তো নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগ থেকে বেশী বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, মুনাফিকরা আজ নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগের থেকেও ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেদিন তারা লুকিয়ে ছাপিয়ে মুনাফিকী করত। কিন্তু আজ প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে তা করছে’।[27] তাদের বিষয়ে মুসলমানদের ভূমিকা হবে নিম্নরূপ :
১. তাদের আনুগত্য না করা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ اتَّقِ اللهَ وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيْماً حَكِيْماً.
‘হে নবী, আল্লাহকে ভয় কর এবং কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য কর না। অবশ্যই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (আহযাব ৩৩/১)। ইমাম তাবারী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে সম্বোধন করে বলেছেন, হে নবী, তুমি আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য এবং তাঁর প্রতি তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে তাঁকে ভয় কর। আর তাঁকে ভয় কর, তাঁর নির্দেশিত হারাম থেকে দূরে থাকা ও তার সীমালংঘন না করার মাধ্যমে। আর তুমি ঐ সকল কাফিরের আনুগত্য করবে না যারা তোমাকে বলে, তোমার যেসব ছোট লোক ঈমানদার অনুসারী আছে তোমার নিকট থেকে তাদের হটিয়ে দাও, যাতে আমরা তোমার কাছে বসতে পারি’। তুমি ঐ সকল মুনাফিকেরও আনুগত্য করবে না যারা দৃশ্যত তোমার উপর ঈমান রাখে এবং তোমার কল্যাণ কামনা করে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তোমার, তোমার দ্বীন এবং তোমার ছাহাবীদের ক্ষতি করতে মোটেও কোন সুযোগ হাতছাড়া করবে না। তুমি তাদের কোন মতামত গ্রহণ করবে না এবং শুভাকাঙ্খী মনে করে তাদের কাছে কোন পরামর্শও চাইতে যাবে না। কারণ তারা তোমার শত্রু। ঐ সমস্ত মুনাফিকের অন্তরে কী লুক্কায়িত আছে আর কী উদ্দেশ্যেই বা তারা বাহ্যত তোমার কল্যাণ কামনা যাহির করছে তা তাঁর ভাল জানা আছে। তিনি তোমার, তোমার দ্বীনের এবং তোমার ছাহাবীদের সহ সমগ্র সৃষ্টির ব্যবস্থাপনায় মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী।[28]
২. মুনাফিকদের উপেক্ষা করা, ভীতি প্রদর্শন ও উপদেশ দান
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, بَشِّرِ الْمُنَافِقِيْنَ بِأَنَّ لَهُمْ عَذَاباً أَلِيْماً ‘তুমি মুনাফিকদের এই সংবাদ জানিয়ে দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (নিসা ৪/১৩৮)।
তিনি আরো বলেন,
أُولَـئِكَ الَّذِيْنَ يَعْلَمُ اللهُ مَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُل لَّهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلاً بَلِيْغاً .
‘ঐ মুনাফিকরাই তো তারা, যাদের অন্তরে কী আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি ওদের এড়িয়ে চল বা উপেক্ষা কর, ওদের উপদেশ দাও এবং ওদের এমন কথা যা মর্মে গিয়ে পৌঁছে’ (নিসা ৪/৬৩)।
আল্লাহ তা‘আলা আয়াতে ‘ওরা’ (اولئك) বলতে মুনাফিকদের বুঝিয়েছেন, ইতিপূর্বে যাদের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, হে রাসূল! তাগূতের কাছে তাদের বিচার প্রার্থনা করা, তোমার কাছে বিচার প্রার্থনা না করা এবং তোমার কাছে আসতে বাধা দানে তাদের মনে কী অভিপ্রায় লুকিয়ে ছিল তা আল্লাহ খুব ভাল জানেন। তাদের মনে তো মুনাফিকী ও বক্রতা লুকিয়ে রয়েছে যদিও তারা শপথ করে বলে, আমরা কেবলই কল্যাণ ও সম্প্রীতি কামনা করি।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলছেন, ‘তুমি ওদের ছাড় দাও, কায়িক-দৈহিক কোন শাস্তি তুমি ওদের দেবে না। তবে তুমি তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি চেপে বসার এবং তাদের বসতিতে আল্লাহর মার অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে তাদেরকে ভয় দেখিয়ে উপদেশ দাও। তারা আল্লাহ ও তার রাসূল সম্পর্কে যে সন্দেহের দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেজন্য যে অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি তারা হবে সে সম্পর্কে তাদের সতর্ক কর। আর তাদের হুকুম কর আল্লাহকে ভয় করতে এবং আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও শাস্তিকে সত্য বলে মেনে নিতে’।[29]
৩. মুনাফিকদের সঙ্গে বিতর্কে না জড়ানো :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلاَ تُجَادِلْ عَنِ الَّذِيْنَ يَخْتَانُوْنَ أَنْفُسَهُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ مَن كَانَ خَوَّاناً أَثِيْماً.
‘যারা নিজেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তুমি তাদের পক্ষে বিতর্কে লিপ্ত হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কখনো বিশ্বাসঘাতক পাপিষ্ঠকে পসন্দ করেন না’ (নিসা ৪/১০৭)।
আল্লাহ বলেছেন, হে রাসূল! যারা নিজেদের সাথে খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের পক্ষ নিয়ে তুমি বিতর্ক করবে না। বনু উবাইরিক গোত্রের কিছু লোক এই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। যাফর গোত্রের তাম‘আহ বা বশীর ইবনু উবাইরিক এক আনছারীর বর্ম চুরি করে। বর্মের মালিক নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে অভিযোগ করে এবং তাম‘আহর প্রতি তার সন্দেহের কথা বলে। অনুসন্ধান শুরু হ’লে সে বর্মটি এক ইহুদীর কাছে গচ্ছিত রাখে। পরে তাম‘আহ, তার ভাই-বেরাদার ও বনু যাফরের আরো কিছু লোক জোট পাকিয়ে সেই ইহুদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। ইহুদীকে জিজ্ঞেস করা হ’লে সে নিজেকে নির্দোষ দাবী করে। কিন্তু তাম‘আহর লোকেরা জোরেশোরে বলতে থাকে, এতো শয়তান ইহুদী, সেতো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করে। তার কথা কেমন করে বিশ্বাসযোগ্য হ’তে পারে? বরং আমাদের কথা মেনে নেওয়া উচিত। কেননা আমরা মুসলমান। এ মোকদ্দমার বাহ্যিক ধারাবিবরণীতে প্রভাবিত হয়ে নবী করীম (ছাঃ) ঐ ইহুদীর বিরুদ্ধে রায় দিতে এবং অভিযোগকারীকে বনু উবাইরিকের বিরুদ্ধে দোষারোপ করার জন্য সতর্ক করে দিতে প্রায় উদ্যত হয়েছিলেন। এমন সময় উক্ত আয়াত নাযিল হয় এবং সমস্ত ব্যাপারটির প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হয়।
আসলে যে ব্যক্তি অন্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে সবার আগে নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। কারণ মন ও মস্তিষ্কের শক্তিগুলো তার কাছে আমানত হিসাবে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। সে সেগুলোকে অযথা ব্যবহার করে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বাধ্য করে। বিবেক-বুদ্ধিকে দ্বীনের অনুগত না করে বরং আপন খেয়ালখুশির অনুগত করে সে এভাবে নিজের সাথে খিয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতা করে।
তাই এমন বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ নিতে নবী করীম (ছাঃ)-কে নিষেধ করা হয়েছে। বস্ত্তত মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করা যাদের স্বভাব এবং এরূপ আত্মসাৎ ও অন্যান্য হারামের মাঝে বিচরণের মাধ্যমে যারা পাপ-পঙ্কিলতার মাঝে ডুবে থাকে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মোটেও ভালবাসেন না এবং পসন্দও করেন না।[30]
৪. মুনাফিকদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে না তোলা :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَتَّخِذُوْا بِطَانَةً مِّنْ دُوْنِكُمْ لاَ يَأْلُوْنَكُمْ خَبَالاً وَدُّوْا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُوْرُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الآيَاتِ إِنْ كُنتُمْ تَعْقِلُوْنَ.
‘হে মুসলিগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করো না; তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোন ত্রুটি করে না- তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বেরোয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে রয়েছে, তা আরো অনেকগুণ বেশী জঘন্য। তোমাদের জন্যে নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া হলো, যদি তোমরা তা অনুধাবন করতে সমর্থ হও’ (আলে ইমরান ৩/১১৮)।
উক্ত আয়াত কিছু মুসলিম সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। তারা তাদের ইহুদী মুনাফিক বন্ধুদের সঙ্গে গভীর মিতালি রাখত এবং প্রাক ইসলামী যুগে জাহেলিয়াতের যামানায় যেসব কারণে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ইসলাম পরবর্তীকালেও তারা তা নির্ভেজালভাবে অটুট রেখেছিল। আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে তাদেরকে এমন বন্ধুত্ব রক্ষা করতে নিষেধ করেন এবং একই সাথে তাদের কোন কাজে ওদের থেকে পরামর্শ নিতেও নিষেধ করে দেন’।[31]
৫. মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালনা এবং কঠোরতা আরোপ :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيْرُ. ‘হে নবী! তুমি কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়ে যাও এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ কর। তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। আর তা কতই না নিকৃষ্ট আবাস’! (তওবা ৯/৭৩)।
মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ভয় দেখানোর মাধ্যমে এই কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করা যায়।
৬. মুনাফিকদের প্রতি অবজ্ঞা দেখান এবং তাদের নেতা না বানানো :
عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ تَقُولُوْا لِلْمُنَافِقِ سَيِّدٌ فَإِنَّهُ إِنْ يَكُ سَيِّدًا فَقَدْ أَسْخَطْتُمْ رَبَّكُمْ عَزَّ وَجَلَّ.
বুরাইদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা কোন মুনাফিককে সাইয়্যিদ বা নেতা নামে আখ্যায়িত করো না। কেননা সে যদি সত্যিই (তোমাদের) নেতা হয়, তাহ’লে তোমরা তোমাদের প্রভুকে ক্ষুব্ধ করবে’।[32]
৭. মুনাফিকদের জানাযার ছালাতে অংশগ্রহণ না করা :
আল্লাহ তা‘আরা বলেন,
وَلاَ تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُم مَّاتَ أَبَداً وَلاَ تَقُمْ عَلَىَ قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُواْ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَمَاتُوْا وَهُمْ فَاسِقُوْنَ.
‘তাদের (মুনাফিকদের) কেউ মারা গেলে তুমি কখনও তার জানাযার ছালাত আদায় করবে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না। নিশ্চয়ই তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছে এবং পাপাচারী অবস্থাতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে’ (তওবা ৯/৮৪)।
এই আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, যখন মুনাফিকদের দলপতি আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই মারা যায় তখন তার পুত্র আব্দুল্লাহ নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনার জামাটা আমাকে দিন, ওটা দিয়ে আমি ওকে কাফন দেব। আর আপনি ওর জানাযার ছালাত আদায় করবেন এবং ওর জন্য ক্ষমা চাইবেন। তিনি তাকে জামাটা দিয়ে বললেন, কাফন জড়ান শেষ হ’লে আমাকে জানাবে। তিনি কাফন সম্পন্ন করে তাঁকে জানালেন। তিনি তখন জানাযার ছালাতে ইমামতির জন্য এগিয়ে গেলেন। কিন্তু সে সময় ওমর (রাঃ) তাঁকে টেনে ধরলেন এবং বললেন, আল্লাহ কি আপনাকে মুনাফিকদের জানাযার ছালাত আদায় করতে নিষেধ করেননি? তিনি কি বলেননি, তুমি তাদের জন্য মাফ চাও কিংবা না চাও সবই সমান। তুমি যদি তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা চাও তবুও আল্লাহ তাদের মোটেও ক্ষমা করবেন না? তখন অবতীর্ণ হয়- ‘হে রাসূল! তুমি তাদের কেউ মারা গেলে কোন দিন তার জানাযার ছালাত আদায় করবে না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না’। তারপর থেকে তিনি মুনাফিকদের জানাযার ছালাতে অংশ নেওয়া বন্ধ করে দেন।[33]
শেষ কথা :
পূর্বের বর্ণনা থেকে মুনাফিকীর বিপদ সম্পর্কে ধারণা সুস্পষ্ট হয়েছে। আসলে মুনাফিকী একটি প্রাণঘাতী মানসিক রোগ এবং নিন্দনীয় স্বভাব। নবী করীম (ছাঃ) এহেন স্বভাবের অধিকারীকে বিশ্বাসঘাতক, আত্মসাৎকারী, মিথ্যুক ও পাপাচারী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা মুনাফিক মনে যা লুকিয়ে রাখে, বাইরে তার উল্টোটা প্রকাশ করে। সে সত্য বলছে বলে দাবী করে অথচ সে জানে যে সে মিথ্যুক। সে দাবী করে আমানত রক্ষা করার, অথচ সে ভালই জানে যে সে তা আত্মসাৎকারী। সে আরও দাবী করে যে, সে অঙ্গীকার পালনে অত্যন্ত দৃঢ় অথচ সে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। সে তার প্রতিপক্ষের নামে বানোয়াট সব দোষ বলে বেড়ায় অথচ সে ভাল করেই জানে তার এসব দোষারোপের মাধ্যমে সে পাপাচারী হচ্ছে। সে মারাত্মক অপরাধ করছে। সুতরাং তার স্বভাব চরিত্রের পুরোটাই ধোঁকা ও প্রতারণার উপর দন্ডায়মান। এমন যার অবস্থা তার বেলায় বড় মুনাফিক হয়ে যাওয়ার ভয় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা নিফাকে আমালী বা আমলভিত্তিক মুনাফিকী যদিও ঐসব পাপের অন্তর্ভুক্ত যদ্দরুন বান্দা ঈমান থেকে খারিজ হয়ে যায় না, তবুও যখন তা বান্দার ওপর জেঁকে বসে এবং তার আচরণকে প্রতারণার জালে আটকে ফেলে এবং তা অনেক্ষণ চলতে থাকে তখন আল্লাহ তাকে বড় ও আসল মুনাফিকের খাতায় নাম তুলে দিতে পারেন। তার আমলের শাস্তি হিসাবেই তার অন্তর থেকে ঈমান খারিজ করে সেখানে মুনাফিকীর জায়গা তিনি করে দেন।
আমরা আল্লাহর নিকট দো‘আ করি- তিনি যেন আমাদের অন্তরের দোষ-ত্রুটিকে সংশোধন করে দেন এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল ফিৎনা-ফাসাদ থেকে আমাদের দূরে রাখেন। আর আল্লাহ তা‘আলা রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন, আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর।
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক