ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি
পূর্বের অংশ পড়ুন: ‘ঈমান’ -এর পরিচয়
কুরআন-হাদীছের বিভিন্ন দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, ঈমান বাড়ে ও কমে।
কুরআন থেকে দলীল :
(১) মহান আল্লাহ বলেন,
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُواْ لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَاناً وَقَالُواْ حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ-
‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তোমাদের বিরুদ্ধে লোকজন সমবেত হয়েছে, অতএব তোমরা তাদেরকে ভয় কর। এতে তাদের বিশ্বাস আরো বৃদ্ধি হয়েছিল এবং তারা বলেছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক’ (আলে ইমরান ৩/১৭৩)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘নিশ্চয় মুমিনরা এরূপ যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে, আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করা হয় তখন সেই আয়াত সমূহ তাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (আনফাল ৮/২)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
وَإِذَا مَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَـذِهِ إِيمَاناً فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُواْ فَزَادَتْهُمْ إِيمَاناً وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ-
‘আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের মধ্যে কিছু লোক বলে, তোমাদের মধ্যে এই সূরা কার ঈমান বৃদ্ধি করল? অনন্তর যেসব লোক ঈমান এনেছে, এই সূরা তাদের ঈমানকে বর্ধিত করেছে এবং তারাই আনন্দ লাভ করেছে’ (তাওবা ৯/১২৪)।
হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, এ আয়াতটিই সর্বাধিক বড় দলীল যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে। আর এটিই হচ্ছে অধিকাংশ উত্তরসূরী ও পূর্বসূরী বিদ্বান এবং ওলামায়ে কেরাম ও আইম্মায়ে কেরামর মত।[1]
(২) হেদায়াত বৃদ্ধি : হিদায়াত হচ্ছে ঈমান। মহান আল্লাহ বলেন,
وَيَزِيدُ اللهُ الَّذِينَ اهْتَدَوْا هُدًى وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوَاباً وَخَيْرٌ مَّرَدًّا-
‘আর যারা সৎ পথে চলে আল্লাহ তাদেরকে অধিক হিদায়াত দান করেন এবং স্থায়ী সৎকর্ম তোমার প্রতিপালকের পুরস্কার প্রাপ্তির জন্যে শ্রেষ্ঠ এবং প্রতিদান হিসাবেও শ্রেষ্ঠ’ (মারিয়াম ১৯/৭৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,وَالَّذِينَ اهْتَدَوْا زَادَهُمْ هُدًى وَآتَاهُمْ تَقْواهُمْ ‘যারা সৎপথ অবলম্বন করে আল্লাহ তাদের হিদায়াত বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে তাক্বওয়া দান করেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৭)। আহলে কাহ্ফ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوْا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى ‘তারা ছিল কয়েকজন যুবক, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম’ (কাহফ ১৮/১৩)। এ আয়াতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঈমান বাড়ে ও কমে।[2]
(৩) বিনয় ও নম্রতা বৃদ্ধি : আল্লাহ তা‘আলা বিনয়-নম্রতা বৃদ্ধির সংবাদ দিয়েছেন। আর এটি ঈমান। মহান আল্লাহ বলেন, وَيَخِرُّونَ لِلأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعاً ‘আর তারা (আল্লাহর ভয়ে) কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১০৯)। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বিনয়-নম্রতার কথা উল্লেখ করেছেন। আর বিনয়-নম্রতা বৃদ্ধি হয়। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, ঈমান বৃদ্ধি হয়। কেননা বিনয়-নম্রতা ঈমান। মহান আল্লাহ বলেন,قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ، الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ- ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ। যারা নিজেদের ছালাতে বিনয়-নম্র’ (মুমিনূন ২৩/১-২)।
মহান আল্লাহ বলেন, أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ ‘মুমিন লোকদের জন্য এখনও সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণ এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের হৃদয় বিনীত হবে’ (হাদীদ ৫৭/১৬)।
বনী ইসরাঈলের ১০৯নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জারীর আত-ত্বাবারী বলেন, কুরআনের মধ্যে যে সমস্ত শিক্ষা, ওয়ায-নছীহত, উপদেশ বর্ণনা করা হয়েছে সে সমস্ত আয়াতের মাধ্যমে মুমিন-মুসলমানদের (ঈমান) ও বিনয়-নম্রতা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ পালন ও তাঁর আনুগত্যে তারা বিনয়ী হয়। কেননা তারা তাতেই শান্তি লাভ করে থাকে।[3] অন্তরের আমল হ’ল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসা, আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা, তাঁর উপর আশা-ভরসা করা, তাঁর জন্যই বিনয়ী ও নম্র হওয়া। অনুরূপ সকল কিছুই ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। যা কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত হয়। আর এটাই এক মানুষ থেকে অপর ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।[4]
(৪) এক মুমিন অপর মুমিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ : এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
لاَّ يَسْتَوِي الْقَاعِدُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ غَيْرُ أُوْلِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِيْنَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِيْنَ دَرَجَةً وَكُـلاًّ وَعَدَ اللهُ الْحُسْنَى وَفَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْراً عَظِيماً-
‘মুমিনদের মধ্যে যারা কোন দুঃখ-কষ্ট ব্যতীতই গৃহে বসে থাকে, আর যারা স্বীয় জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তারা সমান নয়। মহান আল্লাহ জান-মাল দ্বারা জিহাদকারীগণকে উপবিষ্টগণের উপর মর্যাদায় গৌরবান্বিত করেছেন এবং সকলকেই আল্লাহ কল্যাণপ্রদ প্রতিশ্রুতি দান করেছেন। আর উপবিষ্টগণের উপর জিহাদকারীগণের মহা প্রতিদানে গৌরবান্বিত করেছেন (নিসা ৪/৯৫)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
لَا يَسْتَوِيْ مِنْكُم مَّنْ أَنفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُوْلَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ الَّذِيْنَ أَنفَقُوْا مِن بَعْدُ وَقَاتَلُوْا وَكُلاًّ وَعَدَ اللهُ الْحُسْنَى وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيرٌ-
‘তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে (তারা উভয়ে কখনই) সমান নয়। তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের অপেক্ষা যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে। তবে মহান আল্লাহ উভয়কেই কল্যাণের (জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তোমরা যা কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’ (হাদীদ ৫৭/১০)। আল্লাহ আরো বলেন, وَلَقَدْ آتَيْنَا دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ عِلْماً وَقَالَا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي فَضَّلَنَا عَلَى كَثِيرٍ مِّنْ عِبَادِهِ الْمُؤْمِنِينَ ‘আমি অবশ্যই দাঊদ ও সুলাইমানকে জ্ঞান দান করেছিলাম এবং তাঁরা বলেছিলেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যই যিনি আমাদেরকে তাঁর বহু মুমিন বান্দার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন’ (নামল ২৭/১৫)। মহান আল্লাহ বলেন,
وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَداً ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ-
‘আর যেসব মুহাজির ও আনছার (ঈমানের দিক দিয়ে) অগ্রবর্তী ও প্রথম, আর যেসব লোক একান্ত নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুগামী, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্যে এমন জান্নাত প্রস্ত্তত করে রেখেছেন যার তলদেশ দিয়ে নহর সমূহ প্রবাহিত। তাতে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। সুতরাং এটাই হচ্ছে মহা সাফল্য’ (তওবা ৯/১০০)।
বর্ণিত আয়াতগুলো থেকে সুস্পষ্ট হ’ল যে, ঈমান কমে ও বাড়ে। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হ’ল যে, এক মুমিন অপর মুমিন থেকে ঈমানের দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে। এজন্যই শক্তিশালী ঈমানদার আল্লাহর নিকট দুর্বল ঈমানদারের চেয়ে অধিক প্রিয়।[5]
(৫) জান্নাতে মুমিনের মর্যাদা বৃদ্ধি : যার যত বেশী সৎ আমল রয়েছে, সে ব্যক্তি ঈমানের দিক থেকে তত বেশী শক্তিশালী এবং এর ফলশ্রুতিতে জান্নাতেও তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, أُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ ‘তারাই সত্যিকারের ঈমানদার। এদের জন্যেই রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকট উচ্চমর্যাদা। আরও রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা’ (আনফাল ৮/৪)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, انظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَلَلآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلاً ‘লক্ষ্য কর, আমি কিভাবে তাদের একদলকে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম, পরকাল তো নিশ্চয়ই মর্যাদায় মহত্তর ও গুণে শ্রেষ্ঠতর’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২১)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)।
(৬) পূর্ণাঙ্গ দ্বীন : পূর্ণাঙ্গ দ্বীন থেকে কিছু ছেড়ে দেওয়া হ’লে সেটা অপূর্ণাঙ্গ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِيناً-
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। ইমাম বুখারী বলেন, পূর্ণ জিনিস থেকে কিছু বাদ দেয়া হ’লে তা অপূর্ণ হয়।[6]
অতএব আমাদের উপর আল্লাহ তা‘আলা যে ঈমান ওয়াজিব করেছেন তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি হয়, যেমনভাবে পবিত্র কুরআন ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর দ্বীন এভাবেই ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়।[7] অতএব ঈমান বাড়ে এবং কমে এবং মুমিন ব্যক্তিরাও ঈমানের দিক দিয়ে সবাই সমান নয়; বরং তাদের মধ্যে মর্যাদায় পার্থক্য রয়েছে।
(৭) অন্তরের প্রশান্তি : মহান আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে বলেন,
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِـي الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَـكِن لِّيَطْمَئِنَّ قَلْبِيْ-
‘আর যখন ইবরাহীম বলেছিলেন, হে আমার প্রভু! আপনি কিরূপে মৃতকে জীবিত করেন তা আমাকে দেখান। তিনি বললেন, তবে কি তুমি বিশ্বাস কর না? তিনি (ইবরাহীম) বললেন, হ্যঁা; তবে এটা কেবল আমার আত্মিক প্রশান্তির জন্য’ (বাক্বারাহ ২/২৬০)। আয়াতটি থেকে বুঝা যায় ঈমান বৃদ্ধি হয়।[8]
প্রকাশ থাকে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য সৎ আমল করে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী তা সম্পন্ন করে থাকে, সে তার অন্তরে অবশ্যই প্রশান্তি লাভ করবে। আর এটাই হচ্ছে বাস্তবে আল্লাহর ওয়াদা। সুতরাং বান্দা যখন আল্লাহকে বেশী বেশী ডাকে, সৎ আমল বেশী বেশী করে তখন তার ঈমান বেড়ে যায়।
(৮) আল্লাহর প্রতি মুমিনদের ঈমান আনা : মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ آمِنُواْ بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِيَ أَنزَلَ مِن قَبْلُ-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি এবং ঐ কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন এবং ঐ কিতাবের প্রতি যা পূর্বে অবতীর্ণ করেছিলেন’ (নিসা ৪/১৩৬)।
তিনি আরো বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَآمِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِن رَّحْمَتِهِ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার দিবেন’ (হাদীদ ৫৭/২৮)।
মুমিন ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর যখন তাঁর আনুগত্য করে, বেশী বেশী সৎ আমল করে তখন তার ঈমান বাড়ে। এভাবে তারা আল্লাহর প্রতি আরো দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবের প্রতি, তাঁর রাসূলদের প্রতি, পরকালের প্রতি ঈমান আনে। অতএব যে যত বেশী আল্লাহকে ভয় করে এবং সৎ আমল করে, তার ঈমান তত বাড়তে থাকে।[9]
(৯) মুমিনদের স্তর : মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। এ থেকে বুঝা যায় ঈমান বাড়ে এবং কমে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِيْنَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيرُ-
‘অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করলাম আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি। তবে তাদের মধ্যে কেউ নিজের প্রতি যুলুম করেছে, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে, কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণের কাজে অগ্রসর হয়েছে। এটাই (মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে) মহা অনুগ্রহ’ (ফাতির ৩৫/৩২)।
এখানে মহান আল্লাহ ঈমানের দিক দিয়ে মুমিন বান্দাদের তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। এদের মধ্যে যারা কল্যাণের পথে অগ্রসর হয়, তারা ওয়াজিব ও মুস্তাহাব কাজ সমূহ সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করে এবং হারাম বিষয় সমূহ ও অপসন্দীয় বিষয়াবলী থেকে বিরত থাকে, তারাই নৈকট্য প্রাপ্ত। যারা মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী, তারা তাদের উপর অর্পিত ওয়াজিব বিষয় সমূহ সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করে থাকে এবং হারামকৃত বিষয় থেকে বিরত থাকে। আর যারা নিজের আত্মার প্রতি যুলুম করেছে, তারা কিছু হারাম কাজে পতিত হয় এবং কিছু ওয়াজিব বিষয় সমূহ আদায়ে ত্রুটি করে। কিন্তু তাদের সাথে প্রকৃত ঈমান আছে। ঈমানের হরাস-বৃদ্ধির এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় প্রমাণ।[10]
(১০) পাপের কারণে মানুষের অন্তর থেকে ঈমান আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকে। এমনকি তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন,كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِم مَّا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘না এটা কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরের উপর মরিচারূপে জমে গেছে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১৪)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘অবশ্যই কোন মুমিন ব্যক্তি যখন পাপ কাজে পতিত হয় তখন তার অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়। অতঃপর সে পাপ থেকে তওবা-ইস্তেগফার করলে অন্তর থেকে দাগটি উঠিয়ে নেওয়া হয়। ফলে তার অন্তর মসৃণ উজ্জ্বল হয়ে যায়। কালো দাগ বাড়তে থাকলে (পাপ বাড়লে) তার সম্পূর্ণ অন্তর ঘিরে ফেলে। এ মরীচিকা সম্পর্কেই আল্লাহ বলেন, ‘না এটা কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরে মরিচারূপে জমে গেছে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১৪)।[11]
উপরে বর্ণিত আয়াত এবং হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঈমান কমে ও বাড়ে।[12]
ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির প্রমাণে হাদীছে নববী (ছাঃ) :
ঈমান বাড়ে ও কমে এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বহু প্রমাণ রয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা কুরআনের দলীলগুলি উপস্থাপন করেছি। এখানে হাদীছ থেকে কয়েকটি দলীল পেশ করা হ’ল।-
(1) عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ يَزْنِى الزَّانِى حِيْنَ يَزْنِى وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَسْرِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيْهَا أَبْصَارَهُمْ حِيْنَ يَنْتَهِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ.
১. আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘কোন ব্যভিচারী মুমিন অবস্থায় ব্যভিচার করে না এবং কোন মদ্যপায়ী মুমিন অবস্থায় মদ পান করে না। কোন চোর মুমিন অবস্থায় চুরি করে না। কোন লুটেরা লুটতরাজ করে না মুমিন অবস্থায়, যখন সে লুটতরাজ করে তখন তার প্রতি লোকজন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে’।[13]
হাদীছটি থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঈমান কমে ও বাড়ে। কোন মুমিন ব্যক্তি যখন পাপে পতিত হয় তখন তার ঈমান কমে যায়। আবার যখন সে তওবা করে পাপ থেকে ফিরে আসে, তখন তার ঈমান বাড়ে। আব্দুল্লাহ বিন ইমাম আহমাদ (রহ.) বলেন, আমার পিতা থেকে শুনেছি তাঁকে ইরজা (মুরজিয়া, যারা ঈমানকে আমলের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, আমরা ঈমান সম্পর্কে বলব, কথা ও আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা, সেটা কমে ও বাড়ে। যখন (কোন মুমিন ব্যক্তি) যেনা করে ও মদ পান করে তখন তার ঈমান কমে যায়।[14]
মোদ্দাকথা, কোন মুমিন ব্যক্তি বড় পাপ করলে তার ঈমান কমে যায়। তবে সে কাফের হয়ে যায় না। যেমন খারেজীরা এরূপ পাপে পতিত হওয়ার কারণে (মুসলমান ব্যক্তিদের) কাফের ধারণা করে থাকে।[15] উল্লেখ্য যে, কোন মুমিন ব্যক্তি কবীরা গোনাহ করলে (বড় শিরক ব্যতীত) এবং তওবা ছাড়া মারা গেলে সেটা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে তার পাপ পরিমাণ শাস্তি দিয়ে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।[16]
(2) عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه الإِيْمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُوْنَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّوْنَ شُعْبَةً فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيْقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيْمَانِ.
২. আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ঈমানের সত্তর অথবা ষাটের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম শাখা হ’ল তাওহীদের ঘোষণা এ মর্মে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই। আর সর্বনিম্ন হ’ল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত দূর করা। আর লজ্জাও ঈমানের একটি শাখা’।[17] অতএব বুঝা যাচ্ছে ঈমানের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন শাখা রয়েছে। এ হাদীছ প্রমাণ করে যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে।[18]
হাদীছটি থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ঈমানের একটি অঙ্গ অপর অঙ্গ থেকে ভিন্ন হয়। আরো জানা যায় যে, মানুষ ঈমানের দিক দিয়ে অন্যের থেকে অনেক উপরে হ’তে পারে। অতএব যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না সে তার জ্ঞান ও শরী‘আতের দলীলের বিরোধিতা করে।[19]
(3) عَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَفِى قَلْبِهِ وَزْنُ شَعِيْرَةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ، مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَفِى قَلْبِهِ وَزْنُ بُرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَفِى قَلْبِهِ وَزْنُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ.
৩. আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে এবং তার অন্তরে একটি যব পরিমাণ পুণ্য বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হ’তে বের করা হবে। যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে এবং তার অন্তরে একটি গম পরিমাণও পুণ্য বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হ’তে বের করা হবে। যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে এবং তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে, তাকেও জাহান্নাম হ’তে বের করা হবে’।[20]
(4) عَنْ أَبِى سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ قَالَ خَرَجَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِى أَضْحًى أَوْ فِطْرٍ إِلَى الْمُصَلَّى، فَمَرَّ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ يَا مَعْشَرَ النِّسَاءِ تَصَدَّقْنَ، فَإِنِّى أُرِيتُكُنَّ أَكْثَرَ أَهْلِ النَّارِ. فَقُلْنَ وَبِمَ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ تُكْثِرْنَ اللَّعْنَ، وَتَكْفُرْنَ الْعَشِيْرَ، مَا رَأَيْتُ مِنْ نَاقِصَاتِ عَقْلٍ وَدِيْنٍ أَذْهَبَ لِلُبِّ الرَّجُلِ الْحَازِمِ مِنْ إِحْدَاكُنَّ. قُلْنَ وَمَا نُقْصَانُ دِيْنِنَا وَعَقْلِنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ أَلَيْسَ شَهَادَةُ الْمَرْأَةِ مِثْلَ نِصْفِ شَهَادَةِ الرَّجُلِ. قُلْنَ بَلَى.
قَالَ فَذَلِكَ مِنْ نُقْصَانِ عَقْلِهَا، أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ
وَلَمْ تَصُمْ. قُلْنَ بَلَى. قَالَ فَذَلِكَ مِنْ نُقْصَانِ دِيْنِهَا-
৪. আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার ঈদুল আযহা অথবা ঈদুল ফিতরের ছালাত আদায়ের জন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ঈদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি মহিলাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, হে মহিলা সমাজ! তোমরা ছাদাক্বাহ করো। কারণ আমি দেখেছি জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে তোমরাই সর্বাধিক। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, কি কারণে হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, তোমরা অধিক পরিমাণে অভিশাপ দিয়ে থাক এবং স্বামীর অকৃতজ্ঞ হও। বুদ্ধি ও দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একজন সদা সতর্ক ব্যক্তির বুদ্ধি হরণে তোমাদের চেয়ে পারদর্শী আমি আর কাউকে দেখিনি। তাঁরা বললেন, আমাদের দ্বীন ও বুদ্ধির ত্রুটি কোথায় হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, একজন মহিলার সাক্ষ্য কি একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তাঁরা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, এটা হচ্ছে তাদের বুদ্ধির ত্রুটি। আর হায়েয অবস্থায় তারা কি ছালাত ও ছিয়াম হ’তে বিরত থাকে না? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এ হচ্ছে তাদের দ্বীনের ত্রুটি’।[21] আমল কম করলে ঈমান কমে যায়। হাদীছটি ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি প্রমাণ করে।[22]
৫. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيْمَانِ ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোন অন্যায় দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে বাধা দেয়। এতে সমর্থ না হ’লে কথা দিয়ে, এটিতেও সক্ষম না হ’লে অন্তর দিয়ে সেটিকে ঘৃণা করবে। আর এটা হ’ল দুর্বল ঈমান’।[22] ইমাম নববী বলেন, অন্যায় কাজে বাধা দেওয়াটা ঈমানের একটি শাখা।[24]
ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি সম্পর্কে সালাফে ছালেহীনের বক্তব্য :
* ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তাঁর সাথীদের বলতেন, هلموا نزداد إيمانا، ‘এসো আমরা আমাদের ঈমান বৃদ্ধি করি’।[25]
* আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) দো‘আতে বলতেন, اللهم زدني إيمانا ويقينا ‘হে আল্লাহ! আমার ঈমান ও প্রত্যয় বৃদ্ধি করে দাও’।[26]
* মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) তাঁর সাথীকে বলতেন, اجْلِسْ بِنَا نُؤْمِنُ سَاعَةً، يَعْنِي نَذْكُرُ اللهَ. ‘আমাদের সাথে বস, আমরা আল্লাহর প্রতি কিছুক্ষণ ঈমান আনি। অর্থাৎ আল্লাহকে স্মরণ করি।[27]
* আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, الإيمان يَزِيدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান বাড়ে এবং কমে’।[28]
* ওমাইর বিন হাবীব আল-খাতামী (রাঃ) বলেন, الْإِيمَان يَزِيدُ وَيَنْقُصُ. قِيلَ: وَمَا زِيَادَتُهُ وَنُقْصَانُهُ؟ قَالَ : إِذَا ذَكَرْنَا اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَحَمِدْنَاهُ وَسَبَّحْنَاهُ فَذَلِكَ زِيَادَتُهُ وَإِذَا غَفَلْنَا وَضَيَّعْنَا وَنَسِينَا. فَذَلِكَ نُقْصَانه. ‘ঈমান বাড়ে ও কমে। বলা হ’ল, তার কিভাবে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে? তিনি বললেন, আমরা যখন আল্লাহর যিকর করি, তাঁর প্রশংসা করি, তাসবীহ (তাহলীল) পাঠ করি, তখন সেটি বাড়ে। আর যখন আমরা অলসতা করি, যিকর থেকে গাফেল হই, ভুলে যাই তখন সেটি কমে’।[29]
* ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) আদী ইবনু আদী (রহঃ)-এর নিকট এক পত্রে লিখেছিলেন, ঈমানের কতকগুলো হুকুম-আহকাম, বিধি-নিষেধ ফরয এবং কতকগুলো সুন্নাত রয়েছে। যে এগুলো পরিপূর্ণ রূপে আদায় করে তার ঈমান পূর্ণ হয়। আর যে এগুলো পূর্ণভাবে আদায় করে না, তার ঈমান অপূর্ণাঙ্গ হয়।[30]
* আব্দুর রহমান বিন ওমর আল-আওযাঈ (রহঃ) বলেন, الإِيمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ فَمَنْ زَعَمَ أَنَّ الإيْمَانَ يَزِيْدُ وَلاَ يَنْقُصُ فَاحْذَرُوْهُ فَأِنَّهُ مُبْتَدِعٌ ‘ঈমান হ’ল কথা ও কর্ম দ্বারা বাস্তবায়ন করা। সেটি বাড়ে ও কমে। যে ধারণা করে যে ঈমান শুধু বাড়ে, কমে না, তার থেকে তোমরা সতর্ক থাকো। কেননা সে বিদ‘আতী’।[31]
আওযাঈ (রহঃ)-কে ঈমান বাড়ে কি-না এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,نعم حتى يكون كالجبال، قيل فينقص؟ قال نعم، حتى يبقى منه شيئ- ‘হ্যাঁ বাড়ে, এমনকি সেটি পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করা হ’ল, অতঃপর সেটি কি কমে? তিনি বললেন, হ্যাঁ! এমনকি তার যৎসামান্যই অবশিষ্ট থাকে’।[32]
* সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, الإيمان يزيد وينقص ‘ঈমান বাড়ে ও কমে’।[33]
* আব্দুর রায্যাক শায়বানী বলেন, আমি মা‘মার, সুফয়ান ছাওরী, মালেক বিন আনাস, ইবনে জুরাইজ এবং সুফয়ান বিন উয়াইনা থেকে শুনেছি সবাই বলেন, الإِيمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান হ’ল কথা ও কর্ম দ্বারা বাস্তবায়ন করা। সেটি বাড়ে ও কমে’।[34]
* ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, الإِيمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ ‘ঈমান হ’ল কথা ও কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা, সেটি বাড়ে ও কমে’।[35]
* ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন,الإيمان بعضه أفضل من بعض وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ وزيادته في العمل ونقصانه في ترك العمل ‘ঈমানের কিছু অংশ কিছু অংশ থেকে উত্তম। সেটি বাড়ে ও কমে। আমলের মাধ্যমে তা বৃদ্ধি হয় এবং আমল ছেড়ে দিলে তা হ্রাস প্রায়।[36] তিনি আরো বলেন, الإِيمَانُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ إذا عملت الخير زاد وإذا ضعت نقص- ‘ঈমান হ’ল কথা ও কর্মের সমন্বয়। সেটি বাড়ে ও কমে। যখন তুমি ভালো আমল করবে তখন তা বৃদ্ধি পাবে এবং নষ্ট করলে (খারাপ আমল দ্বারা) কমে যাবে।[37] পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ এবং সালাফে ছালেহীনের কথা থেকে বুঝা যায়, ভাল কাজ করলে ঈমান বাড়ে এবং পাপ কাজ করলে কমে। এমনকি কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
মানুষের মাঝে একে অপরের তুলনায় ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয় :
১. যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনল, কিন্তু আমল করল না। অপর ব্যক্তি ঈমান আনল এবং শরী‘আত মুতাবেক আমল করল। এদের মাঝে ঈমানের কম-বেশি পরিলক্ষিত হয়।
২. যে ব্যক্তি শরী‘আতের জ্ঞান অর্জন করল এবং সে অনুযায়ী আমল করল। আর যে ব্যক্তি শরী‘আতের জ্ঞান অর্জন করল, কিন্তু সে অনুযায়ী আমল করল না। এদের মাঝে ঈমানে কম- বেশি পরিলক্ষিত হয়।
৩. যে বিশ্বাস ব্যক্তির অন্তরের আমলকে আবশ্যক করে সেটি তার থেকে পূর্ণাঙ্গ, যার অন্তরের আমল করাটা অবশ্যক করে না। দু’জন ব্যক্তিকে জ্ঞান দেয়া হ’ল, আল্লাহ সত্য, তাঁর রাসূলগণ সত্য, জান্নাত-জাহান্নাম সত্য, এদের একজন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসল, জান্নাত পাওয়ার আশায় আমল করল, জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিকট মুক্তি চাইল। কিন্তু অপরজন তা করল না। অতি সহজেই এ দু’জনের ঈমানের কম-বেশি বুঝা যায়।
৪. অন্তরের আমল যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, ভয়-ভীতি, আশা-ভরসা, এরূপ বিষয়ে একে অপরের মাঝে কম-বেশী লক্ষ্য করা যায়। মানুষের মাঝে ভালবাসার ক্ষেত্রেও কম-বেশী দেখা যায়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللهِ أَندَاداً يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللهِ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَشَدُّ حُبًّا لِّلّهِ ‘আর মানবমন্ডলীর মধ্যে এরূপ কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর মোকাবেলায় অপরকে সমকক্ষ স্থির করে, আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তারা তাদেরকে ভালবাসে এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তর’ (বাক্বারাহ ২/১৬৫)।
ঈমানের পূর্ণতার ব্যাপারে অনেক হাদীছ এসেছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
(1) عَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ مَنْ كَانَ اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَمَنْ أَحَبَّ عَبْدًا لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ، وَمَنْ يَكْرَهُ أَنْ يَعُوْدَ فِى الْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللهُ، كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُلْقَى فِى النَّارِ
১. আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিনটি গুণ যার মধ্যে বিদ্যমান, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে। (১) যার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অন্য সকল বস্ত্ত হ’তে অধিক প্রিয় (২) যে একমাত্র আল্লাহর জন্য কোন বান্দাকে ভালবাসে (৩) আল্লাহ তা‘আলা কুফর হ’তে মুক্তি প্রদানের পর যে কুফরে প্রত্যাবর্তনকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হবার মতোই অপসন্দ করে’।[38]
(2) عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ.
২. আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হব’।[39]
৩. আব্দুল্লাহ ইবনু হিশাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, كُنَّا مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ آخِذٌ بِيَدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فَقَالَ لَهُ عُمَرُ يَا رَسُولَ اللهِ لأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ كُلِّ شَىْءٍ إِلاَّ مِنْ نَفْسِى. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْكَ مِنْ نَفْسِكَ. فَقَالَ لَهُ عُمَرُ فَإِنَّهُ الآنَ وَاللهِ لأَنْتَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ نَفْسِىْ. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم الآنَ يَا عُمَرُ.
‘আমরা একবার নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তখন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর হাত ধরেছিলেন। ওমর (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার নফস ব্যতীত আপনি আমার কাছে সব কিছু অপেক্ষা অধিক প্রিয়। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, না, যাঁর হাতে আমার প্রাণ ঐ সত্তার কসম! তোমার কাছে আমি যেন তোমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় হই। তখন ওমর (রাঃ) তাঁকে বললেন, আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয়। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, এখন হে ওমর! (তুমি সত্যিকার অর্থে মুমিন হ’লে)।[40]
মানুষের ঈমানে ঐরূপ কম-বেশী পরিলক্ষিত হয়, যেমনভাবে প্রকাশ্য আমলে মানুষের মাঝে কম-বেশী দেখা যায়। জিহবার মাধ্যমে সম্পন্ন আমল যেমন, কুরআন তেলাওয়াত, যিকির, ইস্তেগফার, তাকবীর, তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদিতে কমবেশী হয়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে সম্পন্ন আমল যেমন ছালাত, হজ্জ, জিহাদ, ছাদাক্বাহ ইত্যাদি আদায়ে কম-বেশী দেখা যায়। জিহবার মাধ্যমে কৃত আমল সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللهَ ذِكْراً كَثِيْرا، وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلاً-ً ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর’ (আহযাব ৪১-৪২)। কুরআন তেলাওয়াত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَأَقَامُوا الصَّلاَةَ وَأَنفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرّاً وَعَلَانِيَةً يَرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُوْرَ ‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, ছালাত কায়েম করে, আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা হ’তে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার, যার ক্ষয় নেই’ (ফাতির ৩৫/২৯)। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى مُوسَى رضى الله عنه قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم مَثَلُ الَّذِى يَذْكُرُ رَبَّهُ وَالَّذِى لاَ يَذْكُرُ مَثَلُ الْحَىِّ وَالْمَيِّتِ.
আবু মূসা আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের যিকর করে, আর যে যিকর করে না, তাদের উপমা হ’ল জীবিত ও মৃত ব্যক্তির ন্যায়’।[41] কুরআন হাদীছ থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকির-আযকারে ব্যস্ত থাকে এবং যে থাকে না, তাদের উভয়ের মাঝে ঈমানে কম-বেশী রয়েছে।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে কৃত ইবাদত। যেমন ছালাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,حَافِظُواْ عَلَى الصَّلَوَاتِ والصَّلاَةِ الْوُسْطَى وَقُومُواْ لِلّهِ قَانِتِينَ ‘তোমরা ছালাত সমূহ ও মধ্যবর্তী ছালাতের (আছর) ব্যাপারে যত্নবান হও এবং বিনীতভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে দন্ডায়মান হও’ (বাক্বারাহ ২/২৩৮)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, قُل لِّعِبَادِيَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا يُقِيمُوا الصَّلاَةَ وَيُنْفِقُوْا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرّاً وَعَلانِيَةً مِّنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لاَّ بَيْعٌ فِيْهِ وَلاَ خِلاَلٌ ‘আমার বান্দাদের মধ্যে যারা মুমিন তাদেরকে বল ছালাত কায়েম করতে এবং আমরা তাদেরকে যা দিয়েছি তা হ’তে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করতে সেদিন আসার পূর্বে যেদিন ক্রয়-বিক্রয় ও বন্ধুত্ব থাকবে না’ (ইবরাহীম ১৪/৩১)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ، الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حَافِظُوْنَ، إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِيْنَ، فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاء ذَلِكَ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْعَادُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ، وَالَّذِيْنَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ، أُوْلَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ، الَّذِينَ يَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ-
‘অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে। যারা তাদের ছালাতে বিনীত। যারা অসার ক্রিয়াকলাপ হ’তে নিজেকে বিরত রাখে। যারা যাকাত আদায় করে। যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে হেফাযত করে। নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ব্যতীত, এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। সুতরাং কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমালংঘনকারী। আর যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। যারা নিজেদের ছালাতে যত্নবান থাকে, তারাই হবে উত্তরাধিকারী। উত্তরাধিকারী হবে (জান্নাতুল) ফিরদাউসের, যাতে তারা স্থায়ীভাবে জীবন-যাপন করবে’ (মুমিনূন ১-১১)। ছালাত ও যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে কম-বেশী পরিলক্ষিত হয়, অনুরূপভাবে আমানত রক্ষা, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদি বিষয়েও কম-বেশী দেখা যায়। অতএব বুঝা যাচ্ছে, ঈমান কমে ও বাড়ে।
৭. যারা জামা‘আতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে, ইবাদত ও যিকির-আযকারে ব্যস্ত থাকে, সকল ইবাদত কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী আদায় করে, তাদের মাঝে এবং যারা ইবাদত থেকে গাফেল থাকে তাদের মাঝে ঈমানে অনেক কম-বেশী দেখা যায়। অতএব আমাদেরকে গাফলতি থেকে দূরে থেকে ঈমানের বলে বলীয়ান হ’তে হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘আর তুমি উপদেশ দিতে থাক, নিশ্চয়ই উপদেশ মুমিনদের উপকারে আসবে’ (যারিয়াত ৫১/৫৫)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّ فِيْ ذَلِكَ لَذِكْرَى لِمَنْ كَانَ لَهُ قَلْبٌ أَوْ أَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيْدٌ ‘এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্যে যার আছে অন্তঃকরণ অথবা যে শ্রবণ করে একাগ্রচিত্তে’ (ক্বাফ ৫০/৩৭)। যারা আল্লাহর ইবাদতে মশগূল থাকে, তাঁকে ভয় করে তারাই ইহকাল ও পরকালে সফলকাম। আর যারা আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে থাকে, আল্লাহকে ভয় করে না, তারাই হতভাগ্য। মহান আল্লাহ বলেন,سَيَذَّكَّرُ مَنْ يَخْشَى، وَيَتَجَنَّبُهَا الْأَشْقَى- ‘যারা ভয় করে, তারা উপদেশ গ্রহণ করবে। আর যারা তা উপেক্ষা করবে সে নিতান্ত হতভাগ্য’ (আ‘লা ৮৭/১০-১১)।
কুরআন-সুন্নাহর উপদেশ অনুযায়ী জীবন-যাপন না করে নিজের খেয়াল-খুশি মত চললে ক্ষতিগ্রস্ত হ’তে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطاً ‘যার চিত্তকে আমরা আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে তুমি তার আনুগত্য করো না’ (কাহফ ১৮/২৮)। আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে নিজেকে ঈমানের বলে বলীয়ান করতে হবে, গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَاذْكُر رَّبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعاً وَخِيْفَةً وَدُوْنَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالآصَالِ وَلاَ تَكُنْ مِّنَ الْغَافِلِيْنَ ‘তোমার প্রতিপালককে মনে মনে বিনয়-নম্রতা ও ভয়-ভীতি সহকারে অনুচ্চৈঃস্বরে সকাল ও সন্ধ্যায় স্মরণ করবে। তুমি গাফেল ও উদাসীনদের অন্তর্ভুক্ত হবে না’ (আ‘রাফ ৭/২০৫)। অতএব যারা আল্লাহর ইবাদত ও যিকির-আযকারে লিপ্ত থাকে তাদের ঈমান বাড়ে। আর যারা তা করে না, গাফলতি করে তাদের ঈমান কমে যায়।
পরবর্তী অংশ পড়ুন: ঈমান বৃদ্ধির উপায়
– হাফেয আব্দুল মতীন
[10]. আব্দুর রহমান নাছের আস-সা‘দী, তানবীহাত লত্বীফাহ, পৃঃ ৫০; তাফসীর আস-সা‘দী, পৃঃ ৬৮৯; ইবনে কাছীর ৬/৫৬৮।
[25]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ ১১/২৬; লালকাঈ, শারহু উছুলে ইতেক্বাদে আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ ৫/১০১২, হা/১৭০০।
[26]. আব্দুল্লাহ, আস-সুন্নাহ, ১/৩৬৮, হা/৭৯৭; লালকাঈ, শারহু ইতেক্বাদ, ৫/১০১৩, হা/১৭০৪; ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, ১/৪৮, সনদ ছহীহ।
[42]. ইবনে তাইমিয়াহ,কিতাবুল ঈমান, পৃঃ ১৮০-১৮৩; ডঃ আব্দুর রাযযাক্ব আল-বদর, যিয়াদাতুল ঈমান ওয়া নুক্বছানিহি, পৃঃ ১৫৩-১৭৪।