আকাইদ

‘ঈমান’ -এর পরিচয়

ঈমান ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ঈমান ব্যতীত মানুষ তার কোন সৎ আমলের প্রতিদান পরকালে লাভ করতে পারবে না। আবার ঈমানহীন মানুষ জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে চিরকাল। তাই ঈমানকে ইসলামের মূল খুঁটি বললেও অত্যুক্তি হবে না। এ নিবন্ধে ঈমান সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-

ঈমানের আভিধানিক অর্থ : ঈমানের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, নিরাপত্তা দেওয়া, আশঙ্কা মুক্ত করা। এর বিপরীত হচ্ছে ভয়-ভীতি।[1] রাগেব আল-ইছফাহানী বলেন, ঈমানের মূল অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি এবং ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাওয়া।[2] শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ ও আমলের মাধ্যমে।[3]

ঈমানের শারঈ অর্থ : পারিভাষিক অর্থে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট ঈমান হল মূল ও শাখাসহ হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম। প্রথম দু’টি মূল ও শেষেরটি হ’ল শাখা, যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না।[4]

ঈমানের শারঈ অর্থে পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ যখনই সে পাঁচটি বিষয় তার জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখনই সে একজন ঈমানদার ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হবে, নচেৎ নয়।

(১) অন্তরের কথা অর্থাৎ অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস পোষণ করা। মহান আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ، لَهُمْ مَا يَشَاءُوْنَ عِنْدَ رَبِّهِمْ ذَلِكَ جَزَاءُ الْمُحْسِنِيْنَ-  

‘যারা সত্যসহ উপস্থিত হয়েছে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে তারাই তো মুত্তাক্বী, তারা যা চাইবে সব কিছুই আছে তাদের প্রতিপালকের নিকট। এটাই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান’ (যুমার ৩৯/৩৩-৩৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوقِنِيْنَ ‘এমনিভাবেই আমিই ইব্রাহীমকে আসমান ও যমীনের রাজত্ব অবলোকন করিয়েছি, যাতে সে বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’ (আন‘আম ৬/৭৫)

তিনি আরো বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا-   ‘তারাই প্রকৃত মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পরে আর কোন সন্দেহ পোষণ করে না’ (হুজুরাত ৪৯/১৫)

মুমিন ব্যক্তির বিশ্বাসে কোন সন্দেহের লেশমাত্র থাকে না। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি যব পরিমাণও ঈমান বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে এবং যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি গম পরিমাণও পুণ্য বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে। আর যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে’।[5] হাদীছের অর্থ এই নয় যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ে বসে থাকবে। বরং অন্তরে বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল দ্বারাই একজন মুমিন হওয়া যাবে, নচেৎ নয়। যা কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দ্বারা বুঝা যায়।

(২) মুখে উচ্চারণ অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহর মুখে স্বীকৃতি প্রদান করা, উচ্চারণ করে পড়া এবং আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। মহান আল্লাহ বলেন,

قُولُواْ آمَنَّا بِاللهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالأسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لاَ نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ-

‘তোমরা বল, আমরা ঈমান রাখি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব এবং তাদের বংশধরের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং মূসা ও ঈসা-কে যা প্রাদান করা হয়েছিল এবং অন্যান্য নবীগণকে তাদের প্রভু হ’তে যা দেয়া হয়েছিল। আমরা তাদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৩৬)

মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ قَالُوا آمَنَّا بِهِ إِنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّنَا ‘যখন তাদের নিকট এটা আবৃত্তি করা হয় তখন তারা বলে, আমরা এতে ঈমান আনি। এটা আমাদের প্রতিপালক হ’তে আগত সত্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৩)। তিনি আরো বলেন, وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ مِنْ كِتَابٍ ‘বল, আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন আমি তাতে বিশ্বাস করি’ (শূরা ৪২/১৫)। অন্যত্র তিনি বলেন, إِلَّا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ ‘তবে যারা সত্য উপলব্ধি করে সত্যের সাক্ষ্য দেয় তারা ব্যতীত’ (যুখরুফ ৪৩/৮৬)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ ‘যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ এবং এই বিশ্বাসে অবিচল থাকে, তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না’ (আহক্বাফ ৪৬/১৩)

ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষণ না তারা এ মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মা‘বূদ নেই ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল। আর ছালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হ’তে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল। অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন হক থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর অর্পিত’।[6] উপরে বর্ণিত কুরআনের আয়াত এবং হাদীছ থেকে সুস্পষ্ট হ’ল যে, ঈমান অর্থ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ ও তদনুযায়ী আমল করা। এই তিনটি বস্ত্তর সমন্বয়েই খাঁটি মুমিন হওয়া যাবে, নচেৎ নয়।

(৩) অন্তরের আমল অর্থাৎ নিয়ত করা। কারণ সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে ইখলাছ থাকা। কারণ ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করতে হবে। ভালবাসা, আনুগত্য, আশা-ভরসা ইত্যাদি সবই আল্লাহর জন্য হ’তে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ  ‘আর যেসব লোক সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে তুমি দূরে ঠেলে দিও না’ (আন‘আম ৬/৫২)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদান হিসাবে নয়, বরং তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায়’ (লাইল ৯৩/১৯-২০)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَاناً وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ-

‘নিশ্চয় মুমিনরা এরূপ যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সেই আয়াত সমূহ তাদের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (আনফাল ৮/২)

আল্লাহ তা‘আলা  আরো বলেন, وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا آتَوْا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ ‘এবং যারা তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে- এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে’ (মুমিনূন ২৩/৬০)

উল্লিখিত আয়াত সমূহ থেকে এবং অন্যান্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর উপর ভরসা, ভয়-ভীতি, আশা-আকাংখা, বিনয়-নম্রতা, আল্লাহর দিকে রুজূ হওয়া ইত্যাদি অন্তরের আমল।

(৪) জিহবা বা মুখের মাধ্যমে আমল। কুরআন তেলাওয়াত, যিকর-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, তাকবীর, দো‘আ-ইস্তেগফার ইত্যাদি মুখের ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الَّذِيْنَ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّن تَبُورَ-

‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, ছালাত কায়েম করে, আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে তাদের এমন ব্যবসায়ের যার ক্ষয় নেই’ (ফাতির ৩৫/২৯)। তিনি আরো বলেন, وَاتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِن كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ  ‘তুমি তোমার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট তোমার প্রতিপালকের কিতাব আবৃত্তি কর; তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউই নেই’ (কাহফ ১৮/২৭)

অন্যত্র তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللهَ ذِكْراً كَثِيراً، وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلاً- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর’ (আহযাব ৩৩/৪১-৪২)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَاسْتَغْفِرُوا اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ‘তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (মুয্যাম্মিল ৭৩/২০)

এসব দলীল এবং অন্যান্য আরো দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুখের মাধ্যমে উচ্চারণ করে বা পড়ে যেসব আমল করা হয় তা সবই মৌখিক ইবাদতের মধ্যে শামিল হবে।

(৫) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করা। রুকূ-সিজদা আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা, মসজিদের দিকে ছালাতের জন্য রওয়ানা হওয়া, হজ্জ আদায় করা, ছিয়াম পালন করা, আল্লাহর দ্বীন সমুন্নত করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ইত্যাদি যত প্রকার আমল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা করা হয় সবই এর মধ্যে শামিল হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বিনীতভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে (ছালাতে) দন্ডায়মান হও’ (বাক্বারাহ ২/২৩৮)

মহান আল্লাহ আরো বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ، وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ-  

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা রুকূ কর, সিজদা কর, তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর ও সৎকর্ম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। আর আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত’ (হজ্জ ২২/৭৭-৭৮)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْناً وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَقِيَاماً-

‘আর রহমানের বান্দা তারাই যারা (আল্লাহর) যমীনে বিনীতভাবে চলাফেরা করে এবং যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সম্বোধন করে তখন তারা বলে সালাম (শান্তি)। আর তারা রাত্রি অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদারত অবস্থায় ও দন্ডায়মান হয়ে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩-৬৪)। এ সম্পর্কে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আরো অনেক দলীল বর্ণিত হয়েছে।[7]

ইমাম মুহাম্মাদ হুসাইন আল-আজুর্রী বলেন, ঈমান হচ্ছে অন্তরের বিশ্বাস, মুখের স্বীকৃতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করা। সুতরাং যার মধ্যে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে সে প্রকৃত ঈমানদার। এরপর তিনি বলেন, জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের ও আমাদের উপর রহম করুন! মুসলমানদের আলেমগণ যে কথার উপর অটল আছেন সেটা হ’ল, ঈমানের (অর্থ হচ্ছে) অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল করা সকল সৃষ্টির উপর ওয়াজিব। অতঃপর তিনি বলেন, জেনে রেখ, অন্তরের বিশ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না তার সাথে মুখের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তরের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকৃতি পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করবে। সুতরাং যার মধ্যে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান সেই প্রকৃত ঈমানদার হ’তে পারবে। আর এর উপরেই কুরআন ও হাদীছের দলীল এবং মুসলমান আলেমদের কথা প্রমাণিত রয়েছে।[8]

মোদ্দাকথা আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব সমূহের প্রতি, নবী-রাসূলদের প্রতি, পরকালের প্রতি, তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনতে হবে।

ভ্রান্ত ফিরকাসমূহের দৃষ্টিতে ঈমান :

খারেজীগণ তিনটি বিষয়কেই (অর্থাৎ হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়ন) ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। সেকারণে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের মতে কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী। মুরজিয়াদের বারোটি উপদলের মধ্যে কাররামিয়াগণ বিশ্বাস ও আমল ছাড়াই কেবল মুখের ‘স্বীকৃতি’ ঈমানের জন্য যথেষ্ট মনে করেন। সাধারণ মুরজিয়াগণ ‘বিশ্বাস ও স্বীকৃতি’কে ঈমান বলে থাকেন।[9] ইমাম আবু হানীফা ও কিছু সংখ্যক ফক্বীহ ‘আমল’কে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেননি; বরং ‘ঈমানের বাস্তব পদ্ধতি’ (شرائع الإيمان) বলে মনে করেন।[10]

পরবর্তী অংশ পড়ুন: ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি

– হাফেয আব্দুল মতীন


[1]. জাওহারী, আছ-ছিহাহ ৫/২০৭১; ফিরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত, পৃঃ ১১৭৬।

[2]. আল-মুফরাদাত, পৃঃ ৩৫।

[3]. আছ-ছারেম আল-মাসলূল, পৃঃ ৫১৯।

[4]. ইবনু মান্দাহ, কিতাবুল ঈমান ১/৩৩১; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৯৭।

[5]. বুখারী হা/৪৪।

[6]. বুখারী হা/২৫; মুসলিম হা/২২।

[7]. দ্রঃ হাফেয আল-হাকামী, মা‘আরিজুল কুবূল (দার ইবনুল জাওযী, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬হিঃ), ২/৭৩৫-৭৪০; আব্দুর রাযযাক আল-বদর, যিয়াদাতুল ঈমান ওয়া নুক্বছানিহি (দার কুনূয ইশবীলিয়া, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৭ হিঃ), পৃঃ ৩৭-৪০।

[8]. আশ-শারী‘আহ, পৃঃ ১১৯, তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ হামেদ ফেকী; লালকাঈ, শারহু ই‘তিকাদি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ ২/৯১১, তাহক্বীক্ব : ড. আহমাদ বিন সাঈদ গামিদী, ৮ম সংস্করণ, ১৪২৪ হিঃ।

[9]. ইবনু মানদাহ, কিতাবুল ঈমান, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৩৮-৩৩৯।

[10]. আহলে হাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৯৭।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button