সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতন : কারণ ও প্রতিকার

দুনিয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত অফুরন্ত নে‘মতরাজির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যৌবনের শক্তিমত্তা। মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারার তিনটি স্তর শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য। এর মধ্যে যৌবনকাল শ্রেষ্ঠ। অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার যুবসমাজই দেশ ও জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার। তারা দেশ ও জাতির সম্পদ। শত ঝড়-ঝাপটা ও বাতিলের কালো থাবা উপেক্ষা করে তারাই পারে সত্য, ন্যায় ও অহি-র বিধান প্রতিষ্ঠায় বীর বিক্রমে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। যুবসমাজই পারে পরিবার, সমাজ ও দেশকে কুসংস্কার মুক্ত করে অহি-র সোনালী সমাজ কায়েম করতে।

সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি আদর্শবান যুবসমাজ দ্বারাই পৃথিবী উপকৃত হয়েছে। বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) জান্নাত পিয়াসী তাক্বওয়াশীল যুবসমাজ নিয়েই বদর, ওহুদ, খন্দক, তাবূক সহ অন্যান্য যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছেন। তাই যৌবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাকে তিনি গণীমত হিসাবে উল্লেখ করে তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে তাকীদ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, اِغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ ‘পাঁচটি বস্ত্তর পূর্বে পাঁচটি বস্ত্তকে গণীমত মনে কর। যথা- (১) তোমার বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে (২) পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে (৩) দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে (৫) মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে’।[1]

আবার পথভ্রষ্ট ও নৈতিকভাবে অধঃপতিত যুবসমাজের দ্বারাই পৃথিবীতে সংঘটিত হয়েছে যত অপকর্ম, ধ্বংস হয়েছে বহু সভ্যতা। তাই বলা যায় যুবসমাজের অধঃপতনই জাতির অধঃপতন। এজন্য যুবসমাজের অবক্ষয় ও পতন রোধে দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। আলোচ্য প্রবন্ধে যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতনের কারণ ও প্রতিকার তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতনের কারণ

যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতনের বহুবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতিপয় কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-

১. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ঘনঘন সরকার পরিবর্তন, প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা যেমন চলছে। তেমনি অন্যদিকে চলছে হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে যুবকদের দ্বারাই নাশকতামূলক কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদরা নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতে কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে অবৈধ পথে অর্থ খরচ করে চাটুকার ও সন্ত্রাসী লাঠিয়াল বাহিনী লালন করছে। এ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে যুবসমাজ। তারা অর্থ ও ক্ষমতার লোভে বিভিন্ন অপরাধ করে চলেছে। এভাবে নষ্ট রাজনীতি যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

২. বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব : মানুষের ভিতরকার অনুশীলিত কৃষ্টির বাহ্যিক পরিশীলিত রূপকে সংস্কৃতি বলা হয়। এটা তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের আলোকে শারঈ নির্দেশনায় গড়ে উঠলে সেটাই প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতি। এর বাইরে যা কিছু আছে সবই নষ্ট ও অপসংস্কৃতি। বর্তমানে যুবসমাজের মাঝে নষ্ট সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট, যা তাদেরকে নৈতিক অধঃপতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বিজাতীয় সংস্কৃতির মধ্যে ভ্যালেন্টাইন ডে, থার্টি ফার্স্ট নাইট, নববর্ষ উদযাপন প্রভৃতি বিজাতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বেলেল্লাপনা ও বেহায়াপনার সয়লাব চলে। এসব অনুষ্ঠানে যুবক-যুবতীর উন্মাতাল নাচ-গান যুবচরিত্রকে ধ্বংস করছে।

বর্তমানে যুবসমাজকে ধ্বংসে স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট, ফেসবুক প্রভৃতি প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা অত্যধিক। পশ্চিমা জগৎ মুসলিম জাতিকে ধ্বংস করার মানসে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট ও ফেসবুকের মাধ্যমে যৌন সুড়সুড়ি বর্ধক অশ্লীল দৃশ্য, বিদেশী গান-বাজনা, নৃত্যানুষ্ঠান, নগ্ন-অর্ধনগ্ন নারীর চোখ ধাঁধানো বাহারী ছবি যুবক-যুবতীদের মধ্যে ভয়াবহ যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। ফলে দেশব্যাপী হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, এসিড নিক্ষেপ ও ধর্ষণ ন্যক্কারজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এজন্য মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দানকালে বলেছিলেন, ‘পশ্চিমা জগৎ ইন্টারনেটের মাধ্যমে অশ্লীল ও মারদাঙ্গা ছবি গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন এবং মাদক চোরাচালানের চেয়ে কম বিপদজনক নয়। তাদেরকে অবশ্যই সর্বব্যাপী ইন্টারনেটের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তথাকথিত বিশ্বসংবাদ মাধ্যমের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করতে হবে’। তিনি আরো বলেন, ‘প্রচার মাধ্যমগুলোতে শুধু বিকৃত ছবিই প্রচার করা হচ্ছে না, আমাদের উপলব্ধি ক্ষমতাও নস্যাৎ করে দেয়া হচ্ছে। অতীতে পশ্চিমা মিশনারীগুলো দর্শন প্রচারে নিয়োজিত থাকত। বর্তমানে সংবাদ মাধ্যম আমাদের কাঙ্ক্ষিত মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিচ্ছে।[2]

চিত্তবিনোদনের নামে বানানো সিনেমাগুলো অশ্লীল ছবি, নৃত্য, মারামারি ও আজগুবি কাহিনীতে ভরপুর। টিভির অশ্লীল অনুষ্ঠানগুলি একদিকে যেমন শিশু-কিশোর ও যুবকদের চরিত্র বিনষ্ট করছে, অন্যদিকে তেমনি তাদের ভবিষ্যত জীবনকে ধ্বংস করছে। সমাজ থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। তারা সিনেমার বানোয়াট কেচ্ছা-কাহিনী নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করে। এতে করে তাদের আক্বীদা নষ্ট হয় এবং লজ্জা-শরম দূর হয়ে যায়। অন্যদিকে মেধা ও বুদ্ধিমত্তা নষ্ট হয়ে যায়।[3]

বৃটেনের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, টিভির যৌন বিষয়ক প্রোগ্রাম শিশু ও যুবকদের উপরে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তার মতে টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রচারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। সাথে সাথে মা-বাবাকেও শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতীদের শাসনে রাখতে হবে যেন তারা নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে যেতে না পারে।[4]

পশ্চিমা বিশ্ব মুসলিম যুবসমাজকে ধ্বংস করার জন্য ইলেকট্রিক মিডিয়ার সাহায্যে চালাচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। এ আগ্রাসনকে শক্তিশালী করার জন্য তারা এ সবের উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে এর বেপরোয়া ব্যবহার করে চলেছে। এ প্রসঙ্গে এদেরই একজন অন্যতম সমাজ বিজ্ঞানী Michael Kunezik বলেন, Cultural imperialism through communication is a vital Process for Securing and maintaining economic domination and political hegemoni over others (Television is the Third World) অর্থাৎ ‘অর্থনৈতিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন ও তা বহাল রাখার জন্য যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া’। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ডিশ এন্টিনার সাহায্যে পাশ্চাত্যের ধর্ম বিমুখ আল্লাহদ্রোহী ইন্দ্রিয়পরায়ণ ভোগবাদী জীবনের সকল অনুসঙ্গই আজ মুসলমানদের অন্দর মহলে ঢুকে পড়েছে।[5]

৩. পত্র-পত্রিকা : যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতনের আরেকটি কারণ হ’ল পত্র-পত্রিকা। পাশ্চাত্যের খুদকুঁড়ো খাওয়া এক শ্রেণীর বেহায়া মিডিয়া কর্মী ও সাংবাদিক সংবাদ মাধ্যমে সারা পৃথিবীর নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক ও যুবক-যুবতীর প্রেমের অশ্লীল কাহিনী প্রকাশ করছে। বিনোদনের পাতা নামে নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকাদের নগ্ন, অর্ধনগ্ন ছবি এমনভাবে প্রকাশ করছে যা দেখলে যুবমনে যৌন সুড়সুঁড়ি সৃষ্টি হয়। ফলে তারা উত্তেজিত হয়ে নোংরা পথে পা বাড়ায়। এছাড়া অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ছবি সম্বলিত পত্র-পত্রিকা ও বই-পুস্তকের সয়লাব চলছে সর্বত্র। এর অশুভ প্রভাবে যুবচরিত্র বিনষ্ট হচ্ছে।

৪. পোষাক-পরিচ্ছদ ও পর্দাহীনতা : বর্তমানে যুবক ও যুবতীরা প্রগতির দোহাই দিয়ে বিধর্মীদের অনুকরণে তৈরীকৃত পোশাক পরে নগ্ন-অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুবকরা লম্বা চুল রেখে হাতে বিভিন্ন ধাতুর বালা ও সোনার চেইন পরে, পাঞ্জাবী শার্টের বোতাম খুলে, হাতে সিগারেট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার মেয়েরা জিনসের স্কিন টাইট প্যান্ট-শার্ট পরছে। কেউ কেউ মশারীর মত পাতলা পোশাক পরে চলাফেরা করছে। এতে তাদের দেহের উঁচু-নিচু স্থান যুবকদের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। আবার অনেক যুবতী মেয়ে শর্টকাট পোশাক পরে সাইকেল, হোন্ডা চালাচ্ছে। এসব বেহায়াপনা যুবকদেরকে পথভ্রষ্ট করছে।

৫. নেশার দ্রব্য : বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তামাকজাত পণ্য ও মাদকদ্রব্য। যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের তরুণ-তরুণীদের জীবন; ধ্বসিয়ে দিচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল। সেই সাথে মাদক ব্যবসা বর্তমান বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় চোরাকারবারীরা এই ব্যবসার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে। তাছাড়া ভৌগলিক অবস্থান এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক রুট। অধিকন্তু পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে এদেশের উঠতি বয়সের তরুণদের ধ্বংস করার জন্য তাদের সীমান্তে অসংখ্য হেরোইন ও ফেনসিডিল কারখানা স্থাপন করেছে এবং সেখানকার উৎপাদিত সব মাদকদ্রব্য এদেশে ব্যাপকভাবে পাচার করছে উভয় দেশের চোরাকারবারী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এছাড়া স্থল, নৌ ও বিমান পথের কমপক্ষে ৩০টি রুট দিয়ে এ দেশে মাদক আমদানী ও রফতানী হচ্ছে।[6] নেশাকর দ্রব্য দেশের যুবসমাজকে সবদিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় নিকোটিন সহ ৪০০০-এর মত রাসায়নিক ও বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে। এজন্য নিকোটিনকে ‘খুনি’ বলা হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, শতকরা ৯৮ জন মাদকাসক্ত ধূমপানের মাধ্যমে নেশার জগতে প্রবেশ করে। যুবসমাজ বন্ধু-বান্ধবদের দ্বারা, কেউ শখের বসে আবার কেউ হতাশায় ভুগে ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়ে। এই ধূমপানের একশ’ ভাগই ক্ষতিকর। ধূমপান এমন এক জিনিস যা ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটায় না এবং পুষ্টিও যোগায় না; অথচ এগুলো বর্তমান যুবসমাজের নিকট আধুনিকতার প্রতীক। এগুলোর মাধ্যমে যুবসমাজ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নেশাকর দ্রব্যের মাধ্যমে যুবশক্তির শরীর ভাঙ্গছে, ঘরও ভাঙ্গছে। এজন্য বলা হয়, Alchohol is the most important cause of broken bones and of broken homes. অর্থাৎ সুরা এমন এক বস্ত্ত, যা হাড় ভাঙ্গে এবং ঘরও ভাঙ্গে। কারণ রাতভর নেশা করে নেশাসক্ত নিঃশেষ হয়ে ঘরে ফেরে। ওদিকে তার প্রিয়তমা স্ত্রী তার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। দিনের পর দিন এর পুনরাবৃত্তির ফলে সৃষ্টি হয় সন্দেহ-সংশয়। সংসারে শুরু হয় অশান্তি। সংসার জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। যার শেষ পরিণতি হয় বিচ্ছেদ।

৬. সঙ্গদোষ : কথায় বলে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ব্যক্তি জীবনে বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীর প্রভাব যুব সমাজের নৈতিক উন্নতি ও অবনতির ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বন্ধু ও সঙ্গীদের খপ্পরে পড়ে সহজ-সরল বন্ধুটি প্রথমে একটু একটু করে ধূমপান ও মদের স্বাদ আস্বাদন করতে করতে অবশেষে বদ্ধ মাতালে পরিণত হয়। বন্ধু-বান্ধবদের পাল্লায় পড়ে সে যাত্রাগান, টিভি, সিনেমা দেখা, আড্ডা দেওয়া এমনকি যেনা-ব্যভিচারেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাই সৎ বন্ধুদের আর সত্যবাদী সাথীদের সাথে থাকার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُواْ مَعَ الصَّادِقِيْنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)

৮. ত্রুটিযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা : যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতনের জন্য দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকাংশে দায়ী। শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক চরিত্র গঠন, ঈমান, আক্বীদা, আমল সংশোধন এবং আখিরাত, মৃত্যু, কবর ও জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কে সতর্ক করার পদক্ষেপ নেই। আবার এ শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে ধর্মহীন। অথচ যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতনের প্রধানতম কারণ হ’ল সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাব। এ বিষয়ে Stanly Hall বলেন, If you teach your children three Rs (Reading, Writing and Arithmetics) and leave the fourth ‘R’ (Religion) you will get fifth ‘R’ Rascale. ‘যদি আপনি আপনার সন্তানকে তিনটি ‘R’ শিক্ষা দেন, (পড়া, লিখা, অঙ্ক) এবং চতুর্থ ‘R’ টি (ধর্ম) বাদ দেন তাহ’লে আপনি পাবেন পঞ্চম ‘R’ (বদমাশ)।

এছাড়া মাদরাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা নামে দেশে প্রচলিত দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা ১৯৩৬ সালে বৃটিশ সরকার লর্ড মেকলের চালুকৃত। ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ পলিসির অনুকূলে তাদের গৃহীত উক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে তারা মুসলিম উম্মাহর শিক্ষিত শ্রেণীকে দু’টি ধারায় বিভক্ত করতে চেয়েছিল। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদেরকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নাইট-নবাব, খান-বাহাদুর ইত্যাদি লকব এবং সরকারী চাকুরী ও সুযোগ-সুবিধার জালে আটকিয়ে ফেলে ইংরেজ বিরোধী জিহাদ ও স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। অন্যদিকে মাদরাসা শিক্ষিতদের সুযোগ বঞ্চিত করে মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষা বিমুখ করতে তারা ছিল তৎপর। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের বিগত সরকারগুলি বিভিন্ন সময়ে যেসব কমিটি গঠন করেছেন, সেখানে দেখা গেছে সবারই মূল টার্গেট ছিল ইসলামী শিক্ষাকে সংকুচিত করা। ফলে ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে এ জাতি নৈতিকভাবে অধঃপতিত দুর্নীতিগ্রস্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে।

শতকরা ৫০ ভাগ মুসলিম প্রধান দেশ মালয়েশিয়ায় শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক। ফলে মালয়েশিয়া আজ সর্বক্ষেত্রে উন্নত। অথচ শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা সবচেয়ে অবহেলিত। ফলে আমরা আজ সর্বক্ষেত্রে অধঃপতিত।[7]

যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতনের বর্তমানে আরেকটি বড় হাতিয়ার হ’ল সহশিক্ষা। এর ফলে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা অবাধে মেলা-মেশার সুযোগ পাচ্ছে। এই অবাধ মেলামেশার সুযোগে তাদের চরিত্র ধ্বংস হচ্ছে, জড়িয়ে পড়ছে ব্যভিচারে।

শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মূল স্তম্ভ হ’ল তিনটি; শিক্ষক, ছাত্র ও পরিচালনা কমিটি। দলীয় রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলে এই তিনটি ক্ষেত্রই আজ ক্লেদাক্ত হয়ে গেছে। সর্বক্ষেত্রে দলীয় দিকই এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আগে শিক্ষকগণ ছিলেন সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। এখন তারা নিজ দলীয় ছাত্রদের ভাই ও বন্ধুর পর্যায়ে নেমে এসেছেন। বিরোধী মতের ছাত্র ও শিক্ষকগণ প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে পরস্পরের বিরোধী হিসাবে গণ্য হন। খাতায় নম্বর দেওয়ার নিরপেক্ষতাও এখন অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না দলবাজ ছাত্র নেতাদের রক্তচক্ষুর ভয়ে। এমনকি মেডিকেল কলেজের মত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনৈতিক নম্বর দিয়ে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে বিনা মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দিতে শিক্ষকগণ বাধ্য হচ্ছেন। এরাই ডিগ্রী নিয়ে দু’দিন পরে চিকিৎসার নামে রোগী হত্যা করবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এখন আর মেধার লালনক্ষেত্র বলা যাবে না। বরং এগুলি এখন রাজনৈতিক দলবাজি এবং দল পোষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া কমিটি ব্যবস্থাপনায় রয়েছে গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গ্রুপিং।[8]

এসব কিছু যুবকদেরকে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করছে। অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদেরকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে সংকোচবোধ করছেন। কারণ শিক্ষাঙ্গন সমূহ আজ শিক্ষার পরিবর্তে অস্ত্র নির্ভর, টেন্ডার নির্ভর, ক্ষমতা নির্ভর, ভর্তি বাণিজ্য, সিট দখল, হল দখল, মাদক ও নারী নির্ভর মেধাশূন্য ছাত্র রাজনীতির করাল গ্রাসে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এর ফলে এক কালের পবিত্র শিক্ষাঙ্গন আজ রক্তের সাগরে পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়েছে লাশের কফিনে। পরিণত হয়েছে সেশন জটের কারখানায়। হত দরিদ্র, নিরীহ, মেধাবী শিক্ষার্থীরা মেধাহীন ছাত্রসংসদ ও স্বার্থান্বেষী ছাত্র রাজনীতির কবলে পড়ে জীবনের সবকিছু হারিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।[9]

৯. প্রশাসনিক দুর্বলতা : প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে যুবসমাজ নৈতিক অধঃপতনের অতলতলে নিমজ্জিত হচ্ছে। অর্থের লোভে ও ন্যায়-নীতিহীন রাজনৈতিক নেতাদের চাপে পড়ে প্রশাসন পতিতালয় অনুমোদন দিচ্ছে। মদ, জুয়া, লটারী ইত্যাদির রমরমা ব্যবস্থা চলছে প্রশাসনিক অনুমোদনের মাধ্যমে। এক শ্রেণীর যুবক অপরাধ করেও টাকার জোরে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাত করে বুক ফুলিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। ফলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এছাড়াও পুলিশের দুর্নীতি, দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব, সীমিত ক্ষমতা ও অসহায়ত্ব প্রভৃতি কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। ফলে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার নিস্ক্রিয়তা অথবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবহিত হওয়ার পরেও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অপরাধ ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। প্রশাসনের দুর্বলতা ও অবহেলার সুযোগেই সন্ত্রাসীরা তাদের আসন গেড়ে বসে।[10]

১০. সামাজিক কারণ : যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতনে সামাজিক প্রভাবও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সামাজিক রীতি-নীতির কুপ্রভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক অস্থিরতা, সুযোগ-সুবিধার অভাব ও অসম বণ্টন, প্রতারণা ইত্যাদি যুবসমাজকে ধ্বংসের পথে পা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। যুবসমাজ প্রভাবশালী মহলের প্ররোচনায় আবার কখনও প্রভাবশালী মহলের অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হয়ে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়।

১১. অর্থনৈতিক কারণ : অর্থনৈতিক দুর্দশা যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতন ত্বরান্বিত করে। সময়ের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে জীবনে হতাশা জাগে। অনেক যুবক দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রী লাভ করেও উপযুক্ত কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। সূদ, ঘুষ, দুর্নীতি, দলনীতি ইত্যাদি কারণে ন্যায় পথে জীবিকা অর্জন অনেকটা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আবার দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সম্পদের অসম বণ্টন,

অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদন ও বণ্টন বৈষম্য, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদির ফলে সমাজের এক শ্রেণীর লোক অর্থ শোষণ করে জোঁকের মত ফুলে উঠছে। আরেক শ্রেণীর মানুষ সর্বশান্ত হচ্ছে। ফলে যুবসমাজের মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১২. পারিবারিক কারণ : পিতা-মাতার কারণে অনেক যুবক-যুবতী নষ্ট হয়। অনেক পিতা-মাতা আছেন যারা নিজেরা কালেমা, ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, তাহাজ্জুদ ইত্যাদিতে খুবই যত্নবান। কিন্তু তার যুবক ছেলে-মেয়ে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলে না, তারা কোথায় রাত কাটায়, কখন বাড়ী ফেরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখন যায় আসে, সেগুলোর ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখে না। সন্তানকে ছোট অবস্থায় শাসন করতে বললে তারা বলে, বড় হ’লে ভাল হয়ে যাবে। আবার বড় হ’লে বলে, তারা আমাদের কথা মানে না, এখন তাদের সাথে পারি না ইত্যাদি। এসব পিতা-মাতার কারণে যুবক-যুবতীরা নষ্ট হয়। আবার পিতা-মাতা নেশাগ্রস্ত হ’লে স্বভাবতই সন্তানের মধ্যে তার প্রভাব পড়ে। অনুরূপভাবে বড় ভাই-বোন দুশ্চরিত্রের হ’লে তার অনুজরা অনৈতিক পথের দিকে পা বাড়ায়।

১৩. আন্তর্জাতিক কারণ : বর্তমানে কোন দেশকে ধ্বংস করার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উপায় হচ্ছে সে দেশকে কৌশলে সন্ত্রাসী বানানো বা সে দেশের উপর সন্ত্রাসী অভিযোগ আরোপ করা। এতে হিংস্র হায়েনারূপী সাম্রাজ্যবাদী চক্র সে দেশকে নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত খেলতে পারে এবং সে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সহজেই হস্তগত করতে পারে। এই চক্রান্তে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্র পার্শ্ববর্তী দেশে বা পৃথিবীর যে কোন দেশে নিজেদের কর্তৃত্ব বিস্তার করার লক্ষ্যে সে দেশের যুব সমাজকে অর্থ-সম্পদ, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, অস্ত্রসস্ত্র, বুদ্ধি পরামর্শ ইত্যাদি দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে অপরিণামদর্শী যুবসমাজ আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের খপ্পরে পড়ে ধ্বংসের পথে পা বাড়ায়।

প্রতিকার :

যুবসমাজই আগামী দিনে দেশ ও জাতির কর্ণধার। তাদের নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় হ’লে দেশ ও জাতি নিমজ্জিত হবে অধঃপতনের অতল তলে। তাই তাদের অধঃপতন প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে প্রয়োজন যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে কতিপয় প্রস্তাবনা পেশ করা হ’ল-

১. যুবকদের মধ্যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি করা :

মানুষের মধ্যে সৎ কাজের উদ্দীপক ও প্রেরণাদায়ক এবং অসৎ কাজ থেকে বাঁচার মত একটি শক্তিশালী অনুভূতির নাম হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। বর্তমানে ঘুণে ধরা যুবসমাজকে পাপাচার, মন্দকাজ ও নৈতিক অধঃপতন থেকে উত্তরণের সর্বোত্তম পথ হচ্ছে তাদের মধ্যে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীরুতা সৃষ্টি করা। যখন সে জানবে এবং বুঝবে যে, আমার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ছোট-বড় যাবতীয় কথাবার্তা ও কর্মকান্ড আল্লাহপাক দেখছেন এবং ফিরিশতাগণ তা লিপিবদ্ধ করছেন। এর জন্য একদিন অবশ্যই আমাকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। যখন সে বুঝবে যে, কবরের আযাব, হাশরের ময়দান এবং জাহান্নামের শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ, তখনই সে তার যাবতীয় উদ্যম, জোশ, বল-শক্তি, উদ্দীপনা ও চিন্তা-চেতনাকে সুসংহত রাখবে এবং অসৎ পথে ব্যবহার থেকে দূরে থাকবে। যা দুনিয়াবী কোন আইনের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি তারা ভুল করে কোন অন্যায় পথে পা বাড়ায় তাহ’লে তাক্বওয়ার বলেই তওবা করে নিজের পাপ কাজ অকপটে স্বীকার করে দুনিয়াবী যেকোন শাস্তিকে হাসিমুখে বরণ করে নেবে। এর বাস্তব প্রমাণ আমরা দেখতে পাই ছাহাবীদের জীবনে। যুবক মা‘ইয বিন মালিক (রাঃ) যেনা করার পর পরকালীন শাস্তির ভয়ে তওবা করে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট নিজের অপরাধ স্বীকার করে। অতঃপর তাকে রজম করা হয়। একইভাবে আযদ বংশের গামেদী গোত্রীয় এক যুবতী মহিলা তাক্বওয়ার বলে বলীয়ান হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে নিজের যেনার অপরাধ স্বীকার করে। অতঃপর তাকেও রজম করা হয়।[11] কোন সে আদর্শ ও শক্তি! যা ছাহাবীদেরকে নিজের অপরাধ স্বীকার করে দুনিয়াবী সর্বোচ্চ শাস্তি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল? এর জবাবে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ইসলামী আদর্শ ও তাক্বওয়া। তাই যুবসমাজের মাঝে তাক্বওয়ার করতে পারলে ইনশাআল্লাহ তারা তাদের নীতি-নৈতিকতা ধূলায় ধূসরিত হতে দিবে না। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوْتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُم مُّسْلِمُوْنَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করো এবং প্রকৃত মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না’ (আলে ইমরান ৩/১০২)

২. শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো :

মহান আল্লাহ বলেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (‘আলাক ১)। এর মাধ্যমে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য যে, নৈতিক ও বৈষয়িক জ্ঞানের সমন্বয়ে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থাই হ’ল পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা। মানবীয় জ্ঞানের সাথে যদি অহি-র জ্ঞানের আলো না থাকে, তাহ’লে যে কোন সময় মানুষ পথভ্রষ্ট হবে এবং বস্ত্তগত উন্নতি তার জন্য ধ্বংসের কারণ হবে। বিগত যুগে কওমে নূহ, আদ, ছামূদ, শো‘আয়েব এবং ফেরাঊন ও তার কওমের পরিণতি, আধুনিক যুগে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং সাম্প্রতিককালের বসনিয়া, সোমালিয়া, কসোভো এবং সর্বশেষ ইরাক ও আফগানিস্তান ট্রাজেডী এসবের বাস্তব প্রমাণ বহন করে।[12]

যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতন প্রতিরোধে তাওহীদ ও রিসালাতের ভিত্তিতে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশে প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বিমুখী ধারাকে সমন্বিত করে একক ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সেই সাথে নিম্নোক্ত কাজগুলো করা দরকার।

ক. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দলাদলি মুক্ত রাখা :

বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নোংরা রাজনীতি ও দলাদলির নামে মারামারি, কাটাকাটি ও বিভিন্ন অশ্লীল কর্মকান্ড ঘটে থাকে। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহকে সর্বপ্রকারের দলাদলি মুক্ত রাখতে হবে। এছাড়া মুসলমানদের ঈমান, আক্বীদা, আমল-আখলাক বিনষ্টকারী যাবতীয় প্রকার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহকে মুক্ত রাখতে হবে। সেখানে বয়স, যোগ্যতা ও মেধাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।

খ. সহ-শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করা :

আল্লাহ তা‘আলা নারী-পুরুষকে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণীয় করে সৃষ্টি করেছেন। তাই ছেলে-মেয়ে ও যুবক-যুবতীদের একই প্রতিষ্ঠানে পাশাপাশি বসে লেখাপড়া করার কারণে তারা অবাধ মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে। এতে তাদের চরিত্র নষ্ট হচ্ছে। তাই যুবসমাজকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষায় সহ-শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ অসম্ভব হ’লে একই প্রতিষ্ঠানে পৃথক শিফটিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।

৩. পৃথক কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা :

বর্তমানে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ একই সাথে কাজ করে। এই ধারা বাতিল করে নারী-পুরুষের জন্য পৃথক কর্মক্ষেত্র ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সকলে মানসিক চাপমুক্ত পরিবেশে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।

৪. বেকারত্ব দূর করা :

কথায় বলে ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। যুবসমাজ বেকার থাকলে তারা বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়বে। তাই তাদেরকে বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ, যোগ্য ও কর্মঠ করে গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা :

যুবসমাজকে নৈতিক অধঃপতন থেকে ফিরিয়ে আনতে হ’লে বিচার বিভাগকে সরকারের যাবতীয় হস্তক্ষেপ, প্রভাব ও চাপ থেকে মুক্ত এবং স্বাধীন রাখতে হবে। সাথে সাথে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ইসলামী আইন মুতাবিক নির্ভয়ে, নিঃশঙ্কচিত্তে বিচারের রায় প্রদান ও তা কার্যকর করতে হবে। তাহ’লে দুষ্ট চরিত্রের যুবক-যুবতীরা শাস্তির ভয়ে পাপের পথ থেকে ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ। মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর যুগে মাখযূম গোত্রের এক মহিলা চুরি করলে তার গোত্রের লোকজন তার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট সুপারিশ করার জন্য উসামা বিন যায়েদ (রাঃ)-এর কাছে আসে। উসামা (রাঃ) এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে আলোচনা করলে তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলেন,

فَإِنَّمَا أَهْلَكَ النَّاسَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوْا إِذَا سَرَقَ فِيْهِمُ الشَّرِيْفُ تَرَكُوْهُ، وَإِذَا سَرَقَ فِيْهِمِ الضَّعِيْفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ، وَالَّذِىْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا-

‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা এ কারণে ধ্বংস হয়েছে যে, যখন তাদের মধ্যে উচ্চ শ্রেণীর কেউ চুরি করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং যখন দুর্বল কেউ চুরি করত তখন তার উপর নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করত। যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করত, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম’।[13]

৬. পরকালীন চেতনা ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি :

যুবকদের মধ্যে পরকালীন জীবনের স্থায়ীত্ব ও জবাবদিহিতা সম্পর্কে চেতনা জাগ্রত করতে হবে। কেননা পার্থিব জগতের ক্ষণস্থায়ী জীবনের পর রয়েছে চিরস্থায়ী ও অনন্ত জীবন। সে জীবনের তুলনায় এ জীবন অত্যন্ত তুচ্ছ ও নগণ্য। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ ‘এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া কৌতুক বৈ কিছুই নয়। পরকালের জীবনই প্রকৃত জীবন। যদি তারা জানত’ (আনকাবূত ২৯/৬৪)। তিনি আরো বলেন, كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوْا إِلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا ‘যেদিন তারা একে (ক্বিয়ামতকে) দেখবে, সেদিন (তাদের) মনে হবে যেন তারা দুনিয়াতে এক সন্ধ্যা অথবা এক সকাল অবস্থান করেছে’ (নাযি‘আত ৭৯/৪৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَاللهِ مَا الدُّنْيَا فِى الآخِرَةِ إِلاَّ مِثْلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ فِى الْيَمِّ فَلْيَنْظُرْ بِمَ يَرْجِعُ  ‘আল্লাহর কসম! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার উদাহরণ হ’ল, তোমাদের কেউ মহাসাগরের মধ্যে নিজের একটি অঙ্গুলি ডুবিয়ে দিয়ে লক্ষ্য করে দেখুক তা কি (পরিমাণ পানি) নিয়ে আসল’।[14]

জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি মৃত কানকাটা বকরীর বাচ্চার নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আছে যে, একে এক দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করতে পসন্দ করবে? ছাহাবীগণ বললেন, আমরা তো একে কোন কিছুর বিনিময়েই ক্রয় করতে পসন্দ করব না। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এটা তোমাদের কাছে যতটুকু নিকৃষ্ট আল্লাহর কাছে দুনিয়া এর চেয়েও নিকৃষ্ট’।[15]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এভাবে মানুষকে পরকালীন চেতনায় উজ্জীবিত করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নৈতিক  মূল্যবোধ সৃষ্টি করেন। আমাদেরও তাঁরই দেখানো পথে যুবকদেরকে নৈতিক অধঃপতন থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

৭. নেশাকর দ্রব্য নিষিদ্ধকরণ :

বিভিন্ন রকমের নেশাকর দ্রব্য যুবকদেরকে নৈতিক অধঃপতনের দিকে ধাবিত করছে। তাই নেশাকর দ্রব্যাদি নিষিদ্ধ করতে হবে। এগুলো ব্যবহারকারীদের জন্য শাস্তির বিধান সরকারীভাবে কার্যকর করতে হবে। সরকারীভাবে এগুলোর উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। যুবকদের মাঝে নেশাকর দ্রব্যের অপকারিতা তুলে ধরতে হবে যাতে এর প্রতি তাদের ঘৃণা জন্মে এবং তা থেকে ফিরে আসে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ  ‘প্রত্যেক নেশাকর বস্ত্ত হারাম’।[16] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদের সাথে সম্পৃক্ত দশ ব্যক্তিকে লা‘নত করেছেন।[17] তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির জন্য ওয়াদাবদ্ধ, যে নেশাকর বস্ত্ত পান করে তাকে ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ পান করাবেন। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, সেটি কি বস্ত্ত হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, জাহান্নামীদের দেহের ঘাম অথবা দেহ নিঃসৃত রক্তপুঁজ’।[18]

আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, আমার বন্ধু মুহাম্মাদ (ছাঃ) আমাকে অছিয়ত করেছেন যে, ولاَ تَشْرِبِ الْخَمْرَ فَإِنَّهَا مِفْتَاحُ كُلِّ شَرٍّ  ‘তুমি মদ পান কর না। কেননা তা সকল অনিষ্টের মূল’।[19]

৮. সন্তানকে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দান :

সাধারণত পিতা-মাতার স্বভাব-চরিত্রের উপর সন্তানের স্বভাব-চরিত্র গড়ে উঠে। এজন্য পিতা-মাতাকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হ’তে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক সন্তান ফিৎরাতের (ইসলামী স্বভাব) উপর জন্ম গ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজক করে গড়ে তোলে’।[20] তিনি আরো বলেন, ‘পরিবারকে সংশোধন করার জন্য চাবুক এমন স্থানে রাখ যেন পরিবার তা দেখতে পায়। কারণ এটাই তাদের জন্য শিষ্টাচার’।[21] তাই পিতা-মাতার কর্তব্য সন্তানকে শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া। তাহ’লে তারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবে ইনশাআল্লাহ।

৯. উত্তম উপদেশ প্রদান :

পিতা-মাতার দায়িত্ব হ’ল তারা ছেলে-মেয়েদেরকে উত্তম উপদেশ প্রদান করবেন। সন্তানদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে তারা ইসলামী আদর্শে গড়ে উঠে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করতে সচেষ্ট হয়। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قُوْا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيْكُمْ نَاراً وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেকে এবং তোমাদের পরিবারকে সেই আগুন থেকে বাঁচাও, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর’ (তাহরীম ৬৬/৬)

সন্তানদেরকে উত্তম পথে আনার ব্যাপারে লুকমান হাকীম কর্তৃক তাঁর পুত্রের প্রতি প্রদত্ত নয়টি উপদেশ পিতা-মাতার জন্য বিশেষভাবে লক্ষণীয় (লুকমান ৩১/১৩-১৯)

১০. সুস্থ সংস্কৃতি ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা :

যুবসমাজকে নৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করতে হ’লে সুস্থ, সুন্দর চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। উপযুক্ত শরীরচর্চা, মুক্ত বায়ু সেবন, হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের জন্য কুরআন তেলাওয়াত, ইসলামী জাগরণী, কবিতা ইত্যাদি বিষয়ের উপরে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা, মানুষের প্রতি ভালবাসা, পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির প্রতি তাদের কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা। রেডিও-টিভিসহ সকল প্রচার মাধ্যমে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করা। যাবতীয় অশ্লীল বই, পত্র, সাময়িকী বন্ধ করা। সকল প্রকার বিজাতীয় সংস্কৃতি বন্ধ করে সুস্থ সংস্কৃতি চালু করা।

১১. উত্তম বন্ধু নির্বাচন :

কথায় বলে, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। যুবসমাজকে নৈতিক বলে বলীয়ান ও উন্নত করতে হ’লে সৎসঙ্গ গ্রহণ ও অসৎসঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। সৎ ও চরিত্রবান বন্ধুদের সাথে থাকলে তারাও তাদের গুণে গুণান্বিত হবে এবং কল্যাণের পথে পরিচালিত হবে। বন্ধু নির্বাচন সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘সৎসঙ্গ ও অসৎসঙ্গের দৃষ্টান্ত হচ্ছে কস্ত্তরি বিক্রেতা ও কামারের হাপরে ফুঁক দানকারীর ন্যায়। কস্ত্তরি বিক্রেতা হয়তো এমনিতেই তোমাকে কিছু দিয়ে দিবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে কিনে নিবে কিংবা তুমি তার কাছ থেকে সুঘ্রাণ অবশ্যই পাবে। আর কামারের হাপরের ফুলকি তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পুড়িয়ে দিবে অথবা তুমি তার নিকট থেকে দুর্গন্ধ অবশ্যই পাবে’।[22]

১২. ছালাতে অভ্যস্ত করানো :

মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ  ‘নিশ্চয়ই ছালাত মুমিনকে নির্লজ্জ ও অপসন্দনীয় কাজ হ’তে বিরত রাখে’ (আনকাবূত ২৯/৪৫)। পবিত্র কুরআনের সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হ’ল ছালাত। ছালাতের বিধ্বস্তি জাতির বিধ্বস্তি হিসাবে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে’ (মারিয়াম ১৯/৫৯)। জাহান্নামী ব্যক্তির লক্ষণ হ’ল ছালাত ত্যাগ করা ও প্রবৃত্তির পূজারী হওয়া। তাই যুবসমাজকে ছালাতের প্রতি মনোযোগী করতে হবে এবং নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত মসজিদে আদায়ে অভ্যস্ত করতে হবে। তারা যদি ছালাতে অভ্যস্ত হয় তবে তারা অন্যায় পথ থেকে ন্যায়ের পথে ফিরে আসবে। নিম্নোক্ত হাদীছ তার বাস্তব প্রমাণ। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি এসে বলল যে, অমুক ব্যক্তি রাতে (তাহাজ্জুদের) ছালাত পড়ে। অতঃপর সকালে চুরি করে। জবাবে  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বলেন, ‘তার রাত্রি জাগরণ সত্বর তাকে ঐ কাজ থেকে বিরত রাখবে, যা তুমি বলছ’।[23]

১৩. উপযুক্ত বয়সে বিবাহ দান :

উপযুক্ত বয়সে ছেলে-মেয়েকে বিবাহ দেওয়া পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের দায়িত্ব। এতে তাদের মন-মস্তিষ্ক বাজে চিন্তা থেকে মুক্ত থাকে এবং চরিত্র উন্নত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা তা চক্ষুকে অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। আর যে সামর্থ্য রাখে না সে যেন ছিয়াম রাখে। কেননা তা তার প্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য উপযুক্ত মাধ্যম’।[24]

১৪. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শে চরিত্র গঠন :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন উত্তম চরিত্রের মূর্ত প্রতীক। মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী’ (কলম ৬৮/৪)। তাই যুবসমাজ সহ পৃথিবীর সকল মানুষকে অবশ্যই মহানবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আদর্শে জীবন গঠন করতে হবে। তবেই সে নৈতিক অধঃপতনের পথ থেকে মুক্তি পাবে এবং উভয় জীবনে সফলতা লাভ করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চরিত্রকে নমুনা হিসাবে উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ  ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস রাখে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’ (আহযাব ৩৩/২১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে ঈমানে পরিপূর্ণ মুসলমান হচ্ছে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি’।[25]

উপসংহার :

কোন দেশের যুবসমাজ শিক্ষা-সংস্কৃতি ও নৈতিক বলে বলীয়ান হ’লে সে দেশের উন্নতি যেমন কেউ ঠেকাতে পারে না, অনুরূপভাবে কোন কারণে তাদের নৈতিক অধঃপতন ঘটলে সে দেশ ও জাতি অংকুরেই ধ্বংস হ’তে বাধ্য। আল্লাহ প্রদত্ত যৌবনের এই মহামূল্যবান সময়টাকে যুবসমাজ যদি অহি-র বিধান প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ব্যয় না করে অন্যায় পথে ব্যয় করে এবং হেলায় নষ্ট করে, তবে তার হিসাব দিতে হবে ক্বিয়ামত দিবসে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

لاَ تَزُوْلُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيْمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيْمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيْمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيْمَا عَلِمَ.

‘ক্বিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আদম সন্তান স্ব স্ব স্থান হ’তে এক কদমও নড়তে পরবে না। যথা- (১) সে তার জীবন কাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে (২) তার যৌবনকাল কোথায় ব্যয় করেছে (৩) ধন-সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে (৪) কোন পথে তা ব্যয় করেছে (৫) সে দ্বীনের কতটুকু জ্ঞানার্জন করেছে এবং অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সে আমল করেছে কি-না’।[26] তাই আসুন, আমরা যুবসমাজকে নৈতিক অধঃপতনের কবল থেকে রক্ষা করে তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনার সার্বিক চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!

– আব্দুল হালীম বিন ইলিয়াস

[1]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১৭৪, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৯৪৭, ৯/২০৫ পৃঃ।

[2]. মাসিক আত-তাহরীক ২/১২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯, পৃঃ ১৯।

[3]. মাসিক আত-তাহরীক ২/১ অক্টোবর ১৯৯৮, পৃঃ ১৩।

[4]. মাসিক আত-তাহরীক ৫/৭-৮, এপ্রিল-মে ২০০২, পৃঃ ২৯।

[5]. শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, প্রবন্ধ : পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও ইসলাম,  আত-তাহরীক ৪/৬ মার্চ ২০০১, পৃঃ ২৭, ।

[6]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, দরসে কুরআন : মদ, জুয়া, ভাগ্য নির্ধারক শর নিষিদ্ধ বস্ত্ত, আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর ২০১২, পৃঃ ৭-৮।

[7]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, প্রবন্ধ: শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস: কিছু পরামর্শ, আত-তাহরীক ৭/৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৪, পৃঃ ৩।

[8]. ঐ, পৃঃ ৫।

[9]. মোঃ আকবার হোসাইন, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ একটি অবৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আহলেহাদীছ যুবসংঘ স্মারক গ্রন্থ, ২০১৩, (রাজশাহী : বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ), পৃঃ ২০১।

[10]. ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম, প্রবন্ধ, সন্ত্রাসবাদ: কারণ ও প্রতিকার, আহলেহাদীছ যুবসংঘ স্মারক গ্রন্থ, পৃঃ ১৮৫।

[11]. মুসলিম হা/১৬৯৫-৯৬; মিশকাত হা/৩৫৬২ ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৪০৬, ৭/৯০-৯১ পৃঃ।

[12]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন, ৩০তম পারা, (রাজশাহী: হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ ২০১৩), পৃঃ ৩৭৮।  

[13]. বুখারী হা/৪৩০৪, ‘মাগাযী’ অধ্যায়, মুসলিম হা/১৬৮৮ ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়, ‘দন্ডের ব্যাপারে সুপারিশ নিষিদ্ধ’ অনুচ্ছেদ।

[14]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৫৬ রিক্বাক্ব অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৯২৯, ৯/১৯৯ পৃঃ।

[15]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৫৭, ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৯৩০, ৯/১৯৯ পৃঃ।

[16].  মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৩৯, ‘দন্ডবিধি সমূহ’ অধ্যায়।

[17].  তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৭৭৬।

[18]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৩৯।

[19]. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫৮০।

[20]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৯০, ‘ঈমান’ অধ্যায়।

[21]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৪৬।

[22]. মুক্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫০১০, ‘আদব’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর জন্য ও আল্লাহর সাথে ভালবাসা’ অনুচ্ছেদ।

[23]. আহমাদ হা/৯৭৭৭, বায়হাকী শু‘আব, মিশকাত হা/১২৩৭, ছালাত অধ্যায়-৪, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ দান’ অনুচ্ছেদ-৩৩।

[24]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩০৮০ ‘বিবাহ’ অধ্যায়।

[25]. তিরমিযী হা/১১৬২।

[26]. তিরমিযী হা/২৪১৭; মিশকাত হা/৫১৯৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৯৭০ ৯/২১৩ পৃঃ।

মন্তব্য করুন

Back to top button