সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

স্টুপিড কিউপিড অথবা ভ্যালেন্টাইনের দিবস

সত্যিকার মুসলিম আসলে কারা? যারা নিজেদের সীমাবদ্ধতা এবং সৃষ্টিকর্তার অসীম ক্ষমতা অনুভব করে নিজেদের আল্লাহর ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের অর্থ সন্তুষ্টিচিত্তে আল্লাহর পথ নির্দেশনা মেনে নেয়া যাতে উভয় জীবনেই শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করা যায়। জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম সম্পুর্ণ – এর মূলনীতিগুলো সময় কিংবা স্থানের সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল নয়, তা চিরায়ত। ইসলাম আমাদের যা দিয়েছে তা স্বয়ংসম্পুর্ণ এবং তাতে পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করবার কোন অবকাশ আমাদের নেই। তাই বিদায় হাজ্বের দিন মহান আল্লাহ নতুন কোন জীবন-দর্শন বা ইবাদাতের পদ্ধতি বা মানবরচিত বিধানের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বন্ধ করে দিলেন –

“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পুর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহকে সম্পুর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” [মায়িদাহ, ৫-৩]

ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ এতে জাগতিক ও পারলৌকিক – উভয় জীবনের মঙ্গল নিহিত আছে। আমাদের দ্বীনে এমনভাবে ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছে যেন তা কোন বিষয়কে অবহেলা না করে আবার কোন বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়িও না করে। ইসলামে মূল লক্ষ্য আত্মা কিন্তু তাই বলে দৈহিক চাহিদা উপেক্ষিত নয়। আমাদের প্রাধান্য পরকাল কিন্তু তা প্রাপ্তির মাধ্যম ইহকাল।

“আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন তার দ্বারা আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কর। আর দুনিয়া হতে তোমার অংশ ভুলো না” [কাসাস, ২৮-৭৭]

এমন একটা সময় ছিল যখন মুসলিমরা পথ দেখাত, প্রভুভক্ত কুকুরের মত অন্যদের পিছনে হাটত না। একটা সময় ছিল যখন মুসলিমরা হুকুম দিত, হুমকি শুনতনা। যে মানুষেরা ইসলামকে আকঁড়ে ধরে রাখে আল্লাহ তাদের আঁকড়ে ধরার অনুপাতে ক্ষমতা ও সম্মান দেন, যারা যতটা ইসলাম ত্যাগ করে আল্লাহ তাদের সে অনুপাতে লাঞ্চিত করেন। আজ আমরা কোন দোষে সম্মানের সেই স্থান থেকে সরে এসেছি তা রসুলুল্লাহ (সাঃ) আগেই জানিয়ে দিয়ে গেছেন, আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনায় তা এভাবে এসেছে-

“তোমরা প্রতি পদে পদে তোমাদের আগে যারা এসেছে তাদের পদক্ষেপ অনুসরণ করবে, এমনকি যদি তারা গুইসাপের গর্তেও ঢোকে তবুও তোমরা তাই করবে।” সাহাবিরা (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কথা বোঝাচ্ছেন?” রসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তারা নয়তো কারা?”

ইহুদি-খ্রিষ্টান সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদীরা সবসময়ই মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। এখনও তারা মুল্যবান সময় ও সম্পদ ব্যয় করে নানামুখী পরিকল্পনা করছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তাদের মেধা-মনন-অর্থ ব্যবহার করছে। শিক্ষা, বিনোদন, তথ্য-প্রযুক্তি, রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্র, তথা-কথিত আলোকিত মানুষ এমনকি ইসলামের লেবাসধারী হুজুর ইত্যাদি হাতিয়ারের সুকৌশল ব্যবহারে ইসলাম বিহীন “মডারেট মুসলিম” তৈরি করতে চাইছে। প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহর একটা সুন্নাত – কেউ যদি পরিশ্রম করে তবে সে অধ্যাবসায় অনুযায়ী ফল পাবেই, এদের ষড়যন্ত্র যে কতটা সফল হয়েছে তা বুঝতে গুলশানের রাস্তায় চারপাশ দেখতে দেখতে এক বিকেল হাটলেই হবে। হাঁটার কষ্ট বাচাতে চাইলে ইসলাম কেন অগ্রহণযোগ্য এ সংক্রান্ত ব্লগগুলো পড়া যেতে পারে বা ফারুকীর দু’একটা নাটকও দেখা যেতে পারে।

আমাদের সামনে ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে একটা বিশেষ দিন আসছে, ভালোবাসার নামে অনাচারের ঢেউ বয়ে যাবার দিন আসছে। আসলে শয়তানের কৌশলগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম – ভালোর সুদৃশ্য মোড়কে মন্দকে উপহার দেয়া। যে ছেলেটা ঢাবির টিএসসির বারান্দায় বসে প্রেমলীলা করছে তাকে যদি জানানো যায় যে তার বোন ফুলার রোডের ফুটপাথে বসে একই কাজ করছে তবে প্রতিক্রিয়াটা হবে দেখার মত, অথচ তার প্রেমিকাও হয়ত কারো বোন। দুঃখজনকভাবে তার নিজের অন্যায়টা তার চোখে পড়ছেনা।

ইসলামের মূলনীতি হল যে কোন কিছু করতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে ইসলামে তার অনুমোদন আছে কিনা অথবা তা নিষিদ্ধ কিনা। ভ্যালেন্টাইন’স ডে করব কিনা তার আগে তার সম্পর্কে জানতে হবে। বিভিন্ন বর্ণনার ইতিহাস থেকে নিচেরটাই আমার কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে –

পৌত্তলিক গ্রিসে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে বসন্ত উৎসব করা হতো। সে সময় সম্রাট দ্বিতীয় ক্লদিয়াস তার সৈন্যদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন নামে এক তরুণ খ্রিষ্ট ধর্ম-প্রচারক এই নিষেধ অমান্য করে গোপনে সৈন্যদের বিয়ে পড়াতে থাকে। এই ব্যাপারটা বেশিদিন গোপন থাকেনি, ভ্যালেন্টাইন ধরা পড়ে যান এবং কারারুদ্ধ হন। কারাবাসে তিনি এক কারারক্ষকের মেয়ের প্রেমে পড়েন। কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মের একটি বিকৃত নীতি যে ধর্ম যাজকেরা বিয়ে বা নারীদের সাথে কোন সম্পর্কে জড়াতে পারবেনা সেহেতু ভ্যালেন্টাইন শেষমেশ এই প্রেম অস্বীকার করেন। খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতি তার এই অনুরাগ দেখে সম্রাট তাকে একটি লোভ দেখান। তিনি প্রস্তাব দেন তিনি ভ্যালেন্টাইনকে ক্ষমা করবেন ও নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দেবেন এই শর্তে যে তাকে খ্রিষ্ট ধর্ম ত্যাগ করতে হবে। ভ্যালেন্টাইন অস্বীকৃত জানালে তাকে ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। একসময় গ্রিস খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করল। পৌত্তলিক বসন্ত উৎসবের নতুন নাম হলো ভ্যালেন্টাইনের দিবস। সাধু ভ্যালেন্টাইনের নতুন নতুন মহিমা শোনা যেতে লাগল – তিনি প্রেমের শহীদ, ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন ইত্যাদি, ইত্যাদি।

যদিও খ্রিষ্টান ধর্মে বিবাহ বহির্ভুত প্রেম এবং ক্যাথলিক ধর্ম-প্রচারকদের যে কোন ধরণের প্রেমই নিষিদ্ধ তবুও তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ভ্যালেন্টাইনের দিবস একটি উদযাপনযোগ্য দিবস কিন্তু তারপরেও এটি খ্রিষ্টানদের উৎসব, মুসলিমদের নয়। পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই দিবসের চমৎকার একটা আবেদন আছে। লাল গোলাপ, লাল পোষাক, প্রেম-বার্তা বহনকারী কার্ড, বিভিন্ন উপহার বিপণনের এমন সুব্যবস্থা ভোগবাদীদের লাল-গালিচা অভ্যর্থনা পেয়ে দিনটি হয়ে উঠলো “পবিত্র প্রেম” আর “নিখাঁদ ভালোবাসার” প্রতীক। পুঁজিবাদী প্রচারযন্ত্র যুদ্ধ-বিদীর্ণ পৃথিবী আর অপবিত্র প্রেম-খাঁদযুক্ত ভালোবাসাময় পচা সমাজগুলোতে ভালোবাসার সুবাতাস বইয়ে দেয়ার পবিত্র দায়িত্ব তুলে নিল নিঃসীম নিঃস্বার্থে। আর আমরা হতভাগা মুসলিমরা পশ্চিমাদের জাতে উঠার এমন সুযোগ পেয়ে সস্তা প্লাস্টিকের নকল ময়ুর-পাখনা খুঁজে মরলাম।

একজন মুসলিম মূলত তিনটি কারণে ভ্যালেন্টাইনের দিবস পালন করবেনা –

প্রথমত, ইসলামে নবআবিষ্কৃত যে কোন উৎসবই প্রত্যাখ্যাত। আয়িশাহ (রাঃ) বলেন যে রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, “যে দ্বীন ইসলামে নতুন কিছু প্রবর্তন করবে, তা প্রত্যাখান করা হবে।” [বুখারি ও মুসলিম] মুসলিমদের আলাহর প্রদত্ত উৎসব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে, এটা আল্লাহ ও তার রসুলকে ভালোবাসার নিদর্শন। আর আমাদের উৎসব হল ঈদ। আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে যখন রসুলুল্লাহ (সাঃ) মাদিনায় আসলেন তখন তিনি তাদের জাহিলিয়াতের দু’টি দিন উৎসব হিসেবে পালন করতে দেখেন। তিনি তখন বলেন যে, “আল্লাহ এই দু’টি দিনের পরিবর্তে তোমাদের আরো উত্তম দু’টি দিন দিয়েছেন, আর তা হলো – ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফিতর” [আহমাদ, নাসাঈ, আবু-দাউদ]

দ্বিতীয়ত, একজন মুসলিম বিবাহ বহির্ভুত কোন প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক রাখতে পারেনা। আর বিবাহিতদের ক্ষেত্রে একজন স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে বছরের একদিন ঘটা করে ভালোবাসবে, অন্যান্য দিন উদাসীন থাকবে এমনটি হতে পারেনা। রসুলুল্লাহ (সাঃ) বিভিন্ন হাদিসে উপহার, সুন্দর কথা এবং ভাল ব্যবহার দিয়ে পরষ্পরের মন জয় করতে বলেছেন এবং তা সবসময়, হঠাৎ একদিন নয়।

তৃতীয়ত, আমরা ইসলামের এই মূলনীতি সবসময় মনে রাখব যে “যে যেই সম্প্রদায়ের অনুকরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত” [ আহমদ , আবু দাউদ]

আমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বর্তমান সংষ্কৃতিকে করুণার চোখে দেখব, মুগ্ধবোধ নিয়ে নয়। আমাদের মায়া হবে কারণ তাদের প্রতিটি কার্যকলাপ তাদের সত্য থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর মোহ তাদের এমনভাবে গ্রাস করে ফেলছে যে তারা নিজেদের অস্তিত্ব ও উদ্দেশ্য নিয়ে চিন্তার অবকাশও পাচ্ছে না। কি হতভাগা এই মানুষেরা। আমরা তাদের এ অবস্থা দেখে আল্লাহর কাছে ধন্যবাদ দেব বারবার, আর বলব – “রদীতুবিল্লাহি রব্বাও ওয়া বিল ইসলামি দীনাও ওয়া বি মুহাম্মাদিন নাবিইয়া”।

আমরা আল্লাহকে প্রতিপালক হিসেবে সন্তুষ্ট, ইসলাম কে দ্বীন হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট আর মুহাম্মাদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে নাবি হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট।

আল্লাহ আমাদের ঘুমিয়ে থাকা বিবেকগুলো কে জাগিয়ে দিন।

 

– শরীফ আবু হায়াত অপু

মন্তব্য করুন

Back to top button