নৈতিকতা ও উন্নয়ন
মানুষের জৈববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির সমন্বিত ও উন্নীত রূপকে বলা হয় নৈতিকতা। নৈতিকতা ও উন্নয়ন দু’টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নৈতিকতাকে বাদ দিয়ে যদি বস্ত্তগত উন্নয়ন হয়, তাহ’লে ঐ উন্নয়ন হবে ক্ষণস্থায়ী এবং তাতে ধস নামতে বাধ্য। বর্তমান সমাজে নৈতিক অবক্ষয় যেভাবে শুরু হয়েছে, তাতে পুরা বিশ্ব সভ্যতা এখন হুমকির সম্মুখীন। পরিবার, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র-সর্বত্র নেতৃ পর্যায়ে অধঃপতন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই সাথে তৃণমূল পর্যায়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রবাদ আছে যে, ‘আলেমের পতন জগতের পতন’। একইভাবে রাষ্ট্রনেতার পতন রাষ্ট্রের পতন। উপরোক্ত কারণে বিগত যুগে পৃথিবীর ৬টি জাতি আল্লাহ্র গযবে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। সে জাতিগুলি হ’ল কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, কওমে লূত, মাদইয়ান ও কওমে ফেরাঊন। এছাড়া কওমে ইবরাহীম ও অন্যান্য জাতি একত্রে সবাই ধ্বংস না হ’লেও অধিকাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেক কওমের ধ্বংসের প্রধান কারণ ছিল মূলতঃ নেতাদের নৈতিক অধঃপতন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দো‘আর বরকতে মুসলিম উম্মাহ একত্রে ধ্বংস হবে না। তবে দেশ ও অঞ্চল ভিত্তিক গযব আমরাই ডেকে নিয়ে আসছি। আমরা যদি ভেবে থাকি যে, আমাদের পারস্পরিক হিংসা-হানাহানি ও খেস্তি-খেউড় আল্লাহ শুনতে পাচ্ছেন না বা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, তাহ’লে মারাত্মক ভুল হবে। এই ভুল করেই বিগত জাতিগুলি ধ্বংস হয়েছিল। আমরা যেন সে ভুল না করি। নোনা ধরা ইট দিয়ে গড়া কোন সৌধ যেমন টিকে থাকতে পারে না, নৈতিকতাহীন মানুষ দিয়ে তেমনি কোন জাতি টিকে থাকতে পারে না। প্রশ্ন হ’ল নৈতিকতা গড়বে কি দিয়ে?
জবাবে বলব, মানুষকে আগে নিজের সম্পর্কে জানতে হবে। সে কি আর পাঁচটি প্রাণীর মত? না তার কোন পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে? জানা আবশ্যক যে, মানুষ অন্য সকল প্রাণী থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। তার সাথে অন্য কোন প্রাণীর তুলনা হয় না। মানুষ পশু নয়, ফেরেশতাও নয়। বরং সে হাইওয়ানিয়াত ও মালাকিয়াতের সমন্বিত এক অনন্য প্রাণীসত্তা। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মতে তাকে সৃষ্টি করেছেন ও পৃথিবীকে আবাদ করার দায়িত্ব দিয়েছেন। তার জীবনের মেয়াদ পূর্বনির্ধারিত। সময় এসে গেলে এক সেকেন্ড তাকে ধরে রাখার ক্ষমতা কারু নেই। তাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্র কাছে। সেখানে গিয়ে তাকে তার সারা জীবনের হিসাব দিতে হবে। সেমতে তার জান্নাত ও জাহান্নাম নির্ধারিত হবে। আর এখানেই অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের পার্থক্য।
দুনিয়ার হিসাবকে শক্তিশালী মানুষ তোয়াক্কা করে না। আর তাই কয়েকটি পরাশক্তি মিলে সারা বিশ্বে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তাদের সংজ্ঞায়িত নীতি ও নৈতিকতার আলোকে। যদিও তা আদৌ নৈতিকতা নয়। একদল মানুষ জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে নীরব কৃচ্ছ্রতা সাধনের মাধ্যমে আত্মার উন্নয়নে ব্রতী হয়েছে। আর একদল মানুষ দু’হাতে লুটে-পুটে সবকিছু ভোগ করার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা খুঁুজে ফিরছে। অথচ জীবনহীন কৃচ্ছ্রতায় মানুষ শান্তি পায় না। তাইতো দেখা যায়, সংসারবিরাগী পোপ-পাদ্রী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজেদের দুষ্কর্ম দিয়েই নিজেদের ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। কারণ জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচার কোন অবকাশ মানুষের নেই। এটা মহান স্রষ্টারই সৃষ্টি কৌশল। অন্যদিকে দেখা যায়, বিগত যুগে জনৈক খুনী ৯৯ জনকে খুন করার পর অনুতাপের আগুনে পুড়ে পরিশুদ্ধ হবার জন্য ব্যাকুল হয়েছে। তাই কৃচ্ছ্রতাবাদ ও ভোগবাদ দু’টিই চরমপন্থী মতবাদ এবং দু’টিই মানব চরিত্রের বহির্ভূত। মানুষের প্রকৃতিতে ভোগ ও ত্যাগ দু’টিই আছে। কিন্তু তা যখন হবে নিয়ন্ত্রিত, তখনই তা হবে কল্যাণময় ও সুষম। আর এই নিয়ন্ত্রণ মানবরচিত কোন আইন দ্বারা হবে না। কেননা তাতে আসবে পুনরায় অমানবীয় বর্বরতা। যেমন বিগত দিনে এসেছিল সমাজ নেতাদের মাধ্যমে নবীগণের উপরে এবং এযুগে আসছে রাষ্ট্রনেতা, বিচারপতি ও বিশ্বসভার মাধ্যমে অগণিত নিরপরাধ বনু আদমের উপরে। ৫৫৭ জন জুরীর অধিকাংশ সক্রেটীসের মৃত্যুদন্ড অনুমোদন করেছিলেন। জাতিসংঘের অনুমোদন নিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তানে লাখ লাখ বনু আদমকে হত্যা করা হয়েছে। আজও হচ্ছে লিবিয়া ও পাকিস্তানে। ভারতের সুপ্রীম কোর্ট সমকামিতা বৈধ করেছে ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে। একইরূপ একটি বিলে অনুমোদন দিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। উজানের নদীগুলিতে বাঁধ দিয়ে আস্ত একটি নদীমাতৃক ভাটির দেশকে মরুভূমি বানিয়ে ফেলল পার্শ্ববর্তী উজানের দেশটি। সিডর দুর্গত বনু আদমকে ৫ লাখ টন চাউল সাহায্য দেবেন বলে ওয়াদা করে গেলেন পার্শ্ববর্তী দেশের বাঙ্গালী মন্ত্রী। কিন্তু দিলেন না কিছুই। এটা কোন নৈতিকতা? অথচ ঐ মানুষগুলির জন্য পরাশক্তিগুলি সহ বিশ্বের ৩৩টি রাষ্ট্রের প্রদত্ত অনুদানের চাইতে অনেক বেশী দান করলেন একাই জনৈক সঊদী মুসলিম ভাই, একান্ত গোপনে। আজও বিশ্ব তার নাম জানে না। এটা কোন নৈতিকতা? বলা হচ্ছে, শিক্ষিত জাতি গড়তে পারলেই দেশের উন্নতি হবে। যদি বলি শিক্ষিত পাশ্চাত্য বিশ্বই আজকের পৃথিবীর নববই ভাগ ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী। যদি বলি, দেশের যত অন্যায়-অনাচার, তার সিংহভাগ সাধিত হয় দেশের শিক্ষিত শ্রেণীর মাধ্যমে। বর্তমান বিশ্বের শিক্ষিত বিজ্ঞানীরা তাদের আল্লাহ প্রদত্ত মেধাকে ব্যয় করছেন মানব হত্যার পিছনে। শোনা যাচ্ছে, এটম বোমার চাইতে ছয় থেকে দশগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন নিউট্রন বোমা বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। যা কেবল জনপ্রাণীর মৃত্যু ঘটাবে। অথচ বস্ত্তগত অবকাঠামোর কোন ক্ষতি করবে না। প্রশ্ন হ’ল : এই শিক্ষিত লোকগুলির প্রধান টার্গেট এখন মানুষ হত্যা। তাই বলা যায় যে, নৈতিক মূল্যবোধহীন শিক্ষা মানুষের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে।
এক্ষণে সিদ্ধান্ত দাঁড়ালো এটাই যে, মানুষের রচিত কোন বিধানের অনুসরণ নয়, বরং নৈতিকতা অর্জনের জন্য মানুষকে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্র বিধানের অনুসরণ করতে হবে। তাঁর প্রেরিত অভ্রান্ত হেদায়াতকে নিজের বিশ্বাসে ও কর্মে নিয়ে আসতে হবে। মানুষের Intrinsic ও Extrinsic Value তথা মনোজাগতিক ও বহির্জাগতিক মূল্যবোধকে আল্লাহ্র বিধানের অনুগত করতে হবে। তাঁর সন্তুষ্টি ও পরকালে মুক্তিই মূল লক্ষ্য হ’তে হবে এবং উক্ত উদ্দেশ্যেই মানুষের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হ’তে হবে। তবেই উপ্ত হবে প্রকৃত নৈতিকতা। পরিবারে ও সমাজে আসবে স্বস্তি ও স্থিতি। সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রত্যাশী প্রত্যেক মানুষের জন্য এই একটা পথই মাত্র খোলা রয়েছে। আর এ পথই হ’ল ইসলামের পথ। এ পথে ফিরে আসার কারণেই বর্বর আরবরা হয়েছিল বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত। একজন নির্যাতিত মুসলিম নারীর ইয্যত বাঁচানোর জন্য ছুটে এসেছিল তারা অজানা অচেনা সিন্ধু ভূমিতে। তাদের উদার ব্যবহারে মুগ্ধ সিন্ধুবাসীরা সেই থেকে আজও মুসলমান। ভারত বিজেতা সম্রাট বাবর রাস্তায় খেলারত এক শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে একাই মুকাবিলা করলেন এক মত্ত হস্তীকে। ইয়ারমুকের ময়দানে মৃত্যুকাতর মুসলিম সৈনিক মুখে পানি তুলে নিয়ে ফেরত দিলেন আরেক আহত সৈনিকের জন্য। তাই বলব, মানবসেবা ও মনুষ্যত্বের মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকে, পশুত্বের মধ্যে নয়। আর মনুষ্যত্ব টিকে থাকে আল্লাহ ও আখেরাত বিশ্বাসের কারণে। উক্ত বিশ্বাস ও কর্মের আলোকে গড়ে ওঠে উন্নত নৈতিকতা। নৈতিকতার উন্নয়নের মধ্যেই জাতীয় উন্নয়ন নিহিত রয়েছে। আল্লাহ আমাদের সুপথ প্রদর্শন করুন- আমীন!!