ইহকাল-পরকাল

ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা

জন্মের মাধ্যমে জীবনের শুরু আর মৃত্যুর মাধ্যমে ইহজীবনের পরিসমাপ্তি এবং পরকালীন জীবনের যাত্রা আরম্ভ হয়। কবর বা বারযাখী জীবনের পরে মানুষ ক্বিয়ামতে পার্থিব জীবনের কর্মের হিসাব দিয়ে অনন্ত জীবনে সুখ-শান্তি কিংবা আযাব-শাস্তি  লাভ করবে। আর সেই অনন্ত জীবনের প্রবেশ দ্বার হচ্ছে ক্বিয়ামত। এটা এক ভয়াবহ বিষয়, এক কঠিনতম স্থান। ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা থেকে মানুষ যাতে সতর্ক-সাবধান হয়, এজন্য আলোচ্য নিবন্ধের অবতারণা।

ক্বিয়ামত কখন সংঘটিত হবে?

ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সংবাদ কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন। তিনি বলেন,

يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّيْ لاَ يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلاَّ هُوَ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لاَ تَأْتِيْكُمْ إِلاَّ بَغْتَةً يَسْأَلُوْنَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللهِ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُوْنَ-

‘আপনাকে লোকেরা জিজ্ঞেস করে, ক্বিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? আপনি বলে দিন, এ খবর তো আমার পালনকর্তার নিকটেই রয়েছে। তিনি তা অনাবৃত করে দেখাবেন নির্ধারিত সময়ে। আসমান ও যমীনের জন্য এটা অতি কঠিন বিষয়। তোমাদের উপর তা হঠাৎ এসে যাবে। তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, যেন আপনি তার অনুসন্ধানে লেগে আছেন। বলে দিন, এ সংবাদতো কেবল আল্লাহ্র নিকটেই রয়েছে। কিন্তু তা অধিকাংশ লোক উপলব্ধি করে না’ (আ‘রাফ ১৮৭)। ক্বিয়ামত কখন, কোন তারিখে সংঘটিত হবে তা নির্দিষ্ট করে না জানা গেলেও তা সংঘটিত হওয়ার দিন সম্পর্কে হাদীছ এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَيْرُ يَوْمٍ طَلَعَتْ فِيْهِ الشَّمْسُ يَوْمُ الْجُمُعَةِ فِيْهِ خُلِقَ آدَمُ وَفِيْهِ أُهْبِطَ وَفِيْهِ تِيْبَ عَلَيْهِ وَفِيْهِ مَاتَ وَفِيْهِ تَقُوْمُ السَّاعَةُ، وَمَا مِنْ دَابَّةٍ إِلاَّ وَهِيَ مُسِيْخَةٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ مِنْ حِيْنَ تُصْبِحُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ شَفَقًا مِنَ السَّاعَةِ إِلاَّ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ وَفِيْهِ سَاعَةٌ لَا يُصَادِفُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ يُصَلِّي يَسْأَلُ اللهَ حَاجَةً إِلاَّ أَعْطَاهُ إِيَّاهَا-

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,  ‘সূর্য উদিত হয় এমন সকল দিন অপেক্ষা জুম‘আর দিন উত্তম। এ দিনে আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনেই তাঁকে দুনিয়াতে ক সাগ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এ দিনেই তাঁর তওবা কবুল করা হয়েছে। এ দিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং এ দিনেই ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ভয়ে জুম‘আর দিন ফজর হ’তে সূর্যোদয় পর্যন্ত জ্বিন ও মানুষ ব্যতীত সকল প্রাণী চিৎকার করতে থাকে। জুম‘আর দিন এমন একটা সময় আছে, যদি কোন মুসলমান ছালাতরত অবস্থায় তার নাগাল পায় এবং আল্লাহ্র নিকট কিছু চায়, তাহ’লে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন’।

উপরের হাদীছ দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ক্বিয়ামত জুম‘আর দিনেই সংঘটিত হবে। এছাড়া ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে কিছু নিদর্শন প্রকাশিত হবে। এই সকল নিদর্শন প্রকাশিত হওয়ার পর ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। প্রখ্যাত ছাহাবী হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, ‘একদা আমরা পরস্পর ক্বিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম, এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বিষয়ে আলোচনা করছ? আমরা বললাম, ক্বিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছি। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, দশটি নিদর্শন না আসা পর্যন্ত ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না। আর তা হচ্ছে- ১. ধোঁয়া, যা পূর্ব হ’তে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত এক নাগাড়ে চল্লিশ দিন বিস্তৃত থাকবে। ২. দাজ্জাল বের হবে। ৩. চতুষ্পদ জন্তু বের হবে। ৪. পশ্চিমাকাশ হ’তে সূর্য উদিত হবে। ৫. ঈসা ইবনু মারিয়াম আকাশ হ’তে অবতরণ করবেন। ৬. ইয়া‘জূজ মা‘জূজ বের হবে। ৭. পূর্বাঞ্চলে ভূমিধস হবে। ৮. পশ্চিমাঞ্চলে ভূমিধস হবে। ৯. আরব উপদ্বীপে ভূমিধস হবে। ১০. সবশেষে ইয়ামান হ’তে এমন এক আগুন বের হবে যা মানুষকে তাড়িয়ে একটি সমবেত হওয়ার স্থানে নিয়ে যাবে। অপর এক বর্ণনায় আছে, আদন (এডেন)-এর অভ্যন্তর হ’তে আগুন বের হবে। যা মানুষকে সমবেত হওয়ার স্থানের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। অপর এক বর্ণনায় দশম লক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এমন বাতাস প্রবাহিত হবে, যে বাতাস কাফেরদেররে নিক্ষেপ করবে। আর বিশেষ করে ক্বিয়ামত তখনই সংঘটিত হবে যখন যমীনে ‘আল্লাহ, আল্লাহ বলার কোন মানুষ থাকবে না’। যখন মানুষ আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করবে না, তাঁর দাসত্ব করবে না তখনই ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। কারণ আল্লাহ্র যিকির ও ইবাদত হচ্ছে দুনিয়ার স্থায়ীত্বের প্রমাণ। আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার মধ্য থেকে নেক আমলকারী ব্যক্তি ও সৎ, ঈমানদার ব্যক্তিদের উঠিয়ে নিবেন এবং খারাপ ও নিকৃষ্ট মানুষের উপর ক্বিয়ামত সংঘটিত করবেন।

ক্বিয়ামতের সময় আসমান ও যমীনের অবস্থা :

ক্বিয়ামতের সময় আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে মহান আল্লাহ নিমিষেই সবকিছু ধ্বংস করে দিবেন। মহান আল্লাহ বলেন,  إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ- وَإِذَا النُّجُوْمُ انْكَدَرَتْ- وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ- وَإِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْ- وَإِذَا الْوُحُوْشُ حُشِرَتْ- وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ-  ‘যখন সূর্যকে গুটিয়ে ফেলা হবে। যখন তারকাগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে। যখন পর্বত সমূহকে চলমান করে দেয়া হবে। যখন দশমাসের গর্ভবতী উটনীগুলি ছেড়ে দেয়া হবে। যখন বন্য জন্তুগুলিকে চারদিক হ’তে গুটিয়ে একত্রিত করা হবে। যখন সমুদ্র সমূহে আগুন লাগিয়ে দেয়া হবে’ (তাক্বভীর ১-৬)

উপরের আয়াতগুলিতে ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়ের এক বাস্তব ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। আর সেজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَّنْظُرَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُ رَأْيُ عَيْنٍ فَلْيَقْرَأْ إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ وَإِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ وَإِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ- ‘যে ব্যক্তি স্বচক্ষে ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখতে চায় সে যেন সূরা ইনশিক্বাক্ব, তাকবভীর ও ইনফিতার তেলাওয়াত করে’।

মহান আল্লাহ বলেন, إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ- وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ- وَإِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ- وَإِذَا الْقُبُوْرُ بُعْثِرَتْ- عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ وَأَخَّرَتْ-  ‘যখন আকাশ সমূহ ফেটে যাবে, যখন তারকা সমূহ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। যখন সমুদ্রগুলি উদ্বেলিত হবে। যখন কবর সমূহকে খুলে দেয়া হবে। যখন প্রত্যেক ব্যক্তিই তার আগের ও পরের কৃতকর্ম জানতে পারবে’ (ইনফিতার ১-৫)

إِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ- وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ- وَإِذَا الْأَرْضُ مُدَّتْ- وَأَلْقَتْ مَا فِيْهَا وَتَخَلَّتْ- وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ-

‘যখন আসমান বিদীর্ণ হবে এবং নিজ প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে। আর এটাই তার যথার্থ করণীয়। যখন পৃথিবীকে সম্প্রসারিত করা হবে এবং  তার মধ্যে যা কিছু আছে সব বের করে দিয়ে শূন্য হয়ে যাবে। এভাবে সে আপন প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে। আর এটাই তার যথার্থ করণীয়’ (ইনশিক্বাক্ব ১-৫)। উক্ত সূরাগুলির আয়াতে মহান আল্লাহ ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় দৃশ্য তুলে ধরেছেন।

ক্বিয়ামতের মাঠের অবস্থা :

ক্বিয়ামতের মাঠের অবস্থা হবে অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। ক্বিয়ামতের মাঠে সবাইকে একত্রিত করা হবে (আন‘আম ২২)। সেদিন কোন বান্দাকে ছেড়ে দেওয়া হবে না (কাহাফ ৪৭)

ক্বিয়ামতের মাঠের অবস্থা সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ يُحْشَرُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا، قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ النِّسَاءُ وَالرِّجَالُ جَمِيْعًا يَنْظُرُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ، قَالَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا عَائِشَةُ اَلْأَمْرُ أَشَدُّ مِنْ أَنْ يَنْظُرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ-

আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘ক্বিয়ামতের দিন মানুষকে নগ্নপদে, নগ্নদেহে ও খাতনাবিহীন অবস্থায় সমবেত করা হবে। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! নারী-পুরুষ সকলকেই এভাবে একত্রিত করা হ’লে তো একজন আরেকজনের লজ্জাস্থানের দিকে দৃষ্টিপাত করবে? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হে আয়েশা! সে সময়টা এতই ভয়াবহ হবে যে, কেউ কারো প্রতি দৃষ্টি দেয়ার অবকাশই পাবে না’। অপর একটি হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَعْرَقُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يَذْهَبَ عَرَقُهُمْ فِي الْأَرْضِ سَبْعِيْنَ ذِرَاعًا وَيُلْجِمُهُمْ حَتَّى يَبْلُغَ آذَانَهُمْ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ ঘর্মাক্ত হয়ে পড়বে। এমনকি তাদের ঘাম যমীনের সত্তর গজ পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে। ঘাম তাদের লাগামে পরিণতি হবে। এমনকি ঘাম তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছে যাবে’। ক্বিয়ামতের দিন সূর্যকে মানুষের নিকটে নিয়ে আসা হবে। সূর্যের তাপে মানুষের গায়ের ঘাম মাটিতে ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি যারা কাফির পাপী তারা ঘামে হাবুডুবু খাবে।

ক্বিয়ামতের মাঠে জাহান্নামকে আনা হবে :

ক্বিয়ামতের মাঠে বিচারের দিনে বিশাল জাহান্নামকে ফেরেশতাগণ টেনে নিয়ে আসবেন। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُؤْتَى بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ لَهَا سَبْعُونَ أَلْفَ زِمَامٍ مَعَ كُلِّ زِمَامٍ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ يَجُرُّوْنَهَا-

আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামকে এমন অবস্থায় টেনে নিয়ে আসা হবে যে, তার সত্তর হাযার লাগাম হবে এবং প্রতিটি লাগামের সাথে সত্তর হাযার ফেরেশতা থাকবে। তাঁরা জাহান্নামকে টেনে-হিঁচড়ে বিচারের মাঠে উপস্থিত করবেন’। প্রকৃতপক্ষে ক্বিয়ামতের মাঠ হবে অত্যন্ত ভয়ানক ও কঠিন।

ক্বিয়ামতের মাঠে কাফেদের অবস্থা :

কাফেদের জন্য ক্বিয়ামতের মাঠ হবে অতীব কঠিন ও জটিল জায়গা। মহান আল্লাহ তা‘আলা কাফেদের অবস্থা সম্পর্কে ইরশাদ করেন, إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَوْ أَنَّ لَهُمْ مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيْعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لِيَفْتَدُوْا بِهِ مِنْ عَذَابِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَا تُقُبِّلَ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ- ‘নিশ্চয়ই যারা কাফের, যদি তাদের কাছে পৃথিবীর সমুদয় সম্পদ এবং তৎসহ আরও তদনুরূপ সম্পদ থাকে আর এগুলোর বিনিময় দিয়ে ক্বিয়ামতের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়, তবুও তাদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (মায়েদাহ ৩৬)

মহান আল্লাহ আরও বলেন, وَيَوْمَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ يُبْلِسُ الْمُجْرِمُوْنَ- وَلَمْ يَكُنْ لَّهُمْ مِّنْ شُرَكَائِهِمْ شُفَعَاءُ وَكَانُوْا بِشُرَكَائِهِمْ كَافِرِيْنَ- ‘যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা হতাশ হয়ে যাবে। তাদের দেবতাগুলোর মধ্যে কেউ তাদের জন্য সুপারিশ করবে না এবং তারা তাদের দেবতাকে অস্বীকার করবে’ (রূম ১২-১৩)

ক্বিয়ামতের মাঠে কাফেদের অবস্থা এতই কঠিন হবে যে, তাদেরকে আল্লাহ পায়ের দ্বারা না হাঁটিয়ে মুখের মাধ্যমে হাঁটাবেন। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا نَبِيَّ اللهِ يُحْشَرُ الْكَافِرُ عَلَى وَجْهِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ أَلَيْسَ الَّذِيْ أَمْشَاهُ عَلَى الرِّجْلَيْنِ فِي الدُّنْيَا قَادِرًا عَلَى أَنْ يُمْشِيَهُ عَلَى وَجْهِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ قَتَادَةُ بَلَى وَعِزَّةِ رَبِّنَا-

আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! ক্বিয়ামতের দিন কাফেরদেরকে কিভাবে মুখের মাধ্যমে হাঁটিয়ে একত্রিত করা হবে? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, যিনি দুনিয়াতে মানুষকে পায়ের মাধ্যমে চালাতে সক্ষম, তিনি কি ক্বিয়ামতের দিন তাকে মুখের মাধ্যমে চালাতে সক্ষম হবেন না? ক্বাতাদাহ বলেন, আমাদের রবের কসম! তিনি তা করতে সক্ষম’।১০ ক্বিয়ামতের মাঠে এ এক আশ্চর্য দৃশ্য যে কাফেররা মুখের মাধ্যমে চলাচল করবে।

ক্বিয়ামতের মাঠে মুমিনের অবস্থা :

যারা মুমিন তারা সব জায়গায় নাজাত পাবে, এমনকি ক্বিয়ামতের মাঠেও তাদের নাজাতের ব্যবস্থা করা হবে। আর যে সকল মুমিন ক্বিয়ামতের মাঠে নাজাত পাবে তাদের সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمْ اللهُ فِيْ ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ إِمَامٌ عَادِلٌ وَشَابٌّ نَشَأَ فِيْ عِبَادَةِ اللهِ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ إذَا خَرَجَ مِنْهُ حَتَّى يَعُوْدَ إِلَيْهِ وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ حَسَبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا لَا تَعْلَمُ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِيْنُهُ –

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সাত শ্রেণীর লোককে আল্লাহ তাঁর (আরশের) ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন। সেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। (১) ন্যায়পরায়ণ শাসক, (২) সেই যুবক যে আল্লাহ্র ইবাদতে বড় হয়েছে (৩) ঐ ব্যক্তি যার অন্তর সর্বদা মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে, সেখান থেকে বের হয়ে আসার পর তথায় ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত (৪) এমন দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহ্র ওয়াস্তে পরস্পরকে ভালবাসে, আল্লাহ্র ওয়াস্তে মিলিত হয় এবং তাঁর  জন্যই পৃথক হয়ে যায় (৫) এমন ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আর তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে (৬) এমন ব্যক্তি যাকে কোন সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী (ব্যভিচারের জন্য) আহবান করে, আর সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি এবং (৭) সে ব্যক্তি যে গোপনে দান করে। এমনকি তার বাম হাত জানতে পারে না তার ডান হাত কি দান করে’।১১ এ হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ক্বিয়ামতের মাঠে যখন কোন ছায়া থাকবে না, তখন আল্লাহ তা‘আলা সাত শ্রেণীর মুমিন লোককে বিশেষ ছায়া দান করবেন। এককথায় ক্বিয়ামতের মাঠ হবে কঠিন ও ভয়াবহ। আর এই কঠিন ও ভয়াবহ অবস্থা থেকে নাজাত পাবে একমাত্র আল্লাহভীরু মুমিন বান্দাগণ।

উসংহার :

পরিশেষে বলা যায় যে, আমরা যদি সকল মতবাদ ও তরীকা ছেড়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে নিজেদের সার্বিক জীবন গঠন করি তাহ’লে ক্বিয়ামতের মাঠের ভয়াবহ ও কঠিন আযাব থেকে পরিত্রাণ পেয়ে আল্লাহ্র আরশের নীচে স্থান পাব ইনশাআল্লাহ। অন্যথা ক্বিয়ামতের সেই কঠিন আযাব থেকে মুক্তি পাব না। অতএব আসুন, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গঠন করে ক্বিয়ামতের ভয়াবহ আযাব থেকে পরিত্রাণ লাভ করি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!!

– মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম


. আবূদাঊদ, মিশকাত হা/১৩৫৯, হাদীছ ছহীহ।
. মুসলিম, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬২৩০।
. মুসলিম, মিশকাত হা/৫২৮২।
. মুসলিম, মিশকাত হা/৬২৮৩।
. তিরমিযী, হা/৩৩৩৩, হাদীছ ছহীহ।
. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩০২।
. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫০৭।
. মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩০৬।
. মুসলিম, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৪২২।
১০. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩০৩।
১১. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৭০১, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৪৯।

 

১টি মন্তব্য

  1. আসসালামু আলাইকুম ওয়া-রহমাতুল্লাহ্ ,
    আমার প্রশ্ন হলো,যদি কোন মেয়ের পরিবার তারঁ অপছন্দনীয় পাত্রের সাথে মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয় অর্থাৎ পিতা-মাতার পছন্দকেই মানতে বাধ্য করে এবং তারঁ সাথে বিবাহ কার্য সম্পন্ন করে দেয় তাহলে তাদের বিবাহ সম্পাদন শরিয়াতের দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক হবে কি না?
    এখানে উল্লেখ্য যে ছেলেটির মধ্যে যে অপছন্দনীয় দিক গুলো আছে তা হলো ছেলেটি বেনামাযী নামায পড়লেও মাঝেমধ্যে পড়ে,ছেলেটি সিগারেটের নেশা করে,মিথ্যাও বলে,ইসলামিক মাইন্ডের নয় আরো কিছু কারণে মেয়েটি বিবাহে রাজি ছিল না,তবে ছেলেটির আর্থিক অবস্থা ও সাধারণ শিক্ষা কে বিবেচনা করে তারঁ পিতা-মাতা মেয়েটি কে বিবাহ দিয়েছে, কিন্তু মেয়েটি এখুনো মানসিকভাবে মানতে পারিনি পিতা মাতা কষ্ট পাবে বিধায় সংসার করতে বাধ্য হচ্ছে,মেয়েটির ভাষ্য মতে তাকে পরিবর্তন করাও সম্ভব নয় ,
    বর্তমানে মেয়েটি তারঁ নিজ সিদ্ধান্তে তারঁ স্বামী কে ডিভোর্স করতে চাই,
    আমার প্রশ্ন শরিয়ত এ বিষয়ে কি বলে?
    আসা করি বিস্তারিত উত্তর দিয়ে বাধিত করবেন

মন্তব্য করুন

Back to top button