ইহকাল-পরকালনারী অঙ্গন

জান্নাতে নারীদের অবস্থা

জান্নাতের মনোরম নে‘মত শ্রবনে মানব মন অধীর আগ্রহী ও প্রফুল্য হয়ে ওঠে। আর জান্নাত ও জান্নাতের নে‘মতসমূহ মুত্তাকী পুরুষ বা নারী উভয়ের জন্য প্রস্ত্তত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য’ (আলে ইমরান ৩/১৩৩)। জান্নাতে পুরুষ এবং নারীরা কী পাবে তা আলাদাভাবে কুরআন ও হাদীছে অনেক বর্ণনা এসেছে। বক্ষমান প্রবন্ধে জান্নাতে নারীদের অবস্থা কী হবে, জান্নাতে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

জান্নাতের উত্তরাধিকারী নারী :

সৎ আমলের দ্বারা মানুষ জান্নাতে যেতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলেন, وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ‘আর এটিই জান্নাত, নিজেদের আমলের ফলস্বরূপ তোমাদেরকে এর অধিকারী করা হয়েছে’ (যুখরুফ ৪৩/৭২)। সুতরাং সৎ আমলকারী ব্যক্তি পুরুষ হোক বা নারী হোক সে জান্নাতে যাবে। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন,وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا  ‘পুরুষ হৌক বা নারী হৌক যে বিশ্বাসী হয় ও সৎকর্ম করে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তারা কণা পরিমাণ অত্যাচারিত হবে না’(নিসা ৪/১২৪)

জান্নাতের নারীর জন্য রক্ষিত নে‘মতসমূহ :

মানব প্রকৃতি তার ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে পসন্দ করে। এজন্য ছাহাবায়ে কেরাম প্রায়শই জান্নাত ও জান্নাতের নে‘মত সংক্রান্তপ্রশ্ন করতেন এবং তাদের উত্তর দিতেন। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,

أَخْبِرْنَا عَنْ الْجَنَّةِ مَا بِنَاؤُهَا قَالَ لَبِنَةٌ مِنْ ذَهَبٍ وَلَبِنَةٌ مِنْ فِضَّةٍ مِلَاطُهَا الْمِسْكُ الْأَذْفَرُ حَصْبَاؤُهَا الْيَاقُوتُ وَاللُّؤْلُؤُ وَتُرْبَتُهَا الْوَرْسُ وَالزَّعْفَرَانُ مَنْ يَدْخُلُهَا يَخْلُدُ لَا يَمُوتُ وَيَنْعَمُ لَا يَبْأَسُ لَا يَبْلَى شَبَابُهُمْ وَلَا تُخَرَّقُ ثِيَابُهُمْ

আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ‘জান্নাত সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিন। কী দিয়ে জান্নাত নির্মিত হয়েছে? তিনি বললেন, ‘তার দেয়ালের একটি করে ইট স্বর্ণের এবং আরেক ইট রৌপ্য দ্বারা নির্মিত। তার মসলা বা সিমেন্ট’ হ’ল সুগন্ধময় কস্ত্তরী এবং তার কংকর হ’ল মনি-মুক্তা আর মাটি হ’ল জাফরানের তৈরী। যারা তাতে প্রবেশ করবে কখনো মৃত্যু বরণ করবে না। তারা সুখে-স্বাচ্ছন্দে থাকবে, কখনও হতাশা বা দুশ্চিন্তায় পতিত হবে না। তাদের যৌবন শেষ হবে না। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ময়লা বা পুরাতন হবে না’।[1] আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে অপর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, أَنَصِلُ إِلَى نِسَائِنَا فِي الْجَنَّةِ؟ قَالَ:”إِنَّ الرَّجُلَ لِيَصِلُ فِي الْيَوْمِ إِلَى مِائَةِ عَذْرَاءَ ‘জান্নাতে আমরা কি আমাদের স্ত্রীদের কাছে পৌঁছতে পারব? তিনি বললেন, ‘কোন ব্যক্তি (জান্নাতে) দিনে একশত জন কুমারীর কাছে পৌঁছবে’।[2]

এছাড়া কুরআনেও আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদেরকে ডাগর চোখ বিশিষ্ট হূর ও অপরূপা নারীদের কথা বলে জান্নাতের প্রতি আগ্রহী ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তথাপি নারীদের প্রলুব্ধকর এমন কিছু বলেননি। অথচ জান্নাতে নে‘মত সম্ভার সমানভাবে সকলেই ভোগ করবে। এ প্রশ্নের জবাবে ইসলামের মূলনীতির আলোকে এর হিকমত ও তাৎপর্য বলা যেতে পারে-

(ক) প্রথমতঃ এই বাণীটি আমাদের মাথায় রাখতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ ‘তিনি যা করেন সে ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে’ (আম্বিয়া ২১/২৩)

(খ) এটা সুবিদিত যে, নারী প্রকৃতি বলতেই লজ্জার ভূষণে শোভিত। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সে নে‘মতের বর্ণনা দিয়ে জান্নাতের প্রতি লালায়িত করেননি যা তাদেরকে লজ্জায় আরক্ত করে।

(গ) এটাও সুবিদিত যে, পুরুষের প্রতি নারীর যতটা আকর্ষণ রয়েছে, তার চেয়ে বেশী রয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ। যা নবী করীম (ছাঃ)-এর নিমেণাক্ত বাণীতেও প্রমাণ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنْ النِّسَاء ‘আমার পরে আমি পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে ক্ষতিসাধনকারী আর কিছু রেখে যাইনি’।[3] ফলে আল্লাহ জান্নাতে নারীর কথা বলে পুরুষদের আগ্রহী করেছেন। পক্ষান্তরে পুরুষের প্রতি আকর্ষণের চেয়ে নারীদের আকর্ষণ বেশী হ’ল অলংকার ও পোষাকের সৌন্দর্যের প্রতি। কারণ এটি তাদের সহজাত প্রকৃতি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَوَمَنْ يُنَشَّأُ فِي الْحِلْيَةِ ‘আর যে অলংকারে লালিত পালিত হয়…’ (যুখরুফ ৪৩/১৮)

(ঘ) শায়খ ইবনু উছায়মীন (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা স্ত্রীদের কথা উল্লেখ করেছেন স্বামীদের জন্য।

لأن الزوج هو الطالب وهو الراغب في المرأة فلذلك ذكرت الزوجات للرجال في الجنة وسكت عن الأزواج للنساء ولكن ليس مقتضى ذلك أنه ليس لهن أزواج بل لهن أزواج من بني آدم.

‘কেননা স্বামীই হলেন স্ত্রীর কামনাকারী এবং তার প্রতি মোহিত। এ জন্যই জান্নাতে পুরুষদের জন্য স্ত্রীদের কথা বলা হয়েছে। আর নারীদের জন্য স্বামীদের ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু এর দাবী কিন্তু এই নয় যে, তাদের স্বামী থাকবে না। বরং তাদের জন্যও আদম সন্তানের মধ্য থেকে স্বামী থাকবে’।[4]

দুনিয়াতে অবস্থাভেদে নিমেণাক্ত নারীদের কয়েকটি ধরণ হ’তে পারে। আর এসবের প্রত্যেকটির জন্যই জান্নাতে স্বতন্ত্র অবস্থা রয়েছে। নিম্নে তুলে ধরা হ’ল-

১. বিবাহের পূর্বেই মৃত্যুবরণকারীনী জান্নাতী নারী :

‘যদি ইহকালে মহিলার বিবাহ না হয়ে থাকে তবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে দুনিয়ার এমন একজন পুরুষের সঙ্গে বিবাহ দিবেন যা দেখে তার চোখ জুড়িয়ে যাবে। কেননা জান্নাতের নে‘মত ও সুখসম্ভার শুধু পুরুষের জন্য নয়। বরং তা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য বরাদ্দ। আর জান্নাতের নে‘মত সমূহের একটি নে‘মত হচ্ছে এই বিবাহ’।[5] এ সম্পর্কে হাদীছে রয়েছে যা আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِنَّ أَوَّلَ زُمْرَةٍ تَدْخُلُ الْجَنَّةَ عَلَى صُورَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ وَالَّتِى تَلِيهَا عَلَى أَضْوَإِ كَوْكَبٍ دُرِّىٍّ فِى السَّمَاءِ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ زَوْجَتَانِ اثْنَتَانِ يُرَى مُخُّ سُوقِهِمَا مِنْ وَرَاءِ اللَّحْمِ وَمَا فِى الْجَنَّةِ أَعْزَبُ-

‘ক্বিয়ামতের দিন যে প্রথম দলটি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের চেহারা হবে পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জল; তারপর যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের চেহারা হবে আকাশে প্রজ্জ্বলিত নক্ষত্রের ন্যায়। তাদের প্রত্যেকের জন্য দু’জন করে স্ত্রী থাকবে। যাদের গোশতের উপর দিয়েই তাদের পায়ের গোছার ভিতরের মগজ দেখা যাবে। আর জান্নাতে কোন অবিবাহিত থাকবে না’।[6]

শায়খ উছাইমীন (রহঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন, দুনিয়ায় যদি কোন মেয়ের বিবাহ না হয়ে থাকে তাহ’লে আল্লাহ তাকে জান্নাতে চক্ষুশীতলকারী (স্বামীর) সাথে বিবাহ দিবেন। আর জান্নাতী নে‘মতরাজি শুধুমাত্র পুরুষের জন্য নয় তা পুরুষ ও নারী উভয়কে শামিল করে। আর এই নে‘মতরাজির একটি হ’ল বিবাহ’।

২. যে জান্নাতী নারীর স্বামী জাহান্নামী :

যে নারীর স্বামী জান্নাতে প্রবেশ করেনি তার অবস্থা কি হবে সে সম্পর্কে শায়খ উছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘মহিলা যদি জান্নাতবাসী হন আর তিনি বিবাহ না করেন কিংবা তার স্বামী জান্নাতী না হন, সে ক্ষেত্রে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করলে সেখানে অনেক পুরুষ দেখতে পাবেন যারা বিবাহ করেনি।’ অর্থাৎ তাদের কেউ তাকে বিবাহ করবেন’।[7]

৩. বিবাহের পর মৃত্যুবরণকারীনী নারী :

যে নারী বিবাহের পর মারা গেছেন জান্নাতে তিনি সেই স্বামীরই হবেন যার কাছে থাকা অবস্থায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। যে নারীর স্বামী মারা যাবে আর তিনি পরবর্তীতে আমৃত্যু বিবাহ করবেন না, তিনি জান্নাতে উক্ত স্বামীর সঙ্গেই থাকবেন। এ সম্পর্কে হাদীছ যা হুযায়ফা (রাঃ) তাঁর স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন,

إِنْ سَرَّكِ أَنْ تَكُونِى زَوْجَتِى فِى الْجَنَّةِ فَلاَ تَزَوَّجِى بَعْدِى فَإِنَّ الْمَرْأَةَ فِى الْجَنَّةِ لآخِرِ أَزْوَاجِهَا فِى الدُّنْيَا فَلِذَلِكَ حَرُمَ عَلَى أَزْوَاجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنْ يَنْكِحْنَ بَعْدَهُ لأَنَّهُنَّ أَزْوَاجُهُ فِى الْجَنَّةِ.

‘যদি তোমাকে এ বিষয়টি আনন্দিত করে যে, তুমি জান্নাতে আমার স্ত্রী হিসাবে থাকবে তবে আমার পর আর বিবাহ করো না। কেননা জান্নাতে নারী তার দুনিয়ার সর্বশেষ স্বামীর সঙ্গে থাকবেন। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীদের জন্য অন্য কারো সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম করা হয়েছে। কেননা তাঁরা জান্নাতে তাঁরই স্ত্রী হিসেবে থাকবেন’।[8]

৪ . স্বামী মৃত্যুর পর অন্যত্র বিবাহিত নারী :

যে মহিলার স্বামী মৃত্যুবরণ করে আর তিনি তার পরে অন্য কাউকে বিবাহ করেন, তাহ’লে তিনি যত বিবাহই করুন না কেন জান্নাতে সর্বশেষ স্বামীর সঙ্গী হবেন। কেননা, আবু দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, الْمَرْأَةَ لِآخِرِ أَزْوَاجِهَا ‘মহিলা তার সর্বশেষ স্বামীর জন্যই থাকবে।[9]

দুনিয়ার স্বামীর চেয়ে উত্তম স্বামী :

জানাযার দো‘আয় আমরা বলে থাকি, وَأَبْدِلْهَا زَوْجًا خَيْرًا مِّنْ زَوْجِهَا ‘আর তার স্বামীর পরিবর্তে তাকে আরো উত্তম স্বামী দান করুন’। এর আলোকে তিনি যদি বিবাহিতা হন তাহ’লে আমরা কিভাবে তার জন্য এ দো‘আ করি? কেননা আমরা জানি, দুনিয়াতে তার স্বামী যিনি হবেন জান্নাতে তিনিই তার স্বামী থাকবেন? আর যদি তার বিবাহ না হয় তবে তার স্বামী কোথায়?

শায়খ ইবনুল উছায়মীনের ভাষায় এর জবাব হ’ল- ‘যদি মহিলা বিবাহিতা না হন তবে দো‘আর উদ্দেশ্য হবে ‘তার জন্য বরাদ্দ পুরুষ’। আর যদি বিবাহিতা হন তবে তার জন্য আরো উত্তম স্বামীর উদ্দেশ হবে যা ‘দুনিয়ার স্বামীর চেয়ে গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যে উত্তম স্বামী’। কারণ, বদল দুই ধরনের। (১) সত্তার বদল। যেমন কেউ ছাগলের বিনিময়ে উট কিনল। (২) গুণের বদল। যেমন আপনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যক্তির কুফরকে ঈমানে বদলে দিয়েছেন। এখানে কিন্তু ব্যক্তি একইজন। পরিবর্তন কেবল তার বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলার বাণীতেও আমরা দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। তিনি বলেন, يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ ‘যেদিন এ যমীন ভিন্ন যমীনে রুপান্তরিত হবে এবং আসমানসমূহও’ (ইবরাহীম ১৪/৪৮)। আয়াতে উল্লেখিত যমীন একই থাকবে। তবে তা কেবল প্রলম্বিত হয়ে যাবে। তেমনি আসমানও থাকবে সেটিই তা বিদীর্ণ হয়ে যাবে’।[10]

জান্নাতী নারীর সংখ্যা :

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে একটি হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একবার ঈদের ছালাতে খুৎবায় নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হে নারী সমাজ! ‘তোমরা ছাদাক্বাহ করতে থাক। কারণ আমি দেখছি জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে তোমরাই অধিক। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন; কী কারণে, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, তোমরা অধিক পরিমাণে অভিশাপ দিয়ে থাক আর স্বামীর অকৃতজ্ঞ হও। বুদ্ধি ও দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একজন সদাসতর্ক ব্যক্তির বুদ্ধির হরণে তোমাদের চেয়ে পারদর্শী আমি আর কাউকে দেখিনি। তাঁরা বললেন, আমাদের দ্বীন ও বুদ্ধির ত্রুটি কোথায়, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, একজন নারীর সাক্ষ্য কি একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তাঁরা উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন তিনি বললেন, এ হচ্ছে তাদের বুদ্ধির ত্রুটি। আর হায়েয অবস্থায় তারা কি ছালাত ও ছিয়াম হ’তে বিরত থাকে না? তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, এ হচ্ছে তাদের দ্বীনের ত্রুটি’।[11]

অন্য হাদীছে বলা হয়েছে, ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ أَقَلَّ سَاكِنِى الْجَنَّةِ النِّسَاءُ‘জান্নাতে সবচেয়ে কম অধিবাসী হবে নারী’।[12]

অন্যদিকে আরেক ছহীহ হাদীছে বলা হয়েছে জান্নাতে দুনিয়াবাসীর স্ত্রী হবে তার দুনিয়ার স্ত্রী থেকে দু’জন। যেমন ইমাম মুসলিম (রহঃ) বলেন,

عَنْ مُحَمَّدٍ قَالَ إِمَّا تَفَاخَرُوا وَإِمَّا تَذَاكَرُوا الرِّجَالُ فِى الْجَنَّةِ أَكْثَرُ أَمِ النِّسَاءُ فَقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ أَوَلَمْ يَقُلْ أَبُو الْقَاسِمِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ أَوَّلَ زُمْرَةٍ تَدْخُلُ الْجَنَّةَ عَلَى صُورَةِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ وَالَّتِى تَلِيهَا عَلَى أَضْوَإِ كَوْكَبٍ دُرِّىٍّ فِى السَّمَاءِ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ زَوْجَتَانِ اثْنَتَانِ يُرَى مُخُّ سُوقِهِمَا مِنْ وَرَاءِ اللَّحْمِ وَمَا فِى الْجَنَّةِ أَعْزَبُ-

বর্ণিত হয়েছে যে, লোকেরা গর্ব প্রকাশ করে বলল, অথবা আলোচনা করতঃ বলল, জান্নাতে পুরুষ অধিক হবে, না নারী? একথা শ্রবণে আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, আবুল কাশেম (মুহাম্মাদ) (ছাঃ) কি বলেননি, ‘ক্বিয়ামতের দিন যে প্রথম দলটি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের চেহারা হবে পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জল; তারপর যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের চেহারা হবে আকাশে প্রজ্জলিত নক্ষত্রের ন্যায়। তাদের প্রত্যেকের জন্য দু’জন করে স্ত্রী থাকবে। যাদের গোশতের উপর দিয়েই তাদের পায়ের গোছার ভিতরের মগজ দেখা যাবে। আর জান্নাতে কোন অবিবাহিত থাকবে না’।[13] ইমাম মুসলিম (রহঃ) আরো বলেন,

عَنِ ابْنِ سِيرِينَ قَالَ اخْتَصَمَ الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ أَيُّهُمْ فِى الْجَنَّةِ أَكْثَرُ فَسَأَلُوا أَبَا هُرَيْرَةَ فَقَالَ قَالَ أَبُو الْقَاسِمِ صلى الله عليه وسلم بِمِثْلِ حَدِيثِ ابْنِ عُلَيَّةَ

ইবনু সীরীন থেকে বর্ণিত হয়েছে, পুরুষ ও নারীদের মধ্যে কারা অধিক জান্নাতী হবে, এ বিষয়ে পুরুষ ও নারীগণ ঝগড়ায় লিপ্ত হ’ল। তারপর তারা এ ব্যাপারে আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে প্রশ্ন করলে তিনি তাদের উদ্দেশে বললেন, আবুল কাশেম (ছাঃ) বলেন, অতঃপর তিনি ইবনু ও‘আইনা বর্ণিত (পুর্বোক্ত) বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেন’।[14]

এ কারণে আলেমগণ এই হাদীছগুলো মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানে নানা মত ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ নারীরা কি অধিকাংশ জান্নাতে নাকি জাহান্নামে যাবে? জান্নাতে নারীর সংখ্যা বেশী হবে না জাহান্নামে?

কোন কোন আলেম বলেছেন, নারীরা অধিকাংশে জান্নাতবাসী হবে। আবার জাহান্নামের অধিবাসীর অধিকাংশও হবে নারী। কেননা কাযী ‘ইয়ায (রহঃ) বলেন, (النِّسَاء أَكْثَر وَلَد آدَم) ‘আদম সন্তানের মধ্যে অধিকাংশই নারী’।[15]

একদল বলেছেন, পূর্বোক্ত হাদীছগুলোর ভিত্তিতে বুঝা যায়, জাহান্নামের অধিবাসীদের সিংহভাগই হবে নারী। তেমনি ডাগর চোখবিশিষ্ট হূরদের যোগ করলে জান্নাতের অধিকাংশ অধিবাসীও হবে নারী।

অন্য আরেক দল আলেম বলেছেন, হ্যাঁ শুরুতে নারীরাই হবেন জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। পরবর্তীতে মুসলিম নারীদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করানোর পর জান্নাতে তারাই হবেন সংখ্যাগুরু।

‘হে নারী সমাজ! তোমরা বেশী বেশী ছাদাক্বাহ কর। কেননা, আমি তোমাদের বেশি জাহান্নামের অধিবাসী দেখেছি।’ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এ বাণীর ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, يحتمل أن يكون هذا في وقت كون النساء في النار أما بعد خروجهن بالشفاعة والرحمة حتى لا يبقى فيها أحد من قال لا إله إلا الله فالنساء في الجنة أكثر- ‘হ’তে পারে জাহান্নামে নারীদের সংখ্যা বেশী হবার বিষয়টি তাদের জান্নাতে প্রবেশের পূর্বের কথা। যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে তারা সকলেই সুপারিশ লাভ ও আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির পর জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করলে জান্নাতে নারীর সংখ্যাই হবে বেশি’।[16]

সার কথা, নারীদের প্রত্যাশা ও আত্মবিশ্বাস রাখা উচিত যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবেন না।

জান্নাতী নারীর যৌবন :

নারীরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবেন, আল্লাহ তাঁদের যৌবন ফিরিয়ে দিবেন। হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক আনছারী বৃদ্ধা নারী নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন তিনি যেন আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘জান্নাতে, তো কোন বৃদ্ধা মানুষ প্রবেশ করবে না। এ কথা শুনে বৃদ্ধা বড়ই কষ্ট পেলেন। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহ যখন তাদের (বৃদ্ধাদের) জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, তিনি তাদের কুমারীতে রুপান্তরিত করে দিবেন’।[17]

এ সম্পর্কে অপর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

أَتَتْ عَجُوزٌ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يُدْخِلَنِي الْجَنَّةَ فَقَالَ يَا أُمَّ فُلَانٍ إِنَّ الْجَنَّةَ لَا تَدْخُلُهَا عَجُوزٌ قَالَ فَوَلَّتْ تَبْكِي فَقَالَ أَخْبِرُوهَا أَنَّهَا لَا تَدْخُلُهَا وَهِيَ عَجُوزٌ إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَقُولُ إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا-

‘এক বৃদ্ধা নারী নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমার জন্য দো‘আ করুন যেন আল্লাহ আমাকে জান্নাত দান করেন।’ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (রসিকতা করে) বললেন, ‘হে অমুকের মা তুমি কি জানো না জান্নাতে কোন বৃদ্ধা মানুষ প্রবেশ করবে না’। বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে চলে যেতে উদ্যত হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উপস্থিত লোকদের বললেন, ‘তাঁর নিকট যাও এবং বল যে, আল্লাহ তাঁকে বৃদ্ধা অবস্থায় নয় বরং যুবতী বানিয়ে জান্নাতে নিবেন। আল্লাহ বলেছেন, إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَارًا ‘আমি জান্নাতের নারীদেরকে নতুন করে সৃষ্টি করবো, তাদেরকে কুমারী সমবয়সী যুবতী বানাবো (ওয়াক্বিয়াহ ৫৬/৩৫-৩৬)’।[18]

নারীদের জন্য জান্নাতকে সুশোভিত করা হয়েছে যেমন পুরুষদের জন্য একে সুসজ্জিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيكٍ مُقْتَدِرٍ  ‘যথাযোগ্য আসনে, সর্বশক্তিমান মহা অধিপতির নিকটে’ (ক্বামার ৫৪/৫৪-৫৫)। আর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নারী জাতির জান্নাতে যাওয়া সহজ উপায় বলে দিয়েছেন, যা যে কোন নারী পক্ষে সম্ভব। যেমন নারীরা নিম্মোক্ত ৪টি বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতে পারলে তারা জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করা অধিকার অর্জন করতে পারবে। হাদীছটি হ’ল, রাসূল (ছাঃ) বলেন,

إِذَا صَلَّتْ الْمَرْأَةُ خَمْسَهَا وَصَامَتْ شَهْرَهَا وَحَفِظَتْ فَرْجَهَا وَأَطَاعَتْ زَوْجَهَا قِيلَ لَهَا ادْخُلِي الْجَنَّةَ مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ شِئْتِ

‘যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে, রামাযানের ছিয়াম পালন করে, আপন সতীত্ব রক্ষা করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তাকে বলা হবে, যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ কর’।২০

উপসংহার :

অতএব হে নারী সমাজ! অলসতায় সুযোগ হারাবেন না। কারণ এ নশ্বর জীবন আর কয় দিনের? এটা তো দেখতে দেখতেই বয়ে যাবে। আর এরপর অবশিষ্ট থাকবে কেবল অনন্ত জীবন। সুতরাং জান্নাতের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবার চেষ্টা করুন। আর জেনে রাখুন, অতিরিক্ত কল্পনা ও প্রত্যাশা নয়; জান্নাতের মোহরানা হ’ল ঈমান ও আমল।

আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন সকল মুসলিম নর-নারীদের হেদায়াতের পথের পথিক বানিয়ে দেন ও প্রত্যেককে জান্নাতুল ফিরদাঊস নছীব করুন-আমীন!

– হাফীযুর রহমান


[1]. আহমাদ হা/৯৭৪২, শু‘আইব আরনাউত বলেন, হাদীছটি ছহীহ।

[2]. আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১৩০৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬৭।

[3]. বুখারী হা/৫০৯৬; মুসলিম হা/৭১২২।

[4]. ক্বিসমুল আক্বীদা ১৭/৩৫; মাজমু‘ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েলু ইবনু উছাইমীন ২/৩৮।

[5]. মাজমু‘ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েলু ইবনু উছাইমীন ২/৩৮।

[6]. মুসলিম হা/২৮৩৪।

[7]. মাজমু‘ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েলু ইবনু উছাইমীন ২/৩৮।

[8]. বায়হাক্বী, সুনানে কুবরা হা/১৩৮০৩।

[9]. ছহীহুল জামে‘ হা/৬৬৯১; সিলসিলা ছহীহাহ ৩/২৭৫, হা/১২৮১।

[10]. লিকাআতুল বাবুল মাফতুহ ৩/২৫।

[11]. বুখারী হা/৩০৪।

[12]. মুসলিম হা/৭১১৮; আহমাদ হা/১৯৮৫০, ২০০০০।

[13]. মুসলিম হা/২৮৩৪ (৭৩২৫)।

[14]. মুসলিম হা/২৮৩৪ [৭৩২৬]।

[15]. ইমাম নববী, শরহে মুসলিম ১৭/১৭২।

[16]. ফাইযুল ক্বাদীর, ১/৫৪৫, হা/১১১৭।

[17]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৫৫৪৫।

[18]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৮৭।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button