ইহকাল-পরকাল

আখিরাতের মনযিল সমূহ

ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াবী জীবনের নির্ধারিত সময় তথা হায়াত শেষ হ’লে মৃত্যুর মাধ্যমে পরকালে পাড়ি জমাতে হবে। পার্থিব জীবনের স্বল্প সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইবনু ওমর (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, كُنْ فِى الدُّنْيَا كَاَنَّكَ غَرِيْبٌ اَوْ عَابِرُ سَبِيْلٍ ‘তুমি পৃথিবীতে এমনভাবে দিন যাপন কর যেন একজন আগন্তুক অথবা একজন মুসাফির’।[1] কারণ আমরা ছিলাম রূহের জগতে। অতঃপর মাতৃগর্ভে এবং সেখানে থেকে এ দুনিয়ায়। প্রতিটি স্তরে আল্লাহর হুকুমে আমাদের আগমন ও প্রত্যাগমন হয়েছে এবং হবে। ইচ্ছা করে আমরা কোন একটি মনযিলে নির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা দ্রুত করতে পারি না, বিলম্বও করতে পারি না (নাহল ১৬/৬১)। আমাদের বর্তমান অবস্থান স্থল এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মনযিলে, যেটা পরকালীন সকল মনযিলের জন্য পাথেয় সঞ্চয়ের একমাত্র ক্ষেত্র। অথচ এখানকার সময়সীমা সম্পর্কে কারো কিছু জানা নেই। কাজেই আমাদের উচিৎ মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে গণীমত স্বরূপ গ্রহণ করা।[2] পরকালীন জীবনের জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকা। সাথে সাথে আখেরাতের মনযিল সমূহ সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া। আলোচ্য নিবন্ধে আখেরাতের মনযিল সমূহ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা পেশ করা হ’ল।-

১. কবর :

কবর পরকালীন জীবনের প্রথম মনযিল। এখান থেকেই মানুষের পার্থিব জীবনের আমলের প্রতিদান স্বরূপ পুরস্কার অথবা তিরস্কার প্রাপ্তি আরম্ভ হয়। এখানে মুক্তি পেলে পরবর্তী সকল স্তর সহজ হয়ে যায়। ওছমান (রাঃ)-এর মুক্ত দাস হানী বলেন যে, ওছমান (রাঃ) কোন কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এত কাঁদতেন যে, তার দাড়ি ভিজে যেত। তাঁকে প্রশ্ন করা হ’ল জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করা হ’লে তো আপনি কাঁদেন না, অথচ এই কবর দর্শনে আপনি এত বেশী কাঁদেন কেন? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الْقَبْرَ اَوَّلُ مَنَازِلِ الْاَخِرَةِ فَإِنْ نَجَا مِنْهُ فَمَا بَعْدُهُ اَيْسَرُ مِنْهُ وَاِنْ لّمْ يَنْجُ مِنْهُ فَمَا بَعْدَهُ اَشَدُّ مِنْهُ، ‘আখেরাতের মনযিল সমূহের মধ্যে কবর হ’ল প্রথম মনযিল। এখান হ’তে কেউ মুক্তি পেয়ে গেলে তার জন্য পরবর্তী মনযিলগুলোতে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে। আর এখান থেকে কেউ মুক্তি না পেলে পরবর্তী মনযিলগুলো তার জন্য আরোও কঠিন হবে’।[3] মৃত্যুর পর এই কবর আমাদের বাড়ী (ছোয়াদ ৩৮/৪৬)। যেখানে থাকতে হবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত। আর ক্বিয়ামত কবে হবে, তা কারো জানা নেই। কাজেই এই দীর্ঘ বারযাখী জীবন কিভাবে সুখময় করা যায়, সেই বিষয়ে যথাযথ প্রস্ত্ততি গ্রহণকারী ব্যক্তিই প্রকৃত বুদ্ধিমান।[4] যেমনটা ছিলেন ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূব (আঃ) (ছোয়াদ ৩৮/৪৫)

২. হাশর :

প্রথম শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হ’লে সব প্রাণী মারা যাবে। অতঃপর আবার ফুৎকার দেওয়া হবে। আল্লাহ বলেন, وَنُفِخَ فِي الصُّوْرِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيْهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُوْنَ ‘আর শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। অতঃপর আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সবই ধ্বংস হবে, তবে যাকে আল্লাহ ইচছা করেন। অতঃপর শিঙ্গায় আরেকটি ফুঁক দেওয়া হবে। তখন তারা সবাই দাঁড়িয়ে তাকাতে থাকবে’ (যুমার ৩৯/৬৮)

অত্র আয়াতে দু’বার শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়ার কথা এসেছে। প্রথমটি থেকে দ্বিতীয়টির ব্যবধান কতটুকু, সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,  بَيْنَ النَّفْخَتَيْنِ أَرْبَعُونَ‘দুই ফুঁকের মধ্যবর্তী সময় কাল হ’ল চল্লিশ’। লোকেরা বলল, হে আবু হুরায়রা! চল্লিশ দিন? তিনি বললেন, আমি বলতে পারব না। তারা বলল, চল্লিশ বছর? তিনি একই জবাব দিলেন। লোকেরা বলল, চল্লিশ মাস? তিনি বলতে অস্বীকার করলেন। আর এই সময়ের মধ্যে মানুষের দেহের সবকিছু পচে-গলে যাবে, তার মেরুদন্ডের নিম্নাংশটুকু ব্যতীত। যা থেকেই তার দেহ গঠন করা হবে’।[5] তবে ইবনু কাছীর (রহঃ) তিনটি ফুঁকের কথা বলেছেন, ১. ভীত-কম্পিত হওয়ার ফুঁক[6], ২. মৃত্যুর ফুঁক এবং ৩. বেঁচে ওঠার ফুঁক।[7] তবে দু’টি ফুঁকই অগ্রগণ্য।

অতঃপর কবর উন্মোচিত করা হবে (ইনফিতার ৮২/৪)। সকলকেই একত্র করা হবে (কাহাফ ১৮/৯৯)। এই সমবেতকরণ মহান আল্লাহর জন্য অতিশয় সহজ (ক্বফ ৫০/৪৪)। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মানুষকে হাশরের মাঠে উঠানো হবে নগ্ন পদ, নগ্ন দেহ ও খাতনাবিহীন অবস্থায়। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তখন তাহ’লে পুরুষ ও নারীগণ একে অপরের দিকে তাকাবে। তিনি বললেন, এরকম ইচ্ছা করার চেয়ে তখনকার অবস্থা হবে অতীব সংকটময়’।[8] অন্যত্র তিনি আরো বলেন,يُبْعَثُ كُلُّ عَبْدٍ عَلَى مَا مَاتَ عَلَيْهِ، ‘প্রত্যেক বান্দা ক্বিয়ামতের দিন ঐ অবস্থায় পুনরুথিত হবে, যে অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করল’।[9]

মহান রাববুল আলামীনের সামনে সকলে তাদের মর্যাদা অনুযায়ী স্থান পাবে। বিচার দিবসের ব্যাপ্তি সম্পর্কে জানা যায় যে, দুনিয়ার পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান হবে এক দিন। فَيَرَى سَبِيْلَهُ اِمَّا اِلَى الْجَنَّةِ وَاِمَّا اِلَى النَّارِ ‘তারপর সে (প্রত্যেক বান্দা) তার পথ দেখতে পাবে, হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে’।[10]

কাজেই প্রত্যেক আদম সন্তানের উচিৎ সেই ৫০ হাযার বছর দীর্ঘ দিবসের ভয় করা। পার্থিব জীবন সেই তুলনায় কত নগণ্য তা চিন্তা করা। আর হাশরের মাঠ আখেরাতের মনযিল সমূহের অন্যতম মনযিল। ঠিক যেন দুনিয়ার উল্টা পিঠ। এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে যেমন অন্য নতুন এক পৃথিবী হবে।[11] সেখানে মানুষের কৃত আমলের হিসাব হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আজ (পৃথিবী) আমলের জন্য আর কাল (পরকাল) হিসাবের জন্য’।[12]

৩. পুলছিরাত :

বিচারকার্য পরিসমাপ্তির পর বান্দা যখন জান্নাত অথবা জাহান্নামের পথ দেখতে পাবে তখনও জান্নাতের পথ কন্টকাকীর্ণ থাকবে। নতুন আরেকটি মনযিলের সম্মুখীন হবে হাশরবাসী। আল্লাহ বলেন,وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا، ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِيْنَ فِيْهَا جِثِيًّا، ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে সেখানে পৌঁছবে না। এটা তোমার পালনকর্তার অমোঘ সিদ্ধান্ত, অতঃপর আমরা মুত্তাক্বীদের মুক্তি দিব এবং সীমালংঘনকারীদের সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দিব’ (মারইয়াম ১৯/৭১-৭২)। অর্থাৎ পাপী ব্যক্তি জাহান্নামের মধ্যে পড়ে যাবে, পাপ প্রায়শ্চিত্তের পর নাজাত পাবে। পক্ষান্তরে মুত্তাকী ব্যক্তি সহজে জাহান্নামের উপরিস্থিত সেতু অতিক্রম করার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।[13] এ পুল জাহান্নামের উপরে স্থাপিত, যা বান্দার আমল অনুসারে সহজ অথবা কঠিন হবে।[14] রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَيُضْرَبُ الصِّرَاطُ بَيْنَ ظَهْرَىْ جَهَنَّمَ، فَأَكُونُ أَنَا وَأُمَّتِى أَوَّلَ مَنْ يُجِيزُهَا، ‘এরপর জাহান্নামের উপর পুল কায়িম করা হবে। যারা পুল পার হবে, আমি এবং আমার উম্মত তাদের মধ্যে প্রথম থাকব’।[15]

৩. ক্বানত্বারাহ :

অর্থাৎ পুলছিরাত পার হবার পর পুনরায় যে স্থানে মানুষ আটকে যাবে তা ঠিক আ‘রাফের উপর স্থাপিত অভার ব্রিজ স্বরূপ।[16] আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,يَخْلُصُ الْمُؤْمِنُونَ مِنَ النَّارِ، فَيُحْبَسُونَ عَلَى قَنْطَرَةٍ بَيْنَ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ، فَيُقَصُّ لِبَعْضِهِمْ مِنْ بَعْضٍ، مَظَالِمُ كَانَتْ بَيْنَهُمْ فِى الدُّنْيَا، ‘মুমিনগণ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একটি পুলের উপর তাদের দাঁড় করানো হবে, যা জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যস্থলে অবস্থিত। দুনিয়ায় তারা একে অপরের উপর যে যুলুম করেছিল এখানে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করানো হবে’।[17]

৪. আ‘রাফ :

আল্লাহ বলেন, ‘উভয় শ্রেণীর লোকদের মাঝখানে একটি পর্দা থাকবে। আর আ‘রাফের উপর অনেক লোক থাকবে। তারা প্রত্যেককে তার (উজ্জ্বল ও মলিন) চিহ্ন দেখে চিনে নিবে। তারা তখন জান্নাতীদের ডেকে বলবে, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক। তারা তখনো জান্নাতে প্রবেশ করেনি। কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা করবে। আর যখন জাহান্নামবাসীদের দিকে তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তখন তারা (আ‘রাফবাসীরা) বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে অত্যাচারী সম্প্রদায়ের সাথী করো না। আ‘রাফবাসীরা যাদেরকে তাদের চিহ্ন দেখে চিনবে, তাদেরকে ডেকে বলবে, তোমাদের জনবল ও ঔদ্ধত্য তোমাদের কোন কাজে আসল না। (জাহান্নামের উদ্ধত নেতারা দুর্বল আ‘রাফবাসীদের প্রতি ইশারা করে বলবে) এরা কি তারাই, যাদের সম্পর্কে তোমরা কসম করে বলতে যে, এদের প্রতি আল্লাহ দয়া করবেন না (কেননা আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়াতে সচ্ছলতা দেননি। আখেরাতে কেন দিবেন?)। তখন আল্লাহ (আ‘রাফবাসীদের উদ্দেশ্যে) বলবেন, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর। তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা চিন্তান্বিত হবে না’ (আ‘রাফ ৭/৪৬-৪৯)

৫. জাহান্নাম :

আখেরাতের মনযিল সমূহের মধ্য সর্বাধিক ভয়াবহ মনযিল হ’ল জাহান্নাম। আল্লাহ বলেন,إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا  ‘নিশ্চয়ই ওটি অত্যন্ত মন্দ, আশ্রয়স্থল ও বসবাসের স্থান হিসাবে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৬)। তিনি আরো বলেন, وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ ‘আর তোমরা জাহান্নাম থেকে ভীত হও। যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্ত্তত করা হয়েছে’ (আলে ইমরান ৩/১৩১)

জাহান্নামের অধিবাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ الْمُجْرِمِيْنَ فِيْ عَذَابِ جَهَنَّمَ خَالِدُوْنَ، ‘নিশ্চয়ই অপরাধীরা

চিরকাল জাহান্নামের শাস্তির মধ্যে থাকবে’ (যুখরুফ ৪৩/৭৪)

কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও পাপীদেরকে এই জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। সেখানে তারা নানা ধরনের শাস্তি ভোগ করবে। যারা জাহান্নামী হবে, সেখানে তাদের মৃত্যু হবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন,يُقَالُ لأَهْلِ الْجَنَّةِ خُلُودٌ لاَ مَوْتَ وَلأَهْلِ النَّارِ يَا أَهْلَ النَّارِ خُلُودٌ لاَ مَوْتَ ‘(ক্বিয়ামতের দিন) জান্নাতবাসীদেরকে বলা হবে, এ জীবন চিরন্তন, যার কোন মৃত্যু নেই। জাহান্নামের অধিবাসীদেরকে বলা হবে, হে জাহান্নামীরা! এ জীবন চিরন্তন, যার কোন মৃত্যু নেই’।[18]

৬. জান্নাত :

জান্নাত পরকালীন জীবনে মুমিন-মুত্তাক্বীদের আবাসস্থল। হাশরের ময়দানে বিচারের পর মুত্তাকী বান্দাদেরকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِيْ نَعِيْمٍ ‘নিশ্চয়ই নেককারগণ থাকবে জান্নাতে’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/২২)। তিনি আরো বলেন,وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُوْنَ، ‘পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্মাদি সম্পাদন করেছে, তারা হ’ল জান্নাতের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৮২)। জান্নাতের সেই জীবন হবে অনন্তকালের, যার কোন শেষ নেই। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত মানুষকে একটি ময়দানে একত্রিত করবেন, তারপর রাববুল আলামীন তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করে বলবেন, পৃথিবীতে যে যার অনুসরণ করত, এখন কেন সে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে না? অতএব ক্রুশ পূজারীদের জন্য ক্রুশ, মূর্তি পূজারীদের জন্য মূর্তি, অগ্নি উপাসকদের জন্য আগুন উপস্থাপন করা হবে এবং সকলেই নিজ নিজ পূজনীয় মা‘বূদদের সাথে চলবে।

আর মুসলমানরা তাদের জায়গাতেই থেকে যাবে। রাববুল আলামীন তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে বলবেন, তোমরা কেন ঐসব মানুষদের অনুসরণ করছ না? তারা বলবে, নাউযুবিল্লাহ মিনকা, নাউযুবিল্লাহ মিনকা (আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)। আল্লাহ তা‘আলাই আমাদের প্রভু। আর এটা আমাদের জায়গা। আমরা আমাদের প্রভুর সাক্ষাৎ পাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এ স্থান ছেড়ে যাবো না। তিনি তাদেরকে নির্দেশ দিবেন এবং তাদেরকে নিজ জায়গায় অটল রাখবেন।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা অদৃশ্য হয়ে যাবেন। তিনি পুনরায় তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে বলবেন, তোমরা কেন ঐসব মানুষের অনুসরণ করছ না? তারা বলবে, নাউযুবিল্লাহ মিনকা, নাউযুবিল্লাহ মিনকা, আল্লাহ আমাদের রব এবং এটা আমাদের অবস্থানস্থল। আমরা আমাদের রবের দেখা পাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এ জায়গা ছেড়ে যাবো না। তিনি তাদেরকে আদেশ দিবেন এবং স্বস্থানে দৃঢ় রাখবেন।

ছাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমরা কি আমাদের প্রভুর দেখা পাব? তিনি বললেন, তোমাদের কি পূর্ণিমার রাতের চাঁদ দেখতে অন্যদেরকে কষ্ট দিতে হয়? তারা বললেন, না, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, অনুরূপভাবে সে সময় তোমরা তাঁকে দেখার জন্য তোমাদের কাউকে যন্ত্রণা দিতে হবে না। তারপর আল্লাহ তা‘আলা আড়ালে চলে যাবেন।

তিনি পুনরায় তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে নিজের পরিচয় উপস্থাপন করে বলবেন? আমিই তোমাদের প্রভু। তোমরা আমার অনুসরণ কর। মুসলমানরা উঠে দাঁড়াবে। চলার পথে পুলছিরাত স্থাপন করা হবে। তারা তা খুব সহজেই দ্রুতগামী ঘোড়া ও উটের মতো অতিক্রম করবে এবং এর উপরে তাদের ধ্বনি হবে, সাল্লিম সাল্লিম (হে আল্লাহ আমাদেরকে নিরাপদ রাখো)।

জাহান্নামীরা অতিক্রম করতে না পেরে এখানেই থেকে যাবে। তাদের মধ্য হ’তে একটি দলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আর জাহান্নামকে প্রশ্ন করা হবে, তোর পেট ভরেছে কি? সে বলবে, আরো আছে কি? আবার আরেকটি দলকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং প্রশ্ন করা হবে, তোর পেট ভরেছে কি? সে বলবে, আরো আছে কি? এভাবে সমস্ত জাহান্নামীকে যখন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তখন দয়ালু প্রভু আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় পা তার উপর রাখবেন এবং এর এক অংশ আরেক অংশের সাথে সংকুচিত হয়ে যাবে। তিনি বলবেন, যথেষ্ট হয়েছে তো। জাহান্নাম বলবে, হ্যাঁ, যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা যখন জান্নাতীদেরকে জান্নাতে এবং জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, তখন মৃত্যুকে গলায় কাপড় বেঁধে টেনে আনা হবে এবং জান্নাতী ও জাহান্নামীদের মাঝখানের প্রাচীরে রাখা হবে। তারপর ডেকে বলা হবে, হে জান্নাতীগণ! তারা ভয়ে ভয়ে আত্মপ্রকাশ করবে। তারপর বলা হবে, হে জাহান্নামীগণ! তারাও সুসংবাদ মনে করে শাফা‘আত লাভের আশায় আত্মপ্রকাশ করবে। তারপর জান্নাতী ও জাহান্নামীদেরকে প্রশ্ন করা হবে, তোমরা কি একে চেনো? জান্নাতী ও জাহান্নামীরা বলবে, হ্যাঁ আমরা একে চিনে ফেলেছি। এটা মৃত্যু যা আমাদের উপর নির্দিষ্ট করা হয়েছিল।

তারপর মৃত্যুকে চিৎ করে শোয়ানো হবে এবং জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যকার প্রাচীরের উপর যবেহ করা হবে। তারপর বলা হবে, হে জান্নাতীগণ! তোমরা চিরকাল জান্নাতে থাকবে। এরপর আর মৃত্যু নেই। হে জাহান্নামীগণ! তোমরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, এরপর আর মৃত্যু নেই’।[19]

এই নে‘মতপূর্ণ জান্নাতের আছে শতাধিক স্তর এবং প্রত্যেক স্তরের মাঝে ব্যবধান আকাশ ও যমীনের মধ্যবর্তী ব্যবধানের সমান। আর ফেরদাউস যার সর্বোচ্চ স্তর। যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী তাদের জন্য নবী করীম (ছাঃ) এরূপ স্থানে একটি গৃহ প্রদানের ব্যাপারে যামিনদার হবেন।[20]

উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায় যে, আখেরাতের মনযিল সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর সেগুলি থেকে সতর্ক-সাবধান হওয়ার জন্য দুনিয়াতে সাধ্যমত আমলে ছালেহ করতে হবে। যাতে করে পরকালীন জীবনে জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাত লাভ করা যায়। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!

মুহাম্মাদ নাজমুল আহমাদ


[1]. বুখারী হা/৬৪১৬; তিরমিযী হা/২৩৩৩।

[2]. তিরমিযী হা/২৩০৮;  মিশকাত হা/৫১৭৪।

[3]. তিরমিযী হা/২৩০৮; ইবনু মাজাহ হা/৪৫৬৭; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬৮৪।

[4]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৯।

[5]. বুখারী হা/৪৮১৪; মুসলিম হা/২৯৫৫; মিশকাত হা/৫৫২১।

[6]. সূরা নমল ৮৭ আয়াত এবং ছহীহ মুসলিম হা/২৯৪০।

[7]. সূরা ইয়াসীন ৩৬/৪৯-৫০; যুমার ৩৯/৬৮; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নমল ৮৭ আয়াত।

[8]. বুখারী হা/৬৫২৭; মুসলিম হা/২৮৫৯; মিশকাত হা/৫৫৩৬।

[9]. মুসলিম হা/২৮৭৮; মিশকাত হা/৫৩৪৫।

[10]. বুখারী হা/১৪০২।

[11]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৭৯; সূরা ইব্রাহীম ১৪/৪৮।

[12]. বুখারী, মিশকাত হা/৫২১৫।

[13]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৮০।

[14]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৮১।

[15]. বুখারী হা/৭৪৩৭; মুসলিম হা/১৮২।

[16]. আ‘রাফ জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যস্থলে উচু প্রাচীর (আ‘রাফ ৭/৪৬)। আর কানত্বারাহও উভয়ের মধ্যে আ‘রাফের উপরে ওভার ব্রিজ (বুখারী হা/৬৫৩৫)।

[17]. বুখারী হা/৬৫৩৫।

[18]. বুখারী হা/৬৫৪৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৮১২০।

[19]. তিরমিযী হা/২৫৫৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৮০২৫।

[20]. আবূ দাঊদ হা/৪৭২৫।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button