সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

সর্বনাশের সিঁড়ি

বিশ্ব রাজনীতি স্বীকৃত মৌলিক নাগরিক অধিকার পাঁচটি, যথা- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা। মনুষ্যজীবনে এগুলি এমনি আবশ্যক, এর একটিও পরিহার্য নয়। আবার ইসলাম ধর্মও পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, যথা- কালেমা, ছালাত, ছিয়াম, যাকাত এবং হজ্জ। ইসলাম থেকে এর একটিও পরিহার্য নয়। এই নিয়মে আমি সর্বনাশের  পাঁচটি সিঁড়ি চিহ্নিত করতে চাই, যথা- সূদ, ঘুষ, পর্দাহীনতা, টেলিভিশন এবং মোবাইল। এগুলির পরিণাম সর্বনাশ। তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই তাকে বলেছি সর্বনাশের সিঁড়ি। যেহেতু এসবের মাধ্যমেই সর্বনাশ আসে।

প্রথমেই সূদের কথা বলা যাক। সূদের বিনিময়ে যারা টাকা লগ্নী করে, তারা একে ব্যবসা বলে। আর এটি এমনই ব্যবসা যাতে ব্যবসায়ের দু’টি মূলনীতি কিংবা পরিণামের একটি অনুপস্থিত। অর্থাৎ এতে লোকসান নেই। অথচ ব্যবসায়ে লাভ এবং লোকসান দু’টিই থাকার কথা। আবার লাভ-লোকসান বরাবর অপরিবর্তিত থাকারও কথা নয়। কিন্তু সূদের বেলায় শুধু লাভই থাকে এবং তা অপরিবর্তিত। এ কারণে সূদকে ব্যবসা বলার কোন যুক্তি নেই। বরং শোষণের হাতিয়ার বা পন্থা বলাই সংগত। সূদে আবার সূদের সূদ, তস্য সূদ অর্থাৎ চক্রবৃদ্ধির সুযোগটাও রয়েছে। তবু সূদ আন্তর্জাতিক। সেকারণে গণিতশাস্ত্রেও তার স্থান রয়েছে। অর্থাৎ গণিতশাস্ত্র অধ্যয়নে সূদ কষার  নিয়ম শেখার ব্যবস্থা রয়েছে।

সূদের ব্যবসায়ে লোকসান নেই বলেই লগ্নীকারীরা এতে অর্থ লগ্নী করে। কিন্তু সূদে অর্থ গ্রহীতারা সবাই যে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এ ঋণ গ্রহণ করে, তা নয়। অনেক অর্থশালী ব্যবসায়ীরা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সূদী ঋণ গ্রহণ করে। তার ফলে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়। অধিক মুনাফা করতে পারায়, তাদের ধন বৃদ্ধি পায়। আর ধন বৃদ্ধির সংগে পাল্লা দিয়ে অহেতুক বিলাস-ব্যসনের মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়। যারা অধিক টাকা না থাকার কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা আদৌ টাকা না থাকায় ব্যবসা করতে পারে না, তারা সূদের ভিত্তিতে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে। প্রায়শঃ দেখা যায়, এ ধরনের ব্যবসায়ীরা পরিণামে ব্যবসায়ে ফেল মারে। তার কারণ হিসাবে জানা যায় যে, আয়ের  চাইতে ব্যয় অধিক করার ফলেই পরিণামটা এরূপ হয়।

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশে প্রচুর এনজিও রয়েছে, যারা কিস্তিতে সূদ পরিশোধ  (আসলের অংশ সহ) চুক্তিতে ঋণ প্রদান করে। আবার গ্রামের লোকেরাও অনুরূপ ঋণদান সমিতি গড়ে তুলেছে। তারাও এনজিওর মতো সূদ এবং কিস্তি পরিশোধের নিয়মে ঋণ প্রদান করে। এমনও দেখা যায়, অনেক দরিদ্র ব্যক্তি এনজিও কিংবা সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে তেমন কোন ব্যবসা না করে ঘরের চালে টিন দেয়, টেলিভিশন ক্রয় করে। এভাবে অর্থ ব্যয়ে কিছুটা বিলাসী জীবন-যাপনের চেষ্টা করে। অতঃপর খেয়ে- না খেয়ে কিস্তি পরিশোধের চেষ্টা করে। পরিশেষে কিস্তি খেলাপের কবলে পড়ে কেউবা পৈত্রিক ভিটেবাড়ী বিক্রি করে ঋণ পরিশোধে বাধ্য হয়। কেউবা ঘর-বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যায় শহরে। কেউবা আত্মহত্যা করে রেহাই পায়। এরূপ ঘটনা কখনও কখনও আমাদের কর্ণগোচর হয়। আবার বৃহৎ ব্যবসায়ীদেরও কেউ কেউ ঋণ খেলাপী হয়ে পড়ে। অতএব সূদকে সর্বনাশের সিঁড়ি বলতে বাধা কোথায়? সূদ হারাম হ’লেও বহু দেশে সরকারী আইনে তা সিদ্ধ। অবশ্য সর্বনাশটা কারো কখনও কাম্য নয়। কিন্তু সর্বনাশটা প্রায়শঃ হয়ই। আর এই সূদের কারবারে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ডঃ ইউনুস। অথচ সূদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল হারাম করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা কর্য দিয়ে ক্রমবর্ধমানহারে সূদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর, তবেই তোমরা রক্ষা পাবে’ (আলে ইমরান ১৩০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূদ প্রদানকারী, তার লেখক এবং সাক্ষীকে অভিশাপ দিয়েছেন; তারা সকলেই সমান (মুসলিম)

জনগণ কর্তৃক গঠিত হয় সরকার। সরকার নিয়োগ করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের বেতন-ভাতা জনগণ প্রদত্ত ট্যাক্সের দ্বারা নির্বাহ হয়। আসলে তারা জনগণেরই সেবক। এ কারণে তাদেরকে বলা হয় পাবলিক সার্ভেন্ট (Public servant)। জনগণের কাজ করার জন্যই তাদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছে বেতনের বিনিময়ে। তারা তাই জনগণের কাজ করতে বাধ্য। কিন্তু অধুনা আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি যে, ঘুষ না দিলে কোন সরকারী অফিসে কাজ পাওয়া যায় না। ঘুষ অবৈধ, অনৈতিক, বেআইনী। ধর্ম বিধিতে তো নিষিদ্ধ বটেই। তবু দৈনন্দিন বাজার দরের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘুষের পরিমাণও বেড়েই চলেছে। ঘুষ না দিলে অফিসের কোন ফাইল নড়ে না, লাল ফিতার বাঁধন খোলে না, চাকুরী হয় না, পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট, পেনশন আটকে থাকে। এটা সর্বজনবিদিত। আর ঘুষের আদান-প্রদানে গোপনীয়তা রক্ষিত হয় বলে, এর বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করাও যায় না। সূদের বেলায় ইসলামী বিধানে দাতা-গৃহীতা উভয়ে সমান অপরাধী। অবশ্য সরকারী আইন-বিধানে কারো অপরাধ হয় না। কিন্তু ঘুষের বেলায় উভয়েই সমান অপরাধী আইনের চোখেও। কেননা সবাই দায়ে ঠেকে ঘুষ দেয় না। কেউ কেউ অবৈধ কাজকে বৈধ করার জন্য ঘুষ দেয়, অন্যায়কে ঢাকার জন্য ঘুষ দেয়, অপ্রাপ্যকে পাওয়ার জন্য ঘুষ দেয়। এ ধরনের ঘুষ দাতা অবশ্যই ঘুষ গ্রহণকারীর সমানই অপরাধী। এরা ন্যায্য পাওনাদারকে বঞ্চিত করে। এদের কারণে অপরাধী মুক্তি পায়, নিরপরাধ শাস্তি ভোগ করে। তাই ঘুষকে শুধু অপরাধ বললেই চলে না। এটা নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, নিগ্রহ, মানবতার চরম লংঘন। অথচ ঘুষখোরদের নেটওয়ার্ক অধুনা সুদূরপ্রসারী। এদেরও ইউনিয়ন বা সিন্ডিকেট রয়েছে। ইসলামে এই ঘুষ আদান-প্রদান নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আমরা যাকে যে পদে নিয়োগ করি, তাকে সেজন্য বেতন দেওয়া হবে। এ ব্যতীত সে যা গ্রহণ করবে, তা বিশ্বাসঘাতকতা (আল হাদীছ)। যে বা যারা ঘুষ খায় বা দেয়, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে অভিসম্পাত করেছেন। (আবুদাঊদ)

আমাদের দেশে ঘুষ-বাণিজ্য শুধু সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আধা সরকারী, বেসরকারী এবং পাবলিকের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। যার হাতেই কিছু কাজ বা ক্ষমতা  থাকে, সে-ই ঘুষ দাবী করে। মাস্তানেরা চাঁদাবাজি করে। তাও এক রূপ ঘুষই। তফাৎটা এই যে, অফিসের ঘুষ না দিলে প্রাণ নাশের হুমকী থাকে না, থাকে কাজ না পাওয়ার সমস্যা। আর চাঁদাবাজদের বক্তব্য, ‘গাড়ী করছ, বাড়ী করছ, ব্যবসা করছ তো চাঁদার টাকাটা ফ্যালো, নইলে লাশ হয়ে পড়ে থাকবে’। তাই একে চাঁদা বলা হয়, ঘুষ বলা হয় না। আবার গ্রামে-গঞ্জে একদল প্রভাবশালী মাতববর শ্রেণীর লোক থাকে, তাদের কাছ থেকে শালিশ-মীমাংসা পেতে চাইলে কিছু সেলামী দিতে হয়। এও এক প্রকার ঘুষ। পাড়া-প্রতিবেশীর কোন না কোনভাবে একটু উপকারের বিনিময়ে এরূপ অর্থগ্রহণ অমানবিক, অনৈতিক। কখনও কখনও এরা সরকারী অফিস-আদালতের দালালীও করে। এদেরকে ভদ্র ভিক্ষুক বললেও ক্ষতি নেই। এরাও গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষকে কম ক্ষতিগ্রস্ত করে না। অনেক সময় এরা তাদের আয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সহজ কাজকে জটিল করে তোলে। এলাকায় কলহ-কোন্দল দীর্ঘমেয়াদী করে রাখে।

প্রত্যেক জীবের শরীরে একটা আবরণ থাকে। তাকে বলা হয় চর্ম। বৃক্ষেরও শরীরে আবরণ থাকে। তাকে বলা হয় বল্কল। চর্ম এবং বল্কল স্পর্শকাতর শরীরকে Protection দেয়। আদিম অসভ্য যুগে মানুষ উলঙ্গ থাকতো বলে জানা যায়। এক সময়ে আদিম মানুষেরা উপলব্ধি করে যে, তাদের উলঙ্গ থাকা ঠিক নয়। তখন থেকে তারা গাছের বাকল, পাতা এবং লতা ব্যবহার করতো। আরো ব্যবহার করতো পশুর চামড়া। এসব তারা ব্যবহার করতো লজ্জা নিবারণের প্রয়োজনে। তাহ’লে ধরে নিতে পারি যে, তাদের মধ্যে সে কালেই লজ্জাবোধ জাগ্রত হয়েছিল।

সভ্যতার উন্মেষ এবং অগ্রগতি মানুষকে জ্ঞানী, মার্জিত এবং রুচিশীল করেছে। তারা কাপড় বুনতে এবং পোষাক তৈরী করতে শিখেছে। তখনই তারা সামাজিক জীবে পরিণত হয়েছে। আর পোষাক পরা তাদের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পোষাক পরিধানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তানগণ! আমি অবশ্যই তোমাদের প্রতি পোষাক নাযিল করেছি তোমাদের লজ্জা নিবারণের জন্য এবং শোভার জন্য, আর পরহেযগারীর পোষাকই উত্তম (আ‘রাফ ২৬)

বর্তমান সভ্যযুগের মানুষ তিনটি প্রয়োজন মেটাতে পোষাক পরিধান করে, যথা- লজ্জা নিবারণ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ এবং সৌন্দর্য বর্ধন। ইসলামী বিধান মতে লজ্জা নিবারণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। হাদীছে বলা হয়েছে, ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ’। ইসলামী বিধান পুরুষ এবং নারীর সতর (লজ্জাস্থান) নির্ধারণ করেছে ভিন্ন ভিন্ন। যেমন- পুরুষের সতরের সীমারেখা নাভীর উপর থেকে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত এবং নারীর ক্ষেত্রে সতর মুখমন্ডল, হাতের কব্জি এবং পায়ের পাতা ব্যতীত সর্বাঙ্গ। এ পার্থক্যের কারণ এই যে, নারীর প্রায় সর্বাঙ্গ স্পর্শকাতর। খোলামেলাভাবে সেদিকে পুরুষের দৃষ্টি নিপতিত হ’লে তাদের লালসা-কাতর হয়ে পড়া স্বাভাবিক। এটা আল্লাহ প্রদত্ত। তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই নারী এবং পুরুষের নির্ধারিত সতর আবৃত রাখার বিধান দিয়েছে ইসলাম। একেই সহজ কথায় বলা হয় পর্দা। আর এ পর্দা রক্ষার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের গৃহসমূহে অবস্থান করবে এবং পূর্বের মূর্খতার যুগের ন্যায় সাজ-সজ্জা করে ঘুরে বেড়াবে না’ (আহযাব ৩৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, দাইয়ুছ (যারা বেপর্দায় চলে এবং চালায়) জান্নাতে যাবে না (আল হাদীছ)

এক সময়ে আমাদের দেশে নারীদেরকে নাভী থেকে নিম্নোদর অনাবৃত রেখে শাড়ী পরতে দেখা গেছে। এই আধুনিক ফ্যাশনকে বলা হ’ত অজান্তা-স্টাইল। বস্ত্ততঃ এটা আধুনিকতা নয়, বরং আদিমতা। শোনা যায়, অজান্তা-ইলোরা-কোনারকের মন্দির গাত্রে প্রাচীন গুহাচিত্রের আদলে এই রকমের অর্ধনগ্ন নারী উৎকীর্ণ রয়েছে। তাই দেখে শাড়ী পরার এই স্টাইলটি এসেছে। প্রথমে এটা হিন্দু সমাজে প্রচলিত হয়। পরে মুসলমান সমাজেও প্রবিষ্ট হয়। বর্তমানে মুসলিম সমাজে এটা উচ্ছেদ হয়েছে নারীদের সালোয়ার-কামিজ ব্যবহারের ব্যাপকতার কারণে। তাতেও আবার দেখা যায় কামিজের গলা সামনে-পিছনে কিছুটা বেশি করে কাটা, যাতে বুক-পিঠের কিয়দংশ অনাবৃত থাকে। আবার সালোয়ারের নিচের দিকের জোড়ায় কিয়দংশ সেলাই বিহীন রাখা হয়, যাতে পায়ের নলার কিছু অংশ দেখানো যায়। নারীদের এই ধরনের পোষাক পরে পুরুষদের সামনে চলাফেরা করলে পুরুষের মানসিক অসুস্থতার কারণ ঘটে। দেখা যাচ্ছে, পুরুষদের চাইতে বরং নারীরাই শরীরের অধিকাংশ স্থান অনাবৃত রাখে। একেই বলবো, পর্দাহীনতা। এই পর্দাহীনতা নারীর পক্ষে তো ক্ষতিকর বটেই, পুরুষদের জন্যও ক্ষতির কারণ। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের দাবীতে আমাদের দেশের বিতর্কিত বেহায়া লেখিকা তসলিমা নাসরিন লিখেছে, ‘গরমের কারণে পুরুষ যদি গায়ের জামা খুলে ফেলতে পারে, নারী কেন পারবে না’। তসলিমা নাসরিনের জানবার কথা যে, অনাবৃত নারীর পুরুষ কর্তৃক উত্যক্ত হবার সম্ভাবনা থাকে, পুরুষের তা থাকে না।

পথে-ঘাটে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে পর্দাহীন নারীর অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। আর সর্বত্রই যে অল্পাধিক নারী নির্যাতন ঘটে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবু কেন নারীর পর্দাহীনতাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে? কেন পর্দাহীন নারীর দ্বারা পরিবেশ দূষণ ঘটানো হচ্ছে? এর ফলে পরিবার এবং সমাজ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীরাও। পর্দাহীনতার কুফল হিসাবে সম্প্রতি শুরু হয়ে ইভটিজিং। হাটে-ঘাটে পথে-প্রান্তরে বখাটে কর্তৃক ইভটিজিং বা উত্যক্তের শিকার হচ্ছে নারী। এর পরও আমাদের হুঁশ ফিরছে না।

টেলিভিশন বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার। এর দ্বারা মানুষ উপকার লাভ করছে। কিন্তু এর ক্ষতির দিকটাও একেবারে অল্প নয়। ডিস এন্টেনা সংযোগের ফলে স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্নমুখী অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলেও প্রায় প্রতিঘরে টেলিভিশন রয়েছে। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে যে, টেলিভিশন দেখার কোন সময় অসময় বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। ঘরে ঘরে টেলিভিশন চালানো হচ্ছে সকাল-দুপুর গভীর রাতে, ছালাতের ও আযানের সময়ে। হয়তো কোন বাড়ীতে এক ঘরে রোগাক্রান্ত অসুস্থ মানুষ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, অন্য ঘরে তখন ফুল পাওয়ারে টেলিভিশন চালানো হচ্ছে। হয়তো পাশের বাড়ীতে  কারো মৃত্যুতে কান্নার রোল, তখনও কোন বাড়ীতে টেলিভিশন চলছেই। টেলিভিশন আসক্তি মানুষকে কান্ডজ্ঞানহীন করে তুলেছে। টেলিভিশন ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, ধর্ম-কর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। বাড়াচ্ছে অশান্তি এবং বিশৃংখলা। হরণ করছে একে অন্যের অধিকার।

টেলিভিশনের পর্দায় যৌনাবেদনের দৃশ্য সম্বলিত নাচ-গান-অভিনয় দেখার সুযোগ রয়েছে। এ্যাডফিল্মে অর্ধ নগ্ন মহিলাদের অশালীন অঙ্গভঙ্গী দেখা যাচেছ। এসবের মাধ্যমে আমাদের তরুণ-তরুণীদের চরিত্র ধ্বংস হচ্ছে। এ জাতীয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান মানুষকে ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ ব্যভিচারকে নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না’ (বানী ইসরাঈল ৩২)। টেলিভিশনের এই অসুস্থ বিনোদন মানুষকে শুধু অধঃপতনের দিকেই অগ্রসর করাচ্ছে। বলতেই হবে যে, টেলিভিশন অধুনা সর্বনাশের সিঁড়িতে পরিণত হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষ এখন টেলিভিশনের প্রতি এতই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, তাদের হিতাহিত জ্ঞানের বিলুপ্তি ঘটেছে। এ যেন ভাসুর মানে না, শ্বশুর মানে না, এমনি অবস্থা। প্রতিকারের কোন উপায়ও নেই। কেননা টেলিভিশন ওয়ালারা তাদের নাগরিক অধিকার ভোগ করছে। তাদের কে থামাবে? তাই বাড়ীর মধ্যে গভীর রাতে টেলিভিশনে বিশ্বকাপের ফুটবল খেলায় গোল হ’তে দেখে ষাড়ের মতো কোরাসে চেঁচাতে সাহস পাচ্ছে। তারা জানে না যে, অপরের শান্তি ভঙ্গের কারণ ঘটিয়ে নাগরিক অধিকার ভোগ করা আইনসম্মত নয়।

মোবাইল ফোন একটি বিষ্ময়কর আবিষ্কার। এ থেকে মানুষ উপকৃত হচ্ছে টেলিভিশনের চাইতেও অধিক। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে যেকারো সঙ্গে যখন-তখন কথা বলা যায়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের কোন বিকল্প নেই। এটা সহজে বহনযোগ্য। হাতে কিংবা পকেটে রেখে যত্রতত্র যাওয়া যায়। এটি ব্যবহারের জন্য তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ সংযোগের আবশ্যক হয় না। এর দ্বারা ক্যালকুলেটর, ক্যামেরা, রেডিও-টেলিভিশনের কাজ চালানো সম্ভব। কিঞ্চিৎ কম্পিউটারের কাজও চলে। সম্প্রতি মোবাইল ফোন খুবই জনপ্রিয় এবং প্রায় সকলেই ব্যবহার করছে। চলার পথেও মানুষকে মোবাইল ফোনে গান শুনতে দেখা যাচ্ছে। মোবাইল ফোনের উপকারিতা যেমন অপরিসীম, ক্ষতির মাত্রাটাও তেমনি। এখানে ক্ষতির খতিয়ানটা উদ্ধৃত করছি- (১) মোবাইলে ব্লুফিল্মসহ আপত্তিকর ছবি দেখার সুযোগ আছে। (২) মোবাইলে কাউকে উত্যক্ত করা, হুমকী দেওয়া চলে। (৩) এর দ্বারা কাউকে প্রতারিত করা সহজ। (৪) মোবাইলের মাধ্যমে অশ্লীল আলোচনা এবং অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন সহজসাধ্য। (৫) নিষিদ্ধ কিংবা আপত্তিকর কাজে গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব।

মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঘটে যাওয়া অনেক দুর্ঘটনার কথা আমরা শুনতে পাই। যেমন- বখাটে লম্পট যুবকেরা মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কোন যুবতীর সঙ্গে আলাপ জমায়। হয়তো সেই যুবতী পূর্ব পরিচিতাও নয়। আলাপের এক পর্যায়ে ফোনের মাধ্যমে স্থান নির্ধারণ করে গোপনে সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়। অতঃপর ধর্ষণ, গণধর্ষণ, বেশ্যালয়ে বিক্রি, বিদেশে পাচার, এর যেকোন একটি ঘটে যেতে পারে। এরূপ যে হয়, এমন খবরও কখনও কখনও শোনা যায়।

আজকাল গ্রামে-গঞ্জেও বহু তরুণ-তরুণীর হাতে মোবাইল কোন দেখা যায়। অনেকে পড়াশুনা ফেলে রেখে ফোনালাপে মগণ থাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে নিষিদ্ধ ভালবাসা। তার ফলে পরিণামে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিকটা অনেক অভিভাবক ভেবে দেখে না। ছেলে-মেয়েরা আবদার করলেই একটা মোবাইল ফোন কিনে দেয়। মোবাইল ফোন পেয়ে ছেলে-মেয়ে তা কী কাজে ব্যবহার করে তার খোঁজ রাখে না কিংবা খোঁজ রাখার সুযোগ পায় না। ছেলে-মেয়েরা গোপনে  মোবাইল ফোনের অপব্যবহার করে চলে। এভাবেই নেমে আসে সামাজিক অবক্ষয়, চরিত্র হনন। পেয়ে যায় সর্বনাশের সিঁড়ি। তারা ধাপে ধাপে  এগিয়ে যেতে থাকে অনৈতিকতার দিকে। আমি বিজ্ঞান প্রযুক্তির আবিষ্কারকে নিন্দাবাদ করছি না। যা বলেছি তা তার ব্যাপক অপব্যবহারের দিকটা লক্ষ্য করেই বলেছি। দেখা যাচ্ছে, যা দ্বারা আমরা উপকৃত হই, তাই আবার ভয়ানক ক্ষতির কারণ ঘটায়। আমরাতো সবাই বস্ত্তর Merit নিয়ে তুষ্ট থাকি না, Demerit-কেও গ্রহণ করছি। তাই উপকারী বস্ত্ত থেকেও আমাদের সর্বনাশ হচ্ছে। এটাও ভেবে দেখা একান্ত আবশ্যক। অবশ্য প্রতিরোধ, প্রতিকারের বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে।

অন্য ধর্ম এবং সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে মুসলমানদের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। তাদের ধর্ম ইসলাম। এ ধর্ম আল্লাহ প্রেরিত অহি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা সুসংহত। আল্লাহ তা‘আলার কিতাব আল-কুরআনকে মানবজাতির সংবিধান হিসাবে আল্লাহ কর্তৃক প্রণীত এবং এটিই আল্লাহ তা‘আলার সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ আসমানী কিতাব। এই কিতাব আখেরী নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর  উপর নাযিল করা হয়েছে। এই কিতাবের বিধানাবলীকে বলা হয়, শরী‘আত। এ আইন বিধান পাওয়া যায় নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছ সমূহেও। অতএব মুসলমানকে অবশ্যই পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের বিধান অনুসারে জীবন যাপন করতে হবে। এই বিধানাবলী তাদের কাছে অলংঘনীয়। কুরআন পাকে আল্লাহ বলেন, ‘আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা সেই কিতাবের উপর ঈমান আনে, আর যারা এটা মানে না, তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (বাক্বারাহ ২/১২১)

কুরআন পাকে আরও বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে, তারাই লাঞ্ছিত হবে’ (মুজাদালা ২০)। আল্লাহ তাঁর কিতাবে আরও বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ্র কথা মান, রাসূলের অনুসরণ কর’ (মুহাম্মাদ ৩৩)। আল্লাহ তা‘আলার কিতাবেই নির্দেশ রয়েছে রাসূল (ছাঃ)-কে অনুসরণ করার এবং তাঁর কথা মানার। তাই  মুসলমানকে অবশ্যই কুরআন এবং হাদীছের বিধান পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। এই মেনে চলাকেই বলে ধর্ম পালন। মানুষের জন্যই ধর্মবিধি। ধর্মবিধির জন্য মানুষ নয়।

বর্তমান সময়ে মুসলমান সমাজে একদল মানুষ রয়েছে, তারা মুসলমান বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, অথচ তাদের মধ্যে মুসলমানিত্ব অনুপস্থিত। তাদের কাজে, কথায় প্রকাশ পায় ইসলামের বৈরিতা। এমনই এক নাদান বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। পত্রিকায় প্রকাশিত তার একটি কলামে লেখা হয়েছে, দেশের চোর, ডাকাত, খুনী, স্মাগলাররা, দেশের সন্ত্রাসীরা তাদের দিন শুরু করে  আল্লাহ দিয়ে। ইনশাআললাহ, মাশাল্লাহ সোবহানাল্লাহ্র ব্যাপক ব্যবহার দ্বারা, আর যাইহোক মানুষের কোন উপকার হয় না। নাদানেরা কখনো আল্লাহ্র নাম স্মরণের মর্তবা এবং উপকারিতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না। আর এ জন্যই তো তারা নাদান। এরা দিন রাত অশালীন অভিনয়, গান-বাজনা, নৃত্য, বাজে আলাপেই মত্ত থাকে। তাই তারাই সর্বক্ষণ টেলিভিশনের পর্দায় স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখে, রাত জেগে মোবাইল ফোনে চ্যাটিং করে কাটায়। এর ফায়দাটা যে কী, তা দ্বীনদার ঈমানদার মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে পৃথিবীতে শুধু রঙ-তামাসা করার জন্য সৃষ্টি করেননি। সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। আর সেকারণেই আল্লাহ্র নাম সর্বদা স্মরণ করা প্রয়োজন। তবু মানুষ গাফেল হয় এবং সর্বনাশের সিঁড়ি দিয়ে এগিয়ে যায় জাহান্নামের দিকে। মানুষকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য, মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহ্র কিতাবে এবং নবী (ছাঃ)-এর হাদীছে বহু নির্দেশনা এসেছে।

অতএব আসুন! আমরা উপরে বর্ণিত সর্বনাশের সিঁড়ি থেকে পরহেয করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন! আমীন!!

– মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান

মন্তব্য করুন

Back to top button