আকাইদ

ছাহাবায়ে কেরাম কি আমাদের আদর্শ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন?

ছাহাবায়ে কেরাম কি আমাদের আদর্শ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন?

উত্তর : মুসলমানদের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ হ’লেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মাদ (ছাঃ)।[1] অতঃপর দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী, ইসলামের জন্য জান-মাল উৎসর্গকারী নিবেদিতপ্রাণ ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)। তাঁদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,خَيْرُ أُمَّتِى الْقَرْنُ الَّذِينَ يَلُونِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ‘আমার যুগ হ’ল শ্রেষ্ঠ যুগ। অতঃপর তার পরের যুগ, অতঃপর তার পরের যুগ’।[2]

তাছাড়া তাঁদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন,

مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُوْنَ فَضْلًا مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا سِيْمَاهُمْ فِيْ وُجُوْهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُوْدِ

‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সাথীগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পরে সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকূ ও সিজদারত দেখবে। তাদের চেহারায় রয়েছে সিজদার চিহ্ন’ (ফাতহ ৪৮/২৯)। তাঁদের এই প্রশংসাবাণী কুরআন সহ অন্যান্য আসমানী কিতাবেও ঘোষিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ উক্ত আয়াতের শেষাংশে বলেন,

ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيْلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوْقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيْظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ وَعَدَ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيْمًا-

‘তাওরাতে তাঁদের উদাহরণ এরূপ। আর ইঞ্জীলে তাঁদের উদাহরণ হচ্ছে একটি শস্যবীজের মত, যা থেকে উদগত হয় অঙ্কুর, অতঃপর তা শক্ত ও মযবূত হয় এবং কান্ডের উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়। এটা কৃষকদের আনন্দে অভিভূত করে। কিন্তু আল্লাহ তাঁদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। তাঁদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাঁদেরকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন’ (ফাতহ ৪৮/২৯)

ছাহাবীগণের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ تَسُبُّوْا أَصْحَابِىْ، فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيْفَهُ ‘তোমরা আমার ছাহাবীগণকে গালি দিয়োনা। কেননা তোমাদের কেউ যদি ওহোদ পর্বত পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তা তাদের এক মুদ (৬২৫ গ্রাম) বা অর্ধ মুদ-এর সমপরিমাণ হবে না’।[3]

ছাহাবীগণের সম্মান ও মর্যাদার কথা কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বহু জায়গায় বিধৃত হয়েছে। তাই বলে তাঁদের মর্যাদা বাড়াতে গিয়ে এবং তাঁদেরকে আমাদের ‘আদর্শ’ প্রমাণ করতে গিয়ে কোনরূপ জাল ও বানোয়াট হাদীছ বর্ণনা করার কোন প্রয়োজন নেই। যদিও অনেক মাযহাবী ভাই উক্ত বিষয়ে নিমেণাক্ত মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীছ ২টি সমাজে প্রচার করে থাকেন, সে দু’টি নিম্নে পেশ করা হ’ল।-

(১) إِنَّمَا أَصْحَابِيْ مِثْلَ النَّجُوْمُ فَأّيِّهِمْ أَخَذْتُمْ بِقَوْلِهِ اِهْتَدَيَتُمْ  ‘আমার ছাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য। অতএব তোমরা তাদের যে কারু কথা মানবে, সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে’। হাদীছটি মওযূ বা জাল।[4]

(২) أَهْلُ بَيْتِي كَالنُّجُوْمِ، بِأَيِّهِمْ اِقْتَدَيْتُمْ اِهْتِدَيْتُمْ ‘আমার পরিবারের সদস্যগণ নক্ষত্রতুল্য। তোমরা তাদের যে কারু অনুসরণ করলে সঠিক পথ পাবে’। এ হাদীছটিও মওযূ বা জাল।[5]

ছাহাবায়ে কেরামের আদর্শ অনুসরণীয় :

যেসব বিষয়ে হাদীছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেসব ক্ষেত্রে ছাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ-  ‘তোমাদের উপর অপরিহার্য হ’ল আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরা। তোমরা সেগুলি মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধর’।[6] তবে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের বিপরীতে ছাহাবীগণের বক্তব্য অনুসরণীয় নয়।

ছাহাবীগণের আদর্শের কিছু দৃষ্টান্ত :

ছাহাবীগণের আদর্শের অনেক দৃষ্টান্ত পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে উল্লিখিত হয়েছে। নিম্নে তাদের কিছু নমুনা প্রদত্ত হ’ল।-

(১) ছাহাবীগণ ‘হায়াতুন্নবী’তে বিশ্বাসী ছিলেন না :

ছাহাবীগণ ‘হায়াতুন্নবী’ তথা নবী করীম (ছাঃ) এখনো জীবিত আছেন এবং মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন এমন ভ্রান্ত আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিলেন না। যার বাস্তব প্রমাণ নিম্নোক্ত হাদীছটি। নবী করীম (ছাঃ)-এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর যখন মৃত্যু হয়, তখন আবুবকর (রাঃ) সুনহ-এ ছিলেন। ইসমাঈল (রাঃ) বলেন, ‘সুনহ’ মদীনার উঁচু এলাকার একটি স্থানের নাম। ওমর (রাঃ) দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু হয়নি। আয়েশা (রাঃ) বলেন, ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! তখন আমার অন্তরে এ বিশ্বাসই ছিল যে, আল্লাহ অবশ্যই তাঁকে পুনরায় জীবিত করবেন এবং তিনি কিছু সংখ্যক লোকের হাত-পা কেটে ফেলবেন। অতঃপর আবুবকর (রাঃ) আসলেন এবং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা হ’তে আবরণ সরিয়ে তাঁর কপালে চুম্বন করলেন এবং বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার উপর কুরবান হৌক। আপনি জীবনে-মরণে পবিত্র। ঐ সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! আল্লাহ আপনাকে কখনও দু’বার মৃত্যু আস্বাদন করাবেন না। অতঃপর তিনি বেরিয়ে আসলেন এবং বললেন, হে হলফকারী! ধৈর্য অবলম্বন কর। আবুবকর (রাঃ) যখন কথা বলতে লাগলেন, তখন ওমর (রাঃ) বসে পড়লেন। আবুবকর (রাঃ) আল্লাহ তা‘আলার হাম্দ ও ছানা বর্ণনা করে বললেন, যারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ইবাদতকারী ছিলে তারা জেনে রাখ, মুহাম্মাদ (ছাঃ) মারা গেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে তারা নিশ্চিত জেনে রাখ আল্লাহ চিরঞ্জীব, তিনি অমর। অতঃপর আবুবকর (রাঃ) এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি মরণশীল আর তারা সকলেই মরণশীল’ (যুমার ৩৯/৩০)। আরো তিলাওয়াত করলেন, ‘আর মুহাম্মাদ একজন রাসূল বৈ কিছুই নয়। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল বিগত হয়েছে। এক্ষণে যদি সে মৃত্যুবরণ করে অথবা নিহত হয়, তাহ’লে তোমরা কি পশ্চাদপসরণ করবে? বস্ত্ততঃ যদি কেউ পশ্চাদপসরণ করে, সে আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ সত্বর তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাদের পুরস্কৃত করবেন’ (আলে ইমরান ৩/১৪৪)। রাবী বলেন, আবুবকর (রাঃ)-এর এ কথাগুলি শুনে সবাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন’।

অতঃপর আবুবকর (রাঃ) কুরআন থেকে তেলাওয়াত করলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মরণশীল এবং তারাও সকলে মরণশীল’ (যুমার ৩৯/৩০)[7]

আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর উপরোক্ত বক্তব্য থেকে বুঝা গেল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘হায়াতুন্নবী’ তথা চির অমর বলে বিশ্বাস করা শিরক। কেননা আল্লাহ ব্যতীত সকল প্রাণীই মৃত্যুবরণ করবে। সম্মানিত প্রশ্নকারী ও মাযহাবী ভাইয়েরা আবুবকর (রাঃ)-এর এ আদর্শকে আপনারা মানেন কি?

(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শরী‘আতে কোনরূপ হরাস-বৃদ্ধি করা যাবে না :

ছাহাবায়ে কেরামকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেভাবে শরী‘আত শিক্ষা দিতেন, তাঁরা তাতে কোন হরাস-বৃদ্ধি করতেন না।

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ‘এক বেদুইন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলুন, যদি আমি তা সম্পাদন করি তবে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর ইবাদত করবে, আর তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না। ফরয ছালাত আদায় করবে, ফরয যাকাত প্রদান করবে এবং রামাযান মাসে ছিয়াম পালন করবে। সে বলল, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তাঁর শপথ করে বলছি, আমি এর চেয়ে বেশী করব না, কমও করব না। যখন সে ফিরে গেল, তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি কোন জান্নাতী লোককে দেখতে পসন্দ করে সে যেন এই ব্যক্তিকে দেখে’।[8]

উক্ত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যদিও ইসলামের সকল বিধি-বিধানের কথা উল্লেখ করেননি, তবুও ঐ ছাহাবীকে দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন তার এ স্বীকৃতির কারণে যে, ‘আপনি আমাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাতে সামান্যতম হরাস-বৃদ্ধি করব না’। এ হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জান্নাতী হওয়ার মূলনীতি হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনীত শরী‘আতে সামান্যতম হরাস-বৃদ্ধি না করা।

এবার মাযহাবী ভাইদের প্রতি সবিনয় জিজ্ঞাসা, আপনারা ছালাত-ছিয়াম সহ ইবাদতে নাওয়াইতুআন…. এমন গৎবাঁধা নিয়ত, দরূদে ইবরাহীমী ব্যতীত অন্যান্য দরূদ যেমন ইয়া নবী সালামু আলাইকা, দরূদে হাযারী, দরূদে গঞ্জে আরশ, জালালী খতম, আম্বিয়া খতম, কুলখানী, চেহলাম, চল্লিশাসহ এমন বহু কিছু ইসলামী শরী‘আতে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। এবার আপনারাই বলুন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত উক্ত ছাহাবীকে আপনারা ‘আদর্শ’ হিসাবে গ্রহণ করেছেন কি? যদি গ্রহণ করতে পারতেন তাহলে এরকম বানাওয়াট আমল থেকে বিরত থাকতে পারতেন।

(৩) উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া ছাহাবীগণ কারো হাদীছ গ্রহণ করতেন না :

প্রত্যেক ছাহাবী ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও এক ছাহাবী অন্য ছাহাবীর নিকট থেকে উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া হাদীছ গ্রহণ করতেন না। নিম্নোক্ত হাদীছটি তার প্রমাণ।

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি আনছারদের এক মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ আবূ মূসা (রাঃ) ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এসে বললেন, আমি তিনবার ওমর (রাঃ)-এর নিকট অনুমতি চাইলাম, কিন্তু আমাকে অনুমতি দেওয়া হ’ল না। তাই আমি ফিরে এলাম। ওমর (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে ভেতরে প্রবেশ করতে কিসে বাধা দিল? আমি বললাম, আমি প্রবেশের জন্য তিনবার অনুমতি চাইলাম, কিন্তু আমাকে অনুমতি দেওয়া হ’ল না। তাই আমি ফিরে এলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যদি তোমাদের কেউ তিনবার প্রবেশের অনুমতি চায়। কিন্তু তাতে অনুমতি দেওয়া না হয়, তবে সে যেন ফিরে যায়’। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! তোমাকে এ কথার উপর অবশ্যই দলীল পেশ করতে হবে। তিনি সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মাঝে কেউ আছে কি যে নবী করীম (ছাঃ) থেকে এ হাদীছ শুনেছে? তখন উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আপনার কাছে প্রমাণ দিতে দলের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তিই উঠে দাঁড়াবে। আর আমি দলের সর্বকনিষ্ঠ ছিলাম। সুতরাং আমি তাঁর সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, নবী করীম (ছাঃ) অবশ্যই এ কথা বলেছেন’।[9]

উল্লিখিত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ওমর (রাঃ) আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর ন্যায় একজন ন্যায়পরায়ণ, বিশ্বস্ত ও জলীলুল ক্বদর ছাহাবীর নিকট থেকে প্রমাণ ব্যতীত হাদীছ গ্রহণ করেননি। এবার মাযহাবী ভাইদের নিকট সবিনয় প্রশ্ন, আপনারা কি ওমর (রাঃ)-কে এ ব্যাপারে ‘আদর্শ’ হিসাবে মানেন? তাঁকে আদর্শ হিসাবে মানলে তো আর অন্যের তাক্বলীদ করতেন না। কেননা ‘তাক্বলীদ’ মানেই তো অন্যের কথা বিনা দলীলে গ্রহণ করা’।[10]

(৪) সন্দিগ্ধ বিষয়ে ছাহাবীগণ নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী কোন সিদ্ধান্ত নিতেন না :

কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ জানা না থাকলে ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুমোদন ব্যতীত কোন কাজ করতেন না।

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের কয়েকজন আরবের এক গোত্রের নিকট আসলেন। গোত্রের লোকেরা তাদের কোন আতিথেয়তা করল না। তারা সেখানে থাকতেই হঠাৎ সেই গোত্রের নেতাকে সাপ দংশন করল। তখন তারা এসে বলল, আপনাদের কাছে কি কোন ঔষধ আছে কিংবা আপনাদের মধ্যে ঝাড়-ফুঁককারী কেউ আছেন কি? তারা বললেন, তোমরা আমাদের কোন আতিথেয়তা করোনি। কাজেই আমাদের জন্য কোন পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট না করা পর্যন্ত আমরা তা করব না। ফলে তারা তাদের জন্য এক পাল বকরী পারিশ্রমিক নির্ধারণ করল। তখন একজন ছাহাবী উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পড়তে লাগলেন এবং দংশিত স্থানে থুথু দিলেন। ফলে সে আরোগ্য লাভ করল। এরপর তাঁরা বকরীগুলো নিয়ে এসে বলল, আমরা নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করার পূর্বে এটি স্পর্শ করব না। এরপর তাঁরা মদীনায় এসে এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূল (ছাঃ) শুনে হাসলেন এবং বললেন, তোমরা কিভাবে জানলে যে, এটি রোগ সারায়? ঠিক আছে বকরীগুলো নিয়ে যাও এবং তাতে আমার জন্যও এক ভাগ রেখে দিয়ো’।[11]

উক্ত হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঝাড়-ফুঁক করে বিনিময় গ্রহণ করা যাবে কি-না এ ব্যাপারে ছাহাবীগণের জানা ছিল না বিধায় তাঁরা নিজ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি; বরং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে সিদ্ধান্ত জানার পর তারা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করেছেন। তাহ’লে আমরা কিভাবে হাদীছ না জেনে বা না মেনে অন্যের কথা বিনা দলীলে গ্রহণ করতে পারি?

(৫) ছাহাবীগণ ছিলেন পরস্পর দয়ার্দ্র ও কাফিরদের প্রতি কঠোর :

আল্লাহ বলেন,مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ- ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সাথীগণ কাফেরদের প্রতি বজ্রকঠিন, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল’ (ফাৎহ ৪৮/২৯)

(৬) ছাহাবীগণের আক্বীদা ছিল ‘আল্লাহ আরশের উপর আছেন’ :

আল্লাহ নিরাকার নন। বরং তাঁর নিজস্ব আকার আছে। যেমনটি তাঁর উপযুক্ত। তিনি সাত আসমানের উপরে আরশে সমুন্নীত, প্রত্যেক ছাহাবীর এই আক্বীদা ছিল।

মু‘আবিয়া বিন হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমার একজন দাসী ছিল। ওহোদ ও জাওয়ানিইয়াহ নামক স্থানে সে আমার ছাগল চরাত। একদিন দেখি, নেকড়ে আমাদের একটি ছাগল ধরে নিয়ে গেছে। আমি একজন আদম সন্তান (সাধারণ মানুষ), তারা যেভাবে ক্রুদ্ধ হয় আমিও সেভাবে ক্রুদ্ধ হই। আমি তাকে একটা থাপ্পড় মারি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসলে তিনি এটাকে গর্হিত কাজ বলে অভিহিত করলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি কি তাকে আযাদ করে দেব না? তিনি বললেন, তাকে আমার নিকট নিয়ে এস। আমি তাকে আল্ল­াহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্ল­াহ কোথায়? সে বলল, আসমানে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? তখন সে বলল, আপনি আল্ল­াহর রাসূল (ছাঃ)। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও, কারণ সে একজন ঈমানদার নারী’।[12]

উল্লিখিত হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে,  আল্লাহ তা‘আলা আসমানে আছেন এমনই ছিল ছাহাবীদের আক্বীদা। কিন্তু দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, মুক্বাল্লিদ ভাইদের আক্বীদা হ’ল আল্লাহ নিরাকার এবং তিনি সর্বত্র বিরাজমান। অথচ তাদের অনুসরণীয় ইমাম আবু হানীফা (রাঃ)-এর আক্বীদা ছিল আল্লাহ নিরাকার নন এবং সর্বত্র বিরাজমান নন, তিনি আসমানের উপরে আরশে অবস্থান করেন। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন,من قال لا أعرف ربي في السماء أم في الأرض فقد كفر لأن الله تعالى يقول الرحمن على العرش استوى وعرشه فوق سبع سموات. ‘যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন না যমীনে তা আমি জানি না, সে কুফরী করবে। কেননা আল্লাহ বলেন, রহমান আরশে সমুন্নীত। আর তার আরশ সপ্ত আকাশের উপর।[13] তিনি আরো বলেন,من قال لا أعرف ربي في السماء أو في الأرض فقد كفر وكذا من قال إنه على العرش ولا أدري العرش أفي السماء أو في الأرض والله تعالى يدعى من أعلى لا من أسفل ليس من وصف الربوبية والألوهية في شيء. ‘যে বলবে যে, আল্লাহ আসমানে আছেন না যমীনে আছেন তা আমি জানি না, সে কুফরী করবে। অনুরূপভাবে যে বলবে যে, তিনি আরশে আছেন। কিন্তু আরশ আকাশে না যমীনে, আমি তা জানি না, সেও কুফরী করবে। কেননা উপরে থাকার জন্যই আল্লাহকে ডাকা হয়; নীচে থাকার জন্য নয়। আর নীচে থাকাটা আল্লাহর রুবূবিয়াত এবং উলূহিয়াতের গুণের কিছুই নয়’।[14]

এবার  জবাব দিন, আপনাদের এ ভ্রান্ত আক্বীদার উদ্ভাবক কে? আপনারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম এমনকি আপনাদের অনুসরণীয় ইমামকেও তো মানেন না। তাহ’লে আপনারা কোন শ্রেণীর মুসলমান?

মোটকথা যে সকল বিষয়ে কুরআন ও হাদীছে রাসূল (ছাঃ)-এর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা নেই, সে সকল বিষ য়ে

ছাহাবীদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে ছাহাবায়ে কেরামের মর্যাদানুসারে তাদেরকে মান্য করতে হবে। ছাহাবীদের সর্বোত্তম ব্যক্তি হ’লেন আবুবকর (রাঃ)। অতঃপর ওমর (রাঃ), অতঃপর ওছমান (রাঃ), অতঃপর আলী (রাঃ)।[15] অতঃপর আশারায়ে মুবাশশারার বাকী ৬ জন।[16] অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরিবারবর্গ।[17] অতঃপর বদরী ছাহাবীগণ।[18] অতঃপর বাইয়াতে রিযওয়ানে অংশগ্রহণকারী ছাহাবীবর্গ (ফাৎহ ৪৮/১৮)। অতঃপর মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইসলামের জন্য ব্যয়কারী ও জিহাদকারী ছাহাবীগণ। সর্বশেষ মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের জন্য ব্যয়কারী ও জিহাদকারী ছাহাবী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لاَ يَسْتَوِيْ مِنْكُمْ مَنْ أَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُولَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِنَ الَّذِينَ أَنْفَقُوْا مِنْ بَعْدُ وَقَاتَلُوْا وَكُلاًّ وَعَدَ اللهُ الْحُسْنَى وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْر- ‘তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে, তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়; তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের অপেক্ষা যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তোমরা যা কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’ (হাদীদ ৫৭/১০)

অতএব ছাহাবায়ে কেরামের আদর্শ অনুসরণ করা যাবে যদি তা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের পরিপন্থী না হয় এবং তা ছহীহ সূত্রে আমাদের নিকটে পৌঁছে। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন-আমীন!

– কামরুযযামান বিন আব্দুল বারী



[1]. সূরা আহযাব ৩৩/২১; কলম ৬৮/৪; মুসনাদে আহমাদ হা/২৫৩৪১; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৮১১।

[2]. মুসলিম হা/২৫৩৩; বুখারী হা/৩৬৫১, ২৬৫২ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।

[3]. বুখারী, হা/৩৬৭৩, ‘ছাহাবীদের মর্যাদা’ অধ্যায়; আ.প্র. ৩৩৯৮, ই.ফা. ৩৪০৫; মুসলিম হা/২৫৪০।

[4]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬১।

[5]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬২।

[6]. নাসাঈ হা/১৫৭৯; মিশকাত হা/১৬৫, সনদ হাসান।

[7]. বুখারী হা/৩৬৬৭-৬৮, ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায়।

[8]. বুখারী হা/১৩৯৭।

[9]. বুখারী হা/৬২৪৫, ২০৬২ ‘অনুমতি প্রার্থনা’ অধ্যায়, ‘তিনবার সালাম দেয়া ও অনুমতি চাওয়া’ অনুচ্ছেদ; মুসলিম হা/২১৫৩; মুসনাদে আহমাদ হা/১৯৬৩০।

[10]. জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত, পৃঃ ৬৪।

[11]. বুখারী হা/৫৭৩৬, ২২৭৬ ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়, ‘সূরা ফাতিহা দ্বারা ঝাড়-ফুঁক দেওয়া’ অনুচ্ছেদ, আ.প্র. ৫৩১৬, ই.ফা. ৫২১২।

[12]. মুসলিম হা/৫৩৭ ‘মসজিদ সমূহ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অনুচ্ছেদ।

[13]. ইজতিমাউল জুয়ূশিল ইসলামিয়াহ, পৃঃ ৯৯।

[14]. ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিক্বহুল আবসাত, পৃঃ ৫১।

[15]. বুখারী হা/৩৬৫৫, ৩৬৯৭, ৩৬৭১, ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায়, ‘নবী (ছাঃ)-এর পরেই আবুবকর (রাঃ)-এর মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ; ইমাম ছাবুনী, আক্বীদাতুস সালাফ, পৃঃ ৮৬।

[16]. তিরমিযী হা/৩৭৪৭; ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৬১০৯।

[17]. মুসলিম হা/২৪০৮; মিশকাত হা/৬১৩১ ‘রাসূল পরিবারের মর্যাদা’ অধ্যায়।

[18]. বুখারী হা/৩৯৮৩ ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘বদরী ছাহাবীদের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button