লজ্জাশীলতা উত্তম চরিত্রের ভূষণ
উত্তম চরিত্র মানব জীবনের অতি মূল্যবান সম্পদ, যাকে মানব জীবনের ভূষণ বলেও অভিহিত করা যায়। আর উত্তম চরিত্রের ভূষণ হচ্ছে লজ্জাশীলতা বা লাজুকতা। যে কাজ করলে জনসমক্ষে মস্তক অবনত হ’তে পারে ঐ ভয়ে তা পরিহার করা বা তা থেকে বিরত থাকার নাম ‘হায়া’ বা লজ্জা। এই লজ্জা মানুষকে গর্হিত, অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। ফলে মানুষ উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যার লজ্জা নেই, কোন কাজ করতে তার বিবেক বাধা দেয় না। মন যা চায় তাই সে করে যায় দ্বিধাহীনচিত্তে। এ কারণে সমাজে সে হয় নিন্দিত, ঘৃণিত। সুতরাং উত্তম চরিত্রের অন্যতম গুণ লজ্জা সম্পর্কে এই নিবন্ধে আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ।
লজ্জাশীতার পরিচয় ও প্রকারভেদ:
লজ্জা হচ্ছে মানুষের মধ্যকার এমন পরিবর্তন, যা ঘৃণিত ও অপমান-অপদস্ত হওয়ার ভয়ে সংঘটিত হয়। পারিভাষিক অর্থে লজ্জাশীলতা হচ্ছে خلق يبعث على اجتناب القبيح من الأفعال والأقوال ويمنع من التقصير في حق ذي الحق. ‘মানবীয় এমন চরিত্র, যা নিকৃষ্ট, কদর্য কথা ও কর্ম পরিহারে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে এবং যথাযোগ্য হক্বদারকে অবহেলা ও উপেক্ষা করতে বাধা প্রদান করে’। অর্থাৎ প্রাপকের প্রাপ্য যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে বাধ্য করে।[1] আবুল কাসেম আল-জুনায়েদ বলেন, الحياء رؤية الآلاء أى النعم ورؤية التقصير، فيتولد بينهما حالة تسمى حياء ‘লজ্জাশীলতা হ’ল আল্লাহর অপরিসীম দয়া, অনুগ্রহ ও ইহসানের প্রতি লক্ষ্য করা এবং নিজের ত্রুটি ও অক্ষমতা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করা। এ উভয়বিদ চিন্তার ফলে মানসপটে যে ভাবের উদয় হয়, তাকেই বলা হয় লজ্জাশীলতা’।[2] আল্লামা রাগিব আল-ইছফাহানী বলেন, انقباض النفس عن القبائح وتركه ‘খারাপ কাজ থেকে নফসকে বিরত রাখা ও তা পরিত্যাগ করা’।[3]
লজ্জা দুই প্রকার। যথা- ১. জন্মগত ও স্বভাব সুলভ লজ্জা, যা অর্জিত নয়। এটা এক মহৎ চরিত্র যা আল্লাহ মানুষকে দান করে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেন। যেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَلْحَيَاءُ لاَيَأْتِى إِلاَّبِخَيْرٍ ‘লজ্জাশীলতা কল্যাণই আনয়ন করে’।[4] এটা মানুষকে মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখে এবং চারিত্রিক হীনতা ও নীচতা হ’তে বাধা দেয়। আর উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং এদিক থেকে এটা ঈমানের একটা বৈশিষ্ট্য। ওমর (রাঃ) বলেন, من استحيى اختفى ومن اختفى اتقى ومن اتقى وقى ‘যে লজ্জা করল সে আড়ালে গেল। যে আড়ালে গেল সে আত্মরক্ষা করল। আর যে আত্মরক্ষা করল সে বেঁচে গেল, পরিত্রাণ পেল’। আল-জাররাহ ইবনু আব্দুল্লাহ আল-হাকিমী বলেন, تركت الذنوب حياء أربعين سنة ثم أدركنى الورع، ‘লজ্জায় চল্লিশ বছর যাবৎ পাপকর্ম, গোনাহ পরিহার করেছি। অতঃপর আমি আল্লাহভীতি অর্জন করেছি’। কেউ কেউ বলেন, رأيت المعاصى نذالت فتركتها مروءت، فاسحالت ديانة ‘আমি পাপকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছি। অতঃপর তা লোক দেখানোর জন্য পরিহার করেছি। এতে ধার্মিকতা অর্জন অসাধ্য হয়ে গেছে’।[5]
২. অর্জিত লজ্জা; আল্লাহর পরিচয় ও তাঁর মহত্ত্ব, বান্দার নিকটবর্তী হওয়া, বান্দাদেরকে ও তাদের কাজ-কর্ম দেখা, দৃষ্টির অবাধ্যতা ও অন্তরের গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে তাঁর অবগতি প্রভৃতি জানার মাধ্যমে যে লজ্জা অর্জিত হয়। এটা হচ্ছে ঈমানের উচ্চ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি; বরং এটা হচ্ছে সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠতর গুণ বা বদান্যতা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনৈক লোককে উদ্দেশ্য করে বলেন, اِسْتَحِى مِنَ اللهِ كَمَا تَسْتَحِى رَجُلاً مِنْ صَالِحِ عَشِيْرَتِكَ ‘আল্লাহ্কে অনুরূপ লজ্জা কর যেমন কোন লোক যথাযোগ্য স্বজন থেকে লজ্জা করে’।[6]
লজ্জাশীলতার গুরুত্ব :
লাজুকতা মানব চরিত্রের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। গর্হিত ও অশোভন কর্ম পরিহারে এবং উত্তম ও শোভনীয় কার্যাবলী সম্পাদনে লজ্জাশীলতা সহায়তা করে। বিশেষ করে মানুষকে উত্তম চরিত্রে ভূষিত হওয়ার জন্য লজ্জাশীলতা নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। তাই মানব জীবনে লাজুকতার গুরুত্ব অত্যধিক। নিম্নে লজ্জাশীলতার গুরুত্বের বিভিন্ন দিক উল্লিখিত হ’ল।-
লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ :
ঈমান আনয়নের পরে একজন মানুষের উপরে আবশ্যক হ’ল শরী‘আতের বিধি-বিধান পালন করা। শরী‘আতের হুকুম-আহকাম পালনে এবং ইসলাম গর্হিত কাজ বর্জনে লজ্জাশীলতা বিশেষ সহায়ক। এজন্য লাজুকতাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈমানের অঙ্গ বলে ঘোষণা করেছেন। এ মর্মে হাদীছে এসেছে-
عن ابن عمر أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَرَّ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْأَنْصَارِ وَهُوَ يَعِظُ أَخَاهُ فِى الْحَيَاءِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَعْهُ فَإِنَّ الْحَيَاءَ مِنَ الْإِيْمَانِ-
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক আনছার ব্যক্তির নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তখন সে তার ভাইকে লজ্জা করার ব্যাপারে উপদেশ দিচ্ছিল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও। কেননা লজ্জা হ’ল ঈমানের অঙ্গ’।[7]
অপর একটি হাদীছে এসেছে,
عن أبى هريرة قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه وسلم اَلْإِيْمَانُ بِضْعٌ وَ سَبْعُوْنَ شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الْأَذَى عَنِ الطَّرِيْقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِّنَ الْإِيْمَانِ-
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম হ’ল ‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই’ একথা বলা এবং সর্বনিম্ন স্তর হ’ল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরানো। আর লজ্জা হ’ল ঈমানের একটি শাখা’।[8]
লাজুকতা ঈমানের অঙ্গ হ’লেও এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটা ঈমানের জন্য অতীব যরূরী। এই অঙ্গটি যদি না থাকে তাহ’লে অন্য অঙ্গও তিরোহিত হয়ে যায়। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عن ابن عمر رضى قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه وسلم اَلْحَيَاءُ وَالْإِيْمَانُ قَرْنَاءَ جَمِيْعًا فَإِذَا رُفِعَ أَحَدُهُمَا رُفِعَ الْآخَرُ-
ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘লজ্জা ও ঈমান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সুতরাং এর একটি তুলে নেয়া হ’লে অপরটিও তুলে নেয়া হয়’। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-এর এক বর্ণনায় আছে ‘যখন উভয়ের কোন একটিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়, তখন অপরটিও তার পশ্চাতে অনুগমন করে’।[9]
عن ابى أُمَامَةَ عِنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَال: اَلْحَيَاءُ وَ الْعِىُّ شُعْبَتَانِ مِنَ الْإِيْمَانِ، وَالْبَذَاءُ وَالْبَيَانُ شُعْبَتَانِ مِنَ النِّفَاقِ-
আবু উমামা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘লজ্জা ও অল্প কথা বলা ঈমানের দু’টি শাখা। আর অশ্লীলতা ও বাকপটুতা (বাচালতা) মুনাফিকীর দু’টি শাখা’।[10]
লাজুকতা দ্বীনের বিশেষ প্রকৃতি :
লজ্জাশীলতা ইসলামের এক বিশেষ অনুষঙ্গ। যাকে দ্বীনের বিশেষ স্বভাব বা প্রকৃতি বলা হয়েছে। এটা কারো মাঝে থাকলে সে দ্বীনী কাজে নিরন্তর উৎসাহ-উদ্দীপনা অনুভব করে, তেমনি এর অভাব কারো মাঝে থাকলে সে দ্বীন বহির্ভূত কাজ তথা অশ্লীল অপকর্ম করতে কুণ্ঠিত হয় না। এ মর্মে হাদীছে এসেছে,
عن زيد بن طلحة قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه وسلم اِنَّ لِكُلِّ دِيْنٍ خُلُقًا وَخُلُقُ الْإِسْلاَمِ اَلْحَيَاءُ-
যায়েদ ইবনু তালহা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক দ্বীনের একটি বিশেষ স্বভাব আছে। আর দ্বীন ইসলামের বিশেষ স্বভাব হ’ল লজ্জাশীলতা’।[11]
লজ্জাশীলতা কল্যাণ আনয়ন করে :
সৎ চরিত্রের অন্যতম গুণ লাজুকতা পুণ্য ও কল্যাণ আনয়ন করে। এ মর্মে একটি হাদীছে এসেছে,
عن عمران بن حصين قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه وسلم اَلْحَيَاءُ لاَ يَأْتِى إِلاَّ بِخَيْرٍ وَفِى رِوَايَةٍ اَلْحَيَاءُ خَيْرٌ كُلُّهُ-
ইমরান ইবনু হুছাইন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘লজ্জাশীলতা পুণ্য ও কল্যাণ ব্যতীত আর কিছুই আনয়ন করে না’। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘লজ্জার সর্বাংশই উত্তম’।[12]
عن أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَاكَانَ الْفُحْشُ فِىْ شَيْءٍ إلاَّ شَانَهُ وَمَاكَانَ الْحَيَاءُ فِىْ شَىْءٍ إِلاَّ زَانَهُ-
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নির্লজ্জতা কোন জিনিসের মধ্যে থাকলে তাকে ত্রুটিপূর্ণ করে। আর লাজুকতা কোন জিনিসের মধ্যে থাকলে তার শ্রী বৃদ্ধি করে’।[13]
লজ্জার কারণে মানুষ অনেক গর্হিত ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে। ফলে সে সমাজে নন্দিত হয়, প্রশংসিত হয়। সবার নিকটে সে প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে নির্লজ্জ মানুষ পাপ-পুণ্য, ভাল-মন্দের পার্থক্য করে না। বিধায় সে সমাজে হয় নিন্দিত, ঘৃণিত, ধিক্কৃত। মানুষের নিকটে সে অপ্রিয় হয়। এজন্য নিম্নোক্ত হাদীছে লজ্জাশীলতা ও লজ্জাহীনতার পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে এভাবে,
قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه وسلم يَا عَائِشَةُ لَوْكَانَ الْحَيَاءُ رَجُلاً كَانَ رَجُلاً صَالِحًا وَ لَوْكَانَ الْفُحْشُ رَجُلاً لَكَانَ رُجُلٌ سُوْءٌ-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘হে আয়েশা! লজ্জা যদি কোন লোক হয় তাহ’লে সে হবে সৎ ব্যক্তি। আর অশ্লীলতা (লজ্জাহীনতা) কোন লোক হ’লে নিশ্চয়ই সে হবে নিকৃষ্ট লোক’।[14]
সালমান ফারসী (রাঃ) বলেন,
إنَّ الله إذا أرادَ بعبدٍ هلاكًا، نَزَعَ منه الحياءَ، فإذا نزع منه الحياء، لم تلقه إلاَّ مقيتًا مُمَقَّتًا، فإذا كان مقيتًا ممقتًا، نزع منه الأمانةَ، فلم تلقه إلا خائنًا مخوَّنًا، فإذا كان خائنًا مخونًا، نزع منه الرحمة، فلم تلقه إلافظًا غليظًا، فإذا كان فظًا غليظًا، نزع رِبْقَ الإِيمان من عنقه، فإِذا نزع رِبْقَ الإيمان من عنقه لم تلقه إلا شيطانًا لعينًا ملعنًا-
আল্লাহ কোন বান্দার ধ্বংস চাইলে তার থেকে লজ্জা ছিনিয়ে নেন। তার থেকে লজ্জা ছিনিয়ে নেয়া হ’লে সে হয় বিদ্বেষপরায়ণ। বিদ্বেষ পরায়ণ হ’লে তার থেকে আমানতদারিতা তুলে নেয়া হয়। আমানতদারিতা তুলে নেয়া হ’লে সে খিয়ানতকারী হয়। খিয়ানতকারী হ’লে তার থেকে রহমত তুলে নেয়া হয়, ফলে সে কঠোরতা ও নির্দয়তা লাভ করে। নিষ্ঠুর-নির্দয় হ’লে তার থেকে ঈমানের রশি খুলে নেয়া হয়। আর ঈমানের রশি যখন তার গ্রীবাদেশ থেকে খুলে নেয়া হয়, তখন সে অভিশপ্ত শয়তান হিসাবে বিদ্যমান থাকে’।[15]
লাজুকতা আত্মনিয়ন্ত্রণে সহায়ক:
লাজুকতা মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণে সহায়ক। লজ্জা থাকলে মানুষ যথেচ্ছ কাজ করতে পারে না। পক্ষান্তরে লজ্জাহীনতা মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলে। যে কারণে মানুষ ভাল-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ বা যাচাই-বাছাই না করে যেকোন কাজ করতে প্রবৃত্ত হয়। হাদীছেও এ কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এ মর্মে নিম্নোক্ত হাদীছটি প্রণিধানযোগ্য।
عن ابن مسعود قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه وسلم إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلاَمِ النَّبُوَّةِ الْأُوْلَى إِذَالمَ ْتَسْتَحِىْ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ-
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘পূর্ববর্তী নবীগণের বাণী হ’তে পরবর্তী লোকেরা (অবিকৃতাবস্থায়) যা পেয়েছে (এবং যা অদ্যাবধি বিদ্যমান) তা হ’ল তুমি যখন বেহায়া হয়ে যাবে তখন তোমার যা ইচ্ছা তাই কর’।[16]
এ হাদীছের অর্থের ব্যাপারে দু’টি উক্তি রয়েছে। প্রথমতঃ এ হাদীছে যথেচ্ছা কাজ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়নি; বরং এর অর্থ হ’ল তিরস্কার ও নিষেধাজ্ঞা। একে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যথা-১. এ হাদীছে নির্দেশের অর্থ হচ্ছে ধমক ও শাস্তির ভীতি প্রদর্শন। সুতরাং হাদীছের অর্থ হবে যখন তোমার লজ্জা থাকবে না, তখন তোমার যা ইচ্ছা কর। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ এর প্রতিদান তোমাকে দিবেন। যেমন আল্লাহ বলেন, اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ‘তোমরা তোমাদের ইচ্ছামত আমল কর। আর আল্লাহ তোমাদের কর্ম দেখেন’ (ফুছছিলাত ৪০)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, فَاعْبُدُوا مَا شِئْتُم مِّن دُونِهِ ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যার ইচ্ছা ইবাদত কর’ (যুমার ১৫)। ২. এখানে নির্দেশ অর্থ সংবাদ প্রদান। সুতরাং হাদীছের অর্থ হবে যার লজ্জা থাকে না, সে যা ইচ্ছা করে। কেননা মন্দ কর্মের প্রতিবন্ধক হচ্ছে লজ্জা। অতএব যার লজ্জা থাকে না সে অশ্লীল, গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আর লজ্জা না থাকলে কিসে তাকে ঐসব কাজে বাধা দিবে? দ্বিতীয়তঃ বাহ্যিক শব্দ দ্বারা যথেচ্ছা কাজ করার নির্দেশ। সুতরাং হাদীছের অর্থ হবে যখন তুমি কোন কাজ করার ইচ্ছা কর, তা করতে যদি লজ্জিত হ’তে না হয়, সেটা আল্লাহর থেকে হোক বা মানুষ থেকে। সেটা আল্লাহর আনুগত্যশীল কাজ হওয়ায় বা সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও উত্তম শিষ্টাচার হওয়ায় ইচ্ছা করলে তুমি তা সম্পন্ন কর।[17]
লাজুকতাই দ্বীন :
লজ্জাশীলতা এমন একটি মানবীয় উত্তম গুণ, যা মানুষকে দ্বীনের উপর অটল ও অবিচল থাকতে উৎসাহিত করে। পক্ষান্তরে লজ্জাহীনতা সৎ আমলের পরিবর্তে অসৎ কাজ করতে, দ্বীনের কাজের স্থলে অন্যান্য গর্হিত কাজ করতে বাধা দেয় না। এজন্য বিভিন্ন হাদীছে লাজুকতাকে ঈমানের অঙ্গ, দ্বীনের বিশেষ স্বভাব-প্রকৃতি এবং কোন কোন হাদীছে একে দ্বীন বা দ্বীনের পূর্ণতা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হাদীছে এসেছে,
عَنْ قُرَّةَ بْنِ اِيَاسٍ رضى الله عنه قَالَ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرَ عَنْهُ الْحَيَاءَ فَقَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ اَلْحَيَاءُ مِنَ الدِّيْنِ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَلْ هُوَ الدِّيْنُ كُلُّهُ-
কুররাহ ইবনু ইয়াস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। তাঁর নিকটে লজ্জাশীলতার কথা উল্লেখ করা হ’ল। ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! লজ্জাশীলতা হচ্ছে দ্বীনের অংশ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘বরং সেটা (লাজুকতা) হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন’।[18]
লাজুকতার ক্ষেত্রে আল্লাহ্কেই অধিক এবং যথাযথ লজ্জা করতে হবে। হাদীছে এসেছে,
عن عبد الله بن مسعود رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم اسْتَحْيُوْا مِنَ اللهِ حَقَّ الْحَيَاءِ قَال قُلْنَا يا نَبِىَ اللهِ إِنَّا لَنَسْتَحَىْ وَالْحَمْدُ ِللهِ قَالَ لَيْسَ ذَلِكَ وَلَكَِنَّ الْاِسْتِحْيَاءُ مِنَ اللهِ حَقَّ الحَْيَاءِ أَنْ تَحْفَظَ الرَّأْسَ وَمَا وَعَى وَتَحْفَظَ الْبَطَنَ وَمَا حَوَى وَلَتَذْكُرَ الْمَوْتَ وَالْبِلَى وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ تَرَكَ زِيْنَةَ الدُّنْيَا فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ اسْتَحْيَا مِنَ اللهِ حَقَّ الْحَيَاءِ-
আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ্কে যথাযথ লজ্জা কর। রাবী বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা অবশ্যই আল্লাহ্কে লজ্জা করি, আলহামদুলিল্লাহ। তিনি বলেন, এটা নয়। বরং আল্লাহ্কে যথাযথ লজ্জা করতে হবে। অর্থাৎ তুমি তোমার মাথাকে ও উহা যা স্মরণ রাখে তাকে হেফাযত করবে। পেট ও উহার অভ্যন্তরীণ বিষয়কে হেফাযত করবে। মৃত্যু ও পরীক্ষাকে স্মরণ করবে। আর যে আখিরাতের আশায় দুনিয়ার সৌন্দর্য ত্যাগ করে, সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্কে লজ্জা করে’।[19]
লজ্জাশীলতাকে আল্লাহ ভালবাসেন:
লাজুকতা এমন একটি অনন্য গুণ, যাকে মহান আল্লাহ ভালবাসেন। আল-আশাজ্জ আল-আছরী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, إن فيك لَخُلُقَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ، قُلْتُ: وَمَا هُمَا؟ قَالَ: اَلْحِلْمُ وَالْحَيَاءُ، ‘নিশ্চয়ই তোমার মধ্যে এমন দু’টি চারিত্রিক গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আল্লাহ ভালবাসেন বা পসন্দ করেন। আমি বললাম, সে দু’টি কি? তিনি বললেন, বুদ্ধিমত্তা ও লজ্জাশীলতা’।[20]
লজ্জাশীলতা জান্নাতের পথে পরিচালিত করে :
লাজুকতা মানুষকে পাপকর্ম করা থেকে বাধা দেয় এবং সে পুণ্যকর্ম করতে উদ্যোগী হয়। আর লজ্জাশীলতার কারণে সে জান্নাতের দিকে ধাবিত হয়। হাদীছে এসেছে,
عن أبى هريرة رضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم اَلْحَيَاءُ مِنَ الْإِيْمَانِ وَالْإِيْمَانُ فِى الْجَنَّةِ وَالْبَذَاءُ مِنَ الْجَفَاءِ وَالْجَفَاءُ فِى النَّارِ-
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের স্থান জান্নাত। পক্ষান্তরে নির্লজ্জতা দুশ্চরিত্রের অঙ্গ। আর দুশ্চরিত্রতার স্থান জাহান্নাম’।[21]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর লজ্জাশীলতা:
নবী করীম (ছাঃ) অতীব লাজুক ছিলেন। এমর্মে হাদীছে এসেছে,
عن أبى سعيد الخدرى قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَشَدُّ حَيَاءً مِنَ الْعَذْرَاءِ فِيْ خِدْرِهَا، فَإِذَا رَأَى شَيْئًا يَكْرَهُهُ عَرَفْنَاهُ فِيْ وَجْهِهِ،
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পবিত্র পর্দানশীন কুমারী মেয়েদের চেয়েও অধিক লাজুক ছিলেন। কোন বিষয় তাঁর দৃষ্টিতে অপসন্দনীয় হ’লে তাঁর চেহারা দেখেই আমরা তা (তাঁর অসন্তুষ্টি) আঁচ করে নিতাম।[22]
লজ্জাশীলতার ফলাফল:
আল্লাহ তা‘আলার অফুরন্ত নে‘মতরাজি অবলোকন ও নিজের অক্ষমতা ও ত্রুটি সম্পর্কে গভীর চিন্তা হ’তেই লজ্জা সৃষ্টি হয়। সুতরাং কোন বান্দা থেকে এই অর্জিত লজ্জা ছিনিয়ে নেয়া হ’লে তাকে মন্দ কর্ম থেকে বাধা দেওয়ার ও নিকৃষ্ট চরিত্রে ভূষিত হওয়া থেকে বিরত রাখার কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ফলে সে ব্যক্তি যেন ঈমান শূন্য হয়ে যায়। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اَلْحَيَاءُ حَيَاءَانِ: طَرْفٌ مِّنَ الْاِيْمَانِ وَالآخَرُ عَجْزٌ ‘লজ্জা হচ্ছে দুই প্রকার। একটি ঈমানের দিকে এবং অন্যটি অক্ষমতা’। ইমরান বলেন,
ــــــــــــــــــــــــــــــــــــأنما يريد به الخلق الذى يحث على فعل الجميل وترك القبيح فأما الضعف والعجز الذى يوجب التقصير فى شيء من حقوق الله أو حقوق عباده، فليس هو من الحياء، إنما هو ضعف وخور وعجز ومهانة،
‘রাসূলের বাণীতে প্রশংসিত লজ্জা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন চরিত্র যা উত্তম কাজ সম্পাদন করতে এবং খারাপ, মন্দ কাজ পরিত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করে। আর দুর্বলতা ও অক্ষমতা হচ্ছে যা আল্লাহর হক্ব বা বান্দার হক্ব প্রতিপালনে অনীহা সৃষ্টি করে। সুতরাং এটা লাজুকতা নয়; এটা হচ্ছে দুর্বলতা, অক্ষমতা, লাঞ্ছনা, অপমান’।[23]
শারঈ জ্ঞানার্জনে লজ্জা পরিহার :
ইসলামে নিষিদ্ধ বা গর্হিত কাজ বর্জনে, পাপকর্ম থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে লজ্জাশীলতা অবলম্বন করতে হবে। কিন্তু দ্বীনী ইলম হাছিলে বা শারঈ জ্ঞানার্জনে কিংবা দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল জানার ক্ষেত্রে লজ্জা করা চলবে না। বরং এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিষয় জানতে ও আবশ্যকীয় জ্ঞানার্জনে লজ্জা পরিহার করাই শ্রেয়। ছাহাবায়ে কেরাম এ ব্যাপারে কোন লজ্জা করতেন না। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্বীয় জামাতা ও চাচাত ভাই আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মযী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, مِنَالْمَذِىْ الْوُضُوءُ وَمِنَ الْمَنِىِّ الْغُسْلُ ‘মযী বের হ’লে ওযূ করতে হবে এবং মনী বের হ’লে গোসল করতে হবে’।[24]
অপর একটি হাদীছে এসেছে, উম্মু সুলাইম বিনতু মিলহান নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহ হক্ব প্রকাশে লজ্জা করেন না। মহিলারা যদি পুরুষের মত স্বপ্নে কিছু দেখে তাহ’লে কি তাদের গোসল করতে হবে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সে যদি পানি বা সিক্ততা দেখে তাহ’লে গোসল করবে’।[25]
সুতরাং দ্বীনের ব্যাপারে লজ্জা না করে অজানা বিষয় জেনে নিতে হবে। আল্লাহ বলেন, فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ، ‘যদি তোমরা না জান তাহ’লে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (নাহল ৪৩; আম্বিয়া ৭)।
পরিশেষে বলব, দ্বীনের উপরে অটল ও অবিচল থেকে ইবাদত-বন্দেগী সহ যাবতীয় আমল সুন্দর ও সুচারু রূপে আদায় করার জন্য লজ্জাশীলতা অতি যরূরী একটি গুণ। এ গুণ মানুষকে যেমন আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে, তেমনি মানুষকে স্বেচ্ছাচারী হ’তে নিরন্তর বাধা দেয়। তাই এগুণ অর্জনে আমাদেরকে সচেষ্ট হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ, ১৮শ খন্ড (কুয়েত: ওযারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুঊনিল ইসলামিয়া, ২য় প্রকাশ, ১৪১০/১৯৯০ খ্রীঃ), পৃঃ ২৪৬।
[5]. ইবন রজব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, তাহক্বীক্ব: শু‘আইব আল-আরনাউত ও ইবরাহীম বাজিস, ১ম খন্ড (সঊদী আরব: দারাতুল মালিক আব্দুল আযীয, ৯ম প্রকাশ, ১৪২৩/২০০২ খ্রীঃ), পৃঃ ৫০১।
[7]. বুখারী, মুসলিম, আবুদাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৫০৭০ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ‘কোমলতা, লাজুকতা ও সচ্চরিত্রতা’ অনুচ্ছেদ।
[11]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মুত্তয়াত্তা মালিক, বায়হাক্বী, ইবনু মাজাহ, ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৬৩২; মিশকাত হা/৫০৯০।