সাধারণ জ্ঞান

পৃথিবীর প্রচলিত ভাষাসমূহের একটি পরিসংখ্যান

ভাষা বলতে সাধারণত বুঝায় মানুষের এমন প্রাকৃতিক ভাবসমূহকে যার মাধ্যমে মানুষ পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করে। ভাষা মানুষে-মানুষে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ভাষার কতটুকু মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য আর কতটুকু পরিবেশনির্ভর তা আলোচনাসাপেক্ষ। তবে এটা নিশ্চিত যে, মানুষমাত্রেই ভাষা অর্জনের মানসিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় এবং একবার ভাষার মূলসূত্র আয়ত্ব করার পর সারা জীবন সে নিত্য-নতুন বাক্য ব্যবহার করার ক্ষমতা অর্জন করে। এরকম অসীম প্রকাশক্ষমতাসম্পন্ন ভাষা একান্তই একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য।

ভাষার প্রধানত দু’টি রূপ। মৌখিক ও লৈখিক (linguistic sign)। ভাষার লৈখিক রূপের অন্তত ১০ হাজার বছর পূর্বে মৌখিক রূপের উন্মেষ ঘটে। হযরত আদম (আঃ)-কে আল্লাহ রাববুল আলামীন জান্নাতে বাকশক্তি দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেন এবং পৃথিবীর সমস্ত কিছুর নাম শিক্ষা দান করেন। তাঁর ভাষা ছিল আরবী। পৃথিবীতে আগমনের পর আদম (আঃ)-এর সন্তানরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ায় ভাষার ব্যবহারের বিভিন্নতা সৃষ্টি হতে থাকে। প্রতিনিয়ত বিবর্তনের পথ ধরে আরবী ভাষার হাজারো নতুন নতুন রূপ তৈরী হয়। সৃষ্টি হয় স্বতন্ত্র ভাষাসমূহ। যেহেতু আরবী থেকে সকল ভাষার উৎপত্তি, সেজন্য আরবীকে সকল ভাষার মা বলে আখ্যায়িত করা হয়।

ভাষার এই বিবর্তন ধারা এতটাই গতিশীল যে, ভাষাবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন প্রতি ১০ কি. মি. অন্তর মানুষের ভাষা ও তার উচ্চারণ পদ্ধতির বিভিন্নতা তৈরী হয়। প্রাণীজগতের প্রতিটি সামাজিক প্রজাতি পারস্পরিক যোগাযোগ করে নিজস্ব ভাষা বা সংকেতের মাধ্যমে। মৌমাছি থেকে শুরু করে তিমি পর্যন্ত সকল প্রাণীর মাঝে এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিন্তু একমাত্র মানুষের মাঝেই এমন একটি ভাষার উন্মেষ ঘটেছে যার সাদৃশ্য আর কোন প্রাণীর মাঝে নেই। এর গাঠনিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে এই ভাষা সৃষ্টি হয় যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যুত্তর করে না; বরং এমন এক অর্থপূর্ণ ধ্বনি ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে যা সম্পূর্ণ বুদ্ধি-বিবেকপ্রসূত। মানবমস্তিষ্কের এই দিকটি অন্য প্রাণীকুল থেকে একেবারেই ভিন্নধর্মী।

ভাষার প্রাচীন ইতিহাস দুষ্প্রাপ্য। কেননা মাত্র ২০০ বছর পূর্বে ভাষা নিয়ে স্বতন্ত্র গবেষণার সূচনা হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা মোটামুটি ৫০০০-এর মতো (অবশ্য আমেরিকান সংস্থা ‘এথনোলগ’-এর ২০০৯ সালের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে জীবিত ভাষার(অর্থাৎ যে ভাষাকে কমপক্ষে একজন ব্যক্তি ১ম ভাষা হিসাবে ব্যবহার করে।) সংখ্যা মোট ৬৯০৯টি; এশিয়া= ২৩২২টি, আফ্রিকা= ২১১০টি, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল= ১২৫০টি, ইউরোপ= ২৩৪টি, আমেরিকা=৯৯৩টি)। বিশেষজ্ঞরা এসব ভাষাকে কতিপয় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন। যার উল্লেখযোগ্য সংখ্যা প্রায় বিশটির মত। অর্থাৎ এ সকল মৌলিক ভাষাগোষ্ঠীরই শাখা-প্রশাখা হল প্রচলিত সব ভাষা। এর মধ্যে সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভকারী ও সমৃদ্ধ ভাষাগোষ্ঠী হল ইন্দো-ইউরোপিয়ান। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের ভাষা এই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে হিন্দী-ফার্সী থেকে শুরু করে নরওয়েজিয়ান ও ইংলিশ পর্যন্ত সকল ভাষা খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর পূর্বে উত্তর ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার (বর্তমান ইউক্রেন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা)  সমতলভূমিতে বিচরণকারী যাযাবর জনগোষ্ঠীর ভাষা থেকে উদ্গত। বিশেষজ্ঞরা এই ভাষাকে ইন্দো-ইউরোপিয়ান নামকরণ করেছেন। আরেকটি ভাষাগোষ্ঠী- যেটি পশ্চিম এশিয়া জুড়ে অদ্যাবধি প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে- সেটি হল সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠী। এটিও খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর পূর্বে দক্ষিণ আরবে বসবাসকারী যাযাবর শ্রেণীর ভাষা বলে অনুমান করা হয়। দক্ষিণ আরব থেকে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত এলাকা জুড়ে সেমেটিক ভাষাভাষী জাতি সৃষ্টি করেছিল একে একে ব্যবিলনীয়, এ্যসিরীয়, হিব্রু ও ফিনিশীয় সভ্যতা। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে কিছুকালের জন্য আরামাইক নামক এক সেমেটিক ভাষা সার্বজনীন প্রভাব বিস্তার করেছিল।

ভাষার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, ভাষাসমূহ পরস্পরের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে অগ্রসর হয়েছে। রাজ্যজয়, বাণিজ্য, ধর্ম, প্রযুক্তি বা বর্তমান যুগে বিনোদন উপকরণের বিশ্বায়ন প্রভৃতি অনুষঙ্গ ভাষার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। যেমন রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবে জার্মানিক ভাষাসমূহ (ইংলিশ, ডাচ, জার্মান, ডেনিশ, নরওয়েজিয়ান, সুইডিশ, ফ্লেমিশ, আইসল্যান্ডিক) থেকে পৃথক হয়ে ল্যাটিন/রোমান্স (প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ভাষা) ভাষাসমূহ (ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, রোমানিয়ান) স্বতন্ত্র রূপ নিয়েছে। আবার ইংল্যান্ডে তিনশত বছর রাজত্ব করলেও রোমানরা সেখানকার জার্মান গোত্রসমূহ, এঙ্গেলস (প্রাচীন জার্মানিক জনগোষ্ঠী যারা ইংল্যান্ডের গোড়াপত্তন করেছিল) ও স্যাক্সনদের (৫ম ও ৬ষ্ঠ খৃষ্টীয় শতাব্দীতে যেসব জার্মাানিক দক্ষিণ ইংল্যান্ডের অধিকাংশ এলাকা অধিকার করে সেখানে বসতি স্থাপন করেছিল) উপর শক্ত প্রভাব   বিস্তার করতে পারেনি। ফলে এখানকার ভাষা ‘এ্যংলো-স্যাক্সন’ নামে পৃথক রূপ লাভ করে। বর্তমান বিশ্বে ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীভুক্ত ভাষাসমূহ উত্তর থেকে দক্ষিণ আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক প্রভাবের কারণে।
এই দখলদারিত্ব সূত্রেই একদা যখন ফ্রেঞ্চরা ক্ষমতাবলে বিভিন্ন জাতির উপর প্রভাব বিস্তার করল, তখন ফ্রেঞ্চ ভাষা পরিণত হয় আর্ন্তজাতিক ভাষায় (লিঙ্গুয়া ফ্রান্সা)। পরবর্তীতে বৃটিশ ঔপনিবেশিকরা ফ্রেঞ্চদের হটিয়ে বিশ্বমঞ্চ দখল করে নিলে ইংলিশ ভাষা পরিণত হয় আন্তর্জাতিক ভাষায়, যার প্রতাপ আজ অবধি ক্রমবর্ধমান। অবশ্য ইতিহাসের পরিক্রমা সাক্ষ্য দেয় যে, ইংরেজীই চূড়ান্ত আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে চিরস্থায়ী নয়; বরং আবার অন্য কোন ভাষা এর স্থান দখল করবে এবং তারও একসময় অবসান ঘটবে। বর্তমানে চাইনিজদের অর্থনৈতিক শক্তি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে তাদের ভাষার পক্ষে নতুন সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে। যদিও ভাষাটির গাঠনিক কাঠিন্য এর আন্তর্জাতিক উপযোগিতার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।

বিশ্বের প্রতিটি দেশেই একাধিক ভাষার অস্তিত্ব দেখা যায়। সরকারী ভাষা ও ২য় ভাষা হিসাবে এসব ভাষাকে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে সরকারী ভাষা বাংলাসহ উপজাতীয় ভাষা, বিদেশী ভাষা মিলিয়ে ৪৬টি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। পার্শ্ববর্তী ইন্ডিয়াতে রয়েছে ৪৪৫টি ভাষা। ইন্দোনেশিয়াতে ৭৭২টি। চীনে ২৯৬টি। পাকিস্তানে ৭৭টি। যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬৪টি (বিদেশী ১৮৮টি)। যুক্তরাজ্যে ৫৬টি (বিদেশী ৪৪টি)। অষ্ট্রেলিয়ায় ২০৭ টি (বিদেশী ৪৮টি)।
অন্যদিকে প্রতিটি স্বতন্ত্র ভাষাও নিয়মিত নতুন নতুন শব্দ, বাগধারা সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে বিবর্তিত হচ্ছে। ফলে দেখা যায়, ষোল শতকের এলিজাবেথিয়ান ইংরেজীর সাথে আধুনিক ইংরেজীর বিরাট ফারাক। বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শনগুলোর সাথে আধুনিক বাংলার আকাশ-পাতাল তফাৎ। এভাবেই মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে ভাষাসমূহের বিবর্তনের রূপ প্রবলতরভাবে সুস্পষ্ট।

মোটকথা নানা প্রক্রিয়ায় ভাষাসমূহ নিয়মিতই বিবর্তিত হচ্ছে এবং হবে। সৃষ্টিজগতের একমাত্র বাকসম্পন্ন প্রাণী মানবজাতির ভাষার এই বৈচিত্র আল্লাহ্র তা‘আলারই অসীম কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।

ভাষাসমূহকে সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণ দ্বারা সুসংহত করার প্রক্রিয়া সর্বপ্রথম দেখা যায় ইন্ডিয়ায়। খৃষ্টপূর্ব ৫ম শতকে পাণিনি নামক এক ব্যক্তি সংস্কৃত ভাষার ৩৯৫৯টি নিয়ম লিপিবদ্ধ করেন যা অষ্টাধ্যায়ী নামে পরিচিত। খৃষ্টপূর্ব ২য় শতকে তামিল ভাষার জন্য তোলকাপিয়াম নামক আরেক পন্ডিত ব্যাকরণ রচনা করেন। মধ্যপ্রাচ্যে ৭৬০ খৃষ্টাব্দে আরব বৈয়াকরণ সিবওয়াইহ সর্বপ্রথম আরবী ব্যাকরণ রচনা করেন। যার নাম ছিল ‘আল-কিতাব’। এই ব্যাকরণের মাধ্যমে ভাষাতাত্ত্বিক বহু জটিল দিক তিনি উন্মোচন করেন। তাঁর উদ্ভাবিত ধারাকে অনুসরণ করে পরবর্তীতে আরব ভাষাবিদরা নিয়মিতভাবে ব্যাকরণ চর্চার মাধ্যমে পরবর্তীতে কিছুকালের মধ্যেই আরবী ভাষাকে বিজ্ঞানভিত্তিক, সুশৃংখল, সুসমন্বিত ভাষায় পরিণত করেন। আরবী ভাষার পিছনে মুসলিম পন্ডিতদের অধ্যবসায় ছিল কিংবদন্তীতুল্য। তাদের অবিরত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আরবী ভাষা অন্যান্য ভাষার তুলনায় অনেক বেশী সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী ভাষা। তাছাড়া পবিত্র কুরআন আরবী ভাষায় লিখিত হওয়ায় এ ভাষার গাঠনিক কাঠামো ও বাহ্যিক প্রকাশরীতি বিগত পনেরশ’ বছর ধরে প্রায় অবিকৃতই রয়েছে, যা অন্য কোন ভাষার ক্ষেত্রে ঘটেনি।

পাশ্চাত্যে ব্যাকরণ চর্চা শুরু হয় আরো অনেক পরে। ষোড়শ শতকে পাশ্চাত্যে ভাষার ব্যাকরণ সম্পর্কিত আলোচনা ফিলোলজি (ভাষাতত্ত্ব) পরিভাষার অন্তরালে ব্যবহৃত হত। প্রকৃতার্থে ব্যাকরণ চর্চা সেখানে শুরু হয় যখন অষ্টাদশ শতকে বৃটিশ ইন্ডিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য পাশ্চাত্যের দোরগোড়ায় পেঁŠছাল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই সুষম মেলবন্ধনে একই সাথে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব এবং ভাষাসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক ও গাঠনিক সাদৃশ্য আবিষ্কৃত হয়। উইলিয়াম জোন্স, ফ্রেডরিখ শ্লেঘেল, ফ্রাঞ্জ বপ্, অগাষ্ট ফ্রেডরিখ পট্ প্রমুখ এক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। এরপর জ্যাকব গ্রিম রচনা করেন ডাচ ভাষার ব্যাকরণ ‘ডাচ গ্রামাটিক’। যাকে পাশ্চাত্যে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাকরণ বই হিসাবে মর্যাদা দেয়া হয়। শীঘ্রই তাঁর অনুসরণে অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাতেও ব্যাকরণ রচিত হতে শুরু করে। অতঃপর জাভানিজ ভাষার ব্যাকরণ রচনা করে প্রুশিয়ার পন্ডিত উইলহেলম ভন হামবোল্ট (১৭৬৭-১৮৩৫) অন্যান্য ভাষাতেও ব্যাকরণ রচনার পথ অবারিত করেন। বিংশ শতাব্দীতে সুইস পন্ডিত ফার্ডিন্যান্ড ডি সশার ভাষার ধারণাকে ‘সেমানটিক কোড’  (অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও বাহ্যিক প্রকাশের মধ্যে পার্থক্য নিরূপক সংকেত) দ্বারা চিহ্নিত করেন। এভাবে আরো কিছু পন্ডিতের মৌলিক অবদানের মাধ্যমে ব্যাকরণ তথা ভাষাবিজ্ঞান একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রে পরিণত হয়।

নিম্নে বিশ্বের প্রধান প্রধান ১০টি ভাষাগোষ্ঠী (Language family) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি ধারণা দেওয়া হল :

  1.  ইন্দো-ইউরোপীয় (৪২৬টি) : এই ভাষাপরিবারটির চারটি প্রধান শাখা রয়েছে : ইন্দো-ইরানীয়, রোমান্স, জার্মানীয় ও বাল্টো-স্লাভীয়। এই ভাষাপরিবারভুক্ত ভাষায় মানুষ সর্বাধিক কথা বলায় (প্রায় ২৭৩ কোটি) এ ভাষাগোষ্ঠীর উপরই সর্বাধিক গবেষণা হয়েছে। এ পরিবারের উল্লেখযোগ্য ভাষাগুলো- ইংরেজী, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, রুশ, গ্রীক, ফার্সি, পশতু, উর্দূ, হিন্দী, বাংলা ইত্যাদি। এছাড়া প্রাচীন ধ্রুপদী ভাষা সংস্কৃত, ল্যাটিনও এই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।

  2. উরালীয় (৩৫টি) : উরাল পর্বতের পাদদেশীয় ইউরোপ ও সাইবেরিয়ায় অবস্থিত এই ভাষাপরিবারের বিশেষ্যপদের সংগঠন জটিল। এ গোষ্ঠীর অন্তর্গত ভাষাগুলো- হাঙ্গেরীয়, ফিনীয়, মর্দভিন, সুইডিশ, নরওয়েজ ইত্যাদি।

  3. আলতায়ীয় (৬৪টি) : তুরস্ক থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ভাষা পরিবার। এর অন্তর্গত ভাষাগুলো- তুর্কি, উজবেক, মঙ্গোলীয় এবং (মতভেদে) কোরীয় ও জাপানীয়।

  4.  চীনাতিববতী (৪৪৫টি) : বিশ্বের সবচেয়ে বেশী কথিত ভাষা মান্দারিন চীনা এই এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। এই ভাষাগুলো একাক্ষরিক ও সুরপ্রধান।

  5. মালয়পলিনেশীয় (১২৩১টি) : ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের বুক জুড়ে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত ভাষা পরিবার। এ গোষ্ঠীর অন্তুর্গত ভাষাগুলোর মাঝে আছে মালয়, ইন্দোনেশীয়, মাওরি ও হাওয়াই ভাষা।

  6. আফ্রোএশীয় (৩৫৩টি) : এই ভাষা পরিবারের ভাষাগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা জুড়ে বিস্তৃত। আরবী ও হিব্রু এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

  7.  ককেশীয় (৩৩টি) : কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী ককেশাস পর্বতমালা অঞ্চলের ভাষাসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত। জর্জীয়, চেচেন ভাষা এখানকার মূল ভাষা।

  8. দ্রাবিড় (৮৪টি) : এগুলি দক্ষিণ ভারতের ভাষা। তামিল, তেলেগু, কন্নড, মালয়ালম ভাষা সবচেয়ে বেশী প্রচলিত চারটি দ্রাবিড় ভাষা।

  9.  অষ্ট্রোএশীয় (১৬৯টি) : এশিয়ার বিচ্ছিন্ন ভাষাসমূহ। পূর্ব ভারত থেকে ভিয়েতনাম পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি। ভিয়েতনামীয় ও খমের ভাষা অন্যতম উদাহরণ।

  10. নাইজার-কঙ্গো (১৫১০টি) : সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে কথিত আফ্রিকার ভাষাসমূহ নিয়ে এ পরিবার গঠিত। সোয়াহিলি, সহোনা, খোসা ও জুলু এই পরিবারের ভাষার উদাহরণ।

 

নিম্নে বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক প্রচলিত ৩০টি ভাষা ও সেসব ভাষাভাষীদের সংখ্যা উল্লেখ করা হল। –      

ক্রঃ নং

ভাষা

ভাষাগোষ্ঠী

ভাষাভাষীদের সংখ্যা

বিবরণ

মান্দারিন/ চাইনিজ

চীনো-তিববতিয়ান

মাতৃভাষা : ৮৭ কোটি ৩০ লক্ষ
২য় ভাষা : ১৭ কোটি ৮০ লক্ষ
মোট : ১০৫ কোটি ১০ লক্ষ

চীন, সিঙ্গাপুর,

হিন্দী

ইন্দো-ইউরোপিয়ান, ইন্দো-ইরানিয়ান, ইন্দো-আর্য

মাতৃভাষা : ৩৭ কোটি, ২য় ভাষা : ১২ কোটি
মোট : ৪৯ কোটি

ইন্ডিয়া ও ফিজি

স্প্যানিশ

ইন্দোইউরোপিয়ান, ইটালিক, রোমান্স

মাতৃভাষা : ৩৫ কোটি, ২য় ভাষা : ৭ কোটি
মোট : ৪২ কোটি

দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল বাদে বাকী দেশসমূহ এবং ক্যরিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও আমেরিকা

ইংরেজী

ইন্দো-ইউরোপিয়ান

মাতৃভাষা : ৩৪ কোটি, ২য় ভাষা : ১৭ কোটি
মোট : ৫১ কোটি

সবকটি মহাদেশের ৬৩টিরও বেশী দেশে এ ভাষা ১ম বা ২য় ভাষা হিসাবে প্রচলিত।

আরবী

আফ্রো-এশিয়াটিক, সেমেটিক

মাতৃভাষা : ২০ কোটি ৬০ লক্ষ, ২য় ভাষা : ২ কোটি ৪০ লক্ষ, মোট : ২৩ কোটি
অন্য পরিসংখ্যানে ২৫ কোটি ৫০ লক্ষ

এশিয়া ও আফ্রিকার ২৯টি দেশে এ ভাষার প্রচলন আছে

পর্তুগিজ

ইন্দো ইউরোপিয়ান, ইটালিক, রোমান্স

মাতৃভাষা : ২০কোটি ৩০ লক্ষ, ২য় ভাষা : ১ কোটি, মোট : ২১ কোটি ৩০ লক্ষ

দ: আমেরিকার ব্রাজিল, ইউরোপের পর্তুগাল ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এই ভাষা প্রচলিত

বাংলা

ইন্দো ইউরোপিয়ান, ইন্দো-ইরানীয়, ইন্দো-আর্য

মাতৃভাষা : ১৯ কোটি ৬০ লক্ষ
মোট : ২১ কোটি ৩০ লক্ষ

বাংলাদেশ, ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলা এবং সিয়েরালিয়ন

রুশ

ইন্দো-ইউরোপিয়ান, স্লাভিক, ইস্ট স্লাভিক

মাতৃভাষা : ১৪ কোটি ৫০ লক্ষ, ২য় ভাষা: ১ কোটি ১০ লক্ষ, মোট : ২৫ কোটি ৫০ লক্ষ

রাশিয়া, মালদোভা, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, বেলারুশ, জর্জিয়া

জাপানিজ

জাপানিক ভাষা

মাতৃভাষা : ১২ কোটি ৬০ লক্ষ, ২য় ভাষা : ১০ লক্ষ, মোট : ১২ কোটি ৭০ লক্ষ

জাপান, পালাউ

১০

জার্মান

ইন্দো-ইউরোপিয়ান, জার্মানিক, পশ্চিম জার্মানিক

মাতৃভাষা: ১০ কোটি ১০ লক্ষ, ২য় ভাষা: ১২ কোটি ৮০ লক্ষ, মোট: ২২ কোটি ৯০ লক্ষ

জার্মানী, অষ্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ইটালী, লিচটেনষ্টেইন, লুক্সেমবার্গ, পোলান্ড,

১১

পাঞ্জাবী

ইন্দো-ইউরোপিয়ান, ইন্দো-ইরানিয়ান, ইন্দো- ইন্দো-আর্য

মাতৃভাষা: ৬ কোটি, ২য় ভাষা: ২ কোটি ৮০ লক্ষ, মোট: ৮ কোটি ৮০ লক্ষ

ইন্ডিয়া (পাঞ্জাব), পাকিস্তান

১২

জাভানিজ

অষ্ট্রেলেশিয়ান, মালায়ো-পলিনেসিয়ান, সুন্দা-সুলায়েসী

৭ কোটি ৬০ লক্ষ

ইন্দোনেশিয়া (জাভা), মালয়েশিয়া, সুরিনাম

১৩

কোরিয়ান

বিচ্ছিন্ন ভাষা

৭ কোটি ১০ লক্ষ

উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া

১৪

ভিয়েতনামিজ

অষ্ট্রো-এশিয়াটিক, ভিয়েটিক

মাতৃভাষা : ৭ কোটি, ২য় ভাষা : ১ কোটি ৬০ লক্ষ, মোট : ৮ কোটি ৬০ লক্ষ

ভিয়েতনাম

১৫

তেলেগু

দ্রাবিড়

মাতৃভাষা : ৭ কোটি, ২য় ভাষা : ৫০ লক্ষ
মোট : ৭ কোটি ৫০ লক্ষ

ইন্ডিয়া (অন্ধ্র প্রদেশ)

১৬

মারাঠী

ইন্দো-ইরানিয়ান, ইন্দো-আর্য, ইন্দো-ইরানিয়ান

মাতৃভাষা : ৬ কোটি ৮০ লক্ষ, ২য় ভাষা : ৩০ লক্ষ, মোট : ৭ কোটি ১০ লক্ষ

ইন্ডিয়া (গোয়া, মহারাষ্ট্র)

১৭

তামিল

দ্রাবিড়

মাতৃভাষা : ৬ কোটি ৮০ লক্ষ, ২য় ভাষা : ৯০ লক্ষ, মোট : ৭ কোটি ৭০ লক্ষ

ইন্ডিয়া (তামিল নাডু), সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা

১৮

ফ্রেঞ্চ

ইন্দো ইউরোপিয়ান, ইটালিক, রোমান্স

মাতৃভাষা : ৬ কোটি ৭০ লক্ষ, ২য় ভাষা : ৬ কোটি ৩০ লক্ষ, মোট : ১৩ কোটি

এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকার প্রায় ৪০ টি দেশে ভাষাটি প্রচলিত

১৯

উর্দূ

ইন্দো-ইউরোপিয়ান, ইন্দো-ইরানিয়ান, ইন্দো-আর্য

মাতৃভাষা : ৬ কোটি ১০ লক্ষ , ২য় ভাষা : ৪ কোটি ৩০ লক্ষ, মোট : ১০ কোটি ৪০ লক্ষ

ইন্ডিয়া (জম্মু-কাশ্মীর), পাকিস্তান

২০

ইটালিয়ান

ইন্দো ইউরোপিয়ান, ইটালিক, রোমান্স

৬ কোটি ১০ লক্ষ

 ক্রোয়েশিয়া, ইটালী, সান মেরিনো, স্লোভেনিয়া, সুইজারল্যান্ড

২১

টার্কিশ

আলটাইক, টারকিক, অঘুজ

মাতৃভাষা : ৬ কোটি, ২য় ভাষা : ১ কোটি ৫০ লক্ষ, মোট : ৭ কোটি ৫০ লক্ষ

তুরস্ক, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, দক্ষিণ সাইপ্রাস

২২

পশতু

ইন্দো-ইউরোপিয়ান, ইন্দো-আর্য, ইন্দো-ইরানিয়ান

৫ কোটি ৪০ লক্ষ

আফগানিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান

২৩

তাগালগ

অষ্ট্রেলেশিয়ান, মালায়ো-পলিনেসিয়ান, ফিলিপ্পিন

৪ কোটি ৮৯ লক্ষ

ফিলিপাইন

২৪

গুজরাটি

ইন্দো-ইউরোপিয়নি, ইন্দো-আর্য, ইন্দো-ইরানিয়ান

৪ কোটি ৬০ লক্ষ

ইন্ডিয়া

২৫

পোলিশ

ইন্দো-ইউরোপিয়ান, স্লাভিক, ইস্ট স্লাভিক

৪ কোটি ৬০ লক্ষ

পোল্যান্ড

২৬

ইউক্রেনিয়ান

ইন্দো-ইউরোপিয়ান, স্লাভিক, ইস্ট স্লাভিক

৩ কোটি ৯০ লক্ষ

ইউক্রেন, মালদোভা

২৭

মালয়ী

অষ্ট্রেলেশিয়ান, মালায়ো-পলিনেসিয়ান, সুন্দা-সুলায়েসী, মালাইক

৩ কোটি ৯১ লক্ষ

ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড

২৮

উড়িয়া

ইন্দো-ইউরোপিয়নি, ইন্দো-আর্য, ইন্দো-ইরানিয়ান

৩ কোটি ২০ লক্ষ

ইন্ডিয়া (উড়িষ্যা)

২৯

বার্মিজ

সিনো-তিববতিয়ান, তিববতী-বার্মান. লোলো বার্মিজ

৪ কোটি ২০ লক্ষ (২য় ভাষা : ১ কোটি)

মায়ানমার

৩০

থাই

কারাডি, তাই

৬ কোটি  লক্ষ (২য় ভাষা : ৪ কোটি)

থাইল্যান্ড

 

– হোসাইন আল মাহমূদ

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button