আরবী অভিধানচর্চা : সূচনা ও বিকাশ
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম চীনে অভিধানচর্চার শুভ সূচনা হয়। খৃষ্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীতে বাউতিশি নামক জনৈক ভাষাবিদ ৪০ হাযার শব্দ সম্বলিত একটি অভিধান রচনা করেন। অতঃপর ওয়ারু নামক বিদ্বান ল্যাটিন ভাষায় ‘লিঙ্গুয়া ল্যাটিনিয়া’ (Lingua Latinia) নামে একটি অভিধান রচনা করেন। ১৭৭ খৃষ্টাব্দে গ্রীক ভাষাবিদ ইউলিউস বুলাকিস গ্রীক ভাষায় আরেকটি অভিধান প্রণয়ন করেন।
কুরআন মাজীদের দুর্বোধ্য শব্দাবলীর অর্থ ছাহাবায়ে কেরাম না জানলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছ থেকে জেনে নিতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইন্তিকালের পর বিশিষ্ট ছাহাবীগণ এ দায়িত্ব পালন করতেন। বর্ণিত আছে যে, একদা আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) কা‘বা প্রাঙ্গণে জনগণ পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসা ছিলেন। লোকেরা তাঁকে কুরআনের তাফসীর জিজ্ঞাসা করছিল। ইত্যবসরে নাফে ইবনুল আযরাক নাজদা ইবনু উ‘আইমিরকে বললেন, যিনি কুরআনের তাফসীর করছেন তার কাছে চলুন। তারা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, আমরা আপনাকে কুরআন মাজীদের কতিপয় আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করব। আপনি আমাদেরকে তার তাফসীর করবেন এবং আরবদের কবিতা দ্বারা তার সত্যতা প্রমাণ করবেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করেছেন। তাদের কথা শুনে ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, তোমরা যা ইচ্ছা জিজ্ঞাসা কর। নাফে বললেন, আল্লাহর বাণী: ‘দক্ষিণ ও বামদিক হতে, দলে দলে’ (মা‘আরিজ ৩৭) সম্পর্কে বলুন! ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন,‘আযূন অর্থ: বন্ধুদের একত্রিত হওয়া’। নাফে বললেন, আরবরা কি এ অর্থ জানত? ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, তুমি কি উবাইদ ইবনুল আবরাছ-এর এ কবিতা শোননি-
‘তারা তার দিকে ছুটে আসল। এমনকি তার মিম্বারের চতুর্পার্শ্বে দলবদ্ধ হল’। এরপর নাফে বললেন, আল্লাহর বাণী ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরী‘আত ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি’ (মায়েদা ৪৮) সম্পর্কে বলুন! তিনি বললেন, الشرعة : الدين والمنهاج: الطريق। الشرعة হচেছ দ্বীন আর المنهاج অর্থ রাস্তা’। নাফে বললেন, আরবরা কি এ অর্থ জানে? তিনি বললেন, হ্যাঁ! তুমি কি সুফইয়ান ইবনুল হারিছ (রাঃ)-এর এ কবিতা শোননি-
‘মামূন [অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ)] সত্যবাদিতা ও হেদায়াতের কথা বলেন এবং তিনি ইসলামকে ধর্ম ও সরল পথ হিসাবে বর্ণনা করেন’। অতঃপর নাফে বললেন, আল্লাহ্র বাণী
‘লক্ষ্য কর, উহার ফলের প্রতি যখন উহা ফলবান হয় এবং উহার পরিপক্বতা প্রাপ্তির প্রতি’ (আন‘আম ৯৯) সম্পর্কে বলুন! ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, نضجه وبلاغه ‘উহার পরিপক্বতা বা পুষ্ট হওয়া’। নাফে বললেন, আরবরা কি এ অর্থ জানে? ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, তুমি কি কবির নিম্নোক্ত কবিতা শোননি-
এভাবে একের পরে এক ইবনু আববাস (রাঃ) কুরআন মাজীদের ২৫০টি দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা করেন প্রাচীন আরবী কবিতা দ্বারা (বিস্তারিত দ্র: আল-ইতক্বান ১/২৫৫-২৮২, ৩৬ নং প্রকার ‘ফী মা‘রিফাতে গারীবিহি)। এত্থেকে বুঝা যায় যে, কুরআন মাজীদের দুর্বোধ্য, জটিল, কঠিন ও অপরিচিত শব্দের ব্যাখ্যাকল্পে আরবী অভিধানচর্চাা সূচনা হয়। Amidu Sanni বলেন, Explanation of the Quranic idioms and usages was the first chapter in Arabic Lexicograply. (Islamic Studies, Islamic Research Institute, Islamabad, Pakistan, Vol. 13. No.2, 1992, P. 144).
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) আরবী অভিধানচর্চার বীজ বপন করেন। তারপর আবূ সাঈদ আববাস ইবনু তাগলিব (মৃ. ১৪১হিঃ/৭৫৮ খৃঃ) তার পদাংক অনুসরণ করে ‘গারীবুল কুরআন’ নামে গ্রন্থ প্রণয়ন করে কুরআন মাজীদের দুর্বোধ্য ও অপরিচিত শব্দের ব্যাখ্যা করেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে আরবী অভিধানচর্চা মৌখিকভাবে চলতে থাকে। আরবী ভাষাবিদগণ মরুভূমিতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে যেসব শব্দ শুনতেন তা লিপিবদ্ধ করতেন। এক্ষেত্রে যে সকল ভাষাবিদ পন্ডিত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তারা হলেন আল-খাছ‘আমী, ‘কিতাবুল হাশারাত’ প্রণেতা আবূ খায়রাহ আল-আদাবী, আবুদ দাকীস, আবু মাহদিয়্যাহ আল-আরাবী, আবুল মুন্তাজা‘, আবুল বায়দা আর-রায়াহী, আবু তুফাইলা, আবু হায়াত আল-ফাক‘আসী, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল মালেক, ‘আন-নাওয়াদির’ প্রণেতা আমর ইবন কারকারা, আবূ যিয়াদ আল-কিলাবী, আবূ আমর ইবনুল আলা প্রমুখ।
প্রাথমিক যুগে ভাষাবিদগণ একই বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শব্দ সংগ্রহ করে গ্রন্থাবদ্ধ করতেন। যেমন- আল-আছমা‘ঈ (মৃ. ২১৫হিঃ) النخل (খেজুর), الكرم (আঙ্গুর), الإبل (উট), الخيل (ঘোড়া) প্রভৃতি বিষয়ে পৃথক পৃথক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
এভাবে জাহিলী যুগ থেকে উমাইয়া যুগ পর্যন্ত আরবী অভিধানচর্চা মৌখিকভাবে চলতে থাকে। আববাসীয় যুগে এসে আরবী অভিধান সংকলনের কাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন খলীল ইবনু আহমাদ আল-ফারাহীদী। তাঁকে আরবী অভিধান শাস্ত্রের জনক বলা হয়। তিনিই ‘কিতাবুল আইন’ নামে প্রথম পূর্ণাঙ্গ আরবী অভিধান রচনা করেন।
খলীল ইবনু আহমাদ উচ্চারণস্থল ভিত্তিক আরবী বর্ণমালার ক্রমানুসারে তার অভিধানকে এক ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে সাজিয়েছেন। তিনি আলিফ, বা, তা, ছা…….. এরূপ গতানুগতিকভাবে না সাজিয়ে ছহীহ বা নিরেট বর্ণসমূহের মধ্যে প্রথম ওষ্ঠ থেকে উচ্চারিত হরফগুলো সাজিয়েছেন। এরপর মু‘তাল বা পরিবর্তনশীল বর্ণসমূহকে শেষে রেখেছেন। তার বিন্যাস পদ্ধতি নিম্নরূপ:
এভাবে প্রথম ২৫টি নিরেট বর্ণ দ্বারা ২৫টি অধ্যায় এবং শেষ চারটি মু‘তাল বর্ণ দ্বারা একটি মোট ২৬টি অধ্যায় রচনা করেছেন। প্রথম অধ্যায় ‘আইন’ বর্ণ দ্বারা শুরু করার কারণে অভিধানটির নামকরণ হয়েছে ‘কিতাবুল আইন’। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতীর ভাষ্যমতে এ অভিধানটির শব্দ সংখ্যা ১,২৩,০৫,৪১২ (এক কোটি তেইশ লাখ পাঁচ হাযার চারশত বারটি)। তবে আবূ বকর আয-যাবীদীর মতে ৬৬,৯৯, ৪০০টি।
খলীল ইবনু আহমাদের পর আরবী অভিধানচর্চা শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি-অগ্রগতির পথ পাড়ি দিয়ে পূর্ণতার দিকে ধাবিত হয়। অভিধানবিদগণ শব্দসমূহকে গ্রন্থাবদ্ধ করতে গিয়ে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেন। যথাঃ-
১. মাদরাসাতুত তাকলীবাত আছ-ছাওতিয়্যাহ :
খলীল ইবনু আহমাদ এ রীতির উদ্ভাবক ও পথপ্রদর্শক। পরবর্তীতে আবূ আলী আল-কালী (মৃ. ৩৫৬হিঃ) ‘আল-বারি’ অভিধানে, আল-আযহারী ‘তাহযীবুল লুগাহ’, ইবনু সীদাহ ‘আল-মুহকাম’ এবং ছাহিব ইবন আববাদ (মৃ. ৩৮৬ হিঃ) ‘আল-মুহীত’ অভিধানে তার পদাংক অনুসরণ করেন।
এ রীতির অনুসারীরা প্রত্যেকটি শব্দ ও তার পরিবর্তিত রূপগুলোকে মাখরাজের দিক দিয়ে যে অক্ষরটি সবচেয়ে বেশী দূরবর্তী তার অধীনে একত্রিত করেছেন। যেমন كبر শব্দটি ও তার পরিবর্তিত রূপ كرب-ركب-ربك- بكر- برك প্রভৃতি শব্দগুলোকে ‘কাফ’ হরফের অধীনে একত্রিত করা হয়েছে। কেননা এটির উচ্চারণস্থল জিহবার শেষপ্রান্ত।
২. মাদরাসাতুত তাকলীবাত আল-হিজাইয়্যাহ :
‘জামহারাতুল লুগাহ’ শীর্ষক অভিধান রচয়িতা ইবনু দুরাইদ (মৃ. ৩২১) এ রীতির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শব্দের পরিবর্তিত রূপের ক্ষেত্রে খলীল ইবনু আহমাদের রীতি অনুসরণ করেন। তবে পার্থক্য এই যে, ইবনু দুরাইদ আরবী বর্ণমালার সাধারণ বিন্যাস বজায় রেখেছেন। এ পদ্ধতির অনুসারীরা كرب-ركب-ربك-بكر- برك শব্দগুলোকে ‘বা’ হরফের অধীনে সংকলন করেছেন। কেননা এটি বর্ণমালার ধারাবাহিকতায় অগ্রগণ্য। ‘জামহারাতুল লুগাহ’ ছাড়া এ রীতি অবলম্বনে রচিত বিখ্যাত অভিধান হচ্ছে আহমাদ ইবনু ফারিস রচিত ‘মু‘জামু মাকায়ীসিল লুগাহ’ ও ‘কিতাবুল মুজমাল ফিল-লুগাহ’।
৩. মাদরাসাতুল কাফিয়া :
‘তাজুল লুগাহ ওয়া ছিহাহুল আরাবিয়্যাহ’ অভিধান রচয়িতা ইসমাঈল ইবনু হাম্মাদ আল-জাওহারী (মৃ. ৩৯৮ হিঃ) এ পদ্ধতির উদ্ভাবক। এ রীতি অনুযায়ী শব্দের শেষ অক্ষরকে ‘বাব’ ও প্রথম অক্ষরকে ‘ফাছল’ হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে। শব্দের শেষ অক্ষর অনুযায়ী বিন্যস্ত করার কারণে এ পদ্ধতিকে ‘মাদরাসাতুল কাফিয়া’ হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে। এ রীতি অনুযায়ী كبر শব্দটি باب الراء ও فصل الكاف এ উল্লিখিত হয়েছে।
এ পদ্ধতিতে রচিত বিখ্যাত অভিধান হচ্ছে ইবনু মানযূর প্রণীত ‘লিসানুল আরাব’, মাজদুদ্দীন ফিরোযাবাদীর ‘আল-কামূসুল মুহীত’, আয-যাবীদীর ‘তাজুল আরূস’ এবং আহমাদ ফারিস আশ-শিদয়াকের ‘আল-জামূস আল-কামূস’ প্রভৃতি।
৪. মাদরাসাতুল হিজাইয়্যাহ আল-আদিয়া :
আরবী অভিধান রচনায় অনুসৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে এ পদ্ধতিটি সবচেয়ে সহজ। এটি আরবী বর্ণমালার সাধারণ বিন্যাস তথা أ-ب-ت-ث-ج…… এভাবে শব্দগুলোকে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এ রীতি অনুযায়ী শব্দের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী শব্দ বিন্যস্ত করা হয়েছে। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ণের দিকেও লক্ষ্য রাখা হয়েছে। যেমন رمى শব্দটিকে খুঁজতে গেলে ‘রা’ দ্বারা খুঁজতে হবে। মুহাম্মাদ ইবনু তামীম আল-বার্মাকী ‘আল-মুন্তাহা ফিল-লুগাহ’ ও যামাখশারী ‘আসাসুল বালাগাহ’ অভিধানে এ রীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
আধুনিক যুগে এ পদ্ধতি অনুসারে প্রণীত অভিধানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘আল-মিছবাহুল মুনীর’, বুতরুসুল বুস্তানী প্রণীত ‘মুহীতুল মুহীত’, সাঈদ শারতূনীর ‘আকরাবুল মাওয়ারিদ’, ফাদার লুইস মা‘লূফ (মৃ. ১৯৪৬ খৃ.) প্রণীত ‘আল-মুনজিদ’, ‘আল-মু‘জামুল ওয়াসীত’ প্রভৃতি। শেষোক্ত অভিধানটি বর্তমান যুগে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত।
– নূরুল ইসলাম