ভাষার অপপ্রয়োগ ও শব্দবাহুল্য
শাণিত হৃৎকলম -১ : বাহুল্য পরিহার
ভাষা ও কলম এ দু’টো যার আছে, অনেক লক্ষ্যই তার পক্ষে অনায়াসে অর্জন করা সম্ভব। বাঙালী মুসলিম হিসেবে ভাষাটাও আমাদের থাকা দরকার যথেষ্ট শুদ্ধ ও শাণিত। মুখেও এবং কলমেও। ভাষাগত পারদর্শিতা অর্জনে আমাদের পূর্বসূরিগণ ছিলেন খুবই সচেতন। তাদের রেখে যাওয়া কালজয়ী লক্ষ লক্ষ অমর গ্রন্থই যার সবচেয়ে বড় সাক্ষী। আরবি, ফারসি, উর্দুসহ যত ভাষায় মুসলমানরা কথা বলেছেন, সব ভাষার বাগডোর মুসলমানদের দখলেই ছিল সবসময়। এ কারণে আকাবিরদের লিখিত কোনো গ্রন্থে সামান্য কোনো ভুল বের করা যায় না; তা সে যে ভাষাতেই বলেন ও লেখেন।
অনেক হয়েছে বামদের, অনেকে লাফালাফি হয়েছে অপসংস্কৃতির; এবার ভাষার রাশটা টেনে ধরতে হবে আমাদের। মানুষকে সন্ধান দিতে হবে ডানের। সরলমনা মুসলিমদের উপহার দিতে হবে শুভসংস্কৃতি। শাণিত করতে হবে কলম। বাঙালী জাতিকে নেতৃত্ব দিতে হবে সামনে থেকে।
লেখকমনা আলেম, গায়রে আলেম, ছাত্রসহ সর্বস্তরের কলমপ্রেমিক ভাইদের উদ্দেশে আমার এ ক্ষুদ্র সিরিজ-প্রয়াস। বাংলা ভাষার ছাত্র হিসেবে দৈনন্দিন যা শিখছি, তাই অন্যদের জানানোর তাগিদে নিয়মিত উপহার দেয়ার চেষ্টা করবো ‘শাণিত হৃৎকলম’।
আল্লাহর যথাযথ প্রশংসা গেয়ে শুরু আজকের আয়োজন।
লেখা বা বলার সময় আমরা এমন অনেক শব্দ, বাক্য লিখি ও বলি, যা আসলে বাহুল্য হিসেবে বিবেচিত। এরকমই কিছু শব্দ ও বাক্য নিয়ে আজকের এই আয়োজন :
– আপামর জনগণকে আমার সালাম (পামর মানে দুর্বৃত্ত) ভুল প্রয়োগ এটা। এরকমটা বললে একশ্রেণীর মানুষকে আমরা দুর্বৃত্ত বানিয়ে ফেললাম। শুদ্ধরূপটা হবে : সর্বস্তরের জনগণ / সব শ্রেণীর নারী-পুরুষ / সব পেশাজীবী।
– অত্র প্রতিষ্ঠান (ভুল প্রয়োগ)। অত্র মানে এখানে। যেমন, যত্র-তত্র মানে যেখানে সেখানে। এর শুদ্ধরূপটা হবে : এই প্রতিষ্ঠান
– উপরোল্লিখিত / পূর্বোল্লিখিত / উল্লেখিত (এগুলো ভুল প্রয়োগ)। উল্লিখিত অর্থই হলো যা উপরে লেখা আছে (উৎ+লিখিত)। এখন তার আগে ‘উপর’ বা ‘পূর্বে’ বসানোটা হবে বাহুল্য।
– মৃত্যুবরণ (ভুল প্রয়োগ) মৃত্যুকে কেউ ইচ্ছা করে বরণ করে নেয় না (মৃত্যু হয়, মৃত্যু ঘটে, মৃত্যুমুখে পতিত হয়)
– অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, (ভুল প্রয়োগ)। কারণ অবগতি আর জানানো একই অর্থ। এখানে শুধু ‘অবগত করা যাচ্ছে যে’ অথবা ‘আপনাদের জানানো যাচ্ছে যে’ বলা যেতে পারে।
– ১১.১০.২০১৬ ইং : তারিখ লেখার সময় এই যে শেষদিকে ‘ইং’-টা আমরা যোগ করি, এটা কিন্তু মারাত্মক একটা ভুল; বাংলাদেশের প্রায় সব লেখক, উপস্থাপক এমনটা করে থাকেন। ইং বলতে এখানে তারা ইংরেজি বর্ষ বুঝিয়ে থাকেন। কিন্তু ইংরেজি বর্ষ নামে কোনো বর্ষের যে অস্তিত্ব নেই, সে খবর আমরা ক’জন রাখি! তবে হ্যাঁ, খ্রিষ্টীয় বর্ষ আছে। তাই শুদ্ধরূপটা হবে : ১১.১০.২০১৬ খ্রি.
– তাং, নং, ডাঃ, মোঃ : এগুলো যথাক্রমে তারিখ, নাম্বার, ডাক্তার ও মোহাম্মাদ শব্দের সংক্ষিপ্তরূপ হিসেবে আমরা ব্যবহার করে থাকি। এগুলো সম্পূর্ণ ভুল প্রয়োগ। ং এবং ঃ কিন্তু বাংলা ভাষার পৃথক দুটি অক্ষর; সংকেতচিহ্ন নয়। এক্ষেত্রে আমরা : তা. ন. ডা. ও মো. ব্যবহার করতে পারি।
– জবাবদিহিতা : এটি ভুল প্রয়োগ। (জওয়াব+দিহি) জবাবদিহি বললেই যথেষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ্যে রূপ নেয়। এরপরও শেষে ‘তা’ সংযুক্ত করাটা বাহুল্য।
– একত্রিত। শুদ্ধরূপটা হলো ‘একত্র’। এখানে ‘একত্র’ বিশেষ্যের সঙ্গে আবার ‘ইত-প্রত্যয়’ যোগ করাটা বাড়াবাড়ি।
– দুর্ঘটনাজনিত কারণে : ‘জনিত’ আর ‘কারণে’ কিন্তু একই অর্থ। ‘জনিত’ বললে ‘কারণ’ লাগবে না। আর ‘কারণ’ বললে ‘জনিত’ বিলুপ্ত হবে। আমরা ‘দুর্ঘটনার কারণে’ / ‘বার্ধক্যজনিত রোগ’ বলতে পারি।
– বক্তব্য রাখবেন : বক্তব্য শব্দের পর ‘রাখা’টা নিদারুণ ভুল প্রয়োগ। কারণ রাখা অর্থ- রক্ষা করা; যেমন অনুরোধ রাখা, কথা রাখা। বক্তব্য রাখা মানে হলো বক্তব্য রক্ষা করা। এখানে বক্তব্য উপস্থাপন করা / পেশ করা বলা যেতে পারে।
– আসছে আগামী মঙ্গলবার : কোনো সংবাদ বা অনুষ্ঠানের প্রচারণায় আমরা এমনটা বলে থাকি বা শুনে থাকি। অথচ ‘আসছে’ আর ‘আগামী’ কিন্তু একই অর্থ। একটি বললে অপরটির দরকার নেই। তাই আমরা ‘আগামী মঙ্গলবার’ / ‘আসছে মঙ্গলবার’ বলব।
– উমাইর লুৎফর রহমান