সচেতনতা

আপনার সন্তান কিভাবে বেড়ে উঠছে?

শিশুটির চোখ জ্বলজ্বল করছে, হাত মুষ্টিবদ্ধ, চোখেমুখে উত্তেজনা, পুরো শরীর ধনুকের মত টান টান হয়ে আছে। অথচ বেচারার বাবামা এই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যই করছেন না! সে একটি কার্টুন দেখছে। এখানে মানুষের প্রতিকৃতিসম্বলিত কিছু ফল ও সব্জীকে একটি কমলা বিভিন্ন পন্থায় অত্যাচার করছে- কারো মাথা কেটে ফেলছে, কাউকে ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, কাউকে ছুরি দিয়ে চিরে ফেলছে, কাউকে ছেঁচে ফেলছে, কাউকে ব্লেন্ডারে দিয়ে রক্তসদৃশ রস গ্লাসে ঢেলে নিচ্ছে। তাদের প্রবল আর্তনাদ আর বিকট চিৎকারে কমলাটি দাঁত কেলিয়ে হা হা হো হো করে হাসছে। সামসাময়িক পৃথিবীতে এই ঘটনার বাস্তবতার কথা মনে করে আমি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হয়েও এই দৃশ্য কিছুতেই সহ্য করতে পারছিনা, ছটফট করছি। আর ভাবছি শিশুটির কোমল মানসের ওপর এই বীভৎস দৃশ্যগুলো কি ধরনের অশুভ ছায়া ফেলছে। কোন বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন লোকজন এমন কার্টুন বানাতে পারে আমি জানিনা, কিন্তু যে বাবামায়েরা নির্বিচারে তাদের সন্তানদের বাজারের পাওয়া যায় বলেই এসব পণ্য গেলাচ্ছেন তারা কি একবারও ভেবে দেখছেন এর প্রতিক্রিয়া কি? প্রতিক্রিয়া পেতে বেশি অপেক্ষা করতে হোলনা। কার্টুন শেষ হতেই শিশুটি একটি ধারালো খেলনা নিয়ে একটি গাছের ওপর একই পন্থা প্রয়োগ করতে শুরু করল। গাছটিকে প্রদর্শিত পন্থায় উপর্যুপরি আঘাত করতে করতে একটি ডাল কেটে ফেলল, তারপর গাছের পাতাগুলোকে ছেঁচে থ্যাবড়া বানিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলল। বাবামা বাঁধা দিতে গেলে সে হিংস্র হয়ে উঠল এবং জোরপূর্বক কোল থেকে নেমে টেলিভিশনে ধাম ধাম করে বাড়ি দিতে লাগল। বাবামা উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে লাগলেন তারা বুঝতে পারছেন না কেন শিশুটি দিন দিন এমন হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। একটি শিশু যখন জন্মায় সে কিছুই বোঝেনা, কেবল চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সে এতদিন যা গ্রহন করে এসেছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে তার কথাবার্তা, আচরনে। তাহলে শিশুটির এই নরম কোমল মানসকে কলুষিত করার জন্য কে দায়ী? সিদ্ধান্ত আপনাদের।

আমি তখন ক্লাস সেভেনে। আবুধাবীতে। বাংলাদেশ স্কুল থেকে এস এস সি পরীক্ষা দেয়ার ব্যাবস্থা নিশ্চিত নয়। ভর্তি হলাম একটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। প্রথমদিন স্কুলবাসে উঠে দেখি অধিকাংশ ছেলেমেয়ের হাতে একটি ছোট্ট বই। জিজ্ঞেস করে জানলাম এটি কুরআন শরীফের পকেট ভার্শান, সেই প্রথম আমার পকেট কুরআন দেখা। সব আরবী এবং প্রচুর পাকিস্তানী ছেলেমেয়েদের বাসে যাওয়া আসা, টিফিন টাইম, ফ্রি পিরিয়ড, এমনকি দুই পিরিয়ডের মধ্যবর্তী সময় শিক্ষক আসতে দেরী হলে সে সময়টুকুও কাটত কুরআন তিলাওয়াত করে কিংবা এর অংশবিশেষ মুখস্ত করে। আরবী বাচ্চারা ভয় জিনিসটি ছোটবেলা থেকেই শেখেনা। ওরা যখন দোলনায় চড়ত তখন মনে হত দোলনা নিয়ে আকাশে উড়ে যাবে নতুবা দোলনা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। অথচ এই দুরন্ত সাহসী আরবী ছেলেদের কোনদিন দেখিনি দুষ্টুমী করেও খেলার মাঠে কিংবা স্কুলে মেয়েদের সেকশনে প্রবেশ করতে। আমার এক ঈজিপশিয়ান বান্ধবী ছিল, জিহান। সে যেমন ছিল লেখাপড়ায়, তেমনই হাতের কাজে, তেমনই ধর্মীয় জ্ঞানে এবং চর্চায়। শুধু জিহান নয়, সব আরবী মেয়েদের দেখতাম যারা লেখাপড়ায় কাঁচা তাদের সাহায্য করতে। আমি সঠিক উচ্চারণে কুরআন পড়তে পারতাম না, সে আমাকে পাশে বসে কুরআন পড়া শিখিয়েছে। আমি সেলাই পারতাম না, সে আমাকে হাতে ধরে সেলাই শিখিয়েছে যেন পরীক্ষায় পাশ করতে পারি। সেই বয়সেই অসাধারন রূপবতী জিহানের ছিল হাঁটুসমান সোনালী চুল, অথচ সে এমনভাবে হিজাব করত যে আমরা কোনদিন ক্লাসে ওর এক গোছা চুলও দেখতে পাইনি। আমি স্কার্ফ পরতে জানতাম না, সে আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে সঠিকভাবে স্কার্ফ পরতে হয়। যুহরের নামাজ হত স্কুল অডিটরিয়ামে। সে একদিন নামজের পর আমার সাথে বসে রুকু এবং সিজদার ভঙ্গিগুলো ঠিকভাবে বুঝিয়ে দিলো, হাতেকলমে দেখিয়ে দিল এবং আমাকে দিয়ে প্র্যাক্টিস করিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলো আমি পদ্ধতিগুলো ঠিকভাবে শিখেছি কিনা। আবার যেবার আমি প্রথম ইংরেজীতে হাইয়েস্ট পেলাম সেবার সে আগ বাড়িয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাল যদিও এর পর সে আর হৃত স্থানটি ফিরে পায়নি। যেবার প্রথম ইয়াং টাইমসে আমার লেখা ছাপা হোল তখন লন্ডন থেকে আগত দুই ফিলিস্তিনি বান্ধবী উচ্ছ্বসিত হয়ে ফোন করল এবং অনেকক্ষণ কথা বলল, যদিও আমার ক্লাসে একমাত্র বাংলাদেশী মেয়েটি নাক সিঁটকানো ছাড়া আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। এদের বাবামা এদের ছোটবেলা থেকে কুরআনের সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর কুরআনই তাদের পথ দেখাচ্ছে কিভাবে একজন উত্তম মানুষ হতে হবে। এদের মাঝে প্রস্ফুটিত এবং বিকশিত হচ্ছিল বিশ্বাস, সাহস, উদারতা, সহমর্মীতা, সংবেদনশীলতা, সহযোগিতার মত গুনাবলী; আপনিই ঝরে পড়ছিল হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, কৃপণতা, পরশ্রীকাতরতার মত ব্যাধিগুলো। অথচ এর জন্য ওদের বাবামায়ের তেমন কোন কষ্ট করতে হয়নি হাতে একটি বই ধরিয়ে দেয়া ছাড়া!

আমাদের দেশে বাবা মায়েরা অত্যন্ত স্নেহশীল। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হোল, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’। কিন্তু অন্যের সন্তানটিও যেন দুধেভাতে থাকে সেজন্য আমরা সচরাচর কোন উদ্যোগ নেইনা। তাই, আমাদের সন্তানরা আমাদের আদর্শ অনুসরন করে কেবল ‘চাচা, আপন পরান বাঁচা’তেই শেখে, অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল কিংবা ন্যূনপক্ষে সহানুভূতিশীল হতে শেখেনা। কিন্তু আমরা কি চাইনা আমিত্বকে অতিক্রম করে একটি বৃহত্তর গন্ডিতে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখতে? আমরা কি চাইনা কেবল এই মূহূর্তের জন্য না বেঁচে ইতিহাসে অবিনশ্বর হয়ে থাকতে? আমরা কি চাইনা শুধু পার্থিব জীবনে ভাল না থেকে অনন্ত জীবনেও সাফল্য লাভ করতে?

আমি যখন শিক্ষকতা করতাম তখন আমার ছাত্রছাত্রীদের বলতাম, ‘তোমাদের কৃতিত্বের মাঝেই আমার সাফল্য’। হে পিতা! হে মাতা! আপনার সন্তানের জীবন সাজিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আপনার। আপনার সন্তানের জন্য আজই পরিকল্পনা করুন, আজকের দিনটি তাদের সাথে ব্যায় করুন, আজই তাদের ভবিষ্যত গড়ার ব্যাপারে সচেতন হোন, গড্ডালিকা প্রবাহে না ভেসে সন্তানদের চলার পথটি নিজ হাতে সাজিয়ে দিন যেন তা ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ হতে না পারে, কন্টকাকীর্ণ না হয়, যেন পার্থিব প্রাপ্তিই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য সাব্যাস্ত না হয়। এর ফলে হয়ত আপনি আপনার কাঙ্খিত লক্ষ্য থেকে ইঞ্চিখানেক পিছিয়ে পড়তে পারেন। তখন নিজেকে মনে করিয়ে দিন, ‘আমার সন্তানের সাফল্যই আমার কৃতিত্ব’। একটিবার আপনার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আপনার সাহচর্যে তার উচ্ছ্বল হাসি আপনাকে আপনার সকল ব্যাস্ততা ভুলিয়ে দেবে। বৃদ্ধাবস্থায়ও আপনি পস্তাবেন না, কারণ তখন সে আপনাকে সাহচর্য দেবে যেহেতু আপনি আজ তার জন্য আপনার ক্যারিয়ার, আপনার ব্যাস্ততা, আপনার সম্পদের মোহ বিসর্জন দিচ্ছেন- তাকে নিজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। ভেবে দেখুন, আপনার সন্তানই কি আপনার শ্রেষ্ঠ সম্পদ নয়? তাহলে কেন তাকে ছেড়ে দিচ্ছেন কতগুলো অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মানসিক রোগীর হাতে, কেন তাকে নিজের যত্ন দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলছেন না, কেন ছুটছেন সাফল্য আর সম্পদের পেছনে যখন সে আপনার ঘরেই বসে আপনার জন্য হাহাকার করছে? হে পিতা, হে মাতা! সময় সীমিত। ফিরে আসুন দেরী হয়ে যাবার আগেই!

 

– রেহনুমা বিনতে আনিস

মন্তব্য করুন

Back to top button