সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

বিনোদন ও সংস্কৃতি

পূর্বযুগে রাজা-বাদশারা যৌবিক চাহিদা মেটানোর জন্য রক্ষিতা পুষত, আমোদ-প্রমোদের জন্য নর্তকী রাখত। সেসব রক্ষিতা ও নর্তকী প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্য সব করত। স্বেচ্ছায় করত না, করতে বাধ্য হতো। শুধু নৃত্যের শিল্পগুণে নয়, দেহসুষমা, অঙ্গ-শৌষ্ঠব ও রূপ-যৌবনের বিচারে প্রভু-কর্তৃক এদের মূল্য নির্ধারিত হতো। প্রভুদের ভোগ-লালসার অনুকূলেই রচিত হতো তখনকার কাব্য, সঙ্গীত, শিল্প।

যুগ পাল্টেছে। দুনিয়া নাকি এখন সভ্য হয়েছে। সভ্যযুগে রক্ষিকা পুষতে হয় না, নর্তকী রাখতে হয় না। কিছু নারী মানুষের আমোদ-প্রমোদের জন্য নিজেদের নিয়োজিত করছে স্বেচ্ছায়-সানন্দে। উদ্দেশ্য সামান্য অর্থকড়ি আর মূল্যহীন যশখ্যাতি। এবং এতে তারা কুণ্ঠিত নয়, লজ্জিত নয়; বরং গর্বিত।

এ যুগে এসেও মূল্য-নির্ধারণের আদি রীতি অনুসৃত হচ্ছে। রূপ, যৌবন, দেহসুষমা, অঙ্গশোভা। কাব্য-সঙ্গীত-শিল্পও বলতে গেলে দেহকেন্দ্রিক। ভোগ-লালসাই শেষ কথা। শিল্প-সংস্কৃতি মোড়ক মাত্র।

যাদের পতিতা বলা হয়, ‘বেশ্যা’র মতো কুৎসিত শব্দে ডাকা হয়— তাদের কথা বলছি না। তারা কেউ স্বেচ্ছায়-সানন্দে এই ঘৃণ্য পথে পা বাড়ায় নি। হয়ত পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করেছে, নয়ত দালালের খপ্পরে পড়ে আসতে হয়েছে। তবু তাদের লজ্জাবোধ আছে। তারা লজ্জায় বংশ-পরিচয় প্রকাশ করে না। পুলিশ-কর্তৃক ধৃত হলে ক্যামেরার সামনে আসতে চায় না। কলঙ্কিত চেহারা দেখাতে কুণ্ঠা বোধ করে। লজ্জায় মুখ ঢাকে। এরা ঘৃণ্য নয়, সহানুভূতিযোগ্য।

বলছি তাদের কথা, যারা নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে আনন্দিত; মানুষের মনোষ্কাম মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে গর্বিত। আদর করে আমরা যাদের অভিনেত্রীে বলি, মডেল বলি।

মডেল বলি যাদের, তাদের কাজই তো পণ্যের সঙ্গে নিজেদেরও বিপণন। শাড়ি-গহনা থেকে নিয়ে পুরুষের আন্ডাওয়্যার— সব বিজ্ঞাপনে নারী। কেন? নারীদেহ দেখিয়ে পণ্যের প্রতি গ্রাহক-আকর্ষণ বাড়ানো নয় কি?

রিসিপশনে সেজেগুজে বসে থাকে যে নারী, সে বুঝেশুনেই নিজে ব্যবহৃত হচ্ছে— তা নয় কি?

পূর্বযুগে রক্ষিতা ও নর্তকী ছিল। এ যুগেও আছে। ব্যবধান কেবল রঙে, ঢঙে, ভঙ্গিমায়। এ নারীর আদি দাসত্ব বৈকি। আগে নর্তকীর উদ্দাম নৃত্য সংরক্ষিত ছিল কেবল আমীর-উমারার জন্য। এ যুগে তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। পয়সাওয়ালা ফাইভ স্টার হোটেলে সরাসরি দেখতে পারে, রিক্সাওয়ালা একশ টাকা খরচ করে সিনেমার পর্দায় গিয়ে দেখে— ব্যবধান কেবল এ-ই।

এ যুগের নাটক-সিনেমায় গল্প-শিল্প খুঁজে পাওয়া মুশকিল। স্রেফ রগরগে নারীদেহের প্রদর্শনী। আজকের নাটক-সিনেমায়-বিজ্ঞাপনে নারীরা যেভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, তা নারীদের জন্য অমর্যাদাকর। যেভাবে স্থূল ও তরল উপাদান দিয়ে নাটক-সিনেমা নির্মিত হচ্ছে, এতে সুস্থ মনন-রুচির বিন্দু-বিসর্গ অবশিষ্ট থাকছে না। এতে মাতৃজাতির উপস্থাপনা যেমন আপত্তিকর, তেমনি যুবসম্প্রদায়ের নৈতিক বোধ বিলুপ্ত করার জন্যও যথেষ্ট কার্যকর। তরুণপ্রজন্মের মধ্যে এসব মনন-বিমুখতার জন্ম দেয়। রুচির দুর্ভিক্ষ অনিবার্য করে তোলে। এগুলো সংস্কৃতির নামে স্রেফ অপসংস্কৃতি। গুটিকয় ছাড়া এখনকার নাটক-সিনেমা মানেই বিকৃত পুরুষের কামেচ্ছা জাগরণের আশ্চর্য বটিকা। বিফলে মূল্য ফেরত!

সব জায়গায়ই ফর্সা-সুন্দরী নারী। কালো-কুৎসিত নারীর বাজার ভালো নয়। এই হিসেবে আমরা একে চামড়া-ব্যবসা বলতে পারি। আজকে দুনিয়াজুড়ে চামড়া-ব্যবসা দেদার চলছে। খুব বিকিকিনি চলছে শ্রেষ্ঠ জীবের অমূল্য চামড়ার। আফসোস!

সভ্যযুগে এই হলো বিনোদন আর সংস্কৃতি। নারীদের উৎকট নগ্ন প্রকাশই এখনকার সংস্কৃতি। আমাদের গোড়ায় গলদ। আমরা বিনোদন আর সংস্কৃতির মর্ম বুঝতে ব্যর্থ অবশ্যই।

এক্ষণে ‘বিনোদন’ আর ‘সংস্কৃতি’ সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত জানা প্রয়োজন বোধ করছি।

‘সংস্কৃতি’ শব্দটির মূলে আছে সংস্কার। ‘সংস্কার’ অর্থ শোধন, পতিতাবস্থা থেকে মুক্তকরণ, পরিমার্জন, আজন্ম ধারণা, বিশ্বাস। শব্দটির বিশেষণবোধক ‘সংস্কৃত’ থেকে গঠিত হয়েছে বিশেষ্য ‘সংস্কৃতি’।

এই অর্থে মার্জিত ও সুস্থ উদ্যাপন এবং আজন্ম বিশ্বাসের লালনকেই কেবল সংস্কৃতি বলা সম্ভব। অন্যদিকে ‘বিনোদন’ অর্থ কৌতূহল, আমোদ-প্রমোদ, বিহার ইত্যাদি। এই হিসেবে যে কোনো আমোদ-প্রমোদকেই বিনোদন বলা যাবে। চাই তা মার্জিত হোক, অথবা অমার্জিত। কিন্তু বিনোদন যখন সংস্কৃতি, তখন এই দুটিকে সমন্বয় করতে হবে। দুটিকে সমন্বয় করে বলা যায়, সুস্থ ও মার্জিত উপায়ে আমোদ করাই বিনোদন-সংস্কৃতি। প্রশ্ন হলো আমাদের বিনোদনমাধ্যমকে যে আমরা সংস্কৃতি বলি, তা কি মার্জিত এবং সুস্থ? এবং এতে কি আমাদের বাঙালি ও মুসলিম সমাজের দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস ও আচারের প্রতিফলন ঘটছে?

এই যে এসব বললাম, নারীবাদীদের চোখে আমি নিশ্চয় অসভ্য, নারীবিরোধী ও সংস্কৃতিবিরোধী সনদ পাবার যোগ্যতা লাভ করেছি।

নারীবাদ শেষ জমানার আজব আবিষ্কার। নারীদের স্বার্থ ও সম্মান-রক্ষা যাদের মূল কর্তব্য, তারা নারীদের বিপণন দেখেও নিশ্চুপ, নির্বিকার। বরং আশ্চর্যজনকভাবে বিপণন-বিরোধীদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ।

আল্লাহ আমাদের সুমতি দিন। আমীন!

 

– আবুল কাসেম আদিল

 

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button