ইহকাল-পরকাল

ত্বাগূতের পরিচয় ও পরিণাম

‘ত্বাগূত’ নয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা ফায়ছালাই হল চূড়ান্ত ফায়ছালা। আল্লাহ মানুষের স্রষ্টা। তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন কোথায় মানুষের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাই কোন মানুষ আল্লাহর আইন ব্যতীত আল্লাহদ্রোহী ত্বাগূতের রচনা করা কোন আইনকে বিশ্বাস করতে পারে না, মানতেও পারে না।

ত্বাগূতের পরিচয় :

‘ত্বাগূত’ অর্থ- সীমালংঘনকারী, বিপদগামী, আল্লাহদ্রোহী, আল্লাহর বিধান লংঘনকারী নেতা, অবাধ্য, পথভ্রষ্ট, শয়তান, মূর্তি, দেবতা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) প্রদত্ত বিধানের অনুসরণ না করে মানব রচিত আইন বা শয়তানের অনুসরণ করাই হল ‘ত্বাগূত’।[1]

ত্বাগূতের প্রকারভেদ :

মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে ত্বাগূত পাঁচ প্রকার।[2] যেমন :

(ক) ইবলীস শয়তান। শয়তান ত্বাগূতদের প্রধান। সে মানুষকে ভ্রষ্টতা, কুফরী, ধর্মহীনতা ও জাহান্নামের দিকে আহবান করে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা কুফরী করে তাদের পৃষ্ঠপোষক হল ত্বাগূত। সে তার অনুসারীদেরকে হেদায়াত থেকে ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়। মূলতঃ তারাই জাহান্নামের অধিবাসী, তারা চিরকাল সেখানে অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ ২৫৭)।

(খ) আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদত করা হয়। অথচ আল্লাহ বলেন, যারা ত্বাগূতের পূজা করে তাদের উপর তিনি অভিসম্পাত করেছেন (মায়েদাহ ৬০)।

(গ) যে ব্যক্তি গায়েবের খবর রাখে বলে দাবী করে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েব বা অদৃশ্যের খবর রাখে না। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! আপনি বলুন, আল্লাহ ছাড়া আসমান ও যমীনের কেউই গায়েবের জ্ঞান রাখে না’ (নামল ৬৫)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমাকে বলবে যে, রাসূল (ছাঃ) গায়েব জানেন, তাহলে সে মিথ্যা বলবে’।[3]

(ঘ) যে ব্যক্তি জনগণকে তার ইবাদত করার জন্য আহবান জানায়। যেমন ছূফী ও মিথ্যা ত্বরীকাধারী পথভ্রষ্ট ফকীরেরা এই দাবী করে। তারা বলে, বাবার পূজা করলেই সবকিছু পাওয়া যায়। তারা মানুষের উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। আল্লাহ বিধর্মীদের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেম ও ধর্ম যাজকদেরকে রব হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহকেও গ্রহণ করেছে। অথচ তাদের প্রতি শুধু আদেশ করা হয়েছে যে, তারা একমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবে, যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তারা যা অংশীদার স্থির করে, তা থেকে তিনি মহাপবিত্র’ (তওবা ৩১)।[4]

(ঙ) আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান প্রত্যাখ্যান করে যে ব্যক্তি মানব রচিত আইন দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে। আল্লাহ তাদের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘আপনি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করেননি, যারা মনে করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল করা হয়েছে, তার প্রতিও তারা বিশ্বাস করে- অথচ তারা তাদের ফায়ছালা ত্বাগূতের কাছে কামনা করে। যদিও তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন ত্বাগূতকে অস্বীকার করে। মূলতঃ শয়তান তাদেরকে দূরতম বিভ্রান্তিতে ফেলতে চায়’ (নিসা ৬০)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘যারা ঈমান আনয়ন করে তারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে এবং যারা কুফরী করে তারা ত্বাগূতের রাস্তায় যুদ্ধ করে। অতএব তোমরা শয়তানের এজেন্টদের সাথে সংগ্রাম কর। নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল’ (নিসা ৭৬)।

উক্ত ত্বাগূতকে বর্জন করার জন্যই আল্লাহ প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক জনপদে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক উম্মতের মাঝে রাসূল পাঠিয়েছি এই জন্য যে, তারা যেন নির্দেশ দেন- তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূতকে বর্জন কর’ (নাহল ৩৬)।

দুঃখজনক হল, আমরা ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’-এর অর্থ যেমন বুঝি না, তেমনি ত্বাগূতের অর্থও বুঝি না। অথচ যতক্ষণ ত্বাগূত বা মানব রচিত মতবাদকে অস্বীকার না করা হবে, তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নেয়া হবে এবং তাকে উৎখাত ও প্রতিরোধ করার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত না রাখা হবে, ততক্ষণ আল্লাহর একত্ব প্রমাণিত হবে না। সুতরাং প্রচলিত মা‘বূদগুলোকে আগে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করতে হবে, নাকচ করতে হবে। তারপর এক আল্লাহকে স্থান দিতে হবে। কারণ বিষের মধ্যে দুধ ঢেলে কোন লাভ নেই। অনুরূপ আলকাতরার মাঝে ঘি রেখেও কোন ফায়েদা নেই। এ জন্য ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’-এর অর্থ সে সময় মক্কার মূর্তিপূজারী মুশরিকরা বুঝেছিল। তাই তারা রাসূল (ছাঃ)-কে পাথর মেরেছিল।[5] তারা বুঝেছিল যে, এই বাক্য উচ্চারণ করলে বাপ-দাদার প্রতিষ্ঠিত জাহেলী যুগের ধর্ম আর চলবে না। সব বাতিল প্রমাণিত হবে।

বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ উক্ত বাক্য অনর্গল উচ্চারণ করে। কিন্তু গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন শিরকী ধর্ম ও মতবাদের আইন-কানূন, নিয়ম-নীতি ও আদর্শ মেনে চলে। অথচ এগুলো সবই ত্বাগূতী বিধান ও শিরকের শিখণ্ডী, যা রাজনীতির নামে চালু আছে। অনুরূপ ছূফীবাদী কুমন্ত্রণা, পীর-মুরীদী ধোঁকাবাজী, মারেফতী শয়তানী, মাযহাবী ফেতনা, তরীক্বার নষ্টামি, ইলিয়াসী ফযীলত ইত্যাদি মতবাদের নীতি-আদর্শ স্রেফ ধর্মের নামে লুকোচুরি। উপরিউক্ত উভয় প্রকার ত্বাগূতী ফায়ছালাকে যতক্ষণ অস্বীকার না করবে, ততক্ষণ কেউ আল্লাহ তা‘আলার শক্ত হাতলকে ধারণ করতে পারবে না (বাক্বারাহ ২৫৬)। অতএব ত্বাগূতকে অস্বীকার করা ছাড়া মুমিনের জন্য অন্য কোন পথ খোলা নেই।

ত্বাগূতের পরিণাম :

ত্বাগূতের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অর্থই হল শিরক, কুফর ও নাফরমানীর সাথে জড়িত থাকা। এ জন্য মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও অসংখ্য মানুষ ত্বাগূতের সাথে জড়িত। তারা নিজেদেরকে ঈমানদার মনে করলেও মূলতঃ শয়তানের আনুগত্য করে থাকে। শয়তান তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেছে এবং পথভ্রষ্ট করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের অধিকাংশই যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তারা তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করে’ (ইউসুফ ১০৬)।

তাই ত্বাগূতের সাথে আপোস করে ঈমানদার হওয়ার দাবী করে কোন ফায়েদা নেই। মনেপ্রাণে ত্বাগূতী আইন ও শাসন ব্যবস্থাকে বর্জন করলে বিচারের মাঠ সহজ হবে। অন্যথা জাহান্নাম ছাড়া কোন গতি থাকবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ সমস্ত মানুষকে ক্বিয়ামতের দিন একত্রিত করে বলবেন, পৃথিবীতে যে যার ইবাদত করেছে, সে যেন আজ তার অনুসরণ করে। তখন যারা সূর্যের পূজা করত তারা সূর্যের অনুসরণ করবে। যারা চন্দ্রের পূজা করত তারা চন্দ্রের অনুসরণ করবে। আর যারা ত্বাগূতের ইবাদত করত তারা ত্বাগূতের অনুসরণ করবে। কেবল এই উম্মত অবশিষ্ট থাকবে। তন্মধ্যে মুনাফিকরাও থাকবে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিকটে এমন আকৃতিতে আসবেন, যা তারা চিনে না। তারপর আল্লাহ বলবেন, আমি তোমাদের প্রভু (আমার সাথে চল)। তারা বলবে, নাঊযুবিল্লাহ। আমাদের প্রভু না আসা পর্যন্ত আমরা এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। আর তিনি যখন আসবেন, তখন আমরা তাকে চিনতে পারব। তখন আল্লাহ তাদের নিকট পরিচিত আকৃতিতে আসবেন এবং বলবেন, আমি তোমাদের রব। তারা বলবে হ্যাঁ, আপনি আমাদের রব। এরপর তারা তাঁকে অনুসরণ করবে। এমন সময় জাহান্নামের উপর দিয়ে (ছিরাত) সাঁকো বসানো হবে। আর আমি ও আমার উম্মতই হব এই পথের প্রথম অতিক্রমকারী …।[6] হাদীছের পরের অংশে এসেছে, মুনাফিকদের সিজদা করতে বলা হবে, কিন্তু তারা সিজদা করতে পারবে না। তাদের পীঠ তক্তার মত শক্ত হয়ে যাবে।[7]

অন্য হাদীছে এসেছে, ‘ক্বিয়ামতের দিন সকল দলকে লক্ষ্য করে একজন আহবানকারী আহবান করে বলবেন, পৃথিবীতে যারা যার ইবাদত করেছে, তারা যেন তার সাথে যায়। এরপর যারা ক্রুশের পূজা করেছিল, তারা ক্রুশের সাথে যাবে। মূর্তিপূজারীরা যাবে মূর্তির সঙ্গে। এছাড়া যারা অন্যান্য মা‘বূদের ইবাদত করেছে, তারা তাদের সাথে যাবে। অবশিষ্ট থাকবে কেবল তারাই, যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করেছে। ভাল মানুষ হোক আর খারাপ মানুষ হোক। আহলে কিতাবেরও কিছু মানুষ থাকবে। অতঃপর জাহান্নামকে নিয়ে আসা হবে। সেটি থাকবে মরীচিকার মত।

ইহুদীদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা কিসের ইবাদত করতে? তারা বলবে, আমরা আল্লাহর পুত্র উযায়ের (আঃ)-এর ইবাদত করতাম। তখন তাদেরকে বলা হবে, তোমরা মিথ্যা বলছ। কারণ আল্লাহর কোন স্ত্রীও নেই, সমত্মানও নেই। এখন তোমরা কী চাও? তারা বলবে, আমরা চাই, আপনি আমাদেরকে পানি পান করান। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা পানি পান কর। এরপর তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে থাকবে। খ্রীস্টানদেরকে বলা হবে, তোমরা কিসের ইবাদত করতে? তারা বলবে, আমরা আল্লাহর পুত্র মসীহর (ঈসা (আঃ)) ইবাদত করতাম। তখন তাদেরকে বলা হবে, তোমরা মিথ্যা বলছ। কারণ আল্লাহর কোন স্ত্রীও নেই, সম্মানও নেই। এখন তোমরা কী চাও? তারা বলবে, আমরা চাই, আমাদেরকে পানি পান করান। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা পানি পান কর। এরপর তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে থাকবে।[8] ছহীহ মুসলিমে এসেছে, তারা পানি খেতে চাইলে তাদেরকে ঘাটে যাওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে আগুনের লেলিহান শিখা পানির মত ঢেউ খেলবে। এর একাংশ আরেকাংশকে গ্রাস করবে। তারা তখন জাহান্নামে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকবে।[9]

মুসলিমরা ত্বাগূতকে ভয় করে না। তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশকে উপেক্ষা করে পীর-ফক্বীর, দরবেশ, ইমাম, আলেম, দার্শনিক, পণ্ডিত প্রভৃতি ব্যক্তির আদর্শের অনুসরণ করে থাকে। এ সমস্ত ত্বাগূতই তাদের সম্বল। আল্লাহকে বাদ দিয়ে এ সমস্ত রবের ইবাদত করছে, যা ইহুদী-খ্রীস্টানদের স্বভাব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা তো আল্লাহ ব্যতীত শুধু মূর্তিপূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ। তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের পূজা কর, তারা তোমাদের রূযীর মালিক নয়। সুতরাং তোমরা রূযী কামনা কর আল্লাহর নিকট এবং তাঁরই ইবাদত কর ও তাঁরই কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। তোমরা তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আনকাবূত ১৭)।

ত্বাগূতকে প্রত্যাখ্যান করার প্রতিদান :

ত্বাগূতকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যারা ত্বাগূতের পূজা থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। সুতরাং আপনি আমার বান্দাদেরকে সুসংবাদ প্রদান করুন’ (যুমার ১৭)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় ভ্রষ্টতা হতে হেদায়াত স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং যে ব্যক্তি ত্বাগূতকে অস্বীকার করল এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করল, সে সুদৃঢ় হাতলকে শক্ত করে ধরল, যা কখনো বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞানী’ (বাক্বারাহ ২৫৬)।

একমাত্র আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণের নির্দেশ :

ইবাদত, তাক্বওয়া, ভয়, সাহায্য, দু‘আ, বিধান, আইন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে গ্রহণ করতে পারলে মুমিন জীবনে সফলতা সুনিশ্চিত।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তাদের প্রতি শুধু আদেশ করা হয়েছে, তারা একমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবে, যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তারা যে অংশীদার স্থির করে, তা থেকে তিনি মহাপবিত্র’ (তওবা ৩১)। অন্যত্র বলেন, ‘তাদেরকে কেবল আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে শুধু আল্লাহর ইবাদত করবে’ (সূরা বাইয়েনাহ ৫)।

‘জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনত এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও যমীনের বরকতের উৎস সমূহ খুলে দিতাম। কিন্তু তারা নবী-রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। ফলে তাদের কৃতকর্মের জন্য আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি’ (আ‘রাফ ৯৬)।

‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা কর না, চন্দ্রকেও নয়; বরং সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করে থাক’ (হামীম সাজদাহ ৩৭)।

ইবরাহীম (আঃ) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আপোসহীন চিত্তে তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের সাথে এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যার ইবাদত কর তার সাথে, আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি। তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত না করা পর্যন্ত তোমাদের ও আমাদের মাঝে শত্রম্নতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হল’ (মুমতাহানা ৪)।

নবী-রাসূলগণের দৃষ্টান্ত :

নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের তাওয়াক্কুল ও দ্বীনী দৃঢ়তা এত গভীর ও শক্ত ছিল, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। ইবরাহীম (আঃ) বিপদের মুহূর্তে তাঁর দৃঢ়তা প্রকাশ করছেন এভাবে-

‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই আমাকে খাওয়ান ও পান করান। আর আমি যখন রোগাক্রান্ত হই, তখন তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন। তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর আমাকে পুনর্জীবিত করবেন এবং আশা করি ক্বিয়ামতের দিন আমার অপরাধ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন’ (শু‘আরা ৭৮-৮১)।

চন্দ্র, সূর্য ও তারকা পূজারীদের সামনে নিজের দৃঢ়তা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার মুখম-লকে আমি একনিষ্ঠভাবে সেই মহান সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর সাথে ঝগড়া করতে লাগলে তিনি বলেন, তোমরা কি আল্লাহর ব্যাপারে আমার সাথে ঝগড়া করছ। অথচ তিনি আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। তোমরা আল্লাহর সাথে যা কিছু শরীক করছ, আমি ওটাকে ভয় করি না, তবে আল্লাহ যদি কিছু চান। প্রতিটি বস্ত্ত সম্পর্কে আমার রবের জ্ঞান খুবই ব্যাপক। এরপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না’ (আন‘আম ৭৯-৮০)।

ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর স্ত্রী সারাহ যালেম শাসকের কবলে পড়ে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় আস্থার যে নযীর রেখেছেন, তা বিশ্ব ইতিহাসে অদ্বিতীয়।[10] তাছাড়া নমরূদের জ্বালানো আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে তিনি মোটেও পরোয়া করেননি (আলে ইমরান ১৭৩; আম্বিয়া ৬৭-৭০)।[11]

অনুরূপ মূসা (আঃ) ফেরআঊনের করালগ্রাসে পড়ে যে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, তা চির ভাস্বর। ফলে আল্লাহ বিশাল সাগরের মাঝ দিয়ে রাস্তা তৈরি করে দেন এবং তাদেরকে পার করে দিয়ে ফেরআঊনসহ তার সৈন্য বাহিনীকে ডুবিয়ে মারেন (শু‘আরা ৬১-৬৬)। শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ তাওয়াক্কুলের ক্ষেত্রে বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। হিজরতের সময় ঘটে যাওয়া ‘গারে ছাওর’-এর দৃষ্টান্ত তার অন্যতম (তওবা ৪০)।[12]

রাসূল (ছাঃ)-এর মুখ থেকে সর্বদা যা উচ্চারিত হত, তা তাঁর উম্মতের তাওহীদী চেতনাকে প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘আপনি বলুন! আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবকিছুই জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তার কোন শরীক নেই, আমাকে এটাই নির্দেশ করা হয়েছে। আর আমি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি’ (আন‘আম ১৬১-১৬৩)।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর পিছনে ছিলাম। তিনি বললেন, হে বৎস! আল্লাহর অধিকার সংরক্ষণ কর, আল্লাহ তোমাকে সংরক্ষণ করবেন। তুমি আল্লাহর উপর ভরসা কর, তোমার প্রয়োজনে তাঁকে পাবে। যখন তুমি চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। তুমি জেনে রাখ! সমস্ত মানুষ যদি তোমার উপকার করার চেষ্টা করে তারা সক্ষম হবে না, যদি আল্লাহ তা তোমার জন্য নির্ধারণ না করেন। আর যদি সকলে মিলে কোন বিষয়ে তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে, আর আল্লাহ যদি তা নির্ধারণ না করেন, তাহলে তারা তা করতে পারবে না। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং খাতা বন্ধ করা হয়েছে।[13]

 

লেখক: মুযাফফর বিন মুহসিন


 

[1] ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ১/৫০ পৃঃ।

[2] ফাতাওয়া ফাওযান ২য় খ- দ্রঃ।

[3] ছহীহ বুখারী হা/৭৩৮০, ২/১০৯৮ পৃঃ, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪।

[4] বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/২০৮৪৭, সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৯৩; তিরমিযী হা/৩০৯৫।

[5] আহমাদ হা/১৬৬৫৪, সনদ ছহীহ।

[6] ছহীহ মুসলিম হা/৪৬৯, ১/১০০ পৃঃ, (ইফাবা হা/৩৪৮), ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮৮; ছহীহ বুখারী হা/৭৪৩৭ ও ৭৪৩৯, ২/১১০৬-১১০৭ পৃঃ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪;; মিশকাত হা/৫৫৭৮, ‘হাশর ও শাফা‘আত’ অধ্যায়।

[7] ছহীহ মুসলিম হা/৪৭২, ১/১০২ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮৮।

[8] ছহীহ বুখারী হা/৭৪৩৯, ২/১১০৭ পৃঃ, (ইফাবা হা/৬৯৩২, ১০/৫৭০ পৃঃ), ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪।

[9] ছহীহ মুসলিম হা/৪৭২, ১/১০২ পৃঃ, (ইফাবা হা/৩৫১); মিশকাত হা/৫৫৭৮।

[10] ছহীহ বুখারী হা/২২১৭, ১/২৯৫ পৃঃ, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১০০।

[11] ছহীহ বুখারী হা/৪৫৬৩, ২/৬৫৫ পৃঃ ‘তাফসীর’ অধ্যায়, সূরা আলে ইমরান ১৭৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা অনুচ্ছেদ।

[12] ছহীহ বুখারী হা/৪৬৬৩, ২/৬৭২ পৃঃ ‘তাফসীর’ অধ্যায়, সূরা আলে তওবা ৪০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা অনুচ্ছেদ।

[13] তিরমিযী হা/২৫১৬, ২/৭৮ পৃঃ, ‘ক্বিয়ামতের বিবরণ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫৯; মিশকাত হা/৫৩০২, সনদ ছহীহ।

মন্তব্য করুন

Back to top button