সাহসী মানুষের গল্প

আল্লাহর তরবারি

চারদিকে ইসলামের প্রচার কাজ চলছে।

মক্কা এবং মদীনার লোকেরা জেনে গেছে পবিত্র ইসলাম এবং নবীর (সা) নাম।

দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পরম প্রশান্তির সাথে দ্বীনের পথে কাজ করছেন। কাজ করছেন তাঁরা নবীর (সা) কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। একই সাথে।

খালিদ ইবনে ওয়ালিদ তখনো ইসলাম কবুল করেননি।

তিনি ভাবলেন। ভাবলেন নির্জনে বসে।

গভীর রাত্রিতে।

অনেক চিন্তা ভাবনা করে দেখলেন।

ভাবতে ভাবতে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। পাপ এবং অন্যায়ের জন্যে তিনি ব্যথিত হলেন। ভাবলেন, এভাবে আর কতোদিন?

কতোদিন আর এভাবে অন্যায় ও অসত্যের পথে চলবো?

খালিদের ভেতর সত্য বিবেক সহসা জেগে উঠলো। তিনি পাপের পথ থেকে, অন্ধকারের পথ থেকে ফিরে এলন।

ফিরে এলেন ইসলামর পথে।

সুদূর মদীনায় গিয়ে নবীর (সা) কাছে হাজির হয়ে বললেন,

আমি অনেক পাপ করে ফেলেছি। আমার পাপের জন্যে অনুতপ্ত। আমি এখন সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে পেরেছি। আর পাপের পথে পা বাড়াতে চাইনে। এবার আমাকে ইসলাম গ্রহণ করার সুযোগ দিন। এবং আমার পাপ মুক্তির জন্যে হে দয়ার নবী (সা) একটু দোয়া করুন।

আল্লাহর নবী (সা) খালিদের কথায় অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি খালিদের জন্যে দোয়া করলেন।

ইসলাম গ্রহণের পর শুরু হলো খালিদের জীবনের আর এক অধ্যায়।

সে অধ্যায় সংগ্রামের।

সে অধ্যায় যুদ্ধের।

সে অধ্যায় অগ্নিপরীক্ষার।

ইসলাম গ্রহণের আগে খালিদ ছিলেন মুসলমানদের জন্যে চরম দুশমন।

আর ইসলাম গ্রহণের পর তিনিই হলেন কাফের ও মুশরিকদের জন্যে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক।

খালিদের তরবারির সামনে দাঁড়াতে সাহস করে না কোনো খোদাদ্রোহী শক্তি। কোনো মুশরিক।

তাঁর তরবারি অসংখ্য যুদ্ধে মুশরিকদের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে। তাদেরকে করে দিয়েছে ছিন্নভিন্ন।

খালিদের তরবারি দিয়ে আগুনের হুলকা ছোটে।

ইসলাম গ্রহণের পর খালিদ প্রথমেই মুতার যুদ্ধে অংশ নেন।

এটাই তাঁর জীবনে ইসলামের পক্ষে প্রথম যুদ্ধ।

মুতার যুদ্ধে খালিদ অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। একে একে তিনজন মুসলিম সেনাপতি শহীদ হয়ে গেলেন। এই দৃশ্য দেখে সাধারণ সৈনিকদের মনে সাহসের রশিটা একটু ঢিলে হয়ে গেল। তারা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন।

কিন্তু ঘাবড়ালেন না খালিদ।

তিনজন সেনাপতি শহীদ হবার পর তিনিই সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে ‍যুদ্ধ পরিচালনা করেন। বর-বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর।

বীরের মত খঅলিদ!

সিংহ পুরুষ খালিদ!

তার বীরত্বের ফলে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেল মুসলিম বাহিনী।

মুতার যুদ্ধে খালিদের হাতে একে একে সাতখানা তরবারি ভেঙ্গে যায়।

ইসলামের ইতিহাসে এটা বিরল ঘটনা।

মক্কা বিজয়ের সময় নবীর (সা) সাথে ছিলেন খালিদ। যদিও বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করা হয়, তবু কিছুতো রক্ত ঝরেছিল।

সেটা আর কিছু না, কয়েকজন মুশরিক খালিদের দিকে তীর নিক্ষেপ করলে তার জবাব দিলেন তীরের মাধ্যমে খালিদ। এতে কয়েকজন মুশরিক প্রাণ হারায়।

হুনাইনের যুদ্ধে খালিত অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। শত্রুর আক্রমণে তার শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। সে ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরে। তার শরীর রক্তে ভিজে যায় তবুও তিনি এতটুকু দমে যাননি। শত্রুর আক্রমণে তিনি এতটুকু পিছিয়েও আসেননি। বরং শত্রুর আক্রমণ যতো তীব্র হচ্ছিল, ততোই খালিদের তরবারি ঝলসে উঠছিল।

তায়েফ অভিযানেও খালিদ ছিলেন অগ্রগামী বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার।

জাহেলি যুগে, কুরাইশদের মূর্তি পূজার কেন্দ্রগুলো একটি ছিল ‘উযযা’।

নবী (সা) খালিদকে পাঠালেন সেটা ধ্বংস করে দেবার জন্যে।

দুঃসাহসী খালিদ নবীর (সা) নির্দেশ সেখানে গেলেণ এবং তিনি সেটা মুহূর্তেই মাটিতে মিশিয়ে দিলেন।

নবীল (সা) ওফাতের পরের ঘটনা।

হযরত আবু বকর তখন খলিফার আসনে। এসময়ে আরবের চারদিকে ইসলাম ত্যাগকারী, নবুওয়াতের মিথ্যাদাবিদার ও যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।

খলিফা আবু বকর একটি মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে খালিদকে পাঠালেন ভণ্ড নবীর দাবিদার তুলাইহাকে শায়েস্তা করার জন্যে।

খালিদ তাঁর বাহিনী নিয়ে রওয়ানা হলেন।

তুমুল লড়াই হলো সেখানে।

লড়াইয়ে তুলাইহার সঙ্গী-সাথীরা পরাজিত হলো।

তুলাইহার বহু সঙ্গীকে খালিদের বাহিনী হত্যা করলেন এবং তার ত্রিশজন সঙ্গীকে বন্দী করে খালিদ নিয়ে এলেন আবু বকরের কাছে।

খালিদ মুসাইলামা কাজ্জাবের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করেন।

এই যুদ্ধে হযরত হামজার হন্তা মুসাইলামা কাজ্জাব নিহত হয় ওয়াহিশীর হাতে।

ভণ্ড নবীদের নির্মূল করার পর খালিদ রুখে দাঁড়ালেন মুরতাদদের বিরুদ্ধে।

রুখে দাঁড়ালেন যাকাত প্রদানের অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে।

খালিদের প্রতিটি অভিযানই সফল হলো।

প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি বিজয়ী হয়ে ফিরে এলেন।

এরপর মহাবীর খালিদ যাত্রা করেন ইরাকের দিকে।

ইরাকে একে একে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং প্রতিটি যুদ্ধেই খালিদ বিজয়ী হন।

তার সাহস এবং যুদ্ধ কৌশলের নিপুণতায় সমগ্র ইরাককে তিনি পদানত করেন।

ফাহলের যুদ্ধে খালিদের কাছে রোমান বাহিনী দারুণভাবে পরাজিত হয়।

তারা পুনরায় দেমাশক দখলের প্রচেষ্টা চালায়।

প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে।

হঠাৎ পেছন থেকে ধূমকেতুর মতো উপস্থিত হলেন মহাবীর খালিদ।

রোমান বাহিনীর একে একে বহু সৈন্যনিহত হলো খালিদের তরবারির আঘাতে।

তাদের শোচনীয় পরাজয়ের পর তারা আবার খালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হলো।

সেনাপতি মাহানের নেতৃত্বে দুই লাখ চব্বিশ হাজার রোমান সৈন্য ইয়ারমুকের সমবেত হলো।

রোমানদের যুদ্ধ যাত্রার খবর পেয়ে গেলেন হযরত আবু বকর (রা)। তিনি বললেন- আল্লাহর কসম! খালিদের দ্বারাই আমি তাদেরকে পরাস্ত করবো।

ইয়ারমুকের যুদ্ধ।

ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ।

মহাবীর খালিত তাঁর বাহিনীকে দ্রুত প্রস্তুত করে রওয়ানা হলেন ইয়ারমুকের দিকে।

এই যুদ্ধে তিন মহিলাদের হাতেও তরবারি তুলে দিলেন।

বললেন, যদি কোনো মুসলিম সৈন্য যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পিছটান দেন- তাহলে তাকে এই তরবারি দিযে হত্যা করবে।

নিজের সৈনিকদেরতিনি সাবধান করে দিয়ে বললেন, প্রয়োজনে শহীদ হবেন, কিন্তু যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে কেউ পালাবার চেষ্টা করবেন না।

যুদ্ধের পূর্বে রোমান সেনাপতি খালিদের সাথে কথা বললো। সে বললো, তোমাদের অনেক অভাব। অনেক ক্ষুধা। তাই তোমরা দেশ ছেড়ে এখানে এসেচো।

তোমরা চাইলে আমরা তোমাদেরকে দশটি করে দীনার দেব। এক প্রস্থ কাপড় দেব এবং তোমাদেরকে খাদ্যও দেব। আগামী বছরও তোমরা এভাবে জিনিসপত্র পাবে। তোমরা এখান থেকে চলে যাও। শুধু এই শর্তটুকু মানো।

রোমান সেনাপতির কথায় মহাবীর খালিদ অত্যন্ত অপমানবোধ করলেন। তার ব্যক্তিত্ব এবং তার বীরত্বে আঘাত লাগলো।

তিনি রোমান সেনাপতিকে উচিত জবাবই দিলেন।–

বললেন, আমরা মুসলমান! আমরা বীরের জাত! অর্থের বিনিময়ে আমাদেরকে কেনা যায় না।

বলেই তিনি ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলেন এবং ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে খালিদ সোজা ছুটে চললেন তার নিজ বাহিনীর ছাউনির দিকে।

এবং তারপর।–

তারপর সেনাপতি খালিদ ‘আল্লাহু আকবর’ বলে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।

রোমাদের অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনীর মধ্যাভাগে ঢুকে পড়লেন মহাবীর খালিদ।

তিনি যেদিকে যান, সেদিকেই সব সাফ!

খালিদের তরবারির সামনে রোমান বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

একদিন এবং একরাত- একাধারে যুদ্ধ চললো।

পরদিন প্রভাতেই সবাই অবাক হয়ে দেখলো রোমান সেনাপতির মঞ্চের ওপর বীর দর্পে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ।

ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় খালিদের তরবারির তেজ দেখে রোমান বাহিনীর কমান্ডার জারজাহ তার ছাউনি থেকে বের হয়ে এলেন।

ভয়ে ভয়ে তিনি খালিদের কাছে এগিয়ে গেলেন। বিনরে সাথে জিজ্ঞেস করলেন,

মহাবীর খালিদ! আপনি সত্যি করে বলুন তো, আল্লাহ কি আসমান থেকে আপনাদের নবীকে (সা) এমন কোনো তরবারি দান করেছেন, যা তিনি আপনাকে দিয়েছেন এবং সেই তরবারি আপটনি যাদের বিরুদ্ধেই ওঠান, তারাই পরাজিত হতে বাধ্য হয়!

রোমান কমান্ডার জারজাহর কথা শুনে খঅলিদ হেসে উঠলেন।

খালিদের বীরত্ব এবং ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে জারজাহ তখনই ইসলাম কবুল করলেন। এবং রোমানদরে বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন।

ইয়ারমুকের এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে বিজয়ের পর খালিদ ‘হাদির’ জয় করেন।

‘হাদির’ জয় করার পর তিনি ‘কিন্নাসরীন- এর দিকে অভিযান চালান। মুসিলম বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্যে তারা পূর্বেই কিল্লার প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিয়েছিল।

খালিদ চিৎকার করে তাদেরকে বললেন,

তোমরা কোথায় পালাবে?

যদি মেঘমালার ওপরও আশ্রয় নাও, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে সেখানে উঠিয়ে নেবেন। অথবা তোমাদেরকে নামিয়ে আনবেন আমাদের তরবারির সামনে।

তোমরা কোথাও পালাতে পারবে না।

কিন্নাসরীনের অধিবাসীরা হিমসবাসীদের করুণ পরিণতির কথা চিন্তা করে খালিদের সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করতে বাধ্য হলো।

ইসলাম গ্রহণের পর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানেই সময় কেটেছে মহাবীর খালিদের।

তিনি প্রায় শোয়াশো যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশেই বর্শ, তীর অথবা তরবারির আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট ছিল।

খালিদ ছিলেন যুদ্ধপ্রেমিক এক দুঃসাহসী বীর পুরুষ।

যুদ্ধই যার নেশা।

যুদ্ধই যার ধ্যান।

ইসলামের সপক্ষে তিনি ছিলেন অতন্দ্র এক সেনাপতি। আর তার তরবারি সর্বদা কোষমুক্ত থাকতো শত্রুর মোকাবেলায়।

তার বন্ধু এবং এবং শত্রু-সবাই বলতেন, খালিদ এমন এক যোদ্ধা, যিনি নিজেও ঘুমান না, অন্যকেও ঘুমাতে দেন না।

আর মহাবীর খালিদ বলতেন,

আমার একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হবার সুসংবাদের চেয়েও আমার কাছে ইসলামের পক্ষে শত্রুর মোকাবেলা করা এবং একটি যুদ্ধ অধিক প্রিয়।

এই হলেন মহাবীর খালিদ।

খালিদের মৃত্যুর পর হযরত ওমর (রা) যার সম্পর্কে বলতেন,

নারীরা খালিদের মতো সন্তান প্রসবে অক্ষম হয়ে গেছে।

আর নবী (সা) তাঁর সাহাবীদের বলতেন,

তোমরা খালিদকে কষ্ট দিও না। কারণ সে কাফেরদের বিরুদ্ধে চালিত আল্লাহর তরবারি।

খালিদকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন নবী (সা)। তিনি বলেছৈন, খালিদ আল্লাহর তরবারি। যা কাফের ও ‍মুনাফেকদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত করেছেন।

মহাবীল খালিদ!

খালিদ- আল্লাহর তরবারি!

এই সম্মানজনক বীরত্বের খেতাবটি দিযেছেন স্বয়ং নবী (সা)। সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর ‘তরবারি’ উপাধি একজনই মাত্র পেয়েছেন। তিনি দুঃসাহসী হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ।

 

– মোশাররফ হোসেন খান

১টি মন্তব্য

  1. খালিদের মৃত্যুর পর হযরত ওমর (রা) যার সম্পর্কে বলতেন,

    নারীরা খালিদের মতো সন্তান প্রসবে অক্ষম হয়ে গেছে।

    আর নবী (সা) তাঁর সাহাবীদের বলতেন,

    তোমরা খালিদকে কষ্ট দিও না। কারণ সে কাফেরদের বিরুদ্ধে চালিত আল্লাহর তরবারি।

    er bortoman somoye amaderke khalider moto sahoshi manusderke jongi bole daka hoy, r amrao onder moto kuffarder sateh tal milaschi.

    Jazakallh khair.

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button