খাপ খোলা তলোয়ার
একবারেই অন্ধকার যুগ।
পাপে আর পাপে ছেয়ে গেছে আরবের সমাজ।
মানুষের মধ্যে হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তারক্তি লেগেই আছে।
মানুষের হেদায়েতের জন্যে আল্লাহ পাক নবীকে (স) পাঠিয়েছেন। তিনি মানুষকে আলোর পথে ডাকছেন। ডাকছেন মুক্তির পথে।
নবীর (স) ডাকে যারা সাড়া দিলেন, তাঁরা আলোর সন্ধান পেলেন। নবী (স) সাথে তাঁরাও ইসলাম প্রচার করেন।
কিন্তু গোপনে গোপনে। চুপে চুপে।
কাফেরদের অত্যাচারের ভয়ে কেউ ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেন না। আসলে, তখন সেই পরিবেশও ছিল না। পবিত্র কাবা ঘরে কেউ নামাজও আদায় করতে পারতেন না।
নামাজ আদায় করতেন তাঁরা গোপনে গোপনে।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
সময় পাল্লে যায়।
পাল্টে যায় কালের নির্মম ইতিহাস।
সময়টাকে পাল্টে দেন হযরত ওমর। আল্লাহর অপরিসীম রহমতে। ওমর ইসলামগ্রহণ করার পরপরই মক্কার আকাশে বাতাসে নতুন হওয়া বইতে শুরু করে।
শুরু হলো ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার আর একটি নতুন অধ্যায়।
এতদিন কাফেরদরে ভয়ে কেউ ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে পারেননি।
কিন্তু ওমর?
ইসলাম গ্রহণের পর তিনিই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন, সবাইকে জানিয়ে দিলেন ইসলাম গ্রহণের কথা।
নির্ভীক ওমর! দুঃসাহসী ওমর!
তাঁর সাহস আর বীরত্বের কথা জানে না- মক্কায় তেমন কোনো লোকই নেই। ক্ষ্যাপা বারুদের মতো তাঁর তেজ।
রেগে গেলে ওমর মুহূর্তেই যে কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বুকটান করে কেউ কথা বলার সাহস রাখে না। সবাই তাঁকে ভয় করে চলে।
ইসলাম গ্রহণের আগে ওমর সম্পর্কে এ রকম ধারণা ছিল মক্কার সকল মানুষের।
ওমরের তলোয়ারকে ভয় করে না, এমন লোক মক্কায় নেই।
সেই দুঃসাহসী ওমর ইসলাম গ্রহণ করেছেন!
ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন!
শুধু কি তাই?
তিনি সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে মক্কার পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশ করলেন। প্রকাশ্যে নামায আদায় করলেন।
এই প্রথম কাবাঘরে প্রকাশ্যে নামাজ আদায়ের ঘটনা ঘটলো।
কাফেররা শুনলো সবই। দেখলো সবই। দেখলো, সঙ্গী-সাথীদেরকে নিয়ে দুঃসাহসী ওমর কাবায় যাচেনছন! নামাজ আদায় কাছেন।
কাফেররা দেখলো, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করলো না। কেউ বাধা দিতে ছুটে এলো না।
কে আসবে ওমরের সামনে?
কে আসবে তাঁর খাপ খোলা তলোয়ারের সামনে? এমন হিম্মত কার আছে?
ওমর বীরদর্পে হেঁট গেলেন ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন, সবচেয়ে বড় শত্রু আবু জেহেলের বাড়িতে। জোরে জিৎকার করে বললেন:
ইসলামের দুশমন- আবু জেহেল! আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আল্লাহ ও রাসূলের (সা) প্রতি ঈমান এনেছি এবং রাসূলের (সা) কাছে প্রেরিত বিধান- আল কুরআন ও ইসলামকে সত্য বলে জেনেছি এবং মেনে নিয়েছি।
ওমরের হুংকার আবু জেহেল স্তম্ভিত হয়ে গেল। কিন্তু প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না।
ওমর মিথ্যা ও পৌত্তলিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে জিহাদ ঘোষণা করলেন।
ওমরের ইসলাম গ্রহণ করার সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে গেল দ্রুত গতিতে।
এ খবর শুনে কাফেরদের বুক ভয়ে আর বেদনায়টন টন করে উঠলো। আর মুসলমানদের হৃদয়ে খুশির তুফান বইতে শুরু করলো। তাঁরা আরও সাহসী হয়ে উঠলেন।
ওমর তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মক্কায় প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। কাফেরদের নাকেট ডগা দিয়ে মক্কার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে যান ওমর তাঁর সঙ্গী-সাথীরা।
তাঁরা একত্রে কাবায় নামাজ আদায় করেন।
কাবাঘরে তাওয়াফ করেন।
কেউ বাধা দিতে এলে তাঁরা তা প্রতিহত করেন।
তাঁরা প্রতিহত করেন কাফেরদের যে কোনো আক্রমণ।
অন্য মুসলমানরা গোপনে হিজরত করেন মদীনয়। আর ওমর হিজরত করেন প্রকাশ্যে।
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার আগে ওমর প্রথমে কাবাঘর তাওয়াফ করেন। তারপর কুরাইশদের মধ্যে গিয়ে চিৎকার করে বলেন,
কেউ যদি তার মাকে পুত্রশোকে কাঁদাতে চায়, তাহলে সে যেন এ উপত্যকার অপর প্রান্তে আমার মুখোমুখি হয়।
এই দুৎসাহসী ঘোষণা দিয়ে বীরের মতো তিনি মদীনার পথে রওয়ানা হলেন।
কাফেররা দেখলো, ওমর চলে যাচ্ছে কিন্তু তাঁকে বাধা দিতে কেউ সাহস পেল না।
ওমরের তলোয়ারের ভয়ে তারা প্রকম্পিত।
প্রাণ হারাতে কে যাবে তাঁর তলোয়ারের সামনে।
হযরত ওমর!
দুঃসাহসী ওমর!
নির্ভীক ওমর!
একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেই যিনি পরোয়া করেন না।
ভয় নামক শব্দটিকে যিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন, তিনিই হযরত ওমর।
নবীকে (স) তিনি ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে। তাঁর সে ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না।
নবীর (সা) সাথে তিনি বদর, উহুদ, খন্দকসহ সকল যুদ্ধেই অংশ নিয়েছেন এবং বীরত্বের সাথে কাফেরদের মুকাবেলায় যুদ্ধ করেছেন।
নবীকে (সা) তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। নবীর (সা) ওফাতের সংবাদ শুনে তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি যে, নবী (সা) আর দুনিয়াতে নেই। নবীর (সা) মহব্বতে তখন তিনি পাগলপ্রায়। কোষমুক্ত তলোয়ার নিয়েওমর মসজিদে নববীর সামনে গিয়ে ঘোষণা দিলেন:
যে বলবে নবী (সা) ইন্তেকাল করেছেন, আমি তার মাথা দ্বিখন্ডিত করে দেব।
ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা)।
আর দ্বিতীয় খলিফা হলেন হযরত ওমর (রা)।
দশ বছর খিলাফতকালে তিন গোটা বাইজাইনটাইন, রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান।
তিনি বহু শহর এবং বহু রাজ্য জয় করেন।
অর্ধেক জাহানে তিনি ইসলামের বিজয় পতাকা ওড়াতে সক্ষম হন।
তাঁ সময়েই তিনি জেনার জন্যেদুররা মারা এবং মদপানের জন্যে আশিটি বেত্রাঘাত চালু করেন।
অর্ধেক জাহানের শাসনকর্তা হযরত ওমর।
কিন্তু ক্ষমতার মোহ তাঁকে কখনোই সত্য থেকে দূরে ঠেলে দেয়নি।
তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ন শাসক। তাঁর কাছে ধনী-গরিব, ঠো-বড় কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সকলের প্রতি ছিলেন সমান দরদি।
এতবড় শাসক হয়েও ব্যক্তিগতজীবনে ছিলেন হযরত ওমর অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ। তাঁর ছিল না কোনো বাড়তি চাকচিক্যছিল না কোনো জৌলুস। খুব গরিব হালে তিনি জীবন যাপন করতেন।
কিন্তু শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন।
তিনি নিজের চোখে মানুষের সুখ-দুঃখ দেখার জন্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি এবং রাতের গভীরেও। তাঁর শাসনামলে মানুষ সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতো। নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতো।
হযরত ওমর ছিলেন সবার কাছে অত্যন্ত শ্বিাসী। তাকে বলা হতো আমীরুল মু’মিনীন।
তিনি মানুষকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সবার মুখে মুখে ফিরতো হযরত ওমরের নাম। তাঁর ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতায় সকলেই মুগ্ধ ছিলো।
ভালো মানুষেরা ওমরকে ভঅলোবাসতো প্রাণ দিয়ে। আর দুষ্ট ও ইসলামের শত্রু ওমরের নাম শুনতেই ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতো।
হযরত ওমর!
ওমরের বীরত্ব ও ন্যায়পরায়ণতা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
ইসলাম গ্রহণের আগে তিনি যেমন ছিলেন উগ্র এবং দুঃসাহসী, ঠিক ইসলাম গ্রহণের পরও তিনি ছিলেণ সত্যের পক্ষে প্রশান্ত এবং কোমল। আর মিথ্যা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন বরাবরই-
খাপ খোলা তলোয়ার।
– মোশাররফ হোসেন খান