সাহসী মানুষের গল্প

তায়েফের পথে আলোর পথিক

ভাবছেন আর ভাবছেন নবী মুহাম্মদ (স)

কী করবেন এখন?

মক্কার শত্রুদের আক্রমণ দিনে দিনে বাড়ছে। উত্তপ্ত আবহাওয়ার মক্কা নগরী বিষাক্ত। অশান্ত লু হাওয়া। আপাতত আর মক্কায় থাকা চলবে না। এখঅনে এখন ইসলাম প্রচার করা সম্ভব নয়।

তাহলে? কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন নবী (স)। তারপর।–

তারপর সুদূরের পথ তায়েফ। বহু- বহু- দূরের পথ। নবীজ (স) মক্কা থেকে সাময়িক বিদায় নিয়ে তায়েফের পথে রওয়ানা হলেন।

মরুভূমির পথ। বালি আর বালি। কোথাও কোনো গাছ নেই। নদী নেই। শুধু আছে ধু-ধু মাঠ। আর আছে ছোট বড় পাহাড় পর্বত। পাথরের নুড়ি। বহু পথ অতিক্রম করে চলে এসেছেন নবী (স)। প্রায় সত্তর মাইল। পায়ে হেঁটে। বন্ধুর পথ। উঁচু-নিচু। পাথরের নুড়ি ছড়ানো। ব হু কষ্টে হেঁটে চলেছৈন দয়ার নবীজী (স)।

বাস নেই। প্লেন নেই। জাহাজ কিংবা লঞ্চও নেই। এক আছে গাধা এবং উট। প্রিয় নবীর সাথে সেসব বাহনও নেই। তিন চলেছেন পায়ে হেঁটে। ক্রমাগত হাঁটছেন তিনি।

আহার নেই।

নিদ্রা নেই।

বিশ্রাম নেই।

তিনি হাটছেন।

অবশেষে হাঁটতে হাঁটতে, বহু কষ্টে তিনি পৌঁছে গেলেন তায়েফ।

অপরিচিত একটি দেশ। অজানা-অচেনা রাস্তা-ঘাট। অচেনা একানকার মানুষ- জনপদ।

তবু মুসলমানের জন্যে প্রত্যেকটি দেশই তার নিজের দেশ।

প্রত্যেকটি দেশের মানুষেই তার আপন মানষ। কাছের মানুষ।

প্রত্যেকটি দেশেই তার ঘর।

পেছনে মক্কা নগরী ফেলে নবীজী (স) সুদূর তায়েফে এসেছেন। ইসলাম প্রচারের জন্যে।

মক্কার মানুষ আহ্বানে সাড়া দেয়নি। বরং তাঁকে কষ্ট দিয়েছে নির্মমভাবে। তবু তিনি নিরাশ হননি। হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পড়েননি। তি অবশেষে কষ্ট স্বীকার করে তায়েফ এসেছেন ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্যে।

মানুষকে সত্য পথে ডাকতে।

আল্লাহর বাণী শোনাতে।

সুন্দর শহর তায়েফ। মনোরম।

তায়েফের আবহাওয়াতে ছটফটানি নেই। ঝড়েরর দাপাদাপি নেই। একটানা রোদের তেজ নেই। আবার একটানা ‍বৃষ্টিও নেই। চারদিকে সবুজের হাতছানি। ক্ষেত ভরা ফসল। সবুজ সবজির ঢেউ তোলা ভাঁজ। খেজুর গাছের ঘন পল্লবে আরও উজ্জ্বল, আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে তায়েফের প্রান্তর। প্রাচুর্য আর সম্পদের শহর- তায়েফ।

কিন্তু সম্পদে তো আর সুখ বয়ে আনে না। সুখ আনে- মনের সৌন্দর্য, কোমলতা, পবিত্রতা এবং উত্তম চরিত্রে।

তায়েফবাসীদের সম্পদ ছিল অঢেল। কিন্তু তাদের মনে সুখ ছিল না। কেননা, তখওনা সেখানে সুন্দর মানুষ গড়ে ওঠেনি। তারা একে অপরের সাথে কলহ-বিবাদে লিপ্ত ছিল।

আঁতকে উঠলেন নবী (সা)। তাঁর কোমল হৃদয়ে ব্যথার জোয়ার দুলে উঠলো। তিনি দয়াল নবী। মোনুষের অধঃপতন তিনি দেখতে পারেন না।

মানুষ তো আশরাফুল মাখলূকাত। সৃষ্টির সেরা। তাদের স্থঅন সবার ওপরে। কিন্তু পাপী মানুষের স্থান?

নবীজী (স) ভাবেন- না, এদের কোনো দোষ না। কেননা এদের কাছে কোনো উত্তম এবং সুন্দর পথের আহ্বান আসেনি। এরা এখনো আলোর ছোঁয়া পায়নি। শোনেনি- সত্য সুন্দরের সুমিষ্ট বাণী।

নবীজী (স) ভাবেন- তাদেরকে সত্য পথের সন্ধান দিতেই তো আমাকে মহান রাব্বুল আলঅমীন পাঠিয়েছেন। সুতরাং তায়েফবাসীকে দেখাতে হবে আলোর পথ।

তিনি উদাত্ত আহ্বানে তায়েফবাসীকে ডাকেন আলোর পথে।

ডাকেন সত্যের পথে।

কল্যাণের পথে।

তিনি তায়েফবাসীকে বুছালেন- একদিন তোমরা মনে যাবে। কবরে যেতে হবে। কৃতকর্মের জন্যে হিসাব হবে। পাপ ও অন্যায় কাজের জন্যে শাস্তি পেতে হবে।

অতএব ফিরে এসো সত্যের পথে।

ফিরে এসো আল্লাহর পথে।

তিনি সত্য। তাঁর রাসূল মুহাম্মদ (স) সত্য।

তাঁর দ্বীন- ইসলাম সত্য।

আল্লাহ ছাড়া তোমাদের জন্যে আর কোনো প্রভু নেই। ত্রাণকর্তা নেই। তোমরা তাঁরই ইবাদাত কর।

আমার কাজ তোমাদের কাছে সত্য বাণী পৌঁছে দেয়া।

নবীর (স) আহবানে তায়েফেল অনেকেই সাড়া দিল। তারা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। দীর্ঘদিনের আঁধারের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে তারা আলোর ঝলকানিতে নতুন করে তাজা হয়ে উঠলো। সবল হলো। শান্তি ফিরে পেল।

কিন্তু কাফেররা রুখে দাঁড়ালো।

তাদে বিষাক্ত থাবা বেরিয়ে পড়লো। ছড়িয়ে পড়লো তারা তায়েফের অলিতে গলিতে।

কাফেরদের বুকে দাউ দাউ প্রতিশোধের আগুন। কে এসে তাদের কওমের লোকাদেরকে বিভ্রান্ত করছে?

কাফেররা আরও ক্ষেপে যায়।

মহানবী (স) তাদেরকে আহ্বান জানান-

এসো সত্যের পথে।

এসো আলোর পথে।

কাফেররা নবীর কথা শোনে না।

তারা প্রিয় নবীকে কষ্ট দিতে শুরু করে। পাথর ছুঁড়ে মারে। নবীজীর (স) পবিত্র শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে। রক্তে ভিজে যায় তাঁর দেহ। কদম মুবারক। তিনি কষ্ট পান। কিন্তু তিনি নিরাশ হন না। শরীরের সমস্ত ব্যথা-বেদনা কষ্টকে অকাতরে সহ্য করে তবু ঠোঁটে হাসির ফুয়ারা ঝরিয়ে তাদেরকে তিনি ডাকেন-

এসো সত্যের পথে।

এসো আলোর পথে।

এসো কল্যঅণের পথে।

আল্লাহর পথই একমাত্র উত্তম পথ।

মুহাম্মদের (স) সাথীরা বললেন, কাফেরদের জন্যে বদ দোয়া দিন নবী। তারা তো শুধু কষ্টই দিয়ে যাচ্ছে। শত্রুতা করছে আমাদের সাথে।

কিন্তু মুহাম্মদ (স) দয়ার নবী। তিনি কেন বদ দোয়া দেবেন? প্রিয় নবী (স) ক্ষমা কর দিলেন তাদেরকে।

নবীজীর ক্ষমা এবং মহানুভবতা দেখে কাফেরদের অনেকেই বিস্মিত হলো। অবাক হয়ে তারা নবীজীর মুখের দিতে তাকিয়ে থাকে। তাদের ভেতরে অনুশোচনার ঝড় বয়ে যায়। কৃতকর্মের জন্যে তারা দুঃখ প্রকাশ করে। লজ্জিত হয়ে নবীর (স) কাছে ক্ষমা চায়।

নবীজী তাদেরকে কোমল হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করেন। ইসলারেম ছায়াতলে তাদের অশান্ত, অতৃপ্ত হৃদয়কে ডেকে নেন। তাদেরকে শোনান আল্লাহর বাণী। তারা পুলকিত হয়ে নবীকে (স) আপন করে নেয়। তায়েফে সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে যায়।

কাফেররা এতে আরও বেশি করে ক্ষেপে যায়।

নবীকে (স) কষ্ট দেবার জন্যে , তাঁকে সত্যের আহ্বান থেকে বিরত রাখার জন্যে তারা নতুন নতুন কৌশল বের করে।

কিন্তু দয়ার নবী (স) সব বাধাই দু’পায়ে মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে চলেন। ক্রমাগত সামনে।

চরম ধৈর্যের সাথে তিনি মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে মুনাজাত করেন-

হে আল্লঅহ!“ তুমি এদেরকে সঠিক জ্ঞান দাও।

ঈমান দাও। এরা অবুঝ। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বোঝে না।

এদের অন্তর থেকে সকল কালিমা দূর করে দাও।

এদের ওপর রহমত কর।

চরম শত্রুতা করা সত্ত্বেও এভাবে দয়ার নবী (স) দোয়া করলেন তায়েফের অধিবাসীদের জন্যে।

 

– মোশাররফ হোসেন খান

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button