আত্মশুদ্ধি
আল্লাহ রাববুল আলামীন মানুষকে তিনটি বিশেষ উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেগুলো হল জ্ঞান, দেহ এবং আত্মা। জ্ঞানকে দিকনির্দেশনা দেয় ঈমান, দেহের কল্যাণ সাধন করে ইসলাম এবং আত্মার পরিশুদ্ধি নিশ্চিত করে ইহসান। একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠা এ উপাদানগুলোর সুষম সমন্বয়ের উপর নির্ভরশীল। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক কঠিন ও আয়াসসাধ্য বিষয় হলো ইহসান। আত্মার পবিত্রতা অর্জনের সাথেই ইহসান সম্পৃক্ত।
আত্মার স্বরূপ নিয়ে আল্লাহ রাববুল আলামীন এতটুকুই বলেছেন যে, এটি মহান আল্লাহ্র একটি হুকুম। স্রষ্টার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এই তাৎপর্যময় হুকুমের পবিত্রতা রক্ষা করাই মানুষের প্রধান কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনই মানুষকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে পারে। এজন্য ব্যক্তির মাঝে ‘তাযকিয়াতুন নফস’ বা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি সাধন করা ইসলামের মৌলিক লক্ষ্য। ইসলামের সকল নিয়মতান্ত্রিক ইবাদতসমূহ একই লক্ষ্যে নিবেদিত। বলা যায় আত্মশুদ্ধিতার উপরই নির্ভর করে মানুষের যাবতীয় কার্যক্রম ও তার ফলাফল।
মূলতঃ মানুষের অন্তর্জগত এমন একটি বিশাল জগত যার ব্যাপকতা দৃশ্যমান জগতের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আবার এটি এমন এক স্থান একমাত্র আল্লাহ ছাড়া যেখানে অন্য কারোরই প্রবেশাধিকার নেই। মানুষ তার প্রতিটি কাজ কি উদ্দেশ্যে করছে তার খবর কেবল তার আত্মাই জানে। আবার সমস্ত খবর সে বাইরে চেপে যেতে পারলেও নিজের অন্তরের কাছে সে কিছুই লুকাতে পারে না। সেজন্য অন্তরের এই গভীরতম প্রদেশটি মানুষের সবচেয়ে নিকটবর্তী ও সর্বাধিক আপন। এ স্থানের সাথে প্রতারণা করার সাধ্য কারো নেই। পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অদৃশ্য ও অনুভূতিস্তরের এই স্থানটির গতি-প্রকৃতির উপরই নির্ভর করে তার বিস্তীর্ণ কর্মজগত। এজন্য আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বার বার অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য যেমন তাকিদ দিয়েছেন তেমনি এটা অর্জনের উপরই মানুষের সফলতা, ব্যর্থতাকে নির্ভরশীল করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করল সে-ই সফল, আর ব্যর্থ সে-ই যে নিজের অন্তঃকরণকে কলুষিত করল’ (শামস্ ৯-১০)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সাবধান! মানুষের দেহের অভ্যন্তরে একটি পিন্ড রয়েছে, যদি তা পরিশুদ্ধ হয় তবে সমস্ত দেহই পরিশুদ্ধ হয়; আর যদি তা বিকৃত হয়ে যায় তবে সমস্ত দেহই বিকৃত হয়ে যায়। সেটা হল কলব বা আত্মা’। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/ ২৭৬২)
পবিত্র কুরআনে মানুষের নফস বা অন্তরের তিন ধরনের প্রকৃতি উল্লেখিত হয়েছে।
১. মুত্বমায়িন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা): সে অন্তর যে তার প্রভুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং তাঁর আনুগত্যেই সুস্থির হয়েছে। যে আল্লাহ্র দাসত্বে, তাঁর স্মরণে ও ভালবাসায় প্রশান্তি অর্জন করেছে। বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই তাঁর উপর সমর্পণ করেছে। তাঁর ভবিতব্যকে (কাযা ও কদর) অম্লান বদনে গ্রহণ করেছে। তাঁর সাক্ষাৎ ও প্রতিশ্রুতির উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছে এবং এক মুহূর্তের জন্যও যে অন্তর প্রভুর যিম্মাদারী থেকে বিচ্যুৎ হয় না।
২. লাওয়ামাহ (ভৎর্সনাকারী আত্মা): যে অন্তর মানুষকে তার কর্তব্যচ্যুতির জন্য নিরন্তর ভৎর্সনা করে ও ধিক্কার জানায়।
৩. আম্মারাহ (কুমন্ত্রণাদানকারী আত্মা): যে আত্মা মানুষকে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করার জন্য প্ররোচণা দেয়। যে তার অনুগত হয়ে খারাপ পথে পা বাড়ায় তাকে সে যাবতীয় অকল্যাণ ও হীনকর কাজে প্রলুব্ধ করে। অন্তরের এরূপ প্রকৃতি মূর্খতা ও যুলুম থেকে সৃষ্ট। কেননা মানবাত্মা মূলতঃ অজ্ঞ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থাতেই পৃথিবীতে আগমন করেছে। আল্লাহ ইলহামের মাধ্যমে তাতে জ্ঞান ও ন্যায়বিচারের গুণাবলী সংযুক্ত করে দিয়েছেন। যদি আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি অনুগ্রহ না করতেন তবে কোন আত্মাই পরিশুদ্ধ হত না। তিনি যার জন্য কল্যাণের ইচ্ছা পোষণ করেছেন তাকে পরিশুদ্ধ ইচ্ছাশক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি দান করেছেন। আর যার প্রতি কল্যাণের ইচ্ছা করেননি তাকে তার অবস্থানে তথা মূর্খতা ও পাপাচারের উপর ছেড়ে দিয়েছেন (নূর ২১)।
আল্লাহ বলেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’ (ফাজর ২৭)।
আত্মশুদ্ধির পরিচয় ও প্রকারভেদ :
আত্মশুদ্ধির বিষয়টি দুইভাবে ব্যাখ্যা দেয়া যায়।
১. নঞর্থক: যাবতীয় পাপ, অন্যায় ও অপবিত্র কাজ থেকে মুক্ত হওয়া অর্থাৎ যাবতীয় অসদ্গুণাবলী বর্জন করা। অসদ্গুণাবলী হলো- শিরক, রিয়া, অহংকার, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, ঘৃণা, কৃপণতা, ক্রোধ, গীবত, কুধারণা, দুনিয়ার প্রতি মোহ, আখেরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া, জীবনের প্রতি অসচেতনতা, অর্থহীন কাজ করা, অনধিকার চর্চা প্রভৃতি।
২. সদর্থক: উত্তম গুণাবলী দ্বারা আত্মার উন্নতি সাধন করা অর্থাৎ প্রশংসনীয় গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে পরিত্যাগকৃত অসদ্গুণাবলীর শূন্যস্থান পূরণ করা। সদ্গুণাবলী হল তাওহীদ, ইখলাছ, ধৈর্যশীলতা, তাওয়াক্কুল বা আল্লাহ্র প্রতি নির্ভরতা, তওবা, শুকর বা কৃতজ্ঞতা, আল্লাহভীতি, আশাবাদিতা, লজ্জাশীলতা, বিনয়-নম্রতা, মানুষের সাথে উত্তম আচরণ প্রদর্শন, পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও স্নেহ, মানুষের প্রতি দয়া, ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শন, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ, পরোপকার প্রভৃতি।
পবিত্র কুরআনে দু’টি অর্থেই ‘তাযকিয়াতুন নফস’ শব্দটির ব্যবহার এসেছে। তাযকিয়াতুন নাফস সম্পর্কে আরেকটি সংজ্ঞা দেওয়া যায় এভাবে যে, অন্তরকে শিরক ও তার যাবতীয় শাখা-প্রশাখা থেকে মুক্ত রাখা, তাওহীদ ও তার সমস্ত শাখা-প্রশাখাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করা, আল্লাহ্র সুন্দরতম নামগুলোর গুণে গুণান্বিত হওয়া, প্রভুত্বের যাবতীয় উপকরণকে বর্জন করে পূর্ণাঙ্গভাবে এক আল্লাহ্র দাসত্ব করা এবং প্রতিটি বিষয়ে শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দেখানো পথ পুংখানুপুংখ অনুসরণ করা।
আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব :
1. আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআনে আত্মশুদ্ধি অর্জনকারীর সফলতার নিশ্চয়তা ও তা পরিত্যাগকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারে এগারো বার কসম করেছেন (সূরা শামস্)।
2. আত্মা মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয় যখন সে তাকে পাপাচার ও সীমালংঘনের দিকে আহবান করে। কেননা এই অপরিশুদ্ধ, পাপাচারী, ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর মানুষকে আল্লাহ্র স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এজন্য রাসূল (ছাঃ) অন্তরের অনিষ্ট থেকে অধিক পরিত্রাণ চাইতেন- ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার অন্তরকে আত্মরক্ষার ক্ষমতা দাও এবং তাকে পরিশুদ্ধ কর। তুমিই অন্তরের সর্বোত্তম পরিশোধনকারী এবং তুমিই তার অভিভাবক ও প্রতিপালক’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৪৬০)।
3. আত্মশুদ্ধি অর্জন জান্নাত লাভের উপায়। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে উপস্থিত হওয়াকে ভয় করে এবং নিজের অন্তরকে কুপ্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে, জান্নাতই হবে তার জন্য চূড়ান্ত আবাসস্থল’ (নাযি‘আত ৪০)। 4. আত্মা হল ঈমানের সংরক্ষণস্থল। আর ঈমান হল মানুষের সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদ। যদি ঈমান না থাকে তাহ’লে মানুষের সমগ্র জীবনই বৃথা। তাই এ সম্পদকে সুরক্ষা ও তার পরিবৃদ্ধি সাধনের জন্য অন্তরজগতের পরিশুদ্ধি নিশ্চিত করতে হয়।
5. মুসলিম উম্মত আক্বীদা-বিশ্বাস, ইবাদত ও ব্যবহারিক প্রতিটি ক্ষেত্রে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ধারক-বাহক। তাই কোন ধরনের অকল্যাণকর উপাদান যেন তার অন্তরকে বক্র করে না ফেলে বা সংকীর্ণতায় নিক্ষেপ না করে সেজন্য তাকে সদা সতর্ক থাকতে হয়। রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি বলেন, ঐ ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে সত্যবাদী ও পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী, যা পাপাচার, অবিচার, প্রতারণা ও হিংসা থেকে মুক্ত (ইবনে মাজাহ হা/৪২১৬, সনদ ছহীহ)।
6. তাক্বদীরের উপর সন্তুষ্ট ও আস্থাবান আত্মা মানুষের জন্য দুনিয়াবী জীবনে প্রশান্তি অর্জন ও জটিলতা মুক্তির কারণ এবং পরকালীন জীবনে গণীমতস্বরূপ। যে ব্যক্তি কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যই নেক আমল করে সে ব্যক্তি তার সহগামীদের জন্য নিখাদ ভালবাসা ছাড়া অন্য কিছু বহন করতে পারে না। এরূপ নির্ভার, প্রশান্ত, বিদ্বেষমুক্ত আত্মা এমন একটি নে‘আমত যা আল্লাহ্ জান্নাতীদেরকে দান করবেন (হিজর ৪৭)।
7. মানুষ সবসময় পূর্ণতার আকাংখী। এই পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য আত্মশুদ্ধি অপরিহার্য। মানুষ নিজের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য যেভাবে নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ করে ও যাবতীয় অনিষ্ট থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য সার্বক্ষণিক পরিচর্যা করে, ঠিক তেমনি অন্তরকে পবিত্র রাখার জন্য নিয়মিত খাদ্য প্রদান ও পরিচর্যা প্রয়োজন। ঈমান ও নেক আমল হল সেই খাদ্য। শরীর যেমন খাদ্য পেয়ে শক্তি অর্জন করে তেমনি অন্তরও নেক আমলের মাধ্যমে শক্তি অর্জন করে।
সাইয়েদ কুতুব বলেন, ‘মানুষ একই সাথে মাটির তৈরী ও আল্লাহ্র নির্দেশপ্রাপ্ত সত্তা। তাই তার মধ্যে পাপ-পুণ্য, কল্যাণ-অকল্যাণ দুই ধারার প্রকৃতি সমানভাবে ক্রিয়াশীল। এ কারণে সে কোনটি কল্যাণকর, কোনটি অকল্যাণকর তা বাছাই করে যেকোন দিকে নিজেকে পরিচালনা করতে সক্ষম। আল্লাহ মানুষের মধ্যে এই ক্ষমতাকে সহজাত করে দিয়েছেন। যাকে তিনি কুরআনে কখনো ‘ইলহাম’ দ্বারা প্রকাশ করেছেন, যেমন- ‘(অন্তরকে) তিনি অসৎকর্ম ও সৎকর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছেন’ (শামস ৮-৯)। কখনো প্রকাশ করেছেন হিদায়াত দ্বারা, যেমন- ‘আমি তাকে দু’টি পথ প্রদর্শন করেছি’ (বালাদ ১০)। এই সহজাত দু’টি প্রবণতার সাথে মানুষের অন্তরাত্মায় আরো একটি বোধগম্য ও প্রভাবশালী শক্তি রয়েছে যার নাম ‘বিবেক’। যে ব্যক্তি এই বিবেকশক্তিকে অন্তরাত্মার পরিশুদ্ধিতে নিয়োজিত করে, নেক আমলের মাধ্যমে তার প্রবৃদ্ধি সাধন করে এবং অন্যায়-অকল্যাণের বিরুদ্ধে তাকে বিজয়ী করতে পারে সে-ই সফল; আর যে ব্যক্তি বিবেকশক্তির প্রতি অবিচার করে এবং তাকে দুর্বল করে ফেলে সে ব্যক্তি ব্যর্থ’(ফী যিলালিল কুরআন, পৃঃ ৮/৪৮)।
আত্মশুদ্ধি অর্জনের উপায়
নিয়মিত পদক্ষেপ :
1. হালাল-হারাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান অর্জন করা: জীবনের সর্বক্ষেত্রে হালাল-হারাম বাছাই করে চলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে। আত্মাকে সর্বতোভাবে পরিশুদ্ধ রাখার জন্য যা অত্যাবশ্যক। যাবতীয় বদগুণাবলী থেকে নিজেকে পরহেয করে রাখতে হবে। নিয়মিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে এক সময় তা অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে মানুষের স্বভাবগত হয়ে পড়ে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে আছেন’ (আনকাবূত ৬৯)।
2. আত্মাকে বিভিন্ন উত্তম চরিত্র দ্বারা পরিমার্জন ও পরিশোধন করা : নিয়মিতভাবে সৎগুণাবলী অনুশীলনে তা সহজাত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।
3. ফরয ইবাদতসমূহ নিয়মিত আদায় করা : কেননা ফরয ইবাদত আল্লাহ্র আনুগত্যের সর্বোত্তম বহিঃপ্রকাশ যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ্র সর্বাধিক নিকটবর্তী হয়। রাসূল (ছাঃ) হাদীছে কুদসীতে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ বলেন,‘বান্দা আমার নিকটতর হ’তে পারে না এমন কোন আমল দ্বারা যা আমার নিকট অধিক প্রিয়তর হ’তে পারে আমি যেটা ফরয করেছি তা (ছালাত)অপেক্ষা’ (বুখারী, মিশকাত হা/২২৬৬)।
4. অধিকমাত্রায় নফল ইবাদত করা : কেননা নফল ইবাদতকারী ব্যক্তিকেও আল্লাহ তার নৈকট্যের সুসংবাদ দিয়েছেন (ঐ)। নফল আমলের মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রতি অধিক বিনয়াবনতভাব প্রকাশ পায়, যা আত্মার পরিশুদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে।
5. পবিত্র কুরআন পাঠ করা ও তাতে চিন্তা-গবেষণা নিয়োজিত করা : কুরআন পাঠ অন্তরের কালিমা দূর করে দেয়। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বার বার এই কুরআনকে গবেষণা করার জন্য আহবান জানিয়েছেন। আত্মার প্রশান্তিতে কুরআন তেলাওয়াতের ভূমিকা যে কত অপরিসীম পবিত্র কুরআনে ও বহু হাদীছে তা বর্ণিত হয়েছে।
6. সৎসঙ্গ নিশ্চিত করা : সৎস্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তির সংসর্গে থাকলে অজ্ঞাতসারেই তার সদগুণ নিজের অন্তরে প্রবেশ করে। এজন্য রাসূল (ছাঃ) সৎ সঙ্গী নির্বাচনের জন্য জোর তাকীদ দিয়েছেন।
বিশেষ পদক্ষেপ :
1. তওবা : আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রথম পদক্ষেপ হল তওবা করা। তওবার মাধ্যমেই মানুষ পাপ বর্জন করে পুণ্য অর্জনের তৃপ্তি অনুভব করতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ তোমরা সকলে আল্লাহ্র সমীপে তওবা করো যেন তোমরা কৃতকার্য হ’তে পার’ (নূর ৩১)। তিনি আরো বলেন, ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্র নিকট প্রকৃতভাবে তওবা করো; আশা করা যায় আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন’ (তাহরীম ৮)।
2. আল্লাহ্র স্মরণ করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা : আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সঙ্গী’ (যুখরুফ ৩৬)। আল্লাহ্ বলেন, ‘তারা (মু’মিনরা) কখনো পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়লে অথবা অন্যায় কাজ করে নিজের আত্মার উপরে যুলুম করে ফেললে আল্লাহ্কে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে’ (আলে ইমরান ১৩৫)। ‘(মুমিনরা) রাত্রের শেষ প্রহরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে’ (আলে ইমরান ১৭)। ‘কেউ যদি পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে কিংবা নিজের উপর যুলুম করে ফেলে অতঃপর আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চায় সে আল্লাহ্কে ক্ষমাশীল ও দয়াময় হিসাবেই পাবে’ (নিসা ১১০)।
3. প্রবৃত্তির কঠোর বিরুদ্ধাচরণ করা ও অসৎচিন্তাকে কোনভাবেই প্রশ্রয় না দেওয়া : আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে ক্রমাগতভাবে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচরণ করতে হয়। কেননা প্রবৃত্তি মানুষকে শিথিলতা ও অবাধ্যতায় প্ররোচিত করে। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আত্মাকে কু-প্রবৃত্তি হ’তে অবদমিত রাখল তার বাসস্থান হল জান্নাত’ (নাযি‘আত ৪০)। ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, ‘এই অনুশীলন করার সময় তাকে জানতে হবে যে, আজ সে যতবার এই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আগামী দিন তা তার জন্য ততধিক স্বস্তির কারণ হতে যাচ্ছে আর যতবার সে শিথিল হচ্ছে তা আগামী দিন তার জন্য ততধিক কঠিনভাবে ধৃত হওয়ার উপলক্ষ্য হতে যাচ্ছে। তাকে মনে রাখতে হবে যে, তার কর্ম থেকে অর্জিত মুনাফা হল জান্নাতুল ফেরদাউসের সীমাহীন প্রশান্তিপূর্ণ আবাসস্থল এবং মহান প্রভুকে দর্শনের সৌভাগ্য অর্জন। আর লোকসান হওয়ার অর্থ নিশ্চিত জাহান্নামে প্রবেশ ও প্রভুর দর্শন থেকে বঞ্চিত হওয়া। যে ব্যক্তি এই মানসিকতায় দৃঢ়প্রত্যয়ী হতে পারে, পার্থিব জীবনের হিসাব তার নিকট গৌণ হয়ে পড়ে। অতএব একজন প্রকৃত মু’মিনের কর্তব্য হল আত্মসমালোচনায় গাফলতি না করা এবং অন্তরের গতি-প্রকৃতি ও প্রতিটি পদক্ষেপকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। কেননা আত্মা এমন এক অমূল্য সম্পদ যা দ্বারা মানুষ সেই গুপ্তধনের অধিকারী হ’তে পারে যা অনন্তকাল ধরে কখনই নিঃশেষ হয় না। এই অমূল্য আত্মাকে যারা কলুষময় করে ধ্বংস করে ফেলে এবং তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে তার জন্য অবর্ণনীয় ক্ষতি ডেকে আনে সে ব্যক্তি পৃথিবীর সর্বাধিক নির্বোধ ও বিচারজ্ঞানহীন ব্যক্তি। শেষ বিচারের দিনে সে তার পরিণতি জানতে পারবে। আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন প্রত্যেক আত্মা যা সৎকর্ম করেছে ও বদকর্ম করেছে তা উপস্থিত পাবে’(আলে ইমরান ৩০), (ইগাছাতুল লাহফান মিন মাছায়িদিশ শয়তান ১/৮৫ পৃঃ)
4. আল্লাহর আনুগত্যে থাকার জন্য নিজেকে ধমক দেওয়া : অন্যায় কাজের জন্য অন্তরকে ভৎর্সনা ও তিরস্কার করলে নাফসে আম্মারাহ (কুপ্রবৃত্তি) নাফসে মুতমায়িন্নায় (প্রশান্ত আত্মা) পরিণত হয়। অন্যকে উপদেশ দানের পূর্বে নিজেকে বারবার উপদেশ দিতে হবে। সবসময় মৃত্যু ও পরকালের কথা চিন্তা করতে হবে। নিজেকে এমনভাবে প্রস্ত্তত করতে হবে যেন অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে, ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে, দারিদ্রের পূর্বে প্রাচুর্যকে, বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে, মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে পুরোপুরিভাবে পরকালীন প্রস্ত্ততিতে কাজে লাগানো যায়।
5. নিজ সম্পর্কে সুধারণা না করা ও নিজের সৎকর্ম নিয়ে গর্ব অনুভব না করে তা আল্লাহ্র প্রতি সমর্পিত করা : নিজের প্রতি সুধারণার একটা খারাপ প্রতিক্রিয়া হল তা পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে মানুষকে বাধা প্রদান করে। ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, ‘আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সন্তুষ্ট বোধ করা নেহায়েত বোকামী ও আল্লাহ্র হক্ব সম্পর্কে স্বল্পজ্ঞানের পরিচায়ক। অপরদিকে নিজের প্রতি সুধারণা জন্ম দেয় অহংকার, আত্মগর্ব ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ বদ্উপসর্গ যা অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্য কবীরা গুণাহের চেয়ে নিকৃষ্ট। এজন্য পাপীকে সংশোধন করার পূর্বে নিজেকে সংশোধনে মনোযোগী হওয়া যরূরী। একজন পাপীকে লজ্জিত করার চেয়ে নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করা অধিক উত্তম। আল্লাহ্র আনুগত্য, আল্লাহ্র প্রতি শোকরগোযার হওয়া, আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য এটাই অধিক কার্যকর (মাদারিজুস সালিকীন ১/১৭৫)।
6. আমলকে রিয়া (লোকপ্রদর্শনী) থেকে বিরত রাখা : লোক দেখানোর জন্য অথবা অন্যের নিকট প্রশংসা পাওয়া, দোষারোপ থেকে রেহাই পাওয়া, সম্মান-প্রতিপত্তি অর্জন, ক্ষমতা লাভ করা ইত্যাদি অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত আমল আল্লাহ্র নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। এ সমস্ত কাজ মানুষকে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নিখাদচিত্ত হওয়া (ইখলাছ) থেকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে তার নেকআমল আর অন্তর থেকে পালিত হয় না। তার অন্তর হয়ে পড়ে মৃত। তা আর আলোকিত হ’তে পারে না, পারে না সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য চিহ্নিত করতে। হারিয়ে ফেলে আল্লাহ্র বন্ধু ও আল্লাহ্র শক্রদের মাঝে ব্যবধান করার যোগ্যতাটুকুও (ঐ ১/১৭৫)।
7. আত্মসমালোচনা : আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআনে মানব সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিৎ, আগামী কালের জন্য সে কি প্রেরণ করেছে তা চিন্তা করা’ (হাশর ১৮)। ওমর (রাঃ) এক খুৎবায় বলেন, হে মানুষ! তোমরা নিজেদের হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত দিবসে হিসাব গৃহীত হওয়ার পূর্বেই। তোমাদের অন্তরাত্মাকে তোমরা পরিমাপ কর চূড়ান্ত দিনের পরিমাপের পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজেকে পরিমাপ করা আগামী দিনের তুলনায় বহুগুণে সহজ। সেদিনের মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার জন্য নিজেকে অলংকৃত করে সৌন্দর্য্যমন্ডিত করে নাও, যেদিন কোন গোপনকারীর গোপনীয়তা আর অপ্রকাশ্য থাকবে না। মায়মূন বিন মিহরান বলেন, কোন ব্যক্তি মুত্তাকী হ’তে পারে না যতক্ষণ না সে নিজের হিসাব গ্রহণ করে, যেমন সে অন্যের কাছে হিসাব নেয় যে, সে কোথা থেকে খাদ্য ও পোষাক সংগ্রহ করেছে। ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, এমন অনেকে রয়েছে যে নেক আমল প্রচুর করে কিন্তু নিজের খারাপ গুণসমূহ দূর করার অবসর পায় না। ফলে অচিরেই তার মাঝে রিয়া, আত্মগর্ব ইত্যাদি বদগুণ পাহাড়ের মত স্থায়ী জায়গা করে নেয়, যাকে সে কিছুই মনে করে না। এজন্য আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি সে-ই যে সৎ আমল অধিক করে এবং সতর্কতার সাথে অসৎ গুণ থেকে দূরে থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা (মু‘মিনরা) রাতের কম অংশেই নিদ্রা যেত এবং শেষ রাতে আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত’ (যারিয়াত ১৮)।
8. কম ঘুমানো, কম খাওয়া ও কম কথা বলা : আল্লাহ্র স্মরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অতিমাত্রায় কথা বলা অন্তরকে আবশ্যকীয়ভাবে কঠিন করে তোলে। আর কঠিন অন্তরের মানুষের অবস্থান আল্লাহ থেকে সবচেয়ে দূরে। অধিক মাত্রায় খানা-পিনা শয়তানী প্রবৃত্তিকে উস্কে দেয় এবং ঘুম বৃদ্ধি করে দেয়। আর অধিক ঘুম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করার সাথে সাথে আলস্য ও কর্মক্ষমতা হ্রাসেরও কারণ। এজন্য রাসূল (ছাঃ) সকল কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন।
9. ধৈর্য ও দৃঢ় বিশ্বাসের গুণ দ্বারা সুশোভিত হওয়া : প্রবৃত্তির উপর বিজয় লাভ করা, হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা ও আল্লাহ্র আনুগত্যে অটল থাকার জন্য ধৈর্য অবলম্বন অপরিহার্য। আত্মশুদ্ধির দু’টি দিক ‘অর্জন’ ও ‘বর্জন’ ধৈর্য ব্যতীত আত্মস্থ করা অসম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা ধৈর্য ধারণের অপরিসীম পুরস্কার নির্ধারণ করে রেখেছেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ধৈর্য হল আলো স্বরূপ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৮১)। আর আত্মপ্রত্যয়, দৃঢ় বিশ্বাস মানুষকে পথভ্রষ্টতা থেকে পরিত্রাণ দেয় এবং প্রশান্তি ও স্থিরতা দান করে। এজন্য সুফিয়ান ছাওরী বলেন, ধৈর্য ও দৃঢ় বিশ্বাস মানুষকে দ্বীনের ব্যাপারে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা ছবর করত এবং আমার আয়াতের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখত বলে আমি তাদের মধ্য থেকেই নেতা নির্বাচন করেছিলাম’ (সিজদা ২৪)।
10. দো‘আ করা : সর্বোপরি আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য আল্লাহ্র নিকট আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করা অপরিহার্য। কেননা আল্লাহর অনুগ্রহই কেবলমাত্র মানুষের সৎপথ প্রাপ্তি ও আত্মশুদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে (নূর ২১)। দো‘আ মু‘মিনের অস্ত্রস্বরূপ। দো‘আর মাধ্যমেই সে আল্লাহ্র কাছে অকল্যাণ থেকে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং আল্লা্হর আনুগত্যের জন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। রাসূল (ছাঃ) এজন্য দো‘আ করতেন, ‘হে প্রভু! তুমি আমাকে সর্বোত্তম চরিত্র ও সর্বোত্তম আমলের দিকে পথ-প্রদর্শন কর। কেননা উৎকৃষ্টতার দিকে পথপ্রদর্শন করার সাধ্য তুমি ছাড়া আর কারো নেই। তুমি আমাকে অসৎ চরিত্র ও অসৎ আমল হ’তে পরিত্রাণ দাও। কেননা তুমি ব্যতীত কেউই বদস্বভাব থেকে উদ্ধার করতে পারে না’ (নাসাঈ, মিশকাত হা/৮২০)। ‘হে প্রভু! আমাকে পরিশুদ্ধ করে দাও, আমাকে সংশোধন করে দাও এবং সৎকর্ম ও সৎচরিত্রের দিকে আমাকে পথ দেখিয়ে দাও। কেননা সুপথপ্রদর্শন করা ও কুপথ থেকে ফিরিয়ে আনার সাধ্য তুমি ব্যতীত কারো নেই’ (আল জামে‘ঊছ ছাগীর হা/২১৪৬)। আল্লাহ আমাদের সকলকে পরিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন। – আমীন!
– মুহাম্মাদ আরীফুল ইসলাম