সমাজ সংস্কারে ইমামগণের ভূমিকা
আমরা মুসলিম, আমাদের ধর্মের নাম ইসলাম। আর ইসলামই পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। সকলের মধ্যেই ধর্মীয় অনুভূতি কমবেশী বিদ্যমান। তারা তাদের জীবন চলার পথে বিভিন্ন বিষয়ে ইমাম ছাহেবের শরণাপন্ন হয়। সাথে সাথে ইমাম ছাহেবের কথাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করে। এক্ষেত্রে ইমাম ছাহেব তাদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করলে সমাজ সংস্কার করা খুবই সহজসাধ্য হবে। ইমাম ছাহেব প্রতিমাসে ৪/৫টি খুৎবা দিয়ে থাকেন। জুম‘আর খুৎবায় তিনি বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে মানুষকে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন। যা সুষ্ঠু সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আলোচ্য নিবন্ধে সমাজ সংস্কারে ইমামগণের ভূমিকা তুলে ধরা হ’ল।-
১. শিরকমুক্ত জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ প্রদান :
একজন ইমাম ও খত্বীব মুছল্লীদেরকে শিরকমুক্ত জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ খুব সহজেই প্রদান করতে পারেন। মুছল্লীবৃন্দ প্রতিনিয়ত ছালাতে মসজিদে আসে এবং তাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তারা বিভিন্ন অজানা বিষয় ইমাম ও খত্বীবদের কাছ থেকে জেনে নেয়ার চেষ্টা করে। তখন তাদেরকে শিরকের ভয়াবহতা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করা যায়। ইমাম ছাহেব ছালাতান্তে ও খত্বীব ছাহেব জুম‘আর খুৎবায় এর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরবেন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে মানুষকে এ বিষয়ে সতর্ক করবেন। কারণ শিরক ভয়াবহ পাপ। যাকে আল্লাহ ‘বড় যুলুম’ বলেছেন (লোকমান ৩১/১৩; নিসা ৪/৪৮)। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একে বড় পাপ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন (ফুরক্বান ২৫/৬৮)।[1]
শিরক এমন একটি অপরাধ, যা তওবা ব্যতীত আল্লাহ ক্ষমা করেন না। অন্যান্য পাপ আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন ভালো কাজের বিনিময়ে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ কোন কাজে বান্দার উপর বেশী খুশী হ’লে তার কোন কোন পাপ নিজ গুণেই ক্ষমা করে দেন। কিন্তু ব্যতিক্রম হ’ল শিরকের পাপ যা এমনিতেই ক্ষমা হয় না। এর জন্য বিশেষভাবে ক্ষমা চাইতে হয় (নিসা ৪/১১৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মানুষ শিরক না করলে আল্লাহ তার গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন।[2]
শিরকের ভয়াবহতার আরেকটি দিক হ’ল- শিরক করলে সারাজীবনের কৃত আমল ধ্বংস হয়ে যায় (যুমার ৬/৬৫; আন‘আম ৩৯/৮৮)। তাছাড়া শিরক করলে তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায় এবং জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যায় (মায়েদা ৫/৭২)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও বলেছেন, শিরক করলে জাহান্নামে যেতে হবে।[3] সুতরাং মৃত্যুর মুখোমুখি হ’লেও শিরকের সাথে আপোস করা যাবে না। শিরকের বিরুদ্ধে নবী ও রাসূলগণ ছিলেন আপোষহীন। মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না। যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়’।[4]
২. বিদ‘আতমুক্ত জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ প্রদান :
শিরকের মত আরেকটি জঘন্য পাপের নাম বিদ‘আত। বিদ‘আত মূলতঃ ইসলামী শরী‘আতে নতুন কিছু আবিষ্কারের নাম। যা নেকীর উদ্দেশ্যে মানুষ সম্পাদন করে থাকে। কোন প্রকার বিদ‘আত ইসলামে স্বীকৃত নয়। চাই তা ভাল হোক আর মন্দ হোক। সকল প্রকার বিদ‘আতই শরী‘আতে পরিত্যাজ্য। বিদ‘আতমুক্ত জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ইমামগণ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতসহ জুম‘আর খুৎবায় আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে মুছল্লীদেরকে সচেতন করে তুলবেন। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদেরকে হুঁশিয়ার করবেন এবং বিদ‘আতের কুফল আলোচন করবেন। কেননা বিদ‘আত করলে প্রকারান্তরে আল্লাহর বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়। বিদ‘আত শরী‘আতে নবাবিষ্কৃত বিষয়। ইসলামে নতুন কোন জিনিস চালু করার অর্থ হ’ল ইসলাম আগে অপূর্ণ ছিল অত্র কাজ চালুর মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছে। নাঊযুবিল্লাহ! অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদা ৫/৩)। অত্র আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই ইসলাম পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। নতুন করে এখানে কোন বিধান রচনা বা চালু করার সুযোগ নেই।
মুসলিম ব্যক্তি যে আমলই করুক না কেন তা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর তরীকা বা পদ্ধতিতে না হ’লে তা হবে পরিত্যাজ্য।[5] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুমোদন বিহীন কোন আমল ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং তা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। কারণ কোন ব্যক্তি বিদ‘আত করলে তার থেকে সমপরিমাণ সুন্নাত বিদায় নেয়। সে সুন্নাত আর কোন দিন তার মাঝে ফিরে আসে না।[6]
বিদ‘আতের ভয়াবহতার আরেকটি দিক হ’ল বিদ‘আতীর তওবা আল্লাহ কবুল করেন না, যতক্ষণ না সে উক্ত বিদ‘আত থেকে ফিরে আসে।[7]
বিদ‘আতের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হ’ল বিদ‘আতকারীর শেষ ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম।[8] এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রত্যেক জুম‘আর ছালাতের প্রারম্ভে উপস্থিত মুছল্লীদের বিদ‘আত থেকে বিরত থাকার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করতেন।[9]
৩. প্রকৃত সুন্নাত অনুসরণে উদ্বুদ্ধকরণ :
ইমামগণ ছালাতান্তে বা জুম‘আর খুৎবায় একদিকে বিদ‘আতের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরবেন, অন্যদিকে প্রকৃত সুন্নাতের অনুসরণে উৎসাহ প্রদান করবেন। কেননা ছহীহ সুন্নাহর অনুসরণের মধ্যেই মুসলিম মিল্লাতের প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। রাসূল (ছাঃ)-কে অনুসরণের মাধ্যমেই আল্লাহ সন্তুষ্ট হন (আলে ইমরান ৩/৩১)। রাসূল (ছাঃ)-এর পূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত মুমিন হওয়া যায় না (নিসা ৪/৬৫)। [10] আর তাঁর পরিপূর্ণ অনুসরণ ছাড়া কোন ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না।[11]
মূলতঃ পৃথিবীর সব কিছুর উপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রাধান্য দিতে হবে। নচেৎ পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের ব্যতিক্রম কোন ইবাদত করলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। আর যা বাতিল, তা কবুলের তো প্রশ্নই উঠে না (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)। সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণেই প্রতিটি ইবাদত সম্পাদন করতে হবে। অন্যথা ইবাদত বাতিল হয়ে যাবে।
৪. বিশুদ্ধ আমল করার প্রতি প্রশিক্ষণ প্রদান :
ইমাম ছাহেব সকলকে বিশুদ্ধ আমল করার তাকীদ দিবেন। সাথে সাথে অশুদ্ধ আমলের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরবেন। পরকালে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিশুদ্ধ আমলের বিকল্প নেই। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের শুধু আমল করার কথা বলেননি। বরং বিশুদ্ধ আমল করার কথা বলেছেন। যেমন কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا ‘যে ব্যক্তি স্বীয় প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ করতে চায়, সে যেন বিশুদ্ধ আমল করে এবং একক প্রভুর ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে’ (ক্বাহফ ১৮/১১০)। সুতরাং বিশুদ্ধ আমলই একজন মানুষের মূল পুঁজি।
৫. শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা :
ইমাম ও খত্বীবগণ স্বীয় প্রচেষ্টায় শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠনে সচেষ্ট হবেন। পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থানের মর্যাদা মুছল্লীদের মাঝে তুলে ধরবেন। পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করবেন। এ মর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। কাজেই সে তার উপর যুলুম করবে না, তাকে লজ্জিত করবে না এবং তাকে তুচ্ছ মনে করবে না। আল্লাহভীতি এখানে- একথা বলে তিনি তিনবার নিজের বুকের দিকে ইশারা করলেন। নবী করীম (ছাঃ) আরো বলেছেন, কোন ব্যক্তির মন্দ কাজ করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে নিজের কোন মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ মনে করে। একজন মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের জান, মাল ও মান-সম্মান বিনষ্ট করা হারাম’।[12]
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সে তার উপর যুলুম করবে না এবং তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজনে সাহায্য করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজনে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের একটি কষ্ট দূর করবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তার বিপদ সমূহ হ’তে একটি বিপদ দূর করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন’।[13]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, ‘তোমরা (মন্দ) ধারণা হ’তে বেঁচে থাক। কেননা ধারণা বড় ধরনের মিথ্যা। কারো কোন দোষের কথা জানতে চেষ্টা কর না। গোয়েন্দাগিরি কর না, ক্রয়-বিক্রয়ে ধোঁকাবাজি কর না, পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ কর না, পরস্পর শত্রুতা কর না এবং একে অন্যের পিছনে লেগ না। বরং পরস্পর এক আল্লাহর বান্দা ও ভাই ভাই হয়ে থাক। অপর এক বর্ণনায় আছে, ‘পরস্পর লোভ-লালসা কর না’।[14]
উপরোক্ত হাদীছগুলোতে নিজেদের মধ্যে সব ভেদাভেদ ভুলে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের তাকীদ দেয়া হয়েছে। সকলকে সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্বে বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে। যার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন।
৬. সবধরনের কুসংস্কার পরিহারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা :
অসংখ্য দৃশ্য, কথা ও কর্মে মানুষের অশুভ ধারণা হয়। যেমন রাস্তায় বের হয়ে নারীদের সাথে দেখা হ’লে উদ্দেশ্য হাছিল হয় না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর পুনরায় ফিরে গেলে উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। পিছন হ’তে ডাকলে যাত্রা শুভ হয় না। রাতে ঘরের আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে বাইরে ফেলা যায় না। রাতে মানুষকে টাকা ধার দেয়া যায় না। রাতে ও সকালে বাকী বিক্রি করা যায় না। রাতে গাছের ফল পাড়া যায় না, রাতে লোহা নিয়ে বের না হ’লে বাচ্চাকে চোরা চুন্নি পাখিতে ধরে নেয়। জময কলা খেলে জময সন্তান হয়। গরুকে লাথি মারা যায় না। জুতা পায়ে দিয়ে শস্য ক্ষেতে বা শস্যের উপর যাওয়া যায় না। ঘরের উপর কাক ডাকলে মেহমান আসে। হাত হ’তে গ্লাস পড়লে মেহমান আসে। ছেলের মাথায় ঝাড়ু লাগানো যায় না, ছেলের মাথায় মায়ের অাঁচল লাগানো যায় না। স্বামীর নাম ধরে ডাকা যায় না ইত্যাদি অগণিত কুসংস্কার আমাদের সমাজে চালু আছে। সেগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা ইমামের দায়িত্ব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,أَلاَ إِنَّمَا طَائِرُهُمْ عِنْدَ اللهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ ‘মনে রেখ, আল্লাহর কাছেই রয়েছে তাদের কুলক্ষণসমূহের চাবিকাঠি। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই তা বুঝে না’ (আ‘রাফ ৭/১৩১)। তিনি অন্যত্র বলেন,قَالُوا إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهُوْا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُمْ مِنَّا عَذَابٌ أَلِيْمٌ قَالُوْا طَائِرُكُمْ مَعَكُمْ ‘জনগণ রাসূলগণকে বলল, আমরা তোমাদের অশুভ কুলক্ষণে মনে করছি। যদি তোমরা বিরত না হও, তবে অবশ্যই তোমাদের পাথর দ্বারা হত্যা করব এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে। তখন রাসূলগণ বললেন, তোমাদের অশুভ কুলক্ষণ তোমাদের সাথে রয়েছে’ (ইয়াসীন ১৮-১৯)।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুসলিম জাতিকে সর্বপ্রকার কুলক্ষণকে পরিহার করতে বলেছেন। হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ عَدْوَى وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ وفي رواية ولا نَوْءَ ولاَ صَفَرَ ولاَ غُوَلَ ‘দ্বীন ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি, কুলক্ষণ, পেঁচা পাখির ডাকের মন্দ প্রতিক্রিয়া, পেটে পীড়াদায়ক সাপ, নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টিপাত ও ভুত বা দৈত বলে কিছু নেই’।[15]
ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘কুলক্ষণ বা অশুভ ধারণা যে ব্যক্তিকে তার স্বীয় প্রয়োজন, দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে দূরে রাখল, সে মূলতঃ শিরক করল। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, এর কাফ্ফারা কী? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এ কথা বল যে, ‘হে আল্লাহ! তোমার মঙ্গল ব্যতীত কোন মঙ্গল নেই। তোমার অশুভ ছাড়া কোন অশুভ নেই এবং তুমি ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই’।[16] এভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত নানাবিধ কুসংস্কার হতে মুছল্লীদের মুক্ত রাখতে ইমামগণ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন।
বিভিন্ন দিবস পালন, বর্ষবরণ ও বিদায়, কবর ও মাযারে নযর-নেওয়ায পেশ, শহীদ মিনার ও স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মৃতব্যক্তির স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন, প্রসিদ্ধ ব্যক্তির স্মৃতির জন্য মূর্তি ও ভাষ্কর্য নির্মাণ, অফিস-আদালত ও শিক্ষা পতিষ্ঠানে ছবি ঝুলানো ইত্যাদির বিরুদ্ধে ইমামগণ আলোচনা করে মানুষকে সচেতন করতে পারেন। এছাড়া বিবাহে যৌতুক প্রথা, বর-কনেকে গোসল করানো, ক্ষির খাওয়ানো ইত্যাদি কুসংস্কার চালু আছে। এসব উৎখাতে ইমামগণ বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
৭. নারীদের নছীহত প্রদান :
(ক) নারীদের পর্দা করার প্রতি গুরুত্বারোপ : যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সরাসরি জাহান্নামে প্রবেশ করার কথা উল্লেখ করেছেন, বেপর্দা নারী তাদের অন্যতম। মুসলিম নারীদেরকে পর্দার মধ্যে থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম নারীদেরকে নিজ গৃহে অবস্থান করতে বলেছেন। যেমনটি তিনি বলেন,وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَلاَ تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الأُولَى ‘তোমরা স্বগৃহে অবস্থান কর, প্রাচীন জাহেলী যুগের নারীদের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন কর না’ (আহযাব ৩৩/৩৩)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিন নারীদেরকে বলে দাও যে, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না’ (আহযাব ৩৩/৫৯)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘হে নবী! তুমি ঈমানদার নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান থাকে তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তাদের গ্রীবা ও গলদেশ চাদর দ্বারা ঢেকে রাখে’ (নূর ২৪/৩১)। এমনিতেই যা প্রকাশ হয়ে পড়ে অথবা যা প্রকাশ করতে বাধ্য তা ব্যতীত পুরো শরীর চাদরাবৃত রাখাই মুসলিম রমণীদের কর্তব্য।
পবিত্র কুরআনের ন্যায় ছহীহ হাদীছে নারীদের পর্দা প্রথার প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সাথে সাথে পুরুষকে তাদের থেকে সর্তক থাকতে বলা হয়েছে। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,فَاتَّقُوا الدُّنْيَا واتَّقوا النِّسَاءَ فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ كَانَتْ فِي النِّسَاءِ. ‘তোমরা দুনিয়া এবং নারীদের থেকে সাবধান থাক। কারণ নিশ্চয়ই বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা নারীদের মধ্যেই ঘটেছিল’।[17] উক্ববা ইবনু আমের (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِيَّاكُمْ وَالدُّخُوْلَ عَلَى النِّسَاءِ فَقَالَ رَجُلٌ مِنْ الأَنْصَارِ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ الْحَمْوُ الْمَوْتُ. ‘তোমরা নারীদের নিকট যাওয়া থেকে সাবধান থাক। একজন ছাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! দেবর সম্পর্কে কি বলছেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘দেবর মৃত্যু সমতুল্য’।[18]
ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,الْمَرأَةُ عَوْرَةٌ فَإِذَا خَرَجَتْ إِسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ. ‘নারী হচ্ছে গোপন বস্তু। যখন সে বাড়ি থেকে বের হয়, তখন শয়তান তাকে নগ্নতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তুলে’।[19]
উপরোক্ত হাদীছগুলোতে নারীদের পর্দার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে। তাদের পর্দার বিধান মেনে চলার মধ্যেই মানব জাতির কল্যাণ নিহিত। তাদের পর্দার বিধান লঙ্ঘিত হ’লে নানান সমস্যায় মুসলিম জাতিকে পড়তে হবে সেদিকেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
(খ) পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী অভিশপ্ত : নারীরা পুরুষের বেশ ধারণ করতে পারে না। কেননা পুরুষের বেশ ধারণ করা মহাপাপ। তারা পুরুষের পোশাক বা কোন পরিধেয় বস্ত্র পরতে পারে না। কেউ পরলে তার প্রতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অভিশাপ করেছেন। যেমন ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ. ‘নবী করীম (ছাঃ) পুরুষের বেশ ধারণকারী নারীর প্রতি অভিশাপ করেছেন এবং নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষের প্রতি অভিশাপ করেছেন’।[20]
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَنَ الرَّجُلَ يَلْبَسُ لُبْسَةَ الْمَرْأَةِ وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لُبْسَةَ الرَّجُلِ ‘রাসূল (ছাঃ) সেই পুরুষের প্রতি অভিশাপ করেছেন যে মহিলার পোষাক পরিধান করে এবং সে মহিলার প্রতি অভিশাপ করেছেন যে পুরুষের পোষাক পরিধান করে’।[21]
(গ) বেপর্দা নারী জান্নাতে যাবে না : নারীরা পর্দা রক্ষা না করলে তাদেরকে জাহান্নামে যেতে হবে। কেননা ইসলামে পর্দা নারীর জন্য আবশ্যকীয় বিধান। যা কোন অজুহাতে অবহেলা করার সুযোগ নেই। আর তা লঙঘন করা মহাপাপ। যেমন আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘দুই শ্রেণীর লোক জাহান্নামী রয়েছে যাদেরকে এখনও আমি দেখিনি। (প্রথম শ্রেণী) এমন সম্প্রদায় যাদের হাতে গরু পরিচালনা করার লাঠি থাকবে, যা দ্বারা তারা মানুষকে প্রহার করবে। (দ্বিতীয় শ্রেণী) নগ্ন পোষাক পরিধানকারী নারী, যারা পুরুষদেরকে নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা বক্র উঁচু কুঁজ বিশিষ্ট উটের ন্যায় হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি তারা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ জান্নাতের সেই সুগন্ধি এত এত দূর হ’তে পাওয়া যায়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘এক মাসের পথের দূরত্ব হ’তে পাওয়া যায়’।[22] অত্র হাদীছ দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় বেপর্দা নারীরা জান্নাত লাভ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও তারা পাবে না। ফলে তাদের শেষ পরিণতি হবে জ্বলন্ত অগ্নি। যেখানে তারা চিরকাল জ্বলতে থাকবে। এ বিষয়গুলো ইমামগণ স্বীয় মুছল্লী ও জনতার নিকট প্রচার করবেন।
৮. সূদ ও ঘুষ বর্জনে গণসচেতনতা সৃষ্টি : ইসলামে সূদী কারবার বা সূদী অর্থনীতি হারাম। ইমাম ও খত্বীবগণ জনগণের মাঝে সূদের ভয়াবহতা তুলে ধরবেন। এর সামাজিক ক্ষতিকর দিকগুলো বিশ্লেষণ করবেন। সূদের শেষ পরিণতি কি তা ব্যাখ্যা করবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ খেয়ো না। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার’ (আলে ইমরান ৩/১৩০)। তিনি অন্যত্র বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنْ الرِّبَا إِنْ كُنتُمْ مُؤْمِنِينَ. ‘হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং যদি তোমরা মুমিন হও, তবে সূদের মধ্যে যা বকেয়া রয়েছে তা বর্জন কর’ (বাক্বারাহ ২/২৭৮)।
সূদ ও ঘুষ কাবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। যা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। মহানবী (ছাঃ) সূদখোরের প্রতি অভিশাপ করেছেন। যেমন জাবির (রাঃ) বলেন,لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وقَالَ هُمْ سَوَاءٌ. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, সূদের লেখক ও সাক্ষীদ্বয়ের প্রতি অভিশাপ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, অভিশাপে তারা সবাই সমান।[23]
আবদুল্লাহ ইবনু হানযালাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,دِرْهَمُ رِبَا يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ أَشَدُّ مِنْ سِتَّةِ وَثَلاَثِيْنَ زِنْيَةً. ‘কোন ব্যক্তি জেনে শুনে এক দিরহাম বা একটি মুদ্রা সূদ গ্রহণ করলে ছত্রিশ বার যেনা করার চেয়ে কঠিন হবে’।[24]
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الرِّبَا سَبْعُونَ حُوبًا أَيْسَرُهَا أَنْ يَنْكَحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ. ‘সূদের পাপের ৭০টি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হচ্ছে মাতাকে বিবাহ করা’।[25] অর্থাৎ মায়ের সাথে যেনা করা।
ঘুষ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন,لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَاشِيَ وَالْمُرْتَشِيْ. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষ প্রদানকারীর প্রতি অভিশাপ করেছেন’।[26] সূদ ও ঘুষ ইসলামী অর্থনীতিতে হারাম। বিধায় সকল মুসলিমকে এরূপ গর্হিত কাজ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। অন্যথা পরকালে জাহান্নামে যেতে হবে।
শেষকথা : ইমাম হ’লেন সমাজের সর্বোচ্চ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তবে ইমামগণকে সেই ব্যক্তিত্বের পর্যায়ে উন্নীত হ’তে হবে। সমাজে তার মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আর সে গুণ হক্বের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। নিজের মধ্যে কোন দুর্বলতা থাকলে তার দ্বারা সমাজ সংস্কার হওয়া অত্যন্ত দুরূহ। তিনি স্বচ্ছ ব্যক্তি হলে তার কথা ও আচরণের প্রভাব সর্বসাধারণের মধ্যে বিস্তার করবে। তখন সমাজ সংস্কার করা সহজ হবে। মুসলিম সমাজ ইমামগণকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে। বিধায় তাদের কথা ও কর্মকে মূল্যায়নের চেষ্টা করবে। সুতরাং তারা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সমাজ সংষ্কারের চেষ্টা করবেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন- আমীন!