সমাজ/সংস্কৃতি/সভ্যতা

নগ্নতাই যেন নারীর বাঁচার শেষ অবলম্বন!

কতটা রিয়্যাল হতে হবে রিয়্যালিটি শো-কে? বাস্তবতার ঠিক কোন পর্যায়ে সুড়সুড়ি দিলে তবে রিয়্যালিটির রংচঙে মোড়কের  প্রতিটি রেখা তুলে ধরবে এর তীক্ষ্ন দাঁত-নখ? রিয়্যালিটি শোর ঝলমলে স্টেজ ঝাঁপিয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের বাস্তবজীবনের ওপর? রিয়্যাল, আরও রিয়্যাল। মানুষের সবচেয়ে গোপন, সবচেয়ে ব্যক্তিগত ব্যাপারটুকু খোলা মঞ্চে হাজির না করলে কীসের এই রিয়্যালিটি শোর তকমা! তাই নাচ-গান-অভিনয়-লোক হাসানোর ক্ষমতা বা বাইরের দুনিয়ার থেকে বিচ্ছিন্নভাবে এক বাড়িতে ক্যামেরা-বন্দি হয়ে অনেকে মিলে দিন কাটানো নয়, খোলা মঞ্চে নগ্ন নারী শরীর এবার রিয়্যালিটি শোর উপজীব্য। কারণ এই মুখোশ পরা ভদ্র মানুষগুলোর কাছে সব পণ্যের সেরা পণ্য নারীর দেহ। ভোগ্যপণ্যের বাজারে সবচেয়ে চড়া দামে যা বিকোয়, মাথা খাটিয়ে সেটাকেই রিয়্যালিটি শোর বিষয় করেছেন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা।

খবরটা প্রকাশ পায় বিবিসির ওয়েবসাইটে। সংবাদে বলা হয়, ডেনমার্কের ওই রিয়্যালিটি শোর কথা। সে দেশের টিভি চ্যানেলের প্রাইম টাইমে দেখানো হচ্ছে ‘নেকেড লেডি’ নামের এই রিয়্যালিটি শো। সেখানে মঞ্চে বসে স্যুটেড-বুটেড দুই পুরুষ। যাদের একজন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, অপরজন বিশেষ অতিথি। আর সামনে স্টেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক মহিলা, যার শরীরে কোথাও এক টুকরো সুতোও নেই। গদি আঁটা নরম চেয়ারে বসে গম্ভীর মুখে ওই নগ্ন নারীদেহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে চলেছেন পুরুষদ্বয়। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উঠে আসছে তাদের আলোচনায়। এর পুরোটাই হচ্ছে লাইভ টিভি ক্যামেরার সামনে!
আর সেই মেয়েটি? যার শরীর নিয়ে হাজার চোখের সামনে এত আলোচনা? পুরো সময়টায় কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে নিজের শরীর প্রদর্শন করা ছাড়া তার কোনো ভূমিকাই নেই। গোটা আলোচনাপর্বে সে একবারও অংশ নিতে পারবে না। তবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য উদ্যোক্তাদের তরফে ২৫০ ইউরো পাবে সে। নগ্নতার মূল্য…
আজ গোটাবিশ্ব যেন মেনে নিচ্ছে ‘শরীর আমার অধিকার আমার’ স্লোগানের শারীরিক অধিকার তত্ত্ব। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ স্বেচ্ছায় জনসমক্ষে নগ্ন হতে পারে- অন্তত মনুষ্যত্বের কোনো সংজ্ঞায় তা মেনে নেওয়া যায় না। নারীসত্তার কী অবমাননা! যেখানে তার শরীরের প্রতিটি খাঁজের খুঁটিনাটি উঠে আসছে দুই পুরুষের সবিস্তার বর্ণনায়, বহু লোলুপ চোখের দৃষ্টিতে, সেখানে তার কোনো বক্তব্য থাকবে না কেন? কেন এই আলোচনায় সে একবারও অংশ নিতে পারবে না? দোকানে সাজানো শো পিসের মতো সেও নির্বাক, অনুভূতিহীন। নেহাতই জাজমেন্ট প্যানেলের সামনে উপস্থিত একটা ‘সাবজেক্ট’। ক্ষুধার্ত লক্ষ ব্যঘ্র-সিংহের আফ্রিকার জঙ্গলে যেন এক অসহায় হরিণশাবক!

‘সাবজেক্ট’।… তার প্রাণ নেই, অনুভূতি নেই, চিন্তাশক্তি নেই, কথন ক্ষমতা নেই। আছে শুধু একটা শরীর। যে শরীর রিয়্যালিটি শোর লাগামছাড়া বাস্তবতার বিকিকিনির বাজারে মোটা দামে বিকোয়। টিভি চ্যানেলের ঝুলিতে আসে মোটা টিআরপি, প্রচুর বিজ্ঞাপন। খবরেই পড়লাম, এই শো ঘিরে ডেনমার্কে বেশ কয়েকটি নারীবাদী সংগঠন আপত্তি তুললেও জনপ্রিয়তার নিরিখে প্রথম দিকেই রয়েছে ‘নেকেড লেডি’।

এমন একটি শো-তে চটজলদি জনপ্রিয়তা যে আসবেই, সে তো খুবই স্বাভাবিক। তবু ভাবতে অবাক লাগে, পৃথিবীর কোনো এক উন্নত, আলোকজ্জ্বল কোণে এমন একটি অনুষ্ঠান লাইভ টিভিতে সম্প্রচারিত হচ্ছে। সেখানে আসছেন মহিলারা এবং তারা প্রায় প্রত্যেকেই শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। এই শোর একটি এপিসোডে উপস্থিত হওয়া এক মধ্যবয়স্ক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা জানিয়েছেন, শোটি সম্প্রচারিত হওয়ার পর তাঁর কাছে পাঁচ-পাঁচটা বিয়ের সম্বন্ধ আসে!

আমাদের তো অশিক্ষা আর দারিদ্রের বাঁধনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ বিশাল এক দেশ। সেখানে শুধু বেঁচে থাকার লড়াইতেই জীবন কেটে যায় অধিকাংশ মহিলার। নারীর অধিকার, নারীর স্বাধীনতা বা নারীত্বের উদযাপন আজও আমাদের দেশের বেশিরভাগ অংশেই অর্থহীন হেঁয়ালি। কিন্তু প্রাচুর্যের সম্ভারে ঝলমলে ডেনমার্কে তো তা নয়। তাহলে নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে ফেলার পুরস্কার হিসেবে কতগুলো বিয়ের প্রস্তাব এল, সেটাই এমন মূখ্য হিসেবে উঠে এল কেন? ফেমিনিস্টরা ছিছি করায় উদ্যোক্তাদের তরফে বলা হয়েছে, মহিলারা তো এখানে স্বেচ্ছায় আসছেন, কাউকে জোর করা হয়নি। তাও ঠিক। কিন্তু কেন আসছেন, সেটাই প্রশ্ন। অনেকে বলতে পারেন, আমাদের দেশে শরীর নিয়ে যেমন ছুঁত্মার্গ আছে, ওদেশে তেমন নেই। ওরা শরীর নিয়ে কোনো কুণ্ঠায় ভোগে না। কিন্তু নারী শরীর সেখানেও নিছকই একটি ভোগ্যপণ্য। নাহলে তো এমন অনুষ্ঠান ঘিরে এত জনপ্রিয়তা ও বিতর্কের ঢেউ আছড়ে পড়ত না। এখানে উপস্থিত হয়ে গর্বিত কোনো নারী হাসিমুখে নিশ্চয় তার কাছে আসা বিয়ের প্রস্তাবের হিসেব দিত না। দেশ বদলাক, যুগ বদলাক, বদলে যাক শিক্ষার ধরন বা সংস্কৃতির আলো, কোনো কিছুতেই বদল নেই নারী শরীরের পণ্য-সর্বস্বতা।

চিন্তা করা যায় আধুনিক বর্বরতার কথা? ভাবুন তো পাঠক, হলভর্তি দর্শকের সামনে একজন নারীর পুরোপুরি নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য কতটা মর্মান্তিক ও পৈশাচিক হতে পারে? স্পট লাইটের বিম সম্পূর্ণ ঝুলে আছে ওই নগ্ন নারীদেহের ওপর। মূর্তির মতো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে মেয়েটি। আরো ভয়াবহ ব্যাপার দেখুন তো, ওই বিবস্ত্র নারীটির পাশেই সামান্য আলোতে মুখোমুখি বসে দুজন পুরুষ হোস্ট। তারা আলাপের ছলে একের পর এক মন্তব্য করতে থাকেন চোখের সামনে থাকা নারীদেহের প্রলেপ, খাঁজ এবং শৈল্পিক ঢেউ নিয়ে। সেই বর্ণনা শুনে হলভর্তি দর্শক হাত তালি দিয়ে অভিনন্দন জানান সেই নগ্ন নারীকে। আর এই পুরো দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করে সেটা টেলিভিশনে প্রচার করা হচ্ছে!  কেউ মন্তব্য করছে, ‘আহ, মেয়েটি তার শরীরের খাঁজগুলোতে মনে হয় একটু মোমের পরশ বুলিয়েছে। এত মসৃণ যে ওর শরীর থেকে আলো পিছলে পড়ছে,’ জবাবে আরেক হোস্ট বললেন, ‘ওহ, তাই তো। খেয়াল করে দেখ, মেয়েরা সবসময় শুধু নিজেদের প্রশংসা নিজেরাই করে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দর্শক জানতে পারছে একজন পুরুষ তার সামনের নারীকে নিয়ে কি ভাবছে। তাই না?’

‘আরে ধুর, এটা স্রেফ আমার ভাষায় রাবিশ টাইপ সেক্সি!’ : আলো আঁধারের খেলায় এভাবেই চলতে থাকে আলাপচারিতা। নগ্নতার ফেরি করা এই অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে চলছে উত্তেজনা আর তুমুল বিতর্ক। এই অনুষ্ঠানকে ডেনমার্কে বলা হচ্ছে স্রেফ একটি রিয়েলিটি শো। নির্মাতারা দাবি করছেন, ‘এটি একটি কাব্য, নগ্নতা নয়।’ উদ্যোক্তারা এই শোকে শিল্পকলা হিসেবে দেখাতে চাইলেও, নারী শরীর যে আজও পুরুষের কাছে নেহাতই পণ্য ছাড়া কিছু নয় তাই চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন অনেকে। শো’র জন্য মেয়েটিকে আড়াই শো ইউরো দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি শো’তেই মেয়েটির ‘পারিশ্রমিক’-এর টাকা দর্শকদের সামনে নগ্ন অবস্থায় মঞ্চের ওপরই দিয়ে দেওয়া হয়। বিতর্কের একটি অংশে যারা আছেন, তাদের দাবি হলো শরীরের অধিকার তত্ত্ব মেনে নিলে, জনসমক্ষে একটি মেয়ে স্বেচ্ছায় নগ্ন হতেই পারে। কিন্তু তার শরীর নিয়ে প্রকাশ্যে টিভি ক্যামেরার সামনে দু’জন পুরুষ খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছে, কিন্তু তার কোন বক্তব্য নেই। এ ক্ষেত্রে তাকে জড়বস্তু ছাড়া আর কিছুই ভাবা হচ্ছে না বলে অভিযোগ অন্যপক্ষের।
এ ধরনের একটি শো কীভাবে সরকারী ছাড়পত্র পেলো, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নারীকে এভাবে উপস্থাপনের জন্য বিশ্ব গণমাধ্যমে এখন বিতর্কের ঝড়। নারী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অভিযোগ, এভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে নারীর সম্মানহানি করা হচ্ছে। তবে দেশটির মানবাধিকার কর্মীরা এ ধরনের রিয়েলিটি শো বন্ধের দাবি তুলেছেন। তারা দাবি করেন, মানবদেহকে ‘জড়বস্তুর’ মতো উপস্থাপন করা একটি গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধ।

এই রিয়্যালিটি শো শুধু ডেনমার্কের নারীদের নারীসত্তাই বিপন্ন করেনি, বিপন্ন করেছে সারাবিশ্বের নারীসত্তার এবং করা হয়েছে নারীত্বের চরম অবমাননা। আজ আকাশ-সংস্কৃতির যে বিপুল সক্ষমতা তাতে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং সারাবিশ্বের কোটি কোটি টিভি দর্শক দর্শন ও ‘ধর্ষণ’ করে থাকে ওই রিয়্যালিটি শোর আগুনে কামুকতা। টিভিতে উপস্থিত পূর্ণ বিবসনা নারীর একচিলতে সুতামুক্ত নগ্নদেহ সারাবিশ্বের অসংখ্য মানুষের চোখ ‘শীতল’ করার পর উপস্থাপক ও সঞ্চালকের নখ থেকে মাথার চান্দি পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গের বিবরণ শ্রোতাদের কর্ণকে করে মধুময়…

রিয়্যালিটি শো নয়; যেন গরুর হাট! যেখানে প্রতিটি গরুর সঙ্গে থাকে বিশেষ শুভাকাঙ্ক্ষী দালাল! প্রতিটি ক্রেতার সামনে সে নিমিষেই হাজির। এরপর চলে গরুর গুণকীর্তণ বর্ণনা। গরুর নিতম্ব উঁচু, ফোলা, গোস্ত হবে অনেক…
নারীর এই অধঃপতনে পুরুষদের চরিত্র ও মানসিকতায় যে পরিবর্তন হয়েছে সেই বিষয়টিও বিশেষ লক্ষণীয়। এই জঘন্য নগ্ন শোতে অংশগ্রহণ করা এক নারীর কাছে হু হু করে বিয়ের প্রস্তাব আসাটা সে কথারই প্রমাণ। নৈতিকতা বিবর্জিত এই বিশ্বে নারীর শেষ অবলম্বন বুঝি নগ্নতা, বেহায়াপনা আর বেলেল্লাপনা! নগ্নতাকে কেন্দ্র করেই নারীর অর্থোপার্জন, বিয়েশাদীর আয়োজন এবং জীবন-সংসার?

শুধু তাই নয়; নগ্নতাকে আজ বেসাতী করে সমাজসেবা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এক পত্রিকায় সংবাদ বেরুলো ‘পোশাক খুলে সমাজসেবা’। খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয়ের পেছনের মূল কারণটা জানালেন পুনম পান্ডে। তিনি জানান, খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয়ে রাজি হয়েছেন সমাজসেবার জন্য। এর মাধ্যমে তিনি সমাজসেবা করছেন! তিনি বলেন, ‘আমি বিবসনা হয়ে সমাজসেবামূলক কাজ করেছি। কারণ জনগণ আমাকে এভাবে দেখে আনন্দিত হয়েছে। বিপুল সাড়াও মিলেছে!’ তার দাবি, মানুষকে আনন্দ দেওয়াটাই সমাজসেবা। সমাজসেবা না সমাজের ‘জ্বালা’?

হায় মানবতা! হায় পশুত্ব! প্রগতির নামে এভাবেই কি মানবতা আর পশুত্বে গলাগলি হয়! এসব তো আসলে পশুত্বের স্তরকেও অতিক্রম করে। মানুষ আর সব কিছুর স্রষ্টার বাণীতেই পড়ুন : 
‘আর অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষকে। তাদের রয়েছে অন্তর, তা দ্বারা তারা বুঝে না; তাদের রয়েছে চোখ, তা দ্বারা তারা দেখে না এবং তাদের রয়েছে কান, তা দ্বারা তারা শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট। তারাই হচ্ছে গাফেল।’ {সূরা আল-‘আরাফ, আয়াত : ১৭৯}

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button