বিনয় ও নম্রতা
বিনয় ও নম্রতা মানুষের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনয় মানুষকে উচ্চাসনে সমাসীন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সহায়তা করে। বিনয়ীকে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। যে যত বেশী বিনয়ী ও নম্র হয় সে তত বেশী উন্নতি লাভ করতে পারে। এ পৃথিবীতে যারা আজীবন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আসন লাভ করে আছেন তাদের প্রত্যেকেই বিনয়ী ও নম্র ছিলেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিনয়ী ও নম্র মানুষ ছিলেন শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)। তিনি ছিলেন বিনয় ও নম্রতার মূর্তপ্রতীক। তাইতো মহান আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন এভাবেوَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْمٍ ‘আর নিশ্চয়ই তুমি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’ (কালাম ৬৮/৪)।
বিনয় ও নম্রতার বিপরীত শব্দ হ’ল ঔদ্ধত্য, কঠোরতা, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি। এগুলো মানব চরিত্রের সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাব। এ পৃথিবীতে মারামারি, কাটাকাটি, খুন-রাহাজানি সহ যত অশান্তির সৃষ্টি হয় তার মূলে রয়েছে ঔদ্ধত্য, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি।
বিনয় ও নম্রতার আভিধানিক অর্থ : বিনয় ও নম্রতা দু’টি সমার্থক শব্দ। বিনয় শব্দের অর্থ- নম্রভাব, নম্রতা, কোমলতা, মিনতি ইত্যাদি।[1] নম্রতা শব্দের অর্থ- বিনীত, ঔদ্ধত্যহীন, নিরহঙ্কার, অবনত, নরম, কোমল, শান্তশিষ্ট ইত্যাদি।[2]
পারিভাষিক অর্থ : আবূ যায়েদ বিসত্বামী (রহঃ) বলেন, هو أن لا يرى لنفسه مقامًا ولا حالاً، ولا يرى في الخلق شرًا منه ‘বিনয় হ’ল নিজের জন্য কোন অবস্থান মনে না করা এবং সৃষ্টি জগতে নিজের চেয়ে অন্যকে অবস্থান ও অবস্থায় নিকৃষ্ট মনে না করা’।
ইবনু আতা বলেন, هو قبول الحق ممن كان العز في التواضع، فمن طلبه في الكبر فهو كطلب الماء من النار ‘যে কোন ব্যক্তি থেকে সত্যকে গ্রহণ করা। সম্মান হ’ল নম্রতায়। যে ব্যক্তি অহংকারে তা তালাশ করবে, তা হবে আগুন থেকে পানি তালাশতুল্য’।[3]
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক (রহঃ) বলেছেন,
رَأْسُ التَّوَاضُعِ أَنْ تَضَعَ نَفْسَكَ عِنْدَ مَنْ هُوَ دُوْنَكَ فِيْ نِعْمَةِ الدُّنْيَا، حَتَّى تُعْلِمَهُ أَنْ لَيْسَ لَكَ بِدُنْيَاكَ عَلَيْهِ فَضْلٌ، وَأَنْ تَرْفَعَ نَفْسَكَ عَمَّنْ هُوَ فَوْقَكَ فِي نِعْمَةِ الدُّنْيَا، حَتَّى تُعْلِمَهُ أَنَّهُ لَيْسَ لَهُ بِدُنْيَاهُ عَلَيْكَ فَضْلٌ-
‘বিনয় ও নম্রতার মূল হ’ল, তুমি তোমার দুনিয়ার নে‘মতের ক্ষেত্রে নিজেকে তোমার নীচের স্তরের লোকদের সাথে রাখ, যাতে তুমি তাকে বুঝাতে পার যে, তোমার দুনিয়া নিয়ে তুমি তার চেয়ে মর্যাদাবান নও। আর নিজেকে উঁচু করে দেখাবে তোমার চেয়ে দুনিয়াবী নে‘মত নিয়ে উঁচু ব্যক্তির নিকট, যাতে তুমি তাকে বুঝাতে পার যে, দুনিয়া নিয়ে সে তোমার উপর মর্যাদাবান নয়’।[4]
সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) তাঁর শিষ্যদের বলেন, (أتدرون ما الرفق) قالوا: قل يا أبا محمد! قال: أن تضع الأمور في مواضعها: الشدة في موضعها، واللين في موضعه، والسيف في موضعه، والسوط في موضعه. ‘তোমরা কি জান নম্রতা কি? তারা বলল, আপনি বলুন, হে আবূ মুহাম্মাদ! তিনি বললেন, প্রত্যেক বিষয়কে যথাস্থানে রাখা। কঠোরতাকে স্বস্থানে, নম্রতাকে তার স্থানে, তরবারিকে যথাস্থানে, চাবুককে তার স্থানে রাখা’।[5]
বিনয়-নম্রতার প্রকারভেদ
ক্ষেত্র বিবেচনায় বিনয় ও নম্রতাকে ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়। নিম্নে ভাগগুলো উল্লেখ করা হ’ল।-
১. মানুষের সাথে নম্রতা : মানুষের সাথে আচার-আচরণে নম্রতা অবলম্বনের বিষয়ে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ-
‘আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে; যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হ’তে, তবে তারা তোমার আশপাশ হ’তে দূরে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর কোন সংকল্প করলে আল্লাহর উপর ভরসা কর। ভরসাকারীদের আল্লাহ ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলল, আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, لاَ تَغْضَبْ فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ لاَ تَغْضَبْ. ‘তুমি রাগ করো না। সে লোকটি কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করল। তিনি বললেন, ‘তুমি রাগ করো না’।[6]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ. ‘মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং হত্যা করা কুফরী’।[7]
২. খাদেম বা চাকরদের সাথে নম্রতা : চাকরদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। ইবনু ওমর (রাঃ) একদা মাটি থেকে এক খন্ড কাঠি অথবা অন্য কোন বস্ত্ত নিয়ে বললেন, তাকে আযাদ করার মধ্যে এর সমপরিমাণ পুণ্যও নেই। কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,مَنْ لَطَمَ مَمْلُوْكَهُ أَوْ ضَرَبَهُ فَكَفَّارَتُهُ أَنْ يُعْتِقَهُ– ‘যে ব্যক্তি নিজ ক্রীতদাসকে চপেটাঘাত করল অথবা প্রহার করল, এর কাফফারা হ’ল তাকে মুক্ত করে দেয়া’।[8] এটা হচ্ছে ক্রীতদাসের সাথে ইসলাম নির্দেশিত আচরণ।
চাকর-চাকরাণী ও গৃহপরিচারিকার সাথে সদাচরণ করার জন্যও ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا أَتَى أَحَدَكُمْ خَادِمُهُ بِطَعَامِهِ، فَإِنْ لَمْ يُجْلِسْهُ مَعَهُ، فَلْيُنَاوِلْهُ لُقْمَةً أَوْ لُقْمَتَيْنِ أَوْ أُكْلَةً أَوْ أُكْلَتَيْنِ، فَإِنَّهُ وَلِىَ عِلاَجَهُ. ‘তোমাদের কারো খাদেম যখন তার খাবার নিয়ে আসে, তখন তাকে যদি সাথে না বসায় তাহ’লে সে যেন তাকে এক লুকমা বা দু’লুকমা খাবার দেয়। কেননা সে তার গরম ও কষ্ট সহ্য করেছে’।[9]
৩. জীব-জানোয়ারের সাথে নম্রতা : জীব-জন্তু ও পশু-পাখির সাথেও নম্রতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হিশাম ইবনু যায়দ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আনাস (রাঃ)-এর সঙ্গে হাকাম ইবনু আইয়ূবের কাছে গেলাম। তখন আনাস (রাঃ) দেখলেন, কয়েকটি বালক কিংবা বর্ণনাকারী বলেছেন, কয়েকজন তরুণ একটি মুরগী বেঁধে তার দিকে তীর ছুঁড়ছে। আনাস (রাঃ) বললেন, نَهَى النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم أَنْ تُصْبَرَ الْبَهَائِمُ. ‘নবী করীম (ছাঃ) জীবজন্তুকে বেঁধে এভাবে তীর ছুঁড়তে নিষেধ করেছেন’।[10]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইবনু ওমর (রাঃ) কতিপয় কুরায়শ যুবকের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা একটি পাখি বেঁধে সেটির দিকে তীর নিক্ষেপ করছিল। আর প্রত্যেকটি নিশানা ব্যর্থ হওয়ার কারণে তারা পাখির মালিকের জন্য একটি করে তীর নির্ধারণ করছিল। তারপর তারা ইবনু ওমর (রাঃ)-কে দেখে আলাদা হয়ে গেল। ইবনু ওমর (রাঃ) বললেন,مَنْ فَعَلَ هَذَا لَعَنَ اللهُ مَنْ فَعَلَ هَذَا إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَعَنَ مَنِ اتَّخَذَ شَيْئًا فِيْهِ الرُّوْحُ غَرَضًا. ‘কে এ কাজ করলো? যে ব্যক্তি এরূপ করেছে তার প্রতি আল্লাহর লা‘নত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে লা‘নত করেছেন, যে কোন জীব-জন্তুকে লক্ষ্যস্থল বানায়’।[11]
শাদ্দাদ ইবনু আওস বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে আমি দু’টি কথা মনে রেখেছি, তিনি বলেছেন,إِنَّ اللهَ كَتَبَ الإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ فَلْيُرِحْ ذَبِيْحَتَهُ.
‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ‘ইহসান’ অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সঙ্গে হত্যা করবে, আর যখন যবেহ করবে তখন দয়ার সঙ্গে যবেহ করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার যবেহকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে’।[12]
বিনয় ও নম্রতার গুরুত্ব
বিনয়ী হওয়ার নির্দেশ : আল্লাহ রাববুল আলামীন ধীর-স্থিরতা ও নম্রতা অবলম্বন পূর্বক সংযত হয়ে চলাফেরা করার জন্য মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে,وَاقْصِدْ فِيْ مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ- ‘সংযত হয়ে চলাফেরা করো এবং তোমার কণ্ঠস্বরকে সংযত রাখো। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর’ (লোক্বমান ৩১/১৯)।
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে,وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ- ‘তুমি তোমার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হও’ (শু‘আরা ২৬/২১৫)।
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার ইহুদীদের একটি দল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে আসার জন্য অনুমতি চেয়ে বলল, السَّامُ عَلَيْكَ ‘আপনার মৃত্যু ঘটুক’। তখন আমি উত্তরে বললাম,عَلَيْكُمُ السَّامُ وَاللَّعْنَةُ ‘বরং তোমাদের মৃত্যু ঘটুক এবং অভিশম্পাত বর্ষিত হোক’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘হে আয়েশা! থাম। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা সর্ববিষয়ে কোমলতাকেই পসন্দ করেন। উত্তরে আমি বললাম, তারা যা বলেছে, আপনি কি তা শোনেননি? তিনি বললেন, আমি তো ‘ওয়ালাইকুম’ বলে (তাদের কথা তাদের দিকে ফিরিয়ে) দিয়েছি।[13]
অপর বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রাঃ) বলেন, ইহুদীরা নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলল, ‘আসসামু আলাইকা’ ‘আপনার মৃত্যু হোক’। উত্তরে তিনি বললেন, ওয়ালাইকুম। তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, তোমাদের মৃত্যু হোক, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি অভিশম্পাত বর্ষণ করুন এবং তোমাদের উপর রুষ্ট হোন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আয়েশা! থাম, নম্রতা অবলম্বন করো, কঠোরতা ও অশালীনতা পরিহার করো’।[14]
অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,وَإِنَّ اللهَ أَوْحَى إِلَىَّ أَنْ تَوَاضَعُوْا حَتَّى لاَ يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلاَ يَبْغِىْ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ ‘আল্লাহ তা‘আলা আমার প্রতি অহী করেছেন যে, তোমরা পরস্পর বিনয় প্রদর্শন করবে, যাতে কেউ কারো উপর বাড়াবাড়ি ও গর্ব না করে’।[15]
আল্লাহ কর্তৃক বিনয়ীদের প্রশংসা : মহান আল্লাহ বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষদের প্রশংসায় বলেন,
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْناً وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَقِيَاماً، وَالَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَاماً، إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرّاً وَمُقَاماً-
‘দয়াময় আল্লাহর বান্দা তো তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’। আর যারা রাত্রি অতিবাহিত করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত থেকে ও দন্ডায়মান হয়ে এবং যারা বলে, হে আমার প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত কর, নিশ্চয়ই এর শাস্তি নিশ্চিত বিনাশ। নিশ্চয়ই তা অবস্থান ও আবাসস্থল হিসাবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩-৬৬)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لَا يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ ‘এটা আখিরাতের নিবাস যা আমি নির্ধারণ করি তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
পক্ষান্তরে উদ্ধত অহংকারী দাম্ভিকদের সম্পর্কে আল্লাহ রাববুল আলামীন কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন,وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحاً إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ- ‘অহংকার বশে তুমি মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পসন্দ করেন না’ (লোক্বমান ৩১/১৮)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلاَ تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحاً إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلاً- ‘পৃথিবীতে দম্ভভরে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই তুমি পদভারে ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনও পর্বত সম হ’তে পারবে না’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৭)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক বিনয়ীদের প্রশংসা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, الْمُؤْمِنُ غِرٌّ كَرِيْمٌ وَالْفَاجِرُ خِبٌّ لَئِيْمٌ ‘মুমিন ব্যক্তি নম্র ও ভদ্র হয়। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়’।[16] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ–
‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকের সংবাদ দিব না? আর তারা হ’ল সরলতার দরুণ দুর্বল, যাদেরকে লোকেরা হীন, তুচ্ছ ও দুর্বল মনে করে। তারা কোন বিষয়ে কসম করলে আল্লাহ তা সত্যে পরিণত করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সংবাদ দিব না? আর তারা হ’ল প্রত্যেক অনর্থক কথা নিয়ে ঝগড়াকারী বদমেযাজী ও অহংকারী’।[17]
ঔদ্ধত্যপরায়ণ, অহংকারীদের কঠিন পরিণতি সম্পর্কে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يُحْشَرُ الْمُتَكَبِّرُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْثَالَ الذَّرِّ فِىْ صُوَرِ الرِّجَالِ يَغْشَاهُمُ الذُّلُّ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَيُسَاقُوْنَ إِلَى سِجْنٍ فِىْ جَهَنَّمَ يُسَمَّى بُوْلَسَ تَعْلُوْهُمْ نَارُ الأَنْيَارِ يُسْقَوْنَ مِنْ عُصَارَةِ أَهْلِ النَّارِ طِينَةِ الْخَبَالِ ‘ক্বিয়ামতের দিন অহংকারীদেরকে পিপীলিকার ন্যায় জড়ো করা হবে। অবশ্য আকৃতি-অবয়ব হবে মানুষের। অপমান তাদেরকে চতুর্দিক হ’তে বেষ্টন করে রাখবে। ‘বুলাস’ নামক জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। অগ্নিশিখা তাদের উপর ছেয়ে যাবে। আর তাদেরকে পান করানো হবে জাহান্নামীদের দেহনিঃসৃত ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ নামক কদর্য পুঁজ-রক্ত’।[18]
কোমলতা ও নম্রতা আল্লাহর বিশেষ গুণ : আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। আর তিনি কোমলতার প্রতি যত অনুগ্রহ করেন, কঠোরতা বা অন্য কোন আচরণের প্রতি ততটা অনুগ্রহ করেন না’।[19]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে বলেছেন, ‘কোমলতা নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা হ’তে নিজেকে বাঁচাও। কারণ যাতে নম্রতা ও কোমলতা থাকে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়। আর যাতে কোমলতা থাকে না, তা দোষণীয় হয়ে পড়ে’।[20]
মন্দকে প্রতিহত করতে হয় বিনয় ও নম্রতা দ্বারা : মন্দকে মন্দ দ্বারা, শত্রুকে শত্রুতা দ্বারা প্রতিহত না করে বরং বিনয়-নম্রতা ও উৎকৃষ্ট ব্যবহার দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করে মানুষের হৃদয় জয় করতে হয়। মহান আল্লাহ এমনটাই নির্দেশ দিয়েছেন, وَلاَ تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلاَ السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ ‘ভাল ও মন্দ সমান হ’তে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يَسِّرُوْا وَلاَ تُعَسِّرُوْا، وَسَكِّنُوْا وَلاَ تُنَفِّرُوْا ‘তোমরা নম্র হও, কঠোর হয়ো না। শান্তি দান কর, বিদ্বেষ সৃষ্টি করো না’।[21]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,ادْفَعْ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ السَّيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُوْنَ ‘মন্দের মুকাবিলা কর যা উত্তম তা দ্বারা; তারা যা বলে আমরা সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত’ (মুমিনূন ২৩/৯৬)। অন্যত্র তিনি বলেন,خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِيْنَ ‘ক্ষমাশীলতা অবলম্বন কর, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল’ (আ‘রাফ ৭/১৯৯)।
ইবনু মারদুবিয়া (রহঃ) সা‘দ ইবনু ওবাদা (রাঃ)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, ওহোদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাচা হামযাহ (রাঃ)-কে শহীদ করা হয় এবং অত্যন্ত নৃশংসভাবে তাঁর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে লাশের প্রতি চরম অসম্মানজনক আচরণ করা হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লাশটিকে সে অবস্থায় দেখতে পেয়ে বললেন, যারা হামযাহ (রাঃ)-এর সাথে এহেন আচরণ করেছে, আমি তাদের সত্তর জনের সাথে এমনি আচরণ করে ছাড়ব। এরই প্রেক্ষিতে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং এতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলে দেয়া হয় যে, এটা আপনার জন্য সমীচীন নয়; বরং আপনার মর্যাদার উপযোগী হ’ল ক্ষমা ও অব্যাহতি দান’।[22]
দাঈ-এর অন্যতম গুণ হ’ল কোমলভাষী ও বিনয়ী হওয়া : একজন দাঈ ইলাল্লাহ-এর গুণাবলীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হ’ল কোমলভাষী ও বিনয়ী হওয়া। কোন রুক্ষ বদমেজাযী লোকের দেওয়া দ্বীনের দাওয়াত কেউ কবুল করে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিশ্বের সবচেয়ে কোমলভাষী, বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন এবং ছাহাবীগণও তাঁর সে গুণে গুণান্বিত ছিলেন। বিধায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের বিনয়-নম্রতা, অমায়িক ব্যবহার, সৌহার্দ্যপূর্ণ অমায়িক আচরণ ও কোমলভাষী হওয়ার কারণে।
মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে; যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হ’তে, তবে তারা তোমার আশপাশ হ’তে দূরে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। অতঃপর কোন সংকল্প করলে আল্লাহর উপর ভরসা করবে। ভরসাকারীদের আল্লাহ ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,ادْعُ إِلِى سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيْلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ- ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাক হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়, নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তাই সবিশেষ জ্ঞাত রয়েছেন তার সম্পর্কে, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনি অবহিত আছেন, কারা সঠিকপথে আছে’ (নাহল ১৬/১২৫)।
পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য পাপাচারী ছিল ফেরাউন, যে নিজেকে সবচেয়ে বড় প্রভু বলে দাবী করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-কে সে পাপিষ্ট ফেরাউনের নিকট কোমল ভাষায় ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,اذْهَبَا إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى، فَقُولَا لَهُ قَوْلاً لَّيِّناً لَّعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى- ‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যাও, সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে। অতঃপর তোমরা তার সাথে নম্রভাষায় কথা বল, হয়ত বা সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে’ (ত্বা-হা ২০/৪৩-৪৪)।
বিনয়-নম্রতার ক্ষেত্রসমূহ
১. পবিারের সাথে নম্রতা : আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বহস্তে কোন দিন কাউকে আঘাত করেননি, কোন নারীকেও না, খাদেমকেও না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ব্যতীত। আর যে তাঁর অনিষ্ট করেছে তার থেকে প্রতিশোধও নেননি। তবে আল্লাহর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় এমন বিষয়ে তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছেন’।[23]
২. খাদেমের সাথে নম্রতা : আনাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি নয় বছর রাসূল (ছাঃ)-এর সেবায় নিয়োজিত ছিলাম। কিন্তু আমার জানা নেই যে, কোন কাজ আমি করেছি, অথচ তিনি সে ব্যাপারে বলেছেন, এরূপ কেন করলে? কিংবা কোন কাজ করিনি, সে ব্যাপারে বলেছেন, কেন অমুক কাজটি করলে না’?[24]
৩. শিশুদের সাথে নম্রতা : আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يُؤْتَى بِالصِّبْيَانِ فَيُبَرِّكُ عَلَيْهِمْ وَيُحَنِّكُهُمْ فَأُتِىَ بِصَبِىٍّ فَبَالَ عَلَيْهِ فَدَعَا بِمَاءٍ فَأَتْبَعَهُ بَوْلَهُ وَلَمْ يَغْسِلْهُ. ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে শিশুদেরকে আনা হ’ত। তিনি তাদের জন্যে বরকত ও কল্যাণের দো‘আ করতেন এবং ‘তাহনীক’ (মিষ্টি জাতীয় কিছু চিবিয়ে মুখে দিতেন) করতেন। একদিন একটি শিশুকে আনা হ’ল, তিনি তাকে কোলে তুলে নিলেন। শিশুটি তাঁর কোলে প্রস্রাব করে দিল, পরে তিনি পানি চেয়ে নিলেন এবং প্রস্রাবের উপর পানির ছিটা দিলেন, আর তা ধুলেন না।[25]
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, أن النبي صلى الله عليه و سلم كَانَ يَزُوْرُ الأَنْصَارَ وَيُسَلِّمُ عَلَى صِبْيَانِهِمْ وَيَمْسَحُ رُؤُوْسَهُمْ- ‘নবী করীম (ছাঃ) আনছারদের বাড়ীতে গমন করতেন এবং তাদের বাচ্চাদেরকে সালাম দিতেন। আর তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।[26]
৪. যাচ্ঞাকারীর সাথে নম্রতা : আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, ‘একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে হাঁটছিলাম। তখন তাঁর গায়ে একখানা গাঢ় পাড়যুক্ত নাজরানী চাদর ছিল। এক বেদুঈন তাঁকে পেয়ে চাদর ধরে সজোরে টান দিল। আনাস বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর কাঁধের উপর তাকিয়ে দেখলাম যে, জোরে চাদর খানা টানার কারণে তাঁর কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। তারপর বেদুঈনটি বলল, হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে আল্লাহর দেয়া যে সম্পদ আছে, তা থেকে আমাকে দেয়ার জন্য আদেশ কর। তখন নবী করীম (ছাঃ) তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন এবং তাকে কিছু দান করার জন্য আদেশ করলেন’।[27]
৫. মূর্খদের শিক্ষা দানে নম্রতা : মু‘আবিয়াহ ইবনুল হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক সময় আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করছিলাম। ইতিমধ্যে (ছালাত আদায়কারীদের মধ্যে) কোন একজন লোক হাঁচি দিলে (জবাবে) আমি يَرْحَمُكَ اللهُ ‘আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন’ বললাম। এতে সবাই রুষ্ট দৃষ্টিতে আমার প্রতি তাকাতে থাকল। তা দেখে আমি বললাম, আমার মা আমার বিয়োগ ব্যথায় কাতর হোক। কি ব্যাপার! তোমরা আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ যে? তখন তারা নিজ নিজ উরুতে হাত চাপড়াতে থাকল। আমি যখন দেখলাম যে, তারা আমাকে চুপ করাতে চায় তখন আমি চুপ করে রইলাম। পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত শেষ করলে আমি তাঁকে সবকিছু বললাম। আমার পিতা ও মাতা তাঁর জন্য কুরবান হোক। আমি ইতিপূর্বে বা এরপরে আর কখনো অন্য কোন শিক্ষককে তাঁর চেয়ে উত্তম পন্থায় শিক্ষা দিতে দেখিনি। আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনি আমাকে ধমকালেন না বা মারলেন না কিংবা বকা-ঝকাও করলেন না। বরং বললেন, ছালাতের মধ্যে (মানুষের সাথে) কথাবার্তা ধরনের কিছু বলা সিদ্ধ নয়। বরং তাহ’ল তাসবীহ, তাকবীর বা কুরআন তেলাওয়াত অথবা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেরূপ বলেছেন।[28]
৬. সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধে নম্রতা : আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, أَنَّ أَعْرَابِيًّا بَالَ فِى الْمَسْجِدِ، فَقَامُوْا إِلَيْهِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لا تُزْرِمُوهُ ثُمَّ دَعَا بِدَلْوٍ مِنْ مَاءٍ فَصُبَّ عَلَيْهِ. ‘একবার এক বেদুঈন মসজিদে প্রস্রাব করে দিল। লোকেরা উঠে তার দিকে গেল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তার প্রস্রাব করায় বাধা দিও না। অতঃপর তিনি এক বালতি পানি আনালেন এবং তাতে ঢেলে দিলেন’।[29]
৭. ইবাদতে বিনয়-নম্রতা : ইবাদত-বন্দেগীতে বিনয়-নম্রতা একনিষ্ঠতা ইবাদত কবুলের আবশ্যিক পূর্বশর্ত। মহান আল্লাহ বলেন,حَافِظُواْ عَلَى الصَّلَوَاتِ والصَّلاَةِ الْوُسْطَى وَقُوْمُوْا لِلّهِ قَانِتِيْنَ ‘আর তোমরা আল্লাহর জন্য বিনম্রচিত্তে দাঁড়িয়ে যাও’ (বাক্বারাহ ২/২৩৮)।
অন্যত্র তিনি বলেন,قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ، الَّذِيْنَ هُمْ فِيْ صَلَاتِهِمْ خَاشِعُوْنَ- ‘সফলকাম হয়েছে সে সমস্ত মুমিনগণ, যারা নিজেদের ছালাতে বিনম্র’ (মুমিনূন ২৩/১-২)।
ইবাদতে কিভাবে বিনয়-নম্রতা, একনিষ্ঠতা আসবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার উপায় বর্ণনা করে দিয়েছেন এভাবে, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর তুমি যদি তাঁকে নাও দেখ, তিনি তোমাকে অবশ্যই দেখছেন’।[30]
একথা ধ্রুব সত্য যে, ইবাদতের অবস্থায় যদি ইবাদতকারী আল্লাহকে দেখতে পেত তাহ’লে তার বিনয় ও নম্রতার কিছুই পরিত্যাগ করত না। আর এ অবস্থার সৃষ্টি এজন্যই হ’ত যে তিনি তার সকল অবস্থা তত্ত্বাবধান করছেন ও সবকিছু দেখছেন। আর এ অবস্থা তখনও বিদ্যমান থাকত যখন বান্দা তাঁকে দেখতে না পায়। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তুমি তাঁকে দেখতে না পেলেও তিনি তোমাকে দেখছেন। আর এটাই তোমার বিনয়ী-নম্র হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
৮. তওবাকারী পাপীর সাথে নম্রতা : আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, ‘একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খিদমতে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো ধ্বংস হয়ে গেছি। তিনি বললেন, ‘ওয়াইহাকা’ (আফসোস তোমার জন্য)। এরপর সে বলল, আমি রামাযানের মধ্যেই দিনের বেলায় আমার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে ফেলেছি। তিনি বললেন, একটা গোলাম আযাদ করে দাও। সে বলল, আমার কাছে তা নেই। তিনি বললেন, তাহ’লে তুমি এক নাগাড়ে দু’মাস ছিয়াম পালন কর। সে বলল, আমি এতেও অপারগ। তিনি বললেন, তবে তুমি ষাটজন মিসকীনকে খাদ্য খাওয়াও। লোকটি বলল, আমি এটাও পারি না। নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এক ঝুড়ি খেজুর এলো। তখন তিনি বললেন, এটা নিয়ে যাও এবং ছাদাকাহ করে দাও। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তা কি আমার পরিবার ছাড়া অন্যকে দিব? সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! মদীনার উভয় প্রান্তের মধ্যস্থলে আমার চেয়ে অভাবী আর কেউ নেই। তখন নবী করীম (ছাঃ) এমনভাবে হাসলেন যে, তাঁর পার্শ্বের দাঁত পর্যন্ত প্রকাশ পেল। তিনি বললেন, তবে তুমিই এটা নিয়ে যাও’।[31]
৯. কষ্ট প্রদানকারীর উপর ধৈর্য ধারণ ও নম্রতা : আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, একবার তিনি নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ওহোদের দিনের চেয়ে কঠিন কোন দিন কি আপনার উপর এসেছিল? তিনি বললেন, আমি তোমার ক্বওম হ’তে যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, তা তো হয়েছি। তাদের হ’তে অধিক কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, আকাবার দিন যখন আমি নিজেকে ইবনু আবদে ইয়ালীল ইবনে আবদে কুলালের নিকট পেশ করেছিলাম। আমি যা চেয়েছিলাম, সে তার জবাব দেয়নি। তখন আমি এমনভাবে বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে ফিরে এলাম যে, কারনুস ছা‘আলিবে পৌঁছা পর্যন্ত আমার চিন্তা দূর হয়নি। তখন আমি মাথা উপরে উঠালাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম এক টুকরো মেঘ আমাকে ছায়া দিচ্ছে। আমি সে দিকে তাকালাম। তার মধ্যে ছিলেন জিবরাঈল (আঃ)। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, আপনার ক্বওম আপনাকে যা বলেছে এবং তারা উত্তরে যা বলেছে তা সবই আল্লাহ শুনেছেন। তিনি আপনার নিকট পাহাড়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। এদের সম্পর্কে আপনার যা ইচ্ছে আপনি তাঁকে হুকুম দিতে পারেন। তখন পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে ডাকলেন এবং আমাকে সালাম দিলেন। অতঃপর বললেন, হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! এসব ব্যাপার আপনার ইচ্ছাধীন। আপনি যদি চান, তাহ’লে আমি তাদের উপর আখশাবাইনকে চাপিয়ে দিব। উত্তরে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا. ‘বরং আমি আশা করি মহান আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন সন্তান জন্ম দেবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না’।[32]
১০. কাফিরদের সাথে আচরণে নম্রতা : আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন একদল ইহুদী রাসূলের নিকটে প্রবেশের অনুমতি চাইল। তখন তারা বলল, السَّامُ عَلَيْكَ ‘তোমার মৃত্যু হোক’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, وَعَلَيْكُمْ ‘তোমাদের উপরও’। (আয়েশা বলেন,) আমি বললাম,السَّامُ عَلَيْكُمْ، وَلَعَنَكُمُ اللهُ وَغَضِبَ عَلَيْكُمْ. ‘তোমাদের উপর মৃত্যু, আল্লাহর লা‘নত ও গযব আপতিত হোক’। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,مَهْلاً يَا عَائِشَةُ، عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ، وَإِيَّاكِ وَالْعُنْفَ أَوِ الْفُحْشَ ‘হে আয়েশা! থাম। তোমার জন্য আবশ্যক হ’ল নম্রতা অবলম্বন করা। আর তুমি কঠোরতা অথবা অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাক। তিনি বললেন, আপনি কি শোনেননি তারা কি বলেছে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি কি শোননি আমি কি বলেছি? আমি তাদের বিরুদ্ধে যে জবাব দিয়েছি তাদের সম্পর্কে আমার দো‘আ কবুল করা হবে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তাদের দো‘আ কবুল করা হবে না’।[33]
১১. মানুষের সাথে ইবাদতে নম্রতা : জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ছাহাবী দু’টি উটের পিঠে পানি নিয়ে আসছিলেন। রাতের অন্ধকার তখন ঘনীভূত হয়ে এসেছিল। এ সময় তিনি মু‘আয (রাঃ)-কে ছালাত আদায়রত পান। তিনি তার উট দু’টি বসিয়ে দিয়ে মু‘আয (রাঃ)-এর দিকে (ছালাত আদায় করতে) এগিয়ে এলেন। মু‘আয (রাঃ) সূরা বাক্বারাহ বা সূরা নিসা পড়তে শুরু করেন। এতে ছাহাবী (জামা‘আত ছেড়ে) চলে যান। পরে তিনি জানতে পারেন যে, মু‘আয (রাঃ) এজন্য তার সমালোচনা করেছেন। তিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে মু‘আয (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘হে মু‘আয! তুমি কি লোকদের ফিৎনায় ফেলতে চাও? বা তিনি বলেছিলেন, তুমি কি ফিৎনা সৃষ্টিকারী? তিনি একথা তিনবার বললেন। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا এবং وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى (সূরা) দ্বারা ছালাত আদায় করলে না কেন? কারণ তোমার পিছনে দুর্বল, বৃদ্ধ ও হাজতওয়ালা লোক ছালাত আদায় করে থাকে’।[34]
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি দীর্ঘ করার ইচ্ছা নিয়ে ছালাত শুরু করি। কিন্তু পরে শিশুর কান্না শুনে আমার ছালাত সংক্ষেপ করে ফেলি। কেননা শিশু কাঁদলে মায়ের মন যে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে তা আমি জানি’।[35]
১২. নফল ইবাদতে আত্মিক নম্রতা : আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَصُوْمُ حَتَّى نَقُوْلَ لاَ يُفْطِرُ، وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُوْلَ لاَ يَصُوْمُ. فَمَا رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلاَّ رَمَضَانَ، وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِىْ شَعْبَانَ.
‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একাধারে ছিয়াম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর ছিয়াম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশি) ছিয়াম পালন না করা অবস্থায় একাধারে কাটাতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) ছিয়াম পালন করবেন না। আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে রামাযান ব্যতীত কোন পুরা মাসের ছিয়াম পালন করতে দেখিনি এবং শা‘বান মাসের চেয়ে কোন মাসে অধিক (নফল) ছিয়াম পালন করতে দেখিনি।[36]
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, বনু আসাদের এক মহিলা আমার নিকট উপস্থিত ছিলেন, তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমার নিকট আসলেন এবং তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ মহিলাটি কে? আমি বললাম, অমুক। তিনি রাতে ঘুমান না। তখন তার ছালাতের কথা উল্লেখ করা হ’লে তিনি (নবী ছাঃ) বললেন, مَهْ عَلَيْكُمْ مَا تُطِيقُونَ مِنَ الأَعْمَالِ، فَإِنَّ اللهَ لاَ يَمَلُّ حَتَّى تَمَلُّوا. ‘রাখ রাখ। সাধ্যানুযায়ী আমল করতে থাকাই তোমাদের কর্তব্য। কেননা আল্লাহ তা‘আলা (ছওয়াব দানে) ক্লান্ত হন না, যতক্ষণ না তোমরা ক্লান্ত হয়ে পড়’।[37]
বিনয়-নম্রতার ফযীলত ও উপকারিতা : আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ. ‘হে আয়েশা! আল্লাহ তা‘আলা নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পসন্দ করেন। তিনি নম্রতার দরুন এমন কিছু দান করেন যা কঠোরতার দরুন দান করেন না; আর অন্য কোন কিছুর দরুনও তা দান করেন না’।[38] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ ‘যে বান্দাহ আল্লাহর জন্য বিনীত হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন’।[39]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,اللَّهُمَّ مَنْ وَلِىَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِى شَيْئًا فَشَقَّ عَلَيْهِمْ فَاشْقُقْ عَلَيْهِ وَمَنْ وَلِىَ مِنْ أَمْرِ أُمَّتِى شَيْئًا فَرَفَقَ بِهِمْ فَارْفُقْ بِهِ. ‘হে আল্লাহ! যে আমার উম্মাতের কোনরূপ কর্তৃত্বভার লাভ করে এবং তাদের প্রতি রূঢ় আচরণ করে তুমি তার প্রতি রূঢ় হও, আর যে আমার উম্মাতের উপর কোনরূপ কর্তৃত্ব লাভ করে তাদের প্রতি নম্র আচরণ করে তুমি তার প্রতি নম্র ও সদয় হও’।[40]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ تَرَكَ اللِّبَاسِ تَوَاضُعًا لِلَّهِ وَهُوَ يَقْدِرُ عَلَيْهِ دَعَاهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى رُءُوسِ الْخَلاَئِقِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ مِنْ أَىِّ حُلَلِ الإِيْمَانِ شَاءَ يَلْبَسُهَا. ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিনয়বশত মূল্যবান পোশাক পরিধান ত্যাগ করবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সকল সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং ঈমানের পোশাকের মধ্যে যে কোন পোশাক পরার অধিকার দিবেন’।[41]
বিনয় ও নম্রতার উপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ حُرِمَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ. ‘যাকে নম্রতার কিছু অংশ প্রদান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণের অংশ প্রদান করা হয়েছে। আর যাকে সেই নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত করা হয়েছে’।[42] মহান আল্লাহ বিনয়ীদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন। তিনি আরো বলেন, أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَنْ يَحْرُمُ عَلَى النَّارِ أَوْ بِمَنْ تَحْرُمُ عَلَيْهِ النَّارُ عَلَى كُلِّ قَرِيْبٍ هَيِّنٍ لَيِّنٍ سَهْلٍ ‘আমি কি তোমাদেরকে জানাব না যে, কারা জাহান্নামের জন্য হারাম বা কার জন্য জাহান্নাম হারাম করা হয়েছে? জাহান্নাম হারাম আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী প্রত্যেক বিনয়ী ও নম্র লোকের জন্য’।[43]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, إن الله إذا أحب أهل بيت أدخل عليهم الرفق ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোন গৃহবাসীকে ভালবাসেন, তখন তাদের মাঝে নম্রতা প্রবেশ করান’।[44] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ما أعطي أهل بيت الرفق إلا نفعهم ولا منعوه إلا ضرهم ‘আল্লাহ কোন গৃহবাসীকে নম্রতা দান করে তাদেরকে উপকৃতই করেন। আর কারো নিকট থেকে তা উঠিয়ে নিলে তারা ক্ষতিগ্রস্থই হয়’।[45]
তিনি আরো বলেন, إن الله عز وجل ليعطي على الرفق ما لا يعطي على الخرق، وإذا أحب الله عبدا أعطاه الرفق، ما من أهل بيت يحرمون الرفق إلا حرموا الخير ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নম্রতার মাধ্যমে যা দান করেন, কঠোরতার কারণে তা করেন না। আল্লাহ কোন বান্দাকে ভালবাসলে তাকে নম্রতা দান করেন। কোন গৃহবাসী নম্রতা পরিহার করলে, তারা কেবল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়’।[46]
বিনয় ও নম্রতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত : প্রত্যেক উদ্ধত, অহংকারী মানুষ নিজকে সব সময়ে অন্যের চেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং লোকজন তাকে সর্বদা বেশী সম্মান ও প্রশংসা করুক এটাই তার প্রত্যাশা থাকে। আর একজন বিনয়ী ও নম্র মানুষ সর্বদা নিজেকে অন্যের চেয়ে ছোট মনে করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী রাসূল হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজকে ছোট মনে করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-কে মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ. ‘তোমরা আমার প্রশংসায় সীমালংঘন করো না, যেরকম খ্রীষ্টানরা ইবনু মারিয়ামের প্রশংসায় সীমালংঘন করেছে। মূলতঃ আমি হ’লাম আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বল’।[47]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেছেন,أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ فَخْرَ وَبِيَدِى لِوَاءُ الْحَمْدِ وَلاَ فَخْرَ وَمَا مِنْ نَبِىٍّ يَوْمَئِذٍ آدَمُ فَمَنْ سِوَاهُ إِلاَّ تَحْتَ لِوَائِى وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ تَنْشَقُّ عَنْهُ الأَرْضُ وَلاَ فَخْرَ ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি বনু আদমের নেতা হবো, এতে আমার কোন গর্ব নেই, আমার হাতে প্রশংসার ঝান্ডা থাকবে, এতেও আমার কোন গর্ব নেই। সে দিন আদম (আঃ) সহ সকল নবী-রাসূল আমার ঝান্ডার নীচে সমবেত হবেন এবং আমিই সর্বপ্রথম যমীন থেকে উত্থিত হব, এতেও কোন গর্ব নেই’।[48]
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,
أَنَّ أَعْرَابِيًّا بَالَ فِى الْمَسْجِدِ، فَثَارَ إِلَيْهِ النَّاسُ لِيَقَعُوا بِهِ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم دَعُوهُ، وَأَهْرِيقُوا عَلَى بَوْلِهِ ذَنُوبًا مِنْ مَاءٍ أَوْ سَجْلاً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّمَا بُعِثْتُمْ مُيَسِّرِينَ، وَلَمْ تُبْعَثُوا مُعَسِّرِينَ.
‘একবার এক আরব বেদুঈন মসজিদে প্রস্রাব করে দিল। তখন লোকজন তাকে শাসন করার জন্য উত্তেজিত হয়ে পড়ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, তাকে প্রস্রাব করতে দাও এবং তার প্রস্রাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কারণ তোমাদেরকে নম্র ব্যবহারকারী হিসাবে পাঠানো হয়েছে, কঠোর ব্যবহারকারী হিসাবে নয়’।[49]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অভূতপূর্ব বিনয়-নম্রতায় বেদুঈন এতটাই বিমুগ্ধ হ’ল যে, সে সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম কবুল করল এবং ছালাতে দাঁড়িয়ে দো‘আ করতে লাগল যে,اللَّهُمَّ ارْحَمْنِىْ وَمُحَمَّدًا، وَلاَ تَرْحَمْ مَعَنَا أَحَدًا ‘হে আল্লাহ! আমার ও মুহাম্মাদের প্রতি দয়া করো এবং আমাদের সঙ্গে আর কারো প্রতি দয়া করো না’। সালাম ফিরানোর পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, لَقَدْ حَجَّرْتَ وَاسِعًا ‘তুমি একটি প্রশস্ত বিষয় সংকুচিত করলে অর্থাৎ আল্লাহর অসীম অনুগ্রহকে সংকুচিত করে ফেললে’।[50] উল্লিখিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুপম বিনয় ও নম্রতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বিশ্ব ইতিহাসে বিনয়-নম্রতার এমন দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না।
পরিশেষে বলা যায় যে, বিনয় ও নম্রতা মহান আল্লাহ প্রদত্ত অসংখ্য নে‘মতের মধ্যে অন্যতম। মানবীয় যতগুলো মহৎগুণ রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম মহৎগুণ। এ গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি ইহকালে সর্বসাধারণের মধ্যে হয় সম্মানিত, গ্রহণযোগ্য, স্মরণীয় ও বরণীয়। আর পরকালে হয় জাহান্নামের লেলিহান অগ্নিশিখা হ’তে মুক্ত। তাই দরবারে এলাহীতে প্রার্থনা জানাই, হে আল্লাহ! আমাদেরকে বিনয় ও নম্রতার গুণে গুণান্বিত করে ইহকালে কল্যাণ ও পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তিদান করুন-আমীন!
– কামরুযযামান বিন আব্দুল বারী
* প্রধান মুহাদ্দিছ, বেলটিয়া কামিল মাদরাসা, জামালপুর।
[1]. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৫শ মুদ্রণ: ১৪১৮ বাং/২০১২ খ্রীঃ), পৃঃ ৮৭৫।
[3]. হাফিয ইবনুল ক্বাইয়িম জাওযিইয়া, মাদারিজুস সালেকীন (বৈরূত: দারুল কিতাবিল আরাবী, ২য় সংস্করণ, ১৪১৬ হিঃ/১৯৯৬ খ্রীঃ), ২/৩১৪ পৃঃ।