শিক্ষামূলক গল্প

তাবিজ নামের অলংকারটি…

ফজরের আজানের “আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম” শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আবদুল ওয়াহাবের। ঘুম থেকে উঠেই স্ত্রীকে সালাতের জন্য উঠতে বলে বিছানা ত্যাগ করল সে। জামাটা গায়ে চড়িয়েই চলে গেল ফজরের সালাতে। ঘর থেকে বেরিয়ে বেড়ার দরজাটা আবার লাগিয়ে দিল। গতকাল ইমাম সাহেব বলেছিলেন, ফজর আর এশার সালাত জামাতের সাথে পড়লে সারা রাত ইবাদাত করার সওয়াব পাওয়া যায়। তাই এই বিশাল নেকি হাত ছাড়া করতে চায় না সে।

আবদুল ওয়াহাব পেশায় একজন রিকশাচালক। কিন্তু, তাতে কি, তার মত বড় মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার বাকি সাথীদের দিকে তাকিয়ে অবাক হয় সে। মানুষগুলোর অভিযোগের শেষ নেই। আজ এই সমস্যা তো কাল ওই সমস্যা। সমস্যার কথা তাদের মুখে লেগেই থাকে। কিন্তু সেদিক থেকে সে নিজেকে হাজার গুণ সুখী মনে করে। তার কথা হল, দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষের জীবনেও সমস্যা আসে। সমস্যা আসবেই। কিন্তু তা নিয়ে এত ব্যস্ত হবার কি আছে? আল্লাহ যে অবস্থায় তাকে রেখেছেন, তার চেয়ে খারাপ অবস্থায়ও তো মানুষ আছে। তার কথা হল, সুখ হল মনের ব্যাপার। সব মানুষেরই কম-বেশি সমস্যা থাকে। কিন্তু যে তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে ও আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে, সেই আসলে প্রকৃত সুখ অনুভব করতে পারে।

ফজরের পর মসজিদে বসেই কুরআন তিলাওয়াত করে আবদুল ওয়াহাব। সূর্য উঠলে বাড়ী ফিরে আসে আবার। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। বাড়ী ফিরেই বউকে খাবার দিতে বলল। খাওয়া শেষে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সারাদিন অনেক বিচিত্র রকমের মানুষ তার রিকশায় উঠে।

এক প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দিতে দাড়িয়েছে এক বাসার সামনে। সেখানেই রিকশার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল এক যুবক। ভাড়া আদায় পর্ব চুকাতেই, যুবকটি বলল, মামা যাবেন?

-উঠেন।

যুবকটি রিকশায় চড়ে বসল। আবদুল ওয়াহাব রিকশা সামনে বাড়াল। যুবকটির দাড়ি দেখে আবদুল ওয়াহাবের খুব ভালো লাগল। আবদুল ওয়াহাবের নিজেরও দাড়ি আছে। তাই দাড়িওয়ালা লোক দেখলেই বুকের মধ্যে কেমন যেন এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে তার। কিছু দূর যেতেই যুবকটি প্রশ্ন করল, মামা, নাম কি আপনার?

-আবদুল ওয়াহাব।

-বাসা কোথায়?

-এই তো, পাশের বস্তিতেই থাকি।

-অ! গাড়ি কি নিজের না ভাড়া?

-নিজের গাড়ি, মামা।

-আলহামদুলিল্লাহ্‌, তাহলে তো ভালোই।

-জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ্‌ আল্লাহ অনেক ভালা রাখছে।

-তা, মামা, সালাত পড়েন তো?

-হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ্‌ সবগুলাই পড়ি।

-আচ্ছা মামা, একটা প্রশ্ন করি?

-করেন…

-আপনার ডান হাতে ওটা কি? তাবিজ নাকি?

-জ্বি মামা। ৭-৮ বছর আগে একবার জ্বিনে ধরছিল। হের পর থেইক্যা এক হুজুর এটা পরতে কইছে।

-তাই?

-হ। অনেক বড় হুজুর। আমাগো দেশে উনার অনেক নাম। সবাই অনেক সম্মান করে। অনেক দূর থাইকা লোকজন আসে উনার কাছে।

-আপনি ৭-৮ বছর ধরে এটা পরেন?

-হ। বুঝছেন মামা, হুজুর বিশাল আল্লাহর অলি। সবসময় সুন্নতের উপর থাকে।

যুবকটি বিশাল একটা নিশ্বাস ছাড়ল। যেন হতাশা আর ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। নিরবতা ভেঙ্গে আবার কথা শুরু করল…

-আচ্ছা, মামা, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?

-বলেন মামা।

-মামা, আল্লাহর নবী ﷺ কি তাবিজ ব্যবহার করতেন?

আবদুল ওয়াহাব পেছনে ফিরে একবার যুবকের দিকে তাকালো। চোখমুখ ভরা বিস্ময় তার। তারপর সামনের দিকে ফিরে বলতে শুরু করল,

-আমি কি আর আলেম, মামা? হুজুররা যেহেতু দেয়, তাহলে মনে হয় পরত।

-হুম! মামা, আল্লাহর রসুল যাই করতেন, হুজুররা কি তাই করে?

-তাই তো হবার কথা, মামা।

-আচ্ছা, মামা, কোন সাহাবীরা কি তাবিজ ঝুলাতো?

-(কিছুটা বিরক্ত মনে হল আবদুল ওয়াহাবকে) এত কথা আমারে না জিগাইয়া হুজুরগো জিগান। আমি কি আলেম নাকি?

-মামা, রাগ করলেন নাকি?

-না মামা, রাগ করার কি আছে? আমি তো আর আলেম না, মামা। আমারে এগুলা জিগাইয়া কি হইব?

-মামা, আপনি কি জানেন, আল্লাহর নবী ﷺ এর আচরণ তাবিজের ব্যাপারে কেমন ছিল?

-বলেন মামা, আমি কিছুই জানি না।

-আল্লাহর নবী এগুলোকে শিরক বলেছেন।

-এইডা কি কইলেন মামা? সত্যি?!

-রসুলুল্লাহ সঃ বলেন, ﻣَﻦْ ﺗَﻌَﻠَّﻖَ ﺗَﻤِﻴﻤَﺔً ﻓَﻘَﺪْ ﺃَﺷْﺮَﻙَ -“যে ব্যক্তি তাবীজ লটকালো সে শির্ক করল”।

-কই পাইলেন এটা?

-হাদীসে আছে। মুসনাদে আহমাদ ৪/১৫৬!

-কন কি মামা???

-আরও শুনবেন?

-বলেন।

– ﻖﻠﻋ ﻦﻣ ﺎﺌﻴﺷ ﻞﻛﻭ ﻪﻴﻟﺇ -যে ব্যক্তি কোন জিনিষ লটকাবে, তাকে ঐ জিনিষের দিকেই সোপর্দ করে দেয়া হবে।— আর এটা আছে সহীহুত্ তিরমিযী হাদিস নং- ২০৭২তে

-তাহলে, এত বড় বড় হুজুররা যে দেয়? তারা কি এসব জানেনা?

-মামা, আল্লাহই ভালো জানেন, তারা কি এই কথাগুলো জেনে এমন কাজ করছে নাকি না জেনেই করছে।

-কিন্তু, আপনি শার্ট-পেন্ট পরা যুবক বয়সী পোলাপান, আর কই বড় হুজুর। আমি আপনের কথা কেন মানুম?

-আমি তো মামা, আমার কথা বলছি না। আমি রসুল ﷺ এর কথা আপনাকে দেখিয়ে বলছি।

-হুম! তাও ঠিক বলছেন মামা। কিন্তু আমরা আমরাই যদি এমনে এমনে করে ইসলাম বুঝতে শুরু করি, তা হইলে তো ঝামেলা বাইধা যাইব। সবাই দুই কলম পইড়া নিজেরটা নিয়ে লাফালাফি শুরু করব। তখন তো আরও বিপদ।

-এটা মামা খুব দামি কথা বলছেন। আমরা সবাই আলেম হতে পারব না। কিন্তু সবার একটা নির্দিষ্ট পরিমান জ্ঞান থাকা আবশ্যক। অন্তত শিরক-তাওহীদ তো বুঝতে হবেই।

-তা ঠিক আছে। কিন্তু, তাই বলে এত বড় বড় হুজুর কিনা এই হাদিসই জানবে না, তা কেমনে হয়। তার কাছে যে প্রতিদিন এত মানুষ আসে, তাহলে কি তারাও জানে না?

-হয়ত জানে না।

-কিন্তু মামা, এমনও কি হওয়া সম্ভব? একত্রে এতগুলান মানুষ শিরক কইরা যাইব আর কেউ একবার খুইজাও দেখব না কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল?

-মামা, আপনি দেখেছিলেন?

-না।

-হয়ত আপনার মত বাকিরাও।

-কিন্তু তাই বলে এতজন?

-সুরা ইউসুফে ১০৬ নং আয়াতে আল্লাহ যা বলেছেন শুনলে তো গায়ের লোম দাঁড়ায় যাবে মামা।

-কি বলছেন আল্লাহ?

-আল্লাহ বলেছেন, “তাদের অধিকাংশই আল্লাহকে বিশ্বাস করে; কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে”। (সূরা ইউসুফঃ ১০৬)

-হায় হায়, কন কি মামা।

-সত্যিই বলছি মামা।

-তাহলে এহন কি করমু?

-এটা ফেলে দিতে হবে মামা।

-না ফালাইলে হয়না মামা?

-একবার চিন্তা করুন তো মামা, যদি আল্লাহ এই অবস্থাতেই আপনাকে মৃত্যু দান করেন, এবং আপনি এই তাবিজ পরা অবস্থায় আছেন। আপনি শিরকের উপর মারা যাবেন কিনা?

কথাটা শোনার সাথে সাথেই আবদুল ওয়াহাবের মুখের রঙই পরিবর্তন হয়ে গেল।

-ঠিকই তো কইছেন মামা, এমন কইরা তো চিন্তা করি নাই। হের পরও কিছু “কিন্তু” আছে মামা।

-বলেন শুনি, কি কিন্তু।

-আপনার জানা কোন আলেম কি এই তাবিজকে শিরক বলছেন? আমার সাথে কি তার কথা বলাইয়া দিতে পারবেন? আমি তাহলে কোন আলেমের কাছ থেকে শুনলাম এবার তার কাছ থেকে দলিলও নিয়ে জানলাম?

-হ্যাঁ, সম্ভব। আমি এখন যেখানে যাচ্ছি তা একটা ইসলামিক বইয়ের দোকান। দোকানটার মালিক একজন আলেম। আমরা তার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারি।

-ঠিক আছে তা হইলে।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল গন্তব্যে। যুবকটি এসেছিল কিছু ইসলামিক বই কেনার জন্য। সে এখানে প্রায়ই আসে। সেই সুবাদে আলেমের সাথে তার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তার সাথে দেখা যেন হয়, সেই জন্যই সে সেই সময়গুলোতে আসে যখন তিনি দোকানে থাকবেন।

দোকানে প্রবেশ করার সাথে সাথেই যুবকটিকে দেখে মুচকি হেসে প্রথমেই সালাম দিলেন আলেম। আবদুল ওয়াহাব ও রিকশায় তালা লাগিয়ে ভেতরে এসে গেল। যুবকটি আলেমকে সব খুলে বলতেই আলেম একের পর এক দলিলসহ বুঝিয়ে দিলেন আবদুল ওয়াহাবকে কেন তাবিজ নিষিদ্ধ। আবদুল ওয়াহাব আলেমের কোথায় সন্তুষ্ট হল ও তাবিজটি খুলে ফেলতে সিদ্ধান্ত নিল। তাবিজটি খুলে ফেলে আবদুল ওয়াহাব আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করল। হাত তুলে আল্লাহর কাছে নিজের জন্য, যুবক ও আলেমের জন্য দুয়া করল। তাকে শিরক থেকে ফেরানোর জন্য তাদের  শুকরিয়া জানালো। এরপর আবার রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাজপথে।

আবদুল ওয়াহাবের অন্তর জুড়ে একটা কথাই বার বার তাকে নাড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে, সুরা ইউসুফের সেই আয়াত, “তাদের অধিকাংশই আল্লাহকে বিশ্বাস করে; কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে।” কিন্তু শিরক করলে কি পেছনের সওয়াব বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা না? তাহলে শিরক করছে এমন ব্যক্তির কি আদৌ কোন নেকী বাকি থাকছে? শিরক আর তাওহীদ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারনেই বুঝি অধিকাংশ মানুষের শ্রম পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়ে যাচ্ছে?

রিকশার চাকা ঘুরতে থাকে। কৃতজ্ঞতায় আব্দুল ওয়াহাবের চোখের কোণে জমা পানি দেখে না কেউ।

ahobaan.com

৪টি মন্তব্য

  1. আমি কোন আলেম না। গল্পটার বিষয়ে দু’টি কথা। প্রথমত ওয়াহাব সাহেব এক পক্ষের কথা শুনলো। সে যাকে অনেক বড় হুজুর বলছিলো যিনি ওয়াহাব কে তাবিজ দিলো তার কাছে গিয়ে জানা দরকার ছিলো এসকল হাদিস তিনি জানেন কি না। তাবিজ কখন শিরক হয় তার ও অনেক ব্যাখ্যা আছে। এক কথায় বলে ফেললেন তাবিজ ব্যবহার শিরক ও কুফুর সেটাও ঠিক না। তবে অধিকাংশে শিরক ও কুফুর এটা ঠিক। কাউকে উদ্দেশ্য বা কষ্ট দেওয়া আমার ইচ্ছ না। শুধুমাত্র আমার বিশ্বাস ও জ্ঞানটুকু শেয়ার করলাম।

    1. ডাক্তার না হয়ে যেমন কেউ প্রেসক্রিপশন দিতে পারে না, তেমনি আলেম না হয়ে অর্থাৎ পরিপূর্ণ জ্ঞান ছাড়া কেউ ইসলামের কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তাই প্রথমত শির্ক নিয়ে আপনাকে পড়াশোনা করতে হবে। তারপর আপনি বলতে পারবেন কোনটা শির্ক আর কোনটা শির্ক না। যেহেতু শির্ক একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই এ বিষয়ে আপনাকে পরিষ্কার জ্ঞান রাখতে হবে। সহজ ভাষায় লেখা বইটি পড়ে ফেলুন: বই: শির্কের বেড়াজাল, উম্মত বেসামাল

  2. সহিহ বুখারির কোনো হাদিস দেখাতে পারবেন???? ভারতীয় উপমহাদেশ এ ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী শিক্ষার দিশারী Jamia Islamia Saharanppur, UP, India এবং পশ্চিম বংগের ফুরফুরা শরিফ আজও তাবিজ ব্যবহার করতে তাবিজ লিখে দেন। আমার প্রশ্ন এনারা কি হাদিশ জানেন না????? Fortunately, আমার আব্বাজানও একজন বিখ্যাত আলেম এবং মুহাদ্দিস। আব্বার কাছেও প্রতিদিনই প্রচুর মানুষ আসেন তাবিজের জন্য। আমি আব্বাকে সরাসরি এই বিষয়এ জিজ্ঞেস করেছিলাম। আব্বা আমাকে কোরআন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে শরিয়তে তাবিজ জায়েজ। এবং এটাও ঠিক কথা যে হাদিশের উপর কুরানের মত প্রাধান্য পাবে। তাহলে কি ফুরফুরা শরিফ / দেওবন্দ ঠিক নাকি আপনারা?????????? উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম[email protected]

    1. আসসালামু আলাইকুম ডা : মর্তুজা সাহেব। নিচের লিংক্টি পড়লে আশাকরি আপনার প্রশ্নের উত্তর পাবেন। যাযাকাল্লাহু খায়রান।
      http://preachingauthenticislaminbangla.blogspot.com/2014/08/blog-post_54.html?m=1

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button