আইলাইনার
১.
সামিরা শখের আইলাইনারটা হাতে নিয়ে আয়নার দিকে তাকালো। চোখ আঁকতে যাবে, এমন সময় ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ভীষণ একটা অপরাধবোধ ভিতর থেকে জেঁকে ধরলো। আপন মনে ভাবতে শুরু করলো, “সামিরা! তুমি এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছ যেটা আল্লাহ সুবহানাতা’আলা পছন্দ করবেন না! হিজাব পরে মুখটা এতো সুন্দর করে সাজিয়ে বের হলে কি আর তোমার ইবাদাতটুকু আন্তরিক থাকলো?” চাপা থাকা দীর্ঘশ্বাসটা বের করে দিলো সামিরা।
খুব বেশি দিন হয়নি সে হিজাব পড়া শুরু করেছে, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর পথে ফিরে আসার আগে সে খুব ফ্যাশন্যাবল ছিল! ভারী মেকআপ আর টাইট কাপড় ছাড়া বাসা থেকে বের হতো না। এক বছর আগে হঠাৎ করে এক্সিডেন্টে ওর বড় বোনটা মারা গেলো। এর পর থেকে সামিরা পরিবর্তন হয়ে গেলো। মৃত্যুর সময় আপুর পরনে ছিল টাইট জিন্স। সেটা লাশের গায়ের সাথে এমন বাজেভাবে আটকে গিয়েছিলো যে শেষ পর্যন্ত জিন্স কেটে গোসল দিতে হয়েছে।
যেই আপু বেঁচে থাকতে জীবনে কোনোদিন হিজাব করেনি, তার লাশকে কাফনের কাপড় দিয়ে জড়িয়ে হিজাব পড়িয়েই কবরে নামানো হয়েছে। আপুকে শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে হিজাব পড়তে হয়েছিল! লাশ হয়ে! বোনের এ মৃত্যু খুব দাগ কাটে সামিরার মনে। আপুর জায়গায় যদি সে মরে যেত? এই কালো কুচকুচে ঈমানহীন অন্তর নিয়ে কিভাবে সে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতো?
আস্তে আস্তে নিজের দ্বীন পালনের ব্যাপারে সচেতন হতে শুরু করলো। যতই আল্লাহকে ভালোবাসতে শিখলো, ততই তার কথা-বার্তা, চালচলনে পরিবর্তন আসতে লাগলো! নিয়মিত নামাজ শুরু করলো। জামা-কাপড় ঢিলে-ঢালা হতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা হাতে হিজাবটাও ধরে ফেললো! গীবতের মজলিস ছেড়ে খোঁজ নিয়ে নিয়ে কুরআন হাদিসের মজলিসে যেতে শুরু করলো।
সে বুঝতে পারলো, দুনিয়া এবং আখিরাতে সাফল্যের জন্যে ইসলাম ছাড়া তার আর কোনো গতি নেই। এ যুগে কমবয়সী একটা মেয়ের ইসলাম পালন করা মানে স্রোতের বিপরীতে চলা। সামিরাকেও আল্লাহর বিধান মানতে গিয়ে খুব প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। বান্ধবীদের সাথে কথা বলার সময় কারো নামে গীবত না করা, হারাম প্রেমের প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করা, মুখস্ত হওয়া গানগুলি সুর তুলে তুলে গাওয়া আর শোনা বন্ধ করা, ইউনিভার্সিটিতে নন-মাহরাম ছেলেদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলা এবং হিজাব পড়া শুরু করা – কোনোটাই সহজ ছিলোনা।
এই প্রতিটা মাইলস্টোনে পৌঁছানো মানেই যাত্রার শেষ নয়। এই অভ্যাস এবং ইবাদাতগুলি আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী বজায় রাখা এক আজীবনের সংগ্রাম! এই সংগ্রামের পর্বগুলি পাড় করার সময় যে দ্বীনি বোনেরা সামিরাকে সাপোর্ট দিয়ে গিয়েছে, তাদের কাছে সামিরা কৃতজ্ঞ! সামিরার মুখভর্তি সাজ আর মাথায় রং-বেরঙের হিজাব দেখে তারা কখনো সামিরাকে কটাক্ষ করেনি, সমালোচনাও করেনি। নাসীহা দিয়েছে, সাহস দিয়েছে, সামিরাকে ছোট করে কখনো কথা বলেনি, অনুপ্রেরণা দিয়ে কথা বলে গেছেন সবসময়! সেজন্যে সে আজীবন কৃতজ্ঞ
শুরুতে সে হিজাব ছাড়াই হাদিস ক্লাসে যেত! তার পাশে বসতো হামিদা আপু! কালো আবায়া আর বাদামী রঙের নিকাবের ফাঁকে নূরের মতন আপুর দুইটা চোখ ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যেত না।
আপু সামিরাকে অনেক আদর করেন। ইসলামের প্রতিটা ব্যাপারে হামিদা আপু সামিরাকে অনেক সাহায্য করেছেন। সামিরা প্রায়ই আপুকে বলতো, “আপু তুমি কি সুন্দর করে পর্দা করো মাশাআল্লাহ! তুমি তো আমার অনেক আগে জান্নাতে চলে যাবে! ওখানে গিয়ে আমার কথা মনে থাকবে তো?’
তখন হামিদা আপু বলতেন, “দেখো সামিরা! আমি নিকাব পড়ে যদি মনের মধ্যে অহংকার আর রাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াই, তাহলে তো আমার নিকাব একটা ধোঁকা ছাড়া আর কিছু না। আল্লাহ আমার জন্যে পর্দা করা সহজ করে দিয়েছেন বলেই আমি পর্দা করতে পারি। এখন সেজন্যে যেই বোনটা এই মুহূর্তে পর্দা করছেন না, তার থেকে যদি আমি নিজেকে খুব ভালো মনে করি – তাহলে তো আমি বোকা!
একজন পতিতাকে আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছিলেন, কারণ সেই বোন এক পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করায়, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে। সেই কাজে এতটাই আন্তরিকতা ছিল যে আল্লাহ খুশি হয়ে তার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেন. (মুসলিম, হাদিস ২২৪৫)!
আবার আরেক বোন ছিলেন যে প্রচুর রোজা রাখতো আর দান -খয়রাত করতো। কিন্তু, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন, কারণ সে তার মুখ দিয়ে তার প্রতিবেশীদেরকে ভীষণ কষ্ট দিত। অর্থাৎ তার ওই রোজা আর দান-খয়রাতে কোনো আন্তরিকতা ছিলোনা। তাই সেটা তার কোনো কাজে আসেনি। (সহীহ হাদিস, আল-মুসনাদ)।
তাই শুধু পর্দার জোরে আমি জান্নাতে চলে যাবো – এমনটা ভাবি না বোন! কিন্তু আল্লাহ যদি খুশি হয়ে তার জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ দেন, অবশ্যই জান্নাতে গিয়ে তোমার কথা জিজ্ঞেস করবো! আচ্ছা?”
সামিরা মুগ্ধ হয়ে আপুর কথা শুনে! ইসলাম কি সুন্দর জীবন ব্যবস্থা! ইসলাম ছেড়ে সে কিভাবে এতদিন ছিল? সে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। “অন্য মানুষ কী ভাববে”- এটাকে আল্লাহর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছে। জান্নাত পাবার জন্যে একটুও কষ্ট করতে, সংগ্রাম করতে সে রেডি ছিল না। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ এখন সামিরা অন্যরকম!।
সে বুঝেছে যে, হোক সে মুসলিম, হিন্দু, আস্তিক বা নাস্তিক – প্রতিটা মানুষই সংগ্রাম করে যাচ্ছে। কেউ আল্লাহর পথে, কেউ দুনিয়া নামক এক মরীচিকার পথে! একটাতে বিজয়, আরেকটাতে আফসোস! সংগ্রাম যখন সবারই করতে হবে – তাহলে বিজয়ের পথের সংগ্রামই চলুক! আল্লাহর পথে করে যাওয়া সংগ্রামের আনন্দই অন্যরকম!
আলহামদুলিল্লাহ! অন্য সব পথেই কিছু না কিছু হারানোর ভয় থাকে! এই একটা পথেই কোনো কিছু হারানোর ভয় নেই! প্রতিটা মুহূর্তের আন্তরিক চেষ্টার জন্যে আল্লাহ বান্দাকে পুরস্কৃত করে যাচ্ছেন – দুনিয়াতে সম্মান আর আখিরাতে জান্নাত দেন! তখন নিজের ইচ্ছা আর শয়তানের বিরুদ্ধে করা এই ছোট ছোট যুদ্ধ গুলিকেও অনেক বড় বিজয় মনে হয়! সামিরা আস্তে করে আইলাইনারটা নামিয়ে রাখলো। কোনো প্রকারের মেকআপের স্পর্শ ছাড়াই সে আজকে বের হবে।
২.
আলহামদুলিল্লাহ সামিরার বিয়ে হয়ে গেল! সে যেভাবে চেয়েছিল, আল্লাহর রহমতে সেভাবেই তার বিয়েটা হয়েছে! যেন বিয়ের প্রতিটা স্টেপ আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী হয় সেজন্যে সামিরা আর তার স্বামী মুহাম্মদ অনেক যুদ্ধ করেছে।
আলহামদুলিল্লাহ সামিরার বিয়েতে কোনো গায়ে হলুদ হয়নি। কোনো হারাম গানের বাদ্য বাজেনি। যেন তাদের বিয়েতে আসা বোনেদের পর্দার খেলাফ না হয়, সেজন্যে ছেলে-মেয়েদের জন্যে আলাদা বসার জায়গা ছিল। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বরকতপূর্ণ বিয়ে হচ্ছে যেটাতে খরচ এবং চাকচিক্য থাকে কম।
বিয়ের মতন একটা বিশাল নিয়ামতের শুরুটাই সে যদি করে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করার মাধ্যমে, তাহলে ডাউন দ্য রোড সেটা তাদের বিয়ের জন্যে কি পরিমান অকল্যাণ আনতে পারে, তাদের দুনিয়া আখিরাতের জন্যে কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে – এটা চিন্তা করে সামিরা খুব ভয় পেত! বিয়ের প্রতিটা বিষয় হালালভাবে বাস্তবায়ন করতে সে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট পেয়েছে তার স্বামীর, আলহামদুলিল্লাহ! আনন্দে সামিরার চোখে পানি চলে আসে! কিভাবে আল্লাহ সঠিক সময়ে সঠিক মানুষটিকে তার জীবনে পাঠিয়ে দিয়েছেন; যেন এই মানুষটা সামিরাকে আল্লাহর আরো কাছে নিয়ে যেতে পারে। আলহামদুলিল্লাহ!
সামিরার বিয়ের মোটে এক সপ্তাহ হয়েছে। অনেক আত্মীয় স্বজন বাসায় জড়ো হয়েছে। সবাই নতুন বৌ দেখবেন। সামিরা আত্মীয়-স্বজনদেরকে সালাম দিতে বের হবে, এমন সময় পাশ থেকে এক আত্মীয়ার চাপা কথা শুনলো, “এ কেমন নতুন বৌ? গলায় কিছু নেই। মুখে কোনো সাজ নেই?” দেখতে কেমন লাগে!” সামিরা একটুক্ষণের জন্যে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আন্তরিকভাবে হিজাব ধরার পর থেকে সাজগোজের অভ্যাস একেবারে ছেড়েই দিয়েছে। সেজন্যে অনেকে অনেক কথাই বলতে পারে, সামিরা তেমন কিছু মনে করলো না। কিন্তু আত্মীয়ার এমন কথা শুনে সামিরার আম্মুর মাথা গরম হয়ে গেলো। আম্মু সব রাগ ঝাড়লো সামিরার উপর – “তুই কি এমন আল্লাহ ওয়ালা হয়ে গেছিস যে সারাক্ষন ফকিন্নীর মতন থাকিস? নতুন বিয়ে হয়েছে, অথচ একটুও সেজে-গুজে থাকতে চায় না! সে গায়ে হলুদ করবে না, দামি শাড়ি কিনবে না, সাজগোজ করবে না – কত ঢং! আল্লাহ কি বলেছেন এমন ফকিন্নী হয়ে থাকতে?”
অন্য মানুষের কথা সামিরার গায়ে বেশি লাগেনা। কিন্তু নিজের মানুষের কথার আঘাতটা সে সামলাতে পারেনা। রুমের ভিতরে গিয়ে খুব কান্না পেলো তার। কিন্তু এখন এতো কান্নার সময় নেই। চোখের পানি মুছে আইলাইনারটা হাতে নিলো।
ঠিক ওই মুহূর্তে দরজায় ঠক্ ঠক্! স্বামী মুহাম্মদ বাইরে থেকে অনুমতি চাচ্ছে, “আসতে পারি?” সামিরা দরজা খুলে দিতেই মুহাম্মদ তার ফোলা চোখ দেখে আঁচ করে ফেললো ঘটনা! সামিরা মুহাম্মদকে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে বললো, “আম্মু খুব রাগারাগি করছেন। আমি একটু সেজে বাইরে আসছি, পাঁচটা মিনিট দেন?” মুহাম্মদ হেসে সামিরাকে জিজ্ঞেস করলো, “সামিরা তোমার হাতে এটা কি?” সামিরা বললো, “আইলাইনার”. মুহাম্মদ আবার জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি?” সামিরা আবারো উত্তর দিলো, “এইটা আইলাইনার বললাম তো!।”
মুহাম্মদ এবার সামিরার হাত ধরে আলতো করে আইলাইনারটা নিজের হাতে নিলো – “এটা কি সেই আইলাইনার যেটা তুমি শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্যে দুই বছর আগে ছেড়ে দিয়েছিলে?” “হ্যাঁ!” বলে সামিরা, শক্ত করে ঠোঁট কামড়ে আছে কান্না আটকানোর জন্যে, খুব একটা লাভ হচ্ছে না। টপ টপ করে ফোঁটা গাল বেয়ে পড়তে লাগলো।
মুহাম্মদ ওর চোখ মুছে দিতে দিতে বললো – “তুমি যে জিনিস আল্লাহকে খুশি করার জন্যে ছেড়েছো, সেটা তোমাকে আজ মানুষকে খুশি করার জন্যে ধরতে হবে না সামিরা! বাইরে অনেক গায়ের মাহরাম আত্মীয় আছেন আমাদের। তাদের সামনে সেজে গেলে আল্লাহ কি খুশি হবেন বল? তোমাকে তো আল্লাহ সবচেয়ে সুন্দর করে বানিয়ে আমার জন্যে পাঠিয়েছেন! মাশাআল্লাহ! তুমি কোনো রকম আইলাইনার এবং মেকআপ ছাড়াই সুন্দর! আসো আমরা তাওবা করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই।”
সামিরা স্বামীর হাত শক্ত করে ধরে রইলো। আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করলো, যত ছোট হোক বা বড় হোক – আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট হবেন, এমন কোনো কিছুর সাথে সে আর আপস করবে না। মুহাম্মদের দিকে বুক ভর্তি মমতা আর কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকালো!
আল্লাহর পথে আসার পর নানা দিক থেকে সামিরার জন্যে আসা প্রেমের প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করতে তাকে প্রচন্ড স্ট্রাগল করতে হতো! আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তাকে নফস কন্ট্রোল করার উত্তম প্রতিদান দিয়েছেন! আজকে মুহাম্মদের মতন একটা স্বামী তার জীবনসাথী! আলহামদুলিল্লাহ! মনে মনে দুআ করলো সামিরা, “আল্লাহ! এই মানুষটাকে তুমি জান্নাতেও আমার স্বামী বানিও। দুনিয়াতে যতদিন হায়াত আছে, আমি যেন পরিপূর্ণভাবে আমার স্বামীর হক আদায়ের ব্যাপারে তোমাকে ভয় করি!”
৩.
সামিরার বিয়ের এক বছর হয়ে যাচ্ছে! সামিরা আয়নার দিকে তাকালো। শখের আইলাইনারটা হাতে নিলো। সে তার স্বামীর জন্যে সাজবে। “বিসমিল্লাহ!” বলে সে সাজা শুরু করলো! প্রতিটা আইলাইনারের টান তার জন্যে ইবাদাত হিসেবে কাউন্ট হবে যদি সে এটা স্বামীকে দেখানোর জন্যে করে!
স্বামীর জন্যে পরিপাটি থাকাটা ইবাদাত!
এতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে আরো আন্তরিকতা বাড়বে, বরকত বাড়বে। মুসলিম নারীরা ঘর থেকে বের হবার আগে অনেক সুন্দর করে সাজ-গোজ করে। তাদের সেই অনন্য রূপ বাইরের পুরুষ দেখে। অথচ তার সৌন্দর্যের উপর যার হক সবচেয়ে বেশি, সেই স্বামীর সামনে ঘরের ভিতরে সে থাকে সাদামাটা, ঘাম আর মসলার গন্ধে ভরা কাপড় পরে! বিয়ে গুলিতে কি ভাঙ্গন এমনি এমনি ধরে? সামিরার জন্যে তার স্বামী আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা অনেক বড় একটা উপহার! এই উপহারের সে পূর্ণ সমাদর করতে চায়! এই সম্পর্কের ভালোবাসা আর পবিত্রতা ধরে রাখতে তাকে অবশ্যই ইনভেস্ট করতে হবে। তাই সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে একটু সুযোগ পেলেই সে সাজে! সুন্দর করে মুহাম্মদের জন্যে নিজেকে পরিপাটি করে রাখে। আইলাইনারের উপর দক্ষতা কাজে লাগানোর এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর নেই! মুখের সাজ শেষ করে সামিরা কানের দুল পড়লো। শাড়ির কুঁচিটা ঠিক করে আয়নার দিকে তাকালো! বাহ্! মেয়েটার মুখের একান থেকে ওই কান পর্যন্ত হাসি! আলহামদুলিল্লাহ!
আনমনে নিজের প্রিয় দুয়াটা জপতে থাকলো সামিরা! – ‘রব্বানা হাবলানা মিন আঝওয়াযিনা ওয়া জুর্রিয়াতিনা ক্বুর্রাতা আ’ইউনিওয়াজ ‘আলনা লিল মুত্তাক্বীনা ইমা-মা।’ আমিন। আমিন! দুয়া শেষ করে অধীর আগ্রহে দরজায় টোকা পড়ার অপেক্ষায় রইলো সামিরা!
৪.
সামিরার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শিখার আছে!
একজন স্ত্রী যখন শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলে, এটা তার জন্যে খুব সহজ কাজ না। মেয়েরা ন্যাচারেলি নিজেদের বাহ্যিক রূপ নিয়ে বিভিন্নভাবে স্ট্রাগল করে! স্বামী এক্ষেত্রে বিশাল সাপোর্ট দিতে পারে! শুধু কারণে-অকারণে বউয়ের রূপের প্রশংসা করুন! এক পয়সাও খরচ করতে হবে না! Trust me, just some kind words would go a long way!
ঠিক একই ভাবে বাবারা আপনাদের মেয়েদের রূপের প্রশংসা করুন। একটা মেয়ের জীবনে বাবার ভূমিকা অনেক ভাইটাল! আমি অনেক ছোট থেকেই আমার আব্বুর কাছ থেকে শুনে আসছি আমি নাকি অনেক সুন্দরী আর বুদ্ধিমতী মেয়ে! তখন খুব হাসি পেলেও, এখন বড় হবার পর আমি বুঝি আব্বুর এই ছোট ছোট কমপ্লিমেন্ট গুলি আমার সেলফ ইস্টিম বাড়াতে অনেক হেল্প করেছে আলহামদুলিল্লাহ (আল্লাহ আমার আব্বুকে উত্তম প্রতিদান দিন)! আপনি বাবা হয়ে যদি আপনার মেয়েকে হারাম সম্পর্ক আর হারাম লাইফস্টাইল থেকে বাঁচাতে চান, তাহলে ছোট বেলা থেকেই শরীয়াতের মধ্যে থেকে তার ভিতরের এবং বাইরের রূপকে এপ্রেশিয়েট করুন! When the girl finds love at home, she won’t look for it anywhere else.
স্ত্রীরা যতটা সম্ভব বাসায় সুন্দর পরিপাটি ভাবে থাকুন। দুনিয়ার সবার খেয়াল রেখে দিনশেষে বাসায় বসে সাজ-গোজ করা – এটা মায়েদের এবং স্ত্রীদের জন্যে কষ্টের আমি বুঝি! কিন্তু পাঁচ মিনিট নিয়ে চট করে একটা কাজল-ও যদি চোখে লাগিয়ে ফেলা যায়, সেটাও একটা প্লাস! মনে রাখবেন, শয়তানের সবচেয়ে পছন্দীয় শয়তানী হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো! একটা মেয়ের জন্যে পর্দা মেইন্টেইন করা যেমন কঠিন, একটা ছেলের জন্যেও এ যুগে নিজের দৃষ্টির হেফাজত করাটাও অনেক বেশি কঠিন! স্ত্রীরা যদি স্বামীদেরকে জন্যে চক্ষু শীতলতাকারী হবার জন্যে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা না করি, তাহলে শয়তানেরা সবসময় চেষ্টা করে যাচ্ছে তাকে চোখের পাপ করতে ওয়াসওয়াসা দিতে!
স্বামীদেরকে আমরা স্ত্রীরা আল্লাহর পথে থাকতে বিশাল সাপোর্ট দিতে পারি শুধু বাসায় একটু পরিপাটি থেকে! গত কয়মাসের ব্যবধানে আমার কাছে চারজন দ্বীনি বোনের ডিভোর্সের খবর এসেছে! আল্লাহু আকবার! This is real! একটা মুসলিম ফ্যামিলি ভেঙে দিতে পারলে ইসলামের ব্যাকবোন দুর্বল হয়ে পড়ে! শয়তানের অনেক বড় এজেন্ডা হাসিল হয়ে যায়! এই ছোট ছোট কাজগুলি করে আমরা আমাদের মুসলিম ফ্যামিলিকে স্ট্রং রাখলে পারতঃপক্ষে ইসলাম সমাজে স্ট্রং থাকবে!
যদি আপনার আশেপাশে কাউকে দেখেন হঠাৎ করে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে! অনেক ধার্মিক হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকমের অদ্ভুত কাজ করছে। প্লিজ তাকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলবেন না! হয়তো এই মুহূর্তে তার কাজ কর্মের কিছুই আপনি বুঝতে পারছেন না। আপনার খুব বিরক্ত লাগছে, তাকে দুইটা কথা শোনালে আপনার হয়তো একটু ভালো লাগবে। কিন্তু প্লিস মুখের লাগাম ধরে রাখেন! হতে পারে আপনি এমন কাউকে কষ্ট দিচ্ছেন যিনি আল্লাহর খুব প্রিয় কোনো বন্ধু, আল্লাহর ওয়ালী! সহীহ হাদিসে আছে, যারা আল্লাহর ওয়ালীকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন (বুখারী). আমার মনে হয়না, আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া আমরা কেউ এফোর্ড করতে পারবো! তাই, আপনি যেই হোন আল্লাহর কোনো বন্ধুকে অনেক বড় একটা সাপোর্ট আপনি দিতে পারেন সিম্পলি নিজের মুখের কথাকে সংবরণ করে!
খুব বেশি বেশি দুয়া করতে হবে আমাদের সামিরার মতন! আমরা সবরকমের সব স্টেপ নিলেও, আল্টিমেট শান্তি দিবার মালিক আল্লাহ! তার সামনে নিজেকে হাম্বল রেখে চাইতে হবে! আমরা সিঙ্গেল হই, বিবাহিত বা ডিভোর্সী – সবসময় আল্লাহর কাছে কল্যাণ আর খইর চেয়ে যেতে হবে!
‘রব্বানা হাবলানা মিন আঝওয়াযিনা ওয়া জুর্রিয়াতিনা ক্বুর্রাতা আ’ইউনিওয়াজ ‘আলনা লিল মুত্তাক্বীনা ইমা-মা।’
অর্থঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের/স্বামীর পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।
[সূরা ফুরক্বানঃ৭৪]
আমিন ইয়া রব! আল্লাহ আমাদেরকে ভালো মেয়ে, স্ত্রী এবং মা হবার তাওফিক দিন! ভালো পুত্র, স্বামী এবং বাবা হবার তাওফিক দিন! সর্বোপরি আল্লাহর ভালো একজন বান্দা হবার তাওফিক দিন! আমিন ইয়া রব্বুল আলামিন!
– শারিন সফি
Awesome post! Keep up the great work! 🙂