আবৃত নারী উজ্জ্বল পূর্ণিমার চেয়েও দীপ্তিময়!
নারী জাতি হিরন্ময়ী। বিপ্লবী অগ্রযাত্রার দুর্দমনীয় সহযাত্রী। পুরুষের অলঙ্কার, দুঃসময়ের প্রশান্তিদায়ী, দুর্যোগের অনুপ্রেরণা, সমাজসভ্যতার ধারা অক্ষুণ্ন রক্ষাকারী কন্যা, জায়া জননী ও মা। পুরুষের অগ্রযাত্রা বেগবান ও স্বতঃস্ফূর্ততা রক্ষার অক্লান্ত রণসঙ্গী। নারী এক চেতনা, কর্মস্পৃহা রচনায় শাণিত অনুপ্রেরণা। ভোগের পণ্য নয়; সৃষ্টির অপার মহিমা। স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা এবং উন্নত সভ্যতার সূতিকাগার। নারী কেবলই জননী কিংবা ধাত্রী নন, গতিময় অভিসারী সমাজের সহযাত্রী। নারী আছে কাব্য-কবিতায়, সমাজ বিনির্মাণের সৃষ্টিশীল গল্পে- স্বমহিমায়। যুগ পরম্পরায় তাদের কীর্তির সরব উপস্থিতি কর্মোদ্দীপনার সুরে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। নারী শুধু রমণীই নয়, ইতিহাসের জননী। ইতিহাসের হাজারও রওনকে নারীর আছে নিদাগসম প্রখরতা, অগ্নিঝরা বিদ্রোহী কাব্যে গতির ঊর্মিমালা। নারী উপমা-উৎপ্রেক্ষার স্তম্ভ, অনুজ প্রজন্মের আলোকচ্ছটার প্রতিবিম্ব। নারী দুর্গম গিরিখাদে পুরুষের উদ্দীপনা, দরিদ্রক্লিষ্ট গৃহকর্তার সান্ত্বনার আসমানসম শামিয়ানা।
আবৃত নারী সম্ভ্রমপ্রাচীর, যার আড়ালে রক্ষিত হয় নারীসত্তার সতীত্ব। হাওয়া, সারা, হাজেরা, রহিমা, আছিয়া, মারয়াম, খাদিজা, আয়েশা, আছমা, ফাতেমা, হাফসা, উম্মে সালমা, যয়নব, উম্মে কুলসুম, রোকাইয়া, উম্মে হানী সভ্যতার একেকটি স্তম্ভ, পরিশীলিত জীবনের জীবন্ত সুরাইয়াসম উজ্জ্বল নক্ষত্র। এঁরা যুগের সেরা উপহার। রত্নগর্ভা, রত্নপ্রসবিত এবং রত্নবিস্তারিণী। জগতে যত মনীষী এসেছেন তারা সকলেই মায়ের পেট চিড়েই এসেছেন। মায়েদের অকৃপণ স্নেহ-প্রীতি, স্তন্যদান এবং অকৃত্রিম মায়া-মমতার বদৌলতেই একজন সন্তান পরবর্তীতে দেশ ও মানবতার জন্য নিবেদিত হতে পেরেছেন। সুতরাং সমাজ-সভ্যতার ভীত নির্মাণের জন্য ওই ব্যক্তিকে যতটুকু না মর্যাদা দেব, তারচেয়ে বেশি মর্যাদা দেব ওই নারীকে, যার গর্ভে তার আগমন ঘটেছে, বুকের দুধে প্রতিভা সৃষ্টি হয়েছে এবং অকৃত্রিম আদর-স্নেহে বেড়ে ওঠা হয়েছে।
প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অধিকারী নারী আবৃতবসনেও যে দীপ্তিময় ও প্রখর, তা উলঙ্গ সূর্যের দীপ্তি কিংবা বিবস্ত্র পূর্ণিমার উজ্জ্বলতাকেও ম্লান করে দেয়। মহীয়সী যেবুন্নেছা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তখন ইরান এবং হিন্দুস্তান ছিল ফার্সি সাহিত্যের উর্বরভূমি। হিন্দুদের ভাষায় তীর্থস্থান। কত কাব্যপ্রতিভা যে এই দুই নগরী থেকে জন্ম নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। একবার সব প্রতিভা যেন থমকে গেল। কবিতার একটি অংশ নির্মাণে সকল কথাশিল্প ব্যর্থ হল। ইরানের সেরা কবিরা কবিতার এক চরণ লিখে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরের চরণ রচনা করতে ব্যর্থ হলেন। ঘষামাজার মধ্যে কেটে গেল বেশ কিছুদিন। কিন্তু কিছু থেকেই কিছু হয় না। সন্তোষজনক দ্বিতীয় চরণ রচনা করতে কেউ সক্ষম হন না। শেষ পর্যন্ত ওই চরণ লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হলো হিন্দুস্তানে। দিল্লির প্রতিথযশা কবিগণ থমকে গেলেন। দ্বিতীয় চরণ রচনা করবেন কি, প্রথম চরণের মন্ত্রমুগ্ধতাই তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখল। তাদের সুতীক্ষ্ন কলমের ডগায় যেন মরিচা ধরেছে! গোটা ইরান ও দিল্লির বিশ্বসেরা কবিগণ ব্যর্থ হলেন। কবিদের কাব্যিক নান্দিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে লাগল। তাদের সে কী শরম! উভয় দেশের কবিদের তখন রক্ষা করতে এলেন এক ‘বন্দি’ ‘আবদ্ধ’, ‘পশ্চাদপদ’ নারী! বাদশাহ আলমগীরের কন্যা হাফেজা আলেমা মহীয়সী যেবুন্নেছা কবিতার প্রথম চরণ চেয়ে পাঠালেন। তাতে এক নজর পড়তেই তার কাব্যসত্তা প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠল। তিনি খাতা-কলম হাতে নিয়ে দ্বিতীয় চরণ লিখে ফেললেন। কয়েকবার তা ঘষামাজা করে পাঠিয়ে দিলেন দিল্লির রাজদরবারে। যেবুন্নেছার লেখা কবিতার দ্বিতীয় চরণ গোটা দিল্লিকে স্তম্ভিত করে দিলো। প্রথম চরণের সঙ্গে এত সাদৃশ্যপূর্ণ দ্বিতীয় চরণ দেখে দেশের বাঘা বাঘা কবিরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই বুঝি আবরণের প্রভাব! বন্দিত্বের অবারিত প্রতিভা!
দ্বিতীয় চরণ ইরানে পাঠানো হলে তারা ততোধিক বিস্মিত হলেন এবং কবির নারীত্বের পরিচয় তাদেরকে আরো উদগ্রীব করে তুলল। তারা লিখলেন, হে জ্যোৎস্নামুখী! আপনি আমাদেরকে দিদার দিন! আপনার পূর্ণিমার উজ্জ্বলসম কবিতা আমাদেরকে বিমোহিত করেছে।
জবাবে ওই আব্রু-আবৃত নারী লিখলেন, ‘আমি লুকিয়ে আছি আমার কাব্য প্রতিভায়। যে আমাকে দেখতে চায় সে যেন আমাকে দেখে আমারই কবিতায়।’ এভাবেই কাব্যখ্যাতি পান যেবুন্নেছা। তার রচিত ‘জেব-ই-মুনশোয়াতে’ আছে সত্যিকার কাব্যপ্রতিভার চিহ্ন। বিখাত ফার্সি কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ানে মখফির’ রচয়িত্রীরূপেও আছে এই মহীয়সী নারীর নাম। কিন্তু সবকিছুই হতো পর্দার পবিত্রতা ও শুদ্ধতার আঙিনায়।
তাই তো বলি, আবৃত নারী উজ্জ্বল পূর্ণিমার চেয়েও দীপ্তিময়! যুগে যুগে এই আবৃত নারীরাই কীর্তি স্থাপন করেছেন, পর্দার আড়ালে থেকেই রচনা করেছেন সভ্যতার সুদর্শন মিনার। পক্ষান্তরে অনাবৃত নারী গড়েনি ভালো কিছু। বরং খুলে ফেলেছে সভ্যতার একেকটি ইট। তারা হয়েছে ভোগের পাত্র, পুরুষকে করেছে কামুক এবং চরিত্রহীন। বস্তুত পর্দার নারীই ফুলেল নারীসত্তা। আর এই ফুলেল নারীসত্তা কিছু কীট ও গোবরের পোকা কলঙ্কিত করতে চায়। তারা কারা? যারা নারীর নিয়ন্ত্রিত ও শালীন জীবনাচারের বিরোধী তারাই সেই নর্দমার কীট, গোবরের পোকা!
– আবু বকর সিরাজী