জেদ্দার ঝাড়ুদারদের গল্প
নীল পোশাক পরিহিত কিছু মানুষকে দেখা যায় ঝাড়ু হাতে সৌদি আরবের জেদ্দার রাস্তায়। তাদের কাজ রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখা, শহরের সকল ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা। পথচারীরা করুণা করে কিছু টাকাও দেয় তাদের। এদের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শ্রমিক। তারা হয়তো নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের তাগিদেই সৌদি আরব গিয়েছিলেন। কিন্তু জীবিকা অর্জনের তাগিদে ঝাড়ুদার হওয়া ছাড়া আর কোন পথ ছিল না তাদের। জেদ্দার ঝাড়ুদারদের সমপর্কে সেখানকার মানুষ এতটুকুই কেবল জানে। কিন্তু তাদের জীবনের আরও অনেক গল্প আছে, যা হয়তো কেউ শোনেইনি কখনও, জানেও না। রাস্তার ঝাড়ুদারদের জীবন আসলে কেমন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তাদেরই নীল পোশাক পরে ও মুখে স্কার্ফ বেঁধে একদিন তাদের দলে অগোচরে যোগ দিলেন স্থানীয় আল মদিনা পত্রিকার এক প্রতিবেদক। এরপর ঝাড়ু হাতে নিয়ে তিনিও শুরু করলেন রাস্তায় ঝাড়ু দেয়া। ওই সাংবাদিক ক্রমেই উপলব্ধি করলেন, তাদের জীবন খুবই সাধারণ। সবাই একসঙ্গে আনন্দ করে যখন কোন পথচারী কিছু টাকা দেয় কাউকে। সত্যিকার অর্থে, পথচারীদের এ টাকার জন্য তারা বেশ ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করে। ওই সাংবাদিক জানালেন, দুইদিন ঝাড়ুদারদের দলে থাকার সময় পথচারীদের কাছ থেকে তিনিও ৪২ রিয়াল পেয়েছেন। তার ধারণা, আশেপাশের অন্য ঝাড়ুদাররাও এরকমই পেয়েছেন। আবার অনেক মানুষ এদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, যদিও এরাই শহরটা পরিষ্কার রাখে। ওই প্রতিবেদক বলেন, কেউ খারাপ আচরণ করলে তারা কষ্ট পায়। আমি চিন্তিত ছিলাম যে, কেউ বোধ হয় আমাকে চিনে ফেলবে, এবং আমার উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবে। তবে কিছুক্ষণ পরই আমি বুঝতে পারলাম, আমার নীল পোশাক নিয়ে কেউই চিন্তিত নয়। কেউ আমার চোখে তাকাচ্ছেও না। তিনি জানান, ট্রাফিক লাইট যখন জ্বলে, সেসময় ঝাড়ুদাররা বেশ টাকা পান। যখন লাল রঙের বাতি জ্বলে উঠে এবং বহু গাড়ি থেমে যায়, তখন একটি গাড়ির জানালার পাশে গিয়ে সালাম দিতে হয়। তখন ড্রাইবার হয়তো কাচের জানালা খুলে এক বা দুই রিয়াল দান করেন। ওই সাংবাদিক এও উপলব্ধি করেন যে, সীমিত আয়ের মানুষরাই বেশি দান করে। সে তুলনায় বিলাসবহুল গাড়িতে চড়া মানুষরা তেমন কিছুই দান করেন না। অনেক সময়ই সাধারণ গাড়িতে চড়া মানুষরা ঝাড়ুদারদের ডেকে টাকা দেন। কিন্তু ধনী গাড়ি-মালিকরা এমনটা করেন না। এছাড়া, ধনী মানুষজনের বসবাস যেসব এলাকায়, সেখানকার রাস্তার পাশে দাঁড়ালে তেমন অর্থ পাওয়া যায় না। তবে কিছুটা কম অর্থবান মানুষের বসতির আশেপাশের রাস্তায় দাঁড়ালে বেশি অর্থ পাওয়া যায়। সর্বোচ্চ কত টাকা পাওয়া যায় এভাবে? একজন ঝাড়ুদার জানিয়েছেন, মাঝেমধ্যে একদিনে ১০০০ রিয়ালও আয় করা যায়! রমজানের সময় ২০০০ রিয়ালেও পৌঁছে যায় এ অর্থ। এছাড়া, নগদ ছাড়াও কাপড়, জুতা, ঘড়ি, ইত্যাদি পান তারা। তারা একে অপরকে প্রয়োজনের সময় সাহায্য-সহযোগিতা করেন। এর বাইরেও সামান্য অর্থের বিনিময়ে অন্যান্য কাজও করেন তারা। এসব করে মাসে ৩০০ রিয়ালের বেশি সাধারণত আয় করতে পারেন না। তবে বিষাক্ত জিনিসপত্র পরিষ্কার করেন বলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তাদের বেশি। বেশির ভাগ সময়ই তারা সুরক্ষামূলক হাতমোজা পরেন না। এছাড়া, নিজেদের স্বাস্থ্য ভালো রাখার ব্যাপারে কোন ধারণাও নেই তাদের। এছাড়া, শীত হোক আর গরম, সবসময় একই পোশাক পরেই কাজ করেন তারা। এর বাইরেও অনেক যুবক কোন কারণ ব্যতীতই তাদের আক্রমণ করে। ওই প্রতিবেদক নিজেও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। এত কিছুর পরও তাদের কোন অভিযোগ নেই। নিজেদের এ জীবন নিয়েই তারা সন্তুষ্ট।
(মানবজমিন)