চরিত্রবান মানুষ কাম্য
সুন্দর দেশ ও সমাজ গড়তে গেলে চরিত্রবান মানুষ আবশ্যক। চরিত্রবান মানুষ ও নেতা ব্যতীত সুষ্ঠু সমাজ গড়া সম্ভব নয়। সেকারণ যুগে যুগে আল্লাহ যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, তাদেরকে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী করে পাঠিয়েছেন। কারণ কেবল কথা শুনে নয়, বরং সুন্দর চরিত্র ও আচরণ দেখে মানুষ মানুষকে ভালবাসে ও তাকে অনুসরণ করে। মূসা (আঃ)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ (ক্বাছাছ ২৬)। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর নবুঅত-পূর্ব জীবনে ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত) বলে খ্যাত ছিলেন। এটাই ছিল তাঁর নেতৃত্বের ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। নবুঅত লাভের পর স্বার্থান্বেষীরা তাঁর শত্রু হয়ে যায়। এমনকি তারা তাঁকে ‘কাযযাব’ (মহা মিথ্যাবাদী) বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। নাস্তিক ও মুনাফিকরা আরও নোংরা কথা বলে থাকে। সেকারণ আল্লাহ তাঁর চরিত্র সম্পর্কে সত্যায়ন করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী’ (কলম ৪)। খ্যাতনামা তাবেঈ সা‘দ ইবনু হিশাম (রহঃ) বলেন, আমি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে গেলাম এবং বললাম, হে উম্মুল মুমেনীন! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চরিত্র কেমন ছিল আমাকে বলুন। তিনি বললেন, তুমি কি কুরআন পড়োনি? আমি বললাম, হরযাঁ। তখন তিনি বললেন, আল্লাহরর নবীর চরিত্র ছিল কুরআন’ (মুসলিম হা/১৫২৭)। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন উত্তম চরিত্রকে পূর্ণতা দানের জন্য’ (হাকেম, ছহীহাহ হা/৪৫)। আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন মুমিনের পাল্লায় সবচেয়ে ভারি হবে তার সচ্চরিত্রতা’ (আবুদাঊদ, তিরমিযী)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হ’ল মানুষকে সবচেয়ে বেশী জান্নাতে নিয়ে যায় কোন বস্ত্ত? তিনি বললেন, আল্লাহভীরুতা ও সচ্চরিত্রতা। আবার প্রশ্ন করা হ’ল সবচেয়ে বেশী জাহান্নামে নিয়ে যায় কোন বস্ত্ত? তিনি বললেন, যবান ও লজ্জাস্থান’ (তিরমিযী)। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তার যবান ও লজ্জাস্থানের যামিন হবে, আমি তার জান্নাতের যামিন হব (বুখারী)। তিনি বলেন, যদি তোমাদের উপর কোন নাক-কান কাটা ব্যক্তিও আমীর হন, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহরর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন, তোমরা তার কথা শোন ও আনুগত্য কর’ (মুসলিম)। তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন জামা‘আতবদ্ধ জীবনকে অপরিহার্য করে নেয়’ (তিরমিযী)।
উপরের আলোচনায় পরিষ্কার যে, চরিত্রবান মানুষ ও চরিত্রবান নেতৃত্ব ব্যতীত সুন্দর সমাজ গড়া সম্ভব নয়। আর সুন্দর জীবনের স্বপ্ন নিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন আমাদের দেশে কতটুকু হয়েছে?
স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর আমরা আমাদের রক্তে গড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে কেমন উন্নতি করেছি, নিম্নোক্ত রিপোর্টে কিছুটা হ’লেও তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পাবে। সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি বিভাগীয় শহরের সমাজচিত্র নিয়ে বেসরকারী একটি সংস্থার জরিপে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তার সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ : রাজশাহী মহানগরীতে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৫ শতাধিক ছাত্রী, যাদের বয়স ১৩ থেকে ২৬-এর মধ্যে, তারা নিয়মিত দেহ ব্যবসায়ে লিপ্ত। মহানগরীর ৮টি হোটেলে খোলামেলাভাবেই এবং নামী-দামী হোটেলগুলিতে চলে গোপনে। এছাড়াও ১৫ থেকে ২০টি আবাসিক হোটেল, বিউটি পার্লার, ম্যাসেজ পার্লার ও রেস্ট হাউজে চলছে রমরমা দেহব্যবসা। ছোট-বড় অন্ততঃ ১০টি হোটেলে নির্মিত হচ্ছে পর্ণো ছবি। শিক্ষানগরী বলে খ্যাত রাজশাহীর মত একটি শান্ত ও সুন্দর নগরীর ভিতরকার এই কলংকিত চিত্র বেরিয়ে আসার পর শিল্পনগরী ও বন্দর নগরী বলে খ্যাত চট্টগ্রাম ও খুলনা মহানগরী এবং বিশ্বের এক নম্বর দূষিত নগরী বলে খ্যাত রাজধানী ঢাকার মহানগরীর অবস্থা কেমন, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় কি? সেই সাথে রয়েছে ইভটিজিং, লিভ টুগেদার ও সমকামিতার মত পশুস্বভাবের বিস্তার। যার অধিকাংশ পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির ভয়াল আগ্রাসন মাত্র।
যুবসমাজের এই অধঃপতনের কারণ হিসাবে কয়েকটি বিষয়কে চিহরনিত করা যায়। যেমন (১) শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী নৈতিকতার অভাব (২) আকাশ সংস্কৃতির নীল দংশন ও পর্ণোছবি (৩) মাদকের ছড়াছড়ি (৪) অভাবের তাড়না (৫) শখ বা বিলাসিতার অর্থ যোগান (৬) প্রতারণার ফাঁদ (৭) অভিভাবকদের শৈথিল্য ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা ইত্যাদি।
প্রতিকার হিসাবে বলতে পারি, (১) ধর্মীয় শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দান (২) নারী-পুরুষের সহশিক্ষা ও সহচাকুরী বন্ধ করা (৩) মসজিদ ও পঞ্চায়েতগুলিতে ধর্মীয় উপদেশ ও সামাজিক শাসন বৃদ্ধি করা (৪) পারিবারিক অনুশাসন ও তদারকি বৃদ্ধি করা (৫) ধর্ম ও সমাজ বিরোধী মেলা ও অনুষ্ঠান সমূহ বন্ধ করা (৬) বিদেশী সংস্কৃতি বর্জন করা ও বিদেশী মন্দ চ্যানেলগুলি বন্ধ করা (৭) ইন্টারনেট ও মোবাইলের মন্দ ব্যবহারের সুযোগগুলি বিনষ্ট করা (৮) সেই সাথে প্রয়োজন এমন শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন, যা এই মন্দ স্রোতকে বাধা দিবে এবং তার স্থলে সুস্থ স্রোত প্রবাহিত করবে। মুরববী, যুবক, বালক ও মহিলাদের মধ্যে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমলের প্রচার ও প্রসার যতবেশী ঘটবে এবং মন্দ প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করা হবে, তত দ্রুত স্ব স্ব পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে ইনশাআল্লাহ। নিঃসন্দেহে এটি হ’ল সমাজ বিপ্লবের স্থায়ী পথ এবং এটিই হ’ল নবীগণের পথ। যে পথের শেষ ঠিকানা হ’ল জান্নাত। এ পথে জান-মাল, সময় ও শ্রম ব্যয় করাটাই হ’ল প্রকৃত জিহাদ। এ জিহাদে নিহত হলে শহীদ। এমনকি বিছানায় মরলেও শহীদ (মুসলিম)। অতএব কেবল উপদেশ নয়, বরং জান্নাত পাওয়ার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ইমারতের অধীনে আল্লাহরর নামে সমাজ সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে সমাজ পরিবর্তনে দৃঢ়পদে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে ইহকাল ও পরকালে লজ্জিত হ’তে হবে।
মানব কল্যাণে আল্লাহরর বিধানসমূহ নাযিল হলেও যুগে যুগে মানুষ নিজেরা নানাবিধ আইন-কানূন তৈরী করেছে। কিন্তু এটাই বাস্তব সত্য যে, নৌকা যেমন শুকনা ডাঙ্গায় চলে না, আল্লাহরর আইন মান্য করা ব্যতীত তেমনি সামাজিক শান্তিও আসে না।
যেকোন চিন্তাশীল ব্যক্তিই স্বীকার করেন যে, সামাজিক অধঃপতনের মূল কারণ হ’ল ধর্মবিমুখতা। অথচ দেশের নির্বাচিত কোন সরকারই ইসলামী বিধান অনুযায়ী দেশ শাসন করেন না। এমনকি শিক্ষা ব্যবস্থায়ও ইসলামের প্রসার চান না। ফলে দেশ ক্রমেই রসাতলে যাচ্ছে। ইসলামে ছবি-মূর্তি হারাম। কেন হারাম? তার একটি প্রমাণ নিন। সম্প্রতি মস্কো শহরে একই দিনে পরপর ৫৭১টি গাড়ী দুর্ঘটনা ঘটে। দিশেহারা পুলিশ কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখে যে, সবগুলো দুর্ঘটনাই ঘটেছে একটি ছবিকে কেন্দ্র করে। মস্কোর একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিজ্ঞাপনে নয়া চমক আনতে গিয়ে এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করে। আর তা হ’ল, ৩০টি ট্রাকের গায়ে নারীর নগ্ন ছবি সেঁটে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরানো। আর ঐ ছবির উপর তারা আড়াআড়ি লেবেলের উপর লিখে দেয়, এরা নজর কাড়ে। চলমান ট্রাকের উপর তাক লাগানো ফ্লেক্সে দৃষ্টি আকর্ষণ করার এই ফন্দি কার্যকর করতে গিয়েই ঘটে যায় এই বিপত্তি। অথচ আমাদের দেশে এর চেয়েও মারাত্মক পর্ণো ছবি মোবাইলে ও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সারা দেশে হর-হামেশা। প্রশাসন সবকিছু জেনেও না জানার ভান করেন। হয়তবা সেখানে কোন দুনিয়াবী স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। ফলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। সরকার, পুলিশ, আদালত সবই আছে, নেই কেবল আল্লাহভীরুতা। সচ্চরিত্রবান মানুষ ও সমাজ গড়ার যা একমাত্র হাতিয়ার। আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি সবচেয়ে আল্লাহভীরু (হুজুরাত ১০)। অতএব শোনার মত কান ও বুঝার মত হৃদয় যাদের আছে, তারা এগিয়ে আসবেন কি? আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!।
———–
– প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব