সংবাদ

গাজা এখন বধ্যভূমি

লিফলেটগুলো ভোরের শিশিরের মতো সকালের মৃদু আলোতে আলতোভাবে নেমে আসছিল। এরপরই পড়তে শুরু করল গোলা। ভবনগুলো মুহূর্তের মধ্যে ধুলায় মিশে যেতে লাগল। মনে হলো প্রস্তর যুগ ফিরে এসেছে। শিশু, কিশোর, নারীÑ সব বয়সী মানুষই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগল। বুধবার গাজায় এমন দৃশ্যই ছিল একেবারে স্বাভাবিক।

image

ইসরাইলি হামলায় স্বজনহারা এক ফিলিস্তিনি বৃদ্ধার আহাজারি : এএফপি

অবশ্য ইসরাইলের হুঁশিয়ারির পর গাজার মানুষ পালাতে শুরু করেছিল। ইসরাইল ঘোষণা করেছে, জিএমটি সময় ৫টার মধ্যে তাদের ঘরবাড়ি খালি করতে হবে। কয়েক দিন ধরেই প্রতিটি মুহূর্ত তারা মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে বাস করছিল। নতুন হুঁশিয়ারির পর তারা আবার ছুটতে শুরু করে। প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে ছোট্ট শিশুটি তার চেয়েও ছোট বোনকে কাঁধে নিয়ে দৌড়াতে থাকে, মা তার বাচ্চাদের আগলে নিতে থাকেন, অসহায় বৃদ্ধ, পঙ্গুদেরও কোনোভাবে সরিয়ে নেয়া হতে থাকে। কিন্তু কোথায় যাবে? 
১৪০ বর্গমাইলের গাজা উপত্যকায় ১৭ লাখ লোকের বাস। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর অন্যতম। অধিবাসীদের বেশির ভাগই শিশু। ইসরাইলের কঠোর অবরোধে অনেক আগে থেকেই স্থানটি ‘উন্মুক্ত কারাগারে’ পরিণত হয়েছিল। জীবন ধারনের মৌলিক প্রয়োজনগুলোও সেখানে পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেই উন্মুক্ত কারাগার এখন পরিণত হয়েছে বধ্যভূমিতে।
এক সপ্তাহ ধরে সেখানে চলছে নির্মম হামলা। গাজার প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা এখন ইসরাইলি হামলার লক্ষ্যবস্তু। এক সপ্তাহে প্রায় দেড় হাজার লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালানো হয়েছে। নিহত হয়েছে দুই শতাধিক, আহত হয়েছে দেড় হাজারের বেশি। প্রায় পুরোটাই এক তরফা। ইসরাইলের নিহত হয়েছে মাত্র একজন। ফিলিস্তিনি আহতদের বেশির ভাগই শিশু।
গাজার হাসপাতালগুলোও পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। বেইত জাহিয়ার হাসপাতালে হামলা চালিয়ে তিন রোগী ও এক নার্সকে হত্যা করা হয়েছে।
গাজার অধিবাসীরা এখন প্রশ্ন করছেন, তারা কি মানুষ না? উত্তর গাজার শাতি উদ্বাস্তু শিবিরে ৬৫ বছর বয়স্ক আবু আশরাফ সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা এখানে কারাগারে, বড় একটা কারাগারে আছি। আমরা মুক্ত নই। আমরা কেন অন্য স্বাধীন মানুষের মতো বাস করতে পারব না। আমরা কি মানুষ না?’
ইসরাইল সত্যিই তাদের মানুষ মনে করে না। সুস্থ মানুষ তো দূরের কথা, পঙ্গু, অসুস্থ, বৃদ্ধÑ কাউকেই গাজা থেকে বের হতে দিচ্ছে না ইসরাইল।
এখন যেখানে ইসরাইল, সেখানেই গাজার মানুষদের পৈতৃক ভিটা ছিল। ইহুদিদের আবাসভূমি নির্মাণের জন্য তাদের সেখান থেকে উৎখাত হতে হয়েছে। এখন ইসরাইলিরা তাদেরকে গাজাতেও থাকতে দিচ্ছে না।
তারা বছরের পর বছর যেভাবে বাস করছিল, সেটাকে জীবন বলে না। তারপরও যেটুকু প্রাণের স্পন্দন ছিল তা-ও কেড়ে নিতে চাচ্ছে ইসরাইল।
গাজায় অন্তত ৫৬০টি বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। পানি ও পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির প্রধান জ্যাক ডি ম্যাইয়ো জানিয়েছেন, কয়েক দিনের মধ্যে পুরো উপত্যকায় পানির ভয়াবহ অভাব দেখা দেবে।
চিরতরেই মেরে ফেলুক : ২০০৮ সালে ইসরাইলি হামলায় উম্মে সামের মারুফের বাড়িটি ভেঙে গিয়েছিল। প্রাণভয়ে বাড়ি থেকে সবাইকে নিয়ে পালিয়েছিলেন। তারপর কোনোমতে তিনি বাড়ির কিছু অংশ নির্মাণ করেছিলেন। এবারের হামলায় সেটুকু ধসে পড়েছে। তিনি তার সাত সন্তান নিয়ে পালিয়েছেন। এভাবে আর পারছেন না।
এবার আশ্রয় নিয়েছেন জাতিসঙ্ঘ আশ্রয় শিবিরে। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের মেরে ফেলুক কিংবা আমাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করুক।
তবে তিনি নিজেকে ভাগ্যবানই মনে করেন। এখনো তার পরিবার টিকে আছে। কোনো কোনো পরিবারের সব সদস্যই ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন, একজনও বেঁচে নেই।
তার মেয়ের জামাই হামলায় একটি পা হারিয়েছেন। পবিত্র রমজান মাস চলছে। ইফতার কিংবা সেহরি কোনোটাই ঠিক নেই। যেখানে জীবনেরই কোনো নিশ্চয়তা নেই, সেখানে খাবার, পানির মূল্য কী। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় গাড়ি নেই। কেবল ইসরাইলি বিমান উড়ে যাওয়া কিংবা প্রচণ্ড শব্দে গোলা বিস্ফোরণের শব্দই তারা শুনতে পাচ্ছেন। এর ফাঁকেই কোথাও থেকে কিছু যদি সাহায্য আসেÑ সেই ভরসায় বসে থাকেন তারা।

নয়া দিগন্ত

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button