‘বুকের ওপর পা রেখে দাড়ি উপড়ায় ইরাকি সেনা’
বুকের ওপর পা তুলে, বন্দুক ঠেকিয়ে, প্লাস দিয়ে টেনে টেনে দাড়ি উপড়ে ফেলে ইরাকের সেনা। রাইফেলের বাঁট দিয়ে গিরায় গিরায় আঘাত করে। কোন রকম জান নিয়ে ফিরে এসেছি। ফিরে না এলে হয়তো ওরা আমাকে মেরেই ফেলতো। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দেন ইরাক থেকে ফিরে আসা জালাল উদ্দিন। গত ২৮শে জুন বাংলাদেশীদের ওপর সেনাবাহিনীর সদস্যদের এ ধরনের লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দেন আরও অনেকে। সমপ্রতি ইরাকে শিয়া-সুন্নি সমপ্রদায়ের মধ্যে সংঘাতের ফলে বিদেশীরাও আক্রান্ত হয়। অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় সে দেশে কাজ করতে যাওয়া বাংলাদেশীদের ওপর। কোরিয়ান কোম্পানি হানওয়া’র অধীনে বাগদাদের বিসমায়া নিউ সিটি প্রজেক্টে কর্মরত প্রায় ৪৫০০ বাংলাদেশী ওই নির্যাতনের পর আতঙ্কিত হয়ে দেশে ফিরতে শুরু করেন। গতকাল ভোর সাড়ে ৫টায় কাতার এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে নিজ খরচে ৪১ বাংলাদেশী দেশে ফেরেন। এছাড়া একই দিন ভারতীয় ৬ নাগরিকও দেশে ফিরেছেন। এর আগে ১লা জুলাই নিজ খরচে দেশে ফেরেন আরও ২৭ বাংলাদেশী। এখনও দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন আর ১৭০০ কর্মী। টিকিটের টাকার অভাবে ফিরতে পারছেন না আতঙ্কে থাকা প্রায় হাজার বাংলাদেশী। বাড়ি থেকে পাঠানো টাকায় গতকাল অনেকেই ফিরেছেন বলে জানিয়েছেন। এদিকে শাহজালাল বিমানবন্দরে নেমে দূতাবাস ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। তাদের অভিযোগ, যে কোন অসুবিধায় যোগাযোগের জন্য দেয়া দূতাবাসের হট লাইনে ফোন দিলে কেউ রিসিভ করেন না। আবার কখনও কখনও রিসিভ করলেও খারাপ আচরণ করেন। ফিরে আসা প্রত্যেকেই তাদের দুর্ভোগের জন্য ম্যানেজ পাওয়ার, ইউনিক, ক্যারিয়ার এবং রাজ ওভারসিজ নামে ৪টি এজেন্সিকে দায়ী করেন। তারা আরও অভিযোগ করেন এজেন্সিগুলো তাদের ইরাক পাঠানোর সময় যে পরিমাণ টাকা নিয়েছে ভিডিও জবানবন্দিতে তার কম বলতে বাধ্য করেছে। এছাড়া সেখানে এজেন্সিগুলোর নিয়োজিত লোকজন কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশ করে দেশে পাঠাচ্ছে না। নির্যাতনের শিকার মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার জালাল উদ্দিন জানান, তিনি ইউনিক এজেন্সির মাধ্যমে ৩ লাখ টাকা খরচ করে ইরাকে কোরিয়ান কোম্পানি হানওয়া’র অধীনে বিসমায়া নিউ সিটি প্রজেক্টে ইলেক্টিশিয়ান হিসেবে কাজ নেন। কিন্তু শিয়া-সুন্নি সংঘাতের জের ধরে গত ২৮শে জুলাই তাদের ওপর হামলা করে ইরাকি পুলিশ ও সেনাবাহিনী। তিনি বলেন, সেদিন আমার বুকের ওপর পা দিয়ে চেপে ধরে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে মুখের দাড়ি প্লাস দিয়ে টেনে টেনে তোলে। আমার ওপর নির্যাতনের দৃশ্য দেখে আশেপাশের অনেকেই ভীত হয়ে পড়ে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে দাড়ি রাখি, অথচ ইরাকের শিয়ারা দাড়ি রাখার কারণেই আমার ওপর নির্মম অত্যাচার চালালো। এ সময় তিনি তার দাড়ি সংবলিত ছবিযুক্ত পাসপোর্ট দেখান। তিনি বলেন, আমি তবু জানে বেঁচে এসেছি। কিন্তু ওই দিনের নির্যাতনের শিকার ইমাম মাহবুব ও মান্নানের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। তিনি আকুতি জানিয়ে বলেন, যারা এখনও ওই দেশে আছেন তাদের ভালভাবে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন, তাদের বাঁচান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সুমন সেখানে ক্রেন অপারেটরের কাজ করেন ইউনিক এজেন্সির মাধ্যমে গিয়ে। তিনি যান ৩ লাখ টাকা খরচ করে। ৭ মাসে তিনি ২ লাখ টাকা বাড়িতে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে কথা বলারও স্বাধীনতা ছিল না আমাদের। যখন তখন হুমকি ধামকি দিতো। এ কারণে আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। জবরদস্তি করে কাজ করানো হতো। প্রায়ই গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হতো। তিনি বলেন, আমরা থাকতাম অনেকটা জেলখানার মতো জায়গায়। ২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তারকাঁটা দেয়া। সেনাবাহিনীর কড়া প্রহরা। বাইরের কোন খবর আমাদের কাছে আসতো না। তবে আসার সময় এয়ারপোর্টে কর্মরত বাঙালিরা বলেছে অনেক বাঙালিকে নাকি নির্যাতন করেছে শিয়ারা। সুমন জানান, প্রায়ই সেনাবাহিনী এসে হুমকি দিতো- কাউকে সন্দেহ হলে যখন তখন যাকে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। ওই ঘটনার পর থেকে তাই প্রতিটি দিন কেটেছে আতঙ্কে। বিসমায়া নিউ সিটি প্রজেক্টে ফোরম্যান হিসেবে কাজ করতেন পাবনার শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আশপাশে প্রতিদিনই গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেতাম। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম। তাই ফিরে এলাম। ফিরে আসা ঝালকাঠির কাইয়ুম বলেন, ৮ থেকে ১০ জন সেনাবাহিনীর লোক একটি রুমে আমাদের ৮ থেকে ১০ জনকে আটকে রেখে নির্যাতন করে। বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করে। এলোপাতাড়ি লাথি মারে। এ সময় তারা ঊর্ধ্বতনদের বের করে দেয়। ২ লাখ টাকা দিয়ে ক্যারিয়ার এজেন্সির মাধ্যমে ইরাক যান ব্রহ্মণবাড়িয়ার সিরাজুল। তিনি বলেন, আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কোম্পানি ওপর। অথচ যখন হামলা হয় এবং বিভিন্ন সময় হুমকি-ধমকি দেয়া হয় তখন কোম্পানি বলে- আমাদের কিছুই করার নেই। কোম্পানির লোকজনের সামনেই আমাদের মারধর করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, যাদের কাজ করি তারা যদি নিরাপত্তার দায়িত্ব না নেয় তাহলে কিভাবে থাকবো। ২ লাখ টাকা দিয়ে ম্যানেজ পাওয়ারের মাধ্যমে টেকনিশিয়ানের কাজ নিয়ে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাফেজ মো. জয়নাল আবেদীন। তিনিও ইরাক থেকে বিমান ভাড়া নিয়ে দেশে ফিরেছেন। তিনি বলেন, এজেন্সির লোকেরা হানওয়া কোম্পানিকে বাংলাদেশীদের পাঠাতে নিষেধ করছে এবং টিকিট দিতেও নিষেধ করছে। তিনি বলেন, ১লা ও ২রা জুলাইয়েই প্রায় ১৭০০ জন অব্যাহতির আবেদন করেন। প্রথমে কিছু আবেদনপত্র গ্রহণ করলেও পরে আর গ্রহণ করছে না। তিনি জানান, ২৮শে জুনের ঘটনার পর ২রা জুলাই কোম্পানি নোটিশ দেয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। কিন্তু আজও সে ধরনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তাই শঙ্কার মধ্যে ছিলাম। ফেরত আসা বাংলাদেশীরা অভিযোগ করেন, ৪ এজেন্সির ৪ ব্যক্তির কারণেই মূলত তাদের দেশে ফিরতে সমস্যা হচ্ছে। তারাই কোম্পানিকে বোঝাচ্ছেন যে বাঙালিদের যেতে দেয়ার দরকার নেই। কিন্তু সেখানে মৃত্যুর মুখে কিভাবে কাজ করা যায়? তারা আরও অভিযোগ করেন, বেশির ভাগ কর্মীই ৩ লাখ টাকা খরচ করে ইরাক এসেছে। কিন্তু ভিডিও জবানবন্দিতে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার কথা বলানো হয়েছে। দালাল ও এজেন্টদের চাপে তারা এ স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে জানান। তারা বলেন, ওই সময় এজেন্সি তাদের বলেছিল যদি এ স্বীকারোক্তি না দেয় তবে তাদের পাঠানো হবে না।