শিক্ষামূলক গল্প

প্রেম – ৩

বেশ কিছুক্ষণ হোল দিয়া আর নায়লা ডাইনিং রুমের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে, একটু পর পর খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ছে। মাহিরা বইটা সোফার হাতলে রেখে উঠে দাঁড়াল। রান্নাঘরে যেতে যেতে কিছুক্ষণের জন্য ওকে দেখে স্থির হোল মেয়ে দু’টো। তারপর আবার শুরু হোল খিলখিল ফিসফিস।

মাহিরা ট্রেটা ডাইনিং টেবিলে রেখে ডাক দিলো, ‘নায়লা, দিয়া, খেতে এসো’।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও জানালা থেকে সরে এলো ওরা। নায়লা ডালপুরির এক কামড় মুখে পুরে কাপে চুমুক দিয়েই চমকে উঠল, ‘ওয়াও আন্টি! চা?!’

দিয়া বলল, ‘হরলিকস কি শেষ আম্মু?’

মাহিরা বলল, ‘নাহ! তোমরা এখন বড় হয়েছ। তাই চা’।

আয়েশ করে চায়ে চুমক দিচ্ছে দু’জনে, মাহিরা খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘পাশের বাসার ছেলেটা মাশাল্লাহ খুব সুন্দর, তাইনা?’

দিয়া নায়লার বিষম খাবার জোগাড়, নায়লা চোখ নামিয়ে বলল, ‘কোন ছেলে আন্টি?’

দিয়া বুঝল মায়ের সাথে চালাকি চলবেনা, বলল, ‘মাশাল্লাহ’।

মাহিরা উঠে দুই মেয়ের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল, নায়লার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘সুন্দরকে সুন্দর বলায় কোন অপরাধ নেই মা’।

নায়লা লজ্জা পেল, আন্টি কিভাবে যেন সবার মনের কথা বুঝে যান! মাহিরা বলে চলল, ‘সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষন সহজাত। একটা বয়সে এসে ছেলেদের প্রতি মেয়েদের এবং মেয়েদের প্রতি ছেলেদের আকর্ষন সৃষ্টি হওয়াটাও স্বাভাবিক ব্যাপার। এর প্রয়োজনও আছে। নইলে আদম (আ) এবং হাওয়া (আ) কেবল বন্ধুত্ব করতেন, বিয়ে করতেন না, পৃথিবীতে মানবগোষ্ঠী প্রথম প্রজন্মেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। তুমি, আমি, দিয়া আজ বসে একসাথে চা খেতে পারতাম না’।

খিল খিল করে ফেলে দু’জনে। একটু পর নায়লা উশখুশ করতে করতে বলেই ফেলল, ‘তাহলে আন্টি ছেলেমেয়ের মেলামেশার ব্যাপারটাকে এত নিরুৎসাহিত করা হয় কেন?’

মাহিরা হেসে বলল, ‘তুমি খুব ভাল প্রশ্ন করেছ মা। দিয়া, তুমি কি জানো ছেলেমেয়ের মেলামেশায় কি সমস্যা?’

দিয়া ভাবনাটাকে মনের ভেতর গুছিয়ে নিতে নিতে বলল, ‘আমার কি মনে হয় জানো, রংধনু আমাদের মোহিত করে। কিন্তু বাস্তব জীবনে সবকিছু কি রংধনু রঙে রাঙানো হয়? সবকিছু রংধনু রঙে রঙ্গিন হলে প্রতিটি রঙের যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, স্বকীয় সৌন্দর্য্য তা কি উদ্ভাসিত হতে পারত কিংবা সৃষ্টজগতের মাঝে কোন বৈচিত্র খুঁজে পাওয়া যেত? আমরা যখন অনেক মানুষের সাথে মিশি তখন প্রত্যেকের কিছু না কিছু গুনাবলী আমাদের আকর্ষন করে। কিন্তু আমরা যখন বিয়ে করতে যাই তখন একই মানুষের মাঝে সব গুনের সমাহার আশা করি। যেমন সিনেমার হিরো একই সাথে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গায়ক, নর্তক, কবি আর কারাতে ব্ল্যাকবেল্ট হয়,’ ফিক করে হেসে ফেলে দিয়া, ‘কিন্তু বাস্তব জীবনে কোন মানুষের মাঝে সকল গুনের সমাহার অসম্ভব ব্যাপার। তখন যে মেয়েটি অনেক ছেলের সাথে মেলামেশা করেছে সে বিয়ে করলে অবচেতন মনে তুলনা করতে থাকে- এই ব্যাক্তি অমুকের মত গান গাইতে পারেনা, তমুকের মত কবিতা লিখতে পারেনা, অমুকের মত সাহসী নয় কিংবা তমুকের মত স্টাইলিশ নয়। কিন্তু যে মেয়েটির জীবনে তার স্বামীই প্রথম পুরুষ সে তার মাঝে যে গুনাবলীই খুঁজে পায় তাই তাকে আনন্দিত করে’।

মেয়ের আলোচনায় চমৎকৃত হলেও নায়লার মন খারাপ হবে বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলনা মাহিরা, বলল, ‘হুমম, তোমার কথায় যুক্তি আছে। এটা একটা ব্যাপার বটে, তবে এটাই একমাত্র ব্যাপার নয়’।

দিয়া বলল, ‘আরেকটু বিস্তারিত বল না আম্মু’।

মাহিরা বলল, ‘শোন, চোখ হোল মনের প্রবেশপথ। কিন্তু চোখ সবসময় মনকে সঠিক ফিডব্যাক দেয়না। যেমন ধর, পাশের বাসার ছেলেটা খুব সুন্দর। কিন্তু আমরা কি জানি সে মানুষ হিসেবে কেমন- সে কি মেধাবী না বোকা, ভাল ছেলে না ড্রাগখোর কিংবা ওর চরিত্র কেমন?’

দিয়া আর নায়লা দু’জনই মাথা ঝাঁকালো।

‘মানুষের চোখ মানুষকে অনেকসময় বিপথগামী করে। তাই দৃষ্টির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। ছেলেমেয়ে সবসময় একসাথে থাকলে মন সেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায়না যার দ্বারা সে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। বিশেষ করে ছেলেদের ক্ষেত্রে দৃষ্টি অনেক বড় দুর্বলতা। মনোবিজ্ঞান বলে ওদের মনের ধরনটাই এমন যে এর ওপর রঙ এবং রূপ প্রচন্ডভাবে ক্রিয়া করে। তখন ওদের কোন যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার যোগ্যতা থাকেনা। তাহলে একটা মেয়ে যদি নিজেকে কোন ছেলের সামনে মোহনীয় করে উপস্থাপন করে তাহলে কি সে ছেলেটিকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করল না তার দুর্বলতার সুযোগ নিল?’

নায়লা বলল, ‘ঠিক তো আন্টি! এভাবে তো ভেবে দেখিনি কখনো!’

মাহিরা বলল, ‘তখন কি হয় জানো মা? ক’দিন পর যখন ছেলেটার চোখ ধাঁধানো ভাব কেটে যায়, তারপর শুরু হয় অন্যান্য গুনাবলীর অভাব নিয়ে অসন্তুষ্টি। সংসারে শুরু হয় অশান্তি। ক্ষতিটা কার হয় বল তো? ঠিক, মেয়েটার। কারণ একটা মেয়ের কাছে সংসার যতখানি গুরুত্বপূর্ণ একটি ছেলের কাছে ততটা নয়’।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় দিয়া আর নায়লা।

‘আর মেয়েদের ভালোবাসাটা কেমন জানো? সে যেন এক তীব্র স্রোতস্বিনী। একবার বেগ পেলে সে আর দেখেনা সামনে পাহাড় আছে না গহ্বর। সে যেকোন উপায়ে নিজের পথ তৈরী করে নিতে বদ্ধপরিকর। সাগরের মাঝে নিজেকে বিলীন করে দেয়াই যার একমাত্র কাম্য পরিণতি। এই ভালোবাসা মেয়েদের অসাধ্য সাধন করতে শেখায়। এই তেজস্বীতার প্রয়োজন আছে। নইলে কোন মেয়ে পাহাড়সম বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে সংসার করতে পারতনা, পর্বতপ্রমাণ কষ্ট সহ্য করে মা হতে পারতনা, নিজের অসুস্থ সন্তানটাকে সবল এবং সক্ষম সন্তানদের সমান ভালবাসতে পারতনা। কিন্তু মাগো, পানিই জীবন, পানিই মরণ। যে ভালোবাসা দিয়ে একটা মেয়ে সংসারকে সাজায় সে ভালোবাসাই অপরিসীম ধ্বংস ডেকে আনতে পারে যদি তাতে বিবেচনার সংযোগ না ঘটে’।

আঁতকে ওঠে দিয়া, ‘কিভাবে আম্মু?’

নায়লা বলে, ‘আমি বুঝতে পারছি আন্টি, একটা মেয়ে যদি নিজের পরিবার পরিবেশ এবং নিজের সত্ত্বার প্রতি দায়িত্ব ভুলে গিয়ে কেবল মোহের কারণে একটা ছেলের পেছনে ছোটে। কেউ যখন বিবেচনাশূন্য হয়ে কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়, যেমন আপনি বললেন পাশের বাসার ছেলেটার ব্যাপারে আসলেই তো আমরা কিছু জানিনা, তখন সে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজের ভালবাসার অপরিসীম যোগ্যতার কারণে তার পথের সকল বাঁধাকে দুমড়ে মুচড়ে এগিয়ে যায় যার বলি হতে পারে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, লেখাপড়া থেকে চরিত্র পর্যন্ত! অথচ যার জন্য সে এতটা বাঁধাহীন স্রোত হয়ে ছোটে সে মানুষটা সঠিক না হলে শেষ পর্যন্ত তার নিজের সত্ত্বার প্রতিও সুবিচার করা হয়না কারণ সে হারায় সবকিছুই কিন্তু পায়না কিছুই’।

তিনজনই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, যেন নদীর স্রোতের সাথে পাহাড় পর্বত ডিঙ্গিয়ে এইমাত্র তীরে ভিড়ল তারা।

দিয়া বলল, ‘তাহলে তো আম্মু আমাদের অনেক বেশি সাবধান হওয়া প্রয়োজন!’

নায়লা বলল, ‘ঠিক আন্টি, এই ব্যাপারগুলো মাথায় রেখেই পথ চলতে হবে এখন থেকে যেন আমাদের অসাবধানতার কারণে আমাদের নিজেদের, আমাদের প্রিয়জনদের কিংবা অপরের ক্ষতি হয়ে না যায় আমাদের দ্বারা’।

মাহিরা হেসে দু’জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর ওদেরকে ওদের মত গল্প করতে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসে প্রিয় বইটার সাথে।

খানিকক্ষণ পর দেখে ওরা নাস্তার ট্রে রান্নাঘরে রেখে দিয়ার রুমে গিয়ে বসে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে দিয়া বলে, ‘নিজেদের গড়ে তোলার জন্য অনেক অনেক জ্ঞানার্জন করতে হবে। নইলে পা পিছলে পড়ে যেতে পারি ভুল পথে’।

নায়লা বলে, ‘হুমম, আমাদের আন্টির মত হতে হবে যেন আমরা কেবল নিজেরাই সঠিক পথে না চলি বরং অন্যদেরও সঠিক পথ দেখিয়ে দিতে পারি মমতার সাথে’।

মাথা ঝাঁকিয়ে হাসি লুকোয় মাহিরা, ‘মেয়েগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনেই’।

[ক’দিন আগে আমার কন্যা রাদিয়া আর ওর বান্ধবী নাভেরা কথা বলছিল। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই রাদিয়া বলল, ‘আমি সম্পূর্ন ইসলামী পদ্ধতিতে মসজিদে বিয়ে করব ইনশা আল্লাহ্‌’।

নাভেরা বলল, ‘কেন রাদিয়া? তুমি তোমার বাবামায়ের একমাত্র মেয়ে। তুমি তো চাইলে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করতে পারো!’

রাদিয়া বলল, ‘না পারিনা, কারণ কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ্‌ আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘কত মেয়ের টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছিলোনা। তুমি কেন এত শান শওকত করে বিয়ে করলে? কেন তাদের কথা ভাবলেনা?’’

আমার মনের ইচ্ছেটা আল্লাহ্‌ আমার মেয়ের মুখ থেকে প্রকাশ করলেন। সবাই দু’আ করবেন যেন আমার সন্তানদের এই সুন্দর ইচ্ছেগুলো সারাজীবন বজায় থাকে, হারিয়ে না যায় এই সমাজের কদর্যতার ঘুর্ণিপাকের আবর্তে।]

• এক ভাই জানতে চেয়েছিলেন মেয়েদের ভালবাসার আদল কেমন হয়। তাঁর অনুরোধ রক্ষার্থেই এই লেখা। তাই এই লেখা তাঁর জন্যই উৎসর্গিত।

– রেহনুমা বিনত আনিস

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

  1. খুব সহজ সাবলীল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। ধন্যবাদ। বিবাহ বহির্ভূত ছেলে মেয়েদের ভালোবাসা বা মেলামেশা শয়তানের অনেক বড় একটা ধোঁকা। কারন দু পক্ষই তাদের প্রকৃত রূপ সামনে আনে না যতদিন না পর্যন্ত শয়তান তার কার্যসিদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন না করাতে পারে।
    আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button